post

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

এবনে গোলাম সামাদ

১৯ জানুয়ারি ২০২০

কোন দেশের পররাষ্ট্রনীতি কেবল তার নিজের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে তার কাছ থেকে অন্য রাষ্ট্র কী পেতে চাচ্ছে তারও ওপর। পররাষ্ট্রনীতিতে বিবেচনায় আসে কাছের দেশ। তারপর দূরের দেশ। ভারত আমাদের লাগোয়া দেশ। তার সঙ্গে আমাদের স্থলসীমান্ত আছে ২২৮৮ কিলোমিটার (১৪৩০ মাইল)। বাংলাদেশ ও মিয়ানমায়ের মধ্যে সীমান্ত হচ্ছে ২৭৫ কিলোমিটার (১৭২ মাইল)। এতকাল মিয়ানমার আমাদের কাছে কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু এখন রোহিঙ্গা একটা বড় রকমের সমস্যা হয়ে উঠেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে ভারতের মূল ভূ-ভাগের যোগাযোগ হলো ২৭ কিলোমিটার (১৭ মাইল) চওড়া সিলিগুড়ি করিডোর (অলিন্দ)-এর মাধ্যমে। যার একদিকে হলো বাংলাদেশ আর অন্যদিকে হলো নেপাল। নেপাল যদি এই ২৭ কিলোমিটার চওড়া জায়গাটা দখল করে নেয়, তবে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের আর কোন স্থল যোগাযোগ থাকবে না। ভারত তাই চাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে যাবার পথ। কিন্তু সে যেভাবে এই যাতায়াত সড়ক করতে চাচ্ছে, তা স্বীকার করে নিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ চলে যাবে কার্যত ভারতের নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে ভারতকে এ রকম যাতায়াতের পথ প্রদান করলে চীন হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বৈরী। আমরা ভারতকে খুশি করতে যেয়ে চীনকে শত্রু করে তুলতে পারি না। তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা থেকে বাংলাদেশ ৬০ কিলোমিটার (৪০ মাইল) দূরে অবস্থিত। ১৯৬২ সালের মত চীন-ভারত সংঘাত আবার দেখা দিলে বাংলাদেশকে পড়তে হবে চীন-ভারতের আড়াআড়ি গুলি বর্ষণের মধ্যে। চীন চাচ্ছে সমস্ত উত্তর-পূর্ব ভারত একটা পৃথক স্বাধীন ফেডারেশনে পরিণত হোক। চীন এটা চাচ্ছে ১৯৬২ সালের পর থেকেই। আমরা বলছি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবার সময় বিশেষ ভাবে ভাবতে হয় কাছের রাষ্ট্রসমূহ নিয়ে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাছের দেশ নয়। তথাপি তার সঙ্গে আমাদের দেশের অনেকেই এখন চাচ্ছেন সু-সম্পর্ক গড়তে। তাদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা ইংরেজি। বাংলাদেশের মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা না বললেও একটা ইংরেজি জানা দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়লে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পেতে পারবো জ্ঞান ও বিভিন্ন জিনিসের কৃৎকৌশল সম্পর্কে সহজে শিক্ষা। যা আমাদের অর্থনীতিকে করে তুলবে শক্তিশালী। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। তার সঙ্গে নৈকট্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করবে। তাছাড়া অন্যদেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রদান করতে পারবে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা; যদি তারা সেটা চায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিবুর রহমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন ও পেয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা না আসলে আমাদের দেশে আরও বহুলোক অনাহারে মারা যেতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৃষি উৎপাদনেও আছে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক এগিয়ে। তাই সে ইচ্ছা করলে অন্যদেশে খাদ্য সহায়তা দিতেই পারে। বাংলাদেশকে সামরিক শক্তি অর্জন করতে হবে। কারণ তার ভৌগোলিক অবস্থান (Location) এমন যে, তাকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। রোমানরা বলত, Si vis pacem para bellum। যার অর্থ হলো, শান্তি কামনা করলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। আমাদেরও থাকতে হবে যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সবচেয়ে বেশি মুসলমানদের বাস। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এই তিনটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে কি না সে বিষয়ে ভাবা উচিত হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভারত দেখছে বৃহত্তর ভারত (Greater India) গড়বার স্বপ্ন। অতীতে এই সব এলাকায় ভারতের প্রভাব-প্রতিপত্তি এক সময় বিশেষ ভাবে বিস্তার লাভ করেছিলো। এই অঞ্চলে ভারত চাচ্ছে তার পূর্ব প্রভাব আবার ফিরে পেতে। সে ইতোমধ্যেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে গড়েছে বিরাট সামরিক ঘাঁটি, যাতে সে নাকি নিয়ে গিয়েছে পারমাণবিক বোমা। আমাদের দেশে এক সময় বামরাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন প্রকার বামপন্থীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচার করেছে একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে। তারা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনোভাবেই সহযোগিতা করা উচিত হবে না। কারণ সে তাহলে আমাদের দেশকে গ্রাস করবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর না পাঠাত, তবে বাংলাদেশকে পরিণত হতে হতো ভারতের একটি উপগ্রহ-রাষ্ট্র (Satellite State)। বামপন্থীরা মনে করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে সব জাতি পেয়ে থাকে সমান অধিকার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই ধারণা সঠিক ছিল না। যতগুলো কারণে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে, তার একটা কারণ হলো জাতিসত্তা সমস্যা। ইউক্রেন ও বাইলোরাশিয়া চায়নি সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়বার এটাই প্রধান কারণ। রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্যান্য জাতির সাথে দেখিয়েছে কার্যত সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব। যেকোনো রাষ্ট্রই হয়ে উঠতে পারে সাম্রাজ্যবাদী তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সাম্রাজ্য নেই। এক সময় ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনাধীন। কিন্তু ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ এখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। এক সময় হাউয়াই দ্বীপপুঞ্জ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনাধীন। কিন্তু এখন সে পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য। আর সে অন্যান্য অঙ্গরাষ্ট্রের মতোই ভোগ করছে সমান অধিকার। এক সময় আলাস্কা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনাধীন। কিন্তু সেও এখন পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর একটা অঙ্গরাজ্যে। আর ভোগ করছে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের মতই সমান অধিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা পাশাপাশি দুটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার এ পর্যন্ত বেধে উঠেনি কোন সীমান্ত যুদ্ধ। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোন প্রশ্ন উঠছে না সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণের। কিন্তু মেক্সিকো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নির্মিত হতে যাচ্ছে বিশাল সীমান্ত প্রাচীর। কেননা মেক্সিকো থেকে প্রতি বছর দলে দলে মানুষ আসতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মের খোঁজে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী বংশোদ্ভব মার্কিন নাগরিকদের বলে পাঠিয়েছিলেন যে, হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিতে। জানি না খালেদা জিয়া কিভাবে ভাবতে পেরেছিলেন যে, হিলারি ক্লিনটন জিতলে তিনি ও বাংলাদেশ লাভবান হবেন। বাংলাদেশে কেউই ভাবতে পেরেছিল না যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন। কিন্তু ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন। কারণ তিনি মার্কিন জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করলেন তার নির্বাচনী আওয়াজ হিসাবে। জাতীয়তাবাদ এখনও বিশ্ব রাজনীতিতে এক বড় সত্য হয়ে আছে, যা নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে বিভিন্ন দেশেরই পররাষ্ট্রনীতি।

লেখক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির