post

জনগণ কী সবক নিচ্ছে

৩০ জুন ২০১২
জুবায়ের হুসাইন ধৈর্যের পরীক্ষা বলে একটা কথা আছে। কথাটার অর্থ বুঝতে চাইলে বা নিজেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে চাইলে টেলিভিশনের সামনে বসতে হবে। কাকে রেখে কাকে দেখতে এবং কার কথা শুনতে চান আপনি? তালিকার এক নম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাখতেই হবে। এরপর একে একে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এবং আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম পর্যন্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের চেহারা এবং কথা বলার ঢং বা স্টাইল লক্ষ্য করে দেখা যায়। ঘুষ কেলেংকারিতে ফেঁসে যাওয়া সাবেক রেলমন্ত্রী এবং পদত্যাগের পরও অন্যায়ভাবে সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে পুনরায় শপথ না নেয়া দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং শিল্পমন্ত্রী ‘কমরেড’ দিলীপ বড়–য়াকেও বাদ দেয়া যাবে না। দেখা যাবে, প্রত্যেকে তেড়ে-মেরেই শুধু বলছেন না, মিথ্যার পাহাড়ও বানিয়ে চলেছেন। সময় থাকলে চেষ্টা করে দেখুন,  ধৈর্যের পরীক্ষা হয়ে যাবে! বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে একটি সফল মহাসমাবেশ বিরোধী দলের ভালো অর্জন। সচেতন জনগণ বিরোধী জোটকে হতাশ করেনি। আঠারো দলীয় জোট বল আবার সরকারের কোর্টে ঠেলে দিতে পারল। ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে লাভ হয়নি। ঢাকায় কার্যত হরতালের আমেজ সৃষ্টি করেছে সরকার। লাভবান হয়েছে বিরোধী দল। মাঝখানে ভোগান্তিতে পড়ে জনগণ সরকারের মুণ্ডুপাত করেছে। ক্ষমতাচর্চায় পাঁচ বছরমেয়াদি সংস্কৃতি চালু করতে বিরোধী দল যে আন্তরিকÑ সে প্রমাণ আবার মিলল। ১৭৫ আসনের খোয়াবে রেখে বিরোধী দল সরকারের বরফ গলিয়ে দেয়ার যে নিয়মতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করেছে তার সুফল অবশ্যই মিলবে। সরকার-বিরোধী দল সবাইকে জানতেই হবে, সুস্থ ধারায় গণতন্ত্র চর্চা করা না হলে জটিলতা বাড়ে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে। দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা ও আইনকানুন প্রয়োগে সমতা রক্ষিত না হলে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে। তখন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তার ভাবতে শুরু করে। বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি অগণতান্ত্রিক আচরণ থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটেরই অংশ। সরকার এ সত্যটি এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। সংসদ-আদালত দ্বন্দ্বে যারা উৎকণ্ঠিত হয়েছেন, তাদের অনুভূতিকে সম্মান করি, তবে সহমত পোষণ করি না। যারা বলছেন ‘খোদার বিচার হচ্ছে,’ তারা হয়তো ঠিক বলছেন। তবে আমরা এতটা রূঢ় ভাষায় মন্তব্য করার পক্ষে নই। যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম আইন বিভাগ-বিচার বিভাগ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ ঘটাল। অনেকে ভাবেনÑ এটা আসল রোগ নয়, দুরারোগ্য ব্যাধির লক্ষণ মাত্র। এমনতরো মূল্যায়নের সাথে একমত পোষণ করা যায়। কারণ হিসেবে বলা যায়, আশা-ভরসার তৃন্দ্রস্থল না হলেও সংসদ এখনো আমাদের গণতন্ত্র প্রেমের তাজমহল, উচ্চ আদালত শেষ ভরসাস্থল। সাংবিধানিক এই দু’টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের যথেষ্ট আবেগ আছে। উৎকণ্ঠা আছে। অভিযোগ-অনুযোগও থাকা স্বাভাবিক। কোনো ব্যক্তির জন্য কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তা-ও বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়ে যাক, ভাবমর্যাদা নষ্ট হোক, তা কেউ চাইতে পারেন না। বাস্তব সত্য কথা হচ্ছে, সরকার ও সংশ্লিষ্টরা জনগণের চাওয়া-পাওয়ার কোনো তোয়াক্কা করেনি। তোয়াক্কাহীন অবস্থা চলতে চলতে একপর্যায়ে এসে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ার উপক্রম হলো। এসবই যেন অপরিণামদর্শিতারই খেসারত। জাতীয় সংসদ নিয়ে আশা ভঙ্গের অনেক কারণ থাকতে পারে। হতাশ হওয়ার মতো বিষয়ও আছে। জাতীয় সংসদ সর্বপ্রকার বিতর্ক, নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের স্থান। তবে সরকার যখন গণতন্ত্র মানে না, সংবিধানের ধার ধারে না, তখন সরকারের পক্ষপুটে বসে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার ও বদখেয়াল কারো থাকা উচিত নয়। একইভাবে কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য কিংবা দু-চারটি তর্কিত রায়, রুল ও আদেশ-নিষেধের জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ ও উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে বিষোদগার কাম্য হতে পারে না। অবশ্য এখানে আত্মসমালোচনার সুযোগ রয়েছে। একটা নীতিকথা হচ্ছেÑ পাপ বাপকেও ছাড়ে না। বাড়াবাড়ির একটা অনিবার্য খেসারত সবাইকে দিতে হয়। দায়িত্বহীনতার জন্যও রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। জনগণের সাথে জড়িত বাস্তবতাগুলো এতটাই রূঢ় হয়ে আসে যে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়। আমাদের সংসদ নিয়ে বাড়াবাড়িমূলক মন্তব্য-বক্তব্য জনগণ ভালোভাবে না নিলেও এক ধরনের পুলক ও তৃপ্তিবোধ লালন করছে। একই অবস্থা বিচারালয়ের ব্যক্তিবিশেষের ওভার কনফিডেন্স দেখানোর নামে বাড়াবাড়ি করার ব্যাপারেও জনগণ ভাবছে এটা প্রায়শ্চিত্ত। এমনটি হওয়ারই ছিল। বিলম্বে হলেও ধর্মের কল নড়ল। এখন মেকি দেশপ্রেম প্রদর্শনের নামে রাষ্ট্রবিরোধিতা ও সাংবিধানিক বিরোধিতার বিষয়টি ডাল-ভাত ও ঠুনকো বানানো হয়েছে। কথায় কথায় মানহানির প্রশ্ন উঠছে। কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। পান থেকে চুন খসলে বলা হচ্ছে সংবিধানের বিরোধিতা করা হচ্ছে। গণতন্ত্রে সরকারের চুলচেরা সমালোচনা, নিন্দা, অভিযুক্ত করা শুধু বৈধ নয়, বিরোধী দলের অধিকার এবং কর্তব্যও বটে। অথচ অহরহ সরকার বিরোধিতাকে রাষ্ট্রের বিরোধিতার সমান্তরাল ভাবা হচ্ছে। মামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠিয়ে আনন্দ করা হচ্ছে। তলবি পরোয়ানার নামে হয়রানির মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। ভাবখানা এমনÑ বিচার-আচার পরে, একবার জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়লাম তো! প্রতিপক্ষ ও ভিন্ন মত দলন এবং দমনের এমন উল্লাস রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে গ্রাস করার স্থায়ী ব্যবস্থা হলো। বর্তমান সরকারের স্থাপন করা মন্দ নজিরগুলোর এটাও একটি। এর ফলাফল বর্তমান সরকারে যারা আছেন, তাদেরও ভোগ করতে হবে। কড়ায় গণ্ডায় এবং পাই পাই করে প্রায়শ্চিত্ত হজম করতে হবে। জাতি প্রত্যক্ষ করল অত্যন্ত ঘৃণ্য ও প্রতিশোধের ভাষায় নানাভাবে সম্মানিত লোকদের অসম্মান করা হলো। ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করা হলো। অথচ ইজ্জত আল্লাহ দেন, আল্লাহ আবার ইজ্জত কেড়ে নেন। এখানে অভিজাত, বজ্জাত আর সাধারণের কোনো তফাত নেই। দেশের সম্মানিত লোকদের অসম্মানের অভিযোগ উঠেছে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে। দেশের প্রাজ্ঞ আইনজীবীরা কারো কারো অতি উৎসাহ প্রদর্শনকে ভালো বলেননি। অনুরাগ-বিরাগ প্রদর্শনের ব্যাপারেও অনেক সিনিয়র নাগরিক উষ্মা প্রকাশ করেছেন। যা কিছু করা হলো সবই রাজনীতির অনুরাগ-বিরাগ থেকেই করা হলো। ফলাফলটাও রাজনীতির আঙিনা ছুঁয়ে পরিণতির দিকে যাবে। বিচার-আচারের নামে যা কিছু করা হলো এমন একসময় যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খুন, গুম ও রাজনৈতিক হয়রানির জন্য সরকার স্বদেশে ও বিদেশে অভিযুক্ত হচ্ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে কমপক্ষে দু’জন মন্ত্রী গণরোষে পড়লেন। একই ধরনের রোষ বিস্ফোরিত হলো কোনো কোনো সংসদ সদস্যের ওপর। বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অভিযোগ তুলল। ফাঁকে ঢুকে পড়ল ভারতীয় বিতর্কিত ও মতলববাজ সাহারা। সপ্তম নৌবহর নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো ভারতীয় পত্রিকার ইন্ধনে। তখনই কালো টাকা সাদা করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অসংখ্য খুন-গুম, হত্যা-অপহরণ ও মানবাধিকারের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে বোবাকান্নার শেষ নেই। হত্যা করে লাশ ২৬ টুকরো করার মতো বীভৎস চিত্র নাগরিক জীবনকে আলোড়িত করে। এটিএন বাংলার ড. মাহফুজ মুখ খুললেও সাগর-রুনি হত্যার জট খোলে না, ইলিয়াস ইস্যুর কোনো নিষ্পত্তি হয় না, কূটনীতিক খালাফ হত্যার কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না। পোশাক শিল্প শ্রমিক নেতা হত্যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তোলপাড় হয়, প্রতিক্রিয়া হয় জাতিঘাতী অপতৎপরতার। তার পরও সরকারের টনক নড়ে না। এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে যারা গভীরভাবে ভাবেন না, তারাই সম্মানিতদের ইজ্জত লুণ্ঠনের ইন্ধন জোগান। অনেকের ধারণা, বাইরে প্রবল ঝড় অথচ সংসদ নিরুত্তাপ। রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হতে হতে জমাট বেঁধে গেছেÑ সংসদ কোনো ভূমিকা রাখে না। চার দিকে পুলিশি আতঙ্ক, পুলিশ লাঞ্ছিত করছে বিচারককে। তার পরও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী মুখরোচক শব্দে পুলিশের সাফাই গানÑ তাতেও জাতীয় সংসদে আলোচনার ঢেউ ওঠে না। তাহলে কৃতকর্ম ও দায়দায়িত্বের বোঝা বেড়ে যাওয়ার কারণেই কি সংসদ ও স্পিকারকে তুলাধুনো করার পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি হচ্ছে! যেমনটি দলীয় মেজাজ ঢুকে পড়ায় একজনের দায়ে আজ আদালতও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কেউ বলছেন দুদক ঠুঁটো জগন্নাথ। কারো চোখে দুদক হচ্ছে সরকারের অদৃশ্য হাত। এই হাতের রঙ কালো। এই কালো হাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঠেঙানোর যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করা হয়। এক দিকে এই প্রতিষ্ঠানটিকে তুলনা করা হচ্ছে দন্ত-নখরহীন। অন্য দিকে এই প্রতিষ্ঠানটি দিয়েই খামচে রক্তাক্ত করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। একজন আইনজীবীর ভাষায় দুদক হচ্ছে সরকারের বড় শত্রু। ভাবের কথা বটে! কারণ হয়তো দুদক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সরকারের আপদ বাড়াচ্ছে। তবে যেসব আইনজীবী ভাবছেন বিচারের লম্বা হাত দিয়ে অভিজাতদের আঁতে ঘা দেয়া হয়েছে, তারা ভুলে যাচ্ছেন এখন পর্যন্ত বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ অর্থাৎ সংসদ এবং আইন আদালত তারা কেউ স্বাধীন এমন দৃষ্টান্তমূলক কিছু করে দেখাতে পারেননি। বরং যন্ত্রের মতো কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গেয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তারা কেউ স্বাধীন নন। স্বাধীনতার দাবি এক ধরনের ডুগডুগি। সাধারণভাবে বলা হয় আদালতের হাত লম্বা, সংসদের হাত অনেক দীর্ঘ। লম্বা এবং দীর্ঘÑ এ দুই শব্দের তফাত যতটুকু, বাস্তবতার নিরিখে আমাদের সংসদ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও তাই। অন্য দিকে বলা হয় সংসদ সার্বভৌম, আদালত আইন ও বিবেক ছাড়া কাউকে তোয়াক্কা করে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠেÑ বিরোধীদলীয় নেতারা সাজানো মামলায় এতটা নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন কেন, কিসের তলবি পরোয়ানা! বিবেক ও আইন কি বলে ৩২ নেতা চোর-ছ্যাচ্ছড় কিংবা জামিন না পাওয়ার মতো লোক? বোঝা যাচ্ছে সর্বত্র কীর্তন হয় কর্তার ইচ্ছায়। কর্তা মানে নির্বাহী প্রধান, সোজাসাপটা কথায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর। এখন যেই সুরতে দেশ চালানো হচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত দণ্ডমুণ্ডের মালিক এবং হ্যাঁ-না বলার শেষ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী। আরো সোজা কথায় নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রী চাইলেই হয়Ñ সেটা সংসদে যেমন হয়, আইন-আদালতেও হয়। কোনো ব্যাপারে প্রত্যক্ষ আদেশ-নিষেধ থাকে। কোনো কোনোটি ডিজায়ার থেকেই হয়ে যায়। বিরোধী দলের সমাবেশকে সামনে রেখে কত টালবাহানা দেখলাম, পুলিশ অনুমতি দিতে গড়িমসি করল। সরকার ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। যানবাহন বন্ধ করে পাইকারি পাকড়াও করা হলো। এ পথ গণতান্ত্রিক আচরণের পথ হয় কিভাবে! বিবেক কি সবারই মরে গেছে! যে দেশে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই রায়ের বরাতে সংবিধান সংশোধন হয়Ñ সে দেশে কাকে দুষবেন। মাসের পর মাস রায় লেখা হয় না, এই অভিযোগের কথা কাকে বলবেন। শপথের বাইরে গিয়ে অবসরে বসে রায় লেখা হয়। বলি রায় কি উপন্যাস! আর রায় প্রকাশ না করার জন্য অভিমানী সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এ দায় কার? এই পরিবেশ কারা সৃষ্টি করেছে? সংসদে সব হয়, হয় না শুধু সরকারের অদৃশ্য রাজনৈতিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু। এসব তো আর গল্প নয়, নিরেট সত্যি। এখন কেউ যেন সংবিধান ও শপথের কাছে দায়বদ্ধ নন। সংবিধান যেন দেশ-জাতির জন্য নয়, সরকারের ইচ্ছাপত্র। মর্জিমতো সংশোধন করা যায়, কাটাছেঁড়া করা যায়। আল্লাহর ওপর আস্থার মতো ধারা উপড়ে ফেলতেও কারো বুক কাঁপে না। জনগণের মন-মনন প্রাধান্য পায় না। কুইক রেন্টালের মতো জাতীয় গজব নিয়ে সমালোচনা করলে উপদেষ্টা ক্ষেপে যান। দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসেন। পুলিশ নিয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য আরো উপভোগ্য। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচকেরা ‘রাবিশ’। শেয়ারবাজার ‘দুষ্ট’। সাংবাদিকেরা বজ্জাত, টকশোর বুদ্ধিজীবীরা অন্ধ। এভাবেই মূল্যায়ন চলছে সব কিছুর। আমাদের কাছে মনে হয়, মৌলিক সব জাতীয় ইস্যু বাদ দিয়ে সংসদ-আদালত বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছে একটা মহল। বাস্তবে আমজনতা স্পিকারের রুলিং নিয়ে ভাবে না। আদালতের অনুরাগ-বিরাগের ব্যাপারটিকেও তুচ্ছ জ্ঞান করে। মন্ত্রী-সন্ত্রীদের কথাও আজকাল গায়ে মাখে না। যে দেশে দুর্নীতির প্রসার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সে দেশে আইন বেচাকেনা হয়। বিচারপ্রত্যাশীর ক্রন্দন রোল তো বোবাকান্নার মতোই শোনাবে। পুলিশ শুধু উপরি খায় না, খায় সবাই। সেবা কিনতে পয়সা লাগে। প্রশাসনযন্ত্র পুরোটাকে রাজনীতিকায়ন করে দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। জনগণের পকেট কেটে কে না খাচ্ছেÑ দোষ শুধু নন্দঘোষের। সংসদ-আদালত মুখোমুখি হওয়ার মনস্তাত্ত্বিক কারণটি কেউ খুঁজে দেখছেন না। অনেকেই ভাবছেন, সরকারের দুই বাহুর এই বিতণ্ডা অনেকটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ এই দ্বন্দ্ব উপভোগ করছেন। সুযোগ পেয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকের মুণ্ডুপাত করে ছাড়লেন। আবার অকার্যকর সংসদে একজন বিচারপতি ও একটি বেঞ্চের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ ঝেড়ে বক্তৃতা করলেন কেউ কেউ। কেউ বা ফতোয়া দিচ্ছেন, আসলে কায়েমি স্বার্থে আঘাত এসেছে তাই সব গুনাহগার চটে গেছেন। অন্য মূল্যায়ন হচ্ছেÑ রাষ্ট্রের তিন বাহুর কোনোটির জবাবদিহিতা দেখানোর অবস্থায় নেই। যার যার অবস্থানে সবাই নিজেকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ভাবছেন। সবাই রাজা বনে গেছেন। তাই পুলিশ পেটাচ্ছে সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী ও বিচারকদের। কেউ কেউ দাবড়ে বেড়াচ্ছেন সম্মানিত লোকদের। আমরা ঢালাও মন্তব্য করে নিজেরা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে ওঠার পক্ষপাতী নই। তবে গোদের ওপর বিষফোড়ার সফল অস্ত্রোপচার চাই। কারণ নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগের সর্বত্র দলীয় রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে রাষ্ট্র নীল হয়ে গেছে। দলীয়করণের হিংগ্রতার কারণে নানা জটিল উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তারই দু-একটা বিষফোড়া দেখা যাচ্ছে। এখন ক্যান্সারের উপসর্গ হিসেবে শরীরে কালো দাগ এবং নানা জায়গায় ওঠা ফোড়াকেও বিবেচনা করা হয়। অতএব নির্লজ্জ দলীয়করণের দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধি রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ দেহের সব রক্ত নষ্ট করে দিচ্ছে। অবশিষ্টটুকু নষ্ট করে দেয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে না পারলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা গলায় পরতে হবে। এখন কুইনিন জ্বর সারালেও কুইনিন সারানোর লোক নেই। সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণের পথেই হাঁটতে হবে। রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরলে পরিস্থিতি পাল্টাবে, নয়তো নয়। কারণ এ সব কিছুই নষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের জঠর থেকে জন্ম নিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ এ সব কিছু থেকে জনগণ কী সবক নিচ্ছে? আসলে জনগণের সবক নেয়ার কিছু নেই। জনগণ দেখছে আর ব্যথাতুর মনে দেশের রাজনীতিবিদদের ভাগ্য গণনা করে চলেছে। নেড়া বেলতলায় একবার গেলেও রাজনীতিবিদেরা বারবার যান। বুদ্ধিমানেরা একবার গর্তে পড়লেও রাজনীতিবিদেরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একবার গর্তে পড়তে চান। বর্তমান সরকার গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে অন্যদের তথা প্রতিপক্ষের সাথে কাতুকুতু খেলছে। ঝুঁকিবহুল এ খেলায় যেকোনো সময় কুপোকাত হয়ে যাওয়া সম্ভব। শুধু বিরোধী দল নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল এখন গণদাবি। এই ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়টি সরকার এখন উপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেতো কুইনিনের মতো জেনেও গিলতে হবে। সরকারের শেষ তিন মাসে জাতীয় নির্বাচনের ধারণা প্রচার করাটা রাজনৈতিক বিবেচনায় মন্দ কিছু নয়, তবে ১৭৫ আসন নিশ্চিত করে পাওয়ার মতলবি জরিপের ধারণা প্রচার করা নিপাট ভদ্রগোছের বিরোধী দলের জন্য রাজনৈতিক মেসেজ বটে। এর সরল-গরল দু’টো অর্থই বুঝতে হবে। সরকারের ডিজাইন অ্যান্ড ডিজায়ার দু’টোই বিবেচনায় নিতে হবে। যারা বুঝবেন না কিংবা বিবেচনায় নেবেন না তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে দুগ্ধপোষ্য শিশুই থেকে যাবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির