post

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস

মতিউর রহমান আকন্দ

০৪ জানুয়ারি ২০১৭
[ পূর্ব প্রকাশের পর ] সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ যুদ্ধের ফলেই ইংরেজরা প্রথমে বাংলা দখল করে কালক্রমে সমগ্র ভারত দখল করে নেয়। দাদাভাই নওরোজি তার ‘পোভার্টি ইন ইন্ডিয়া’ বইতে লিখেছেন, ‘ইংরেজরা ভারতের অর্থসম্পদ লুট করেই গ্রেট ব্রিটেনকে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ইংল্যান্ডের রাজা-রানীরা ভারতীয় স¤্রাটের মুকুট পরেছেন।’ যে সময় ইংরেজরা বাংলা দখল করেছিল, তখন বাংলা ছিল ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’। দেশী-বিদেশী সব ঐতিহাসিকই বলেছেন, প্রাক-পলাশী আমলে বাংলার অর্থনীতির বুনিয়াদ ছিল খুবই মজবুত। শুধু এশিয়ার বিভিন্ন দেশ নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত ব্যবসায়ী বাংলায় আসতে শুরু করে। ১৭৫৬-৫৭ সালে একজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলাকে দেখে লিখেছিলেন, ‘বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে এখানে পারসিক, আবিসিনিয়ান, আরব, চীনা, তুর্কি, ইহুদি, আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা দলে দলে আসতে থাকেন।’ ফার্সিভাষী ঐতিহাসিকেরা বাংলার নামকরণ করেছিলেন ‘জান্নাতুল বিলাদ’ বা সুবাহগুলোর স্বর্গ। সব মোগল ফরমানেই বাংলাকে ‘জান্নাতুল হিন্দুস্তান’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের বলেছিলেন, ‘বাংলা এতই সম্পদশালী ছিল যে, এখানে একটি প্রবাদ চালু ছিল- ‘বাংলায় প্রবেশের দরজা অসংখ্য কিন্তু বের হওয়ার দরজা একটিও নেই।’ ঐতিহাসিক ও পর্যটক আলেকজান্ডার ডো লিখেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা বাংলার অনুকূলেই ভারী ছিল এবং বাংলা একমাত্র পাত্র ছিল, যেখানে সোনাদানা এসে শুধু জমত, তার কিছুই বের হতো না।’ ১৭৩৫ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্রে বলা হয়েছে, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাই হচ্ছে একমাত্র সস্তা গণ্ডার প্রাচুর্যে ভরা দেশ। নবাব আলীবর্দির শাসনের সময় (১৭৪০-৫৬) ছিল বাংলার গৌরবোজ্জ্বল যুগ। ইংরেজরা মূলত একটি লুটেরা জাতি। শক্তি দিয়ে পরসম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল তাদের পেশা। ফলে বাংলার সম্পদ তাদের প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করেছে। ১৭৫৬ সালের এপ্রিলে সিরাজ যখন নবাব হন, তখন সুবে বাংলার শৌর্যবীর্য ছিল তুঙ্গে। ওই সময় বাংলায় আরো অনেক বিদেশী কোম্পানি ব্যবসা করতো। একমাত্র ইংরেজরাই দাঙ্গাহাঙ্গামা করে অন্যদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে কখনও ভারত উপমহাদেশ একটিমাত্র রাষ্ট্রীয় ইউনিট হিসেবে শাসিত হয়নি। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে তো নয়ই, মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরও নয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবদের সময়ে ভারতবর্ষ ছিল মোগল শাসনের অধীন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব ছিলেন কেন্দ্রীয় মোগল কর্তৃপক্ষের (দিল্লির বাদশাহদের) অনুগত শাসক, যদিও বাস্তবে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন স্বাধীনভাবেই। ক্লাইভ সেই স্বাধীন নবাবকেই পরাজিত করেন। সে নিরিখেই বলা হয় পলাশীতে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়, পলাশী বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাই এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই। তাই পলাশী যুদ্ধের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী। পলাশী যুদ্ধ কেবল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাই নয়, ক্রমান্বয়ে গোটা ভারতবর্ষকেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। একটানা ১৯০ বছর ভারতবর্ষ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনের অধীন থাকে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে : “ভারতীয় সমাজের বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে বিদেশী ইংরেজ শক্তি সহজলব্ধ শিকার হিসেবে ভারতবর্ষকে গ্রাস করতে আরম্ভ করলো। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়, তারই সূচনামাত্র।” পলাশীর বিপর্যয়ের পূর্বেও এদেশে আরও অনেক জাতি বাইরে থেকে বিজয়ীর বেশে আসে। উদাহরণস্বরূপ এদেশে আর্যদের আগমনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আর্যরা উপমহাদেশে এসে সিন্ধু উপত্যকার হরোপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধারক জনগোষ্ঠী এবং দ্রাবিড়দের পরাজিত করে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে তেরো শতকে মুসলমানদের আগমনও ঘটে একই প্রক্রিয়ায়। উপমহাদেশে আর্য শাসন ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার একটি বড় পার্থক্য ছিল। আর্য ও মুসলিমরা এদেশের বাইরে থেকে এলেও তারা পেছনে কোনো স্বদেশভূমি রেখে এদেশ শাসন করতে আসেনি। তারা তাদের বিজিত জনপদকেই তাদের স্বদেশ করে নেয় এবং এদেশে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস শুরু করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তারা এসেছিল বহিরাগত হিসেবে এদেশকে পদানত করে এদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদের স্বদেশ ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধ করে তুলতে। এ কারণেই ১৭৫৭ সালের পলাশী বিপর্যয়ে আমাদের পরাধীন যুগের সূচনা হয়। রাজনৈতিক পরাজয় মানুষের সামগ্রিক জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন শুধু তার জীবন ও শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটায়নি, বাংলার মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের সূচনাও ঘটেছিল এখান থেকেই। পরাধীন জীবনে মুসলমান সমাজে ভাঙন ধরে এবং তারা একটি ক্ষয়িষ্ণু সমাজে পরিণত হয়। ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতার যুগকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্যায় ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল এবং দ্বিতীয়টি ছিল ব্রিটিশ সরকারের শাসনকাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক শ’ বছর শাসনকালে মুসলমানরা ছিল পুরোপুরিভাবে গোলাম। প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ শাসনামলের পরবর্তী ৯০ বছর তারা ছিল আশ্রিত গোলাম। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্রিটিশ ও মুসলমানদের মধ্যে স্থায়ী দূরত্ব সৃষ্টি করে। পলাশী ও বকসারের যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি মঞ্জুর করার পর এ অঞ্চলের ওপরে তাদের আইনগত অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলার যে চিত্র ফুটে ওঠে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নৈরাশ্যজনক। পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফর প্রভৃতি নামমাত্র নবাব থাকলেও সামরিক শক্তির নিয়ন্তা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৬৫ সালের পর দেশের অর্থনীতিও সম্পূর্ণ তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সর্বাপেক্ষা ও সর্বদিক দিয়ে। সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য উমিচাঁদ-মীর জাফরের সাথে কোম্পানির যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার অর্থনৈতিক দাবি পূরণ করতে গিয়ে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানিকে ভুয়া ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয় এক শ’ লক্ষ টাকা। ইউরোপীয়দেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনীয়দেরকে সাত লক্ষ টাকা। বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বেই ক্লাইভকে দিতে হয় বায়ান্ন লক্ষ টাকা (Fall of Sirajuddowla-Dr. Mohar Ali)| মীর জাফরের ভুয়া নবাব হিসেবে বাংলার মসনদে আরোহণ করার পর কোম্পানির দাবি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। মীর জাফর তাদেরকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রাখতে বাধ্য হয়। রাজস্ব বিভাগ কোম্পানির পরিচালনাধীন হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য হিন্দু ও ইংরেজ আদায়কারীগণ অতিমাত্রায় শোষণ নিষ্পেষণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে কোম্পানির রাজকোষ পূর্ণ করতে থাকে। ইতঃপূর্বে প্রজাদের নিকট থেকে আদায়কৃত সকল অর্থ দেশের জনগণের মধ্যে তাদেরই জন্য ব্যয়িত হতো। তখন থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাংকে ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে স্থানান্তরিত হতে থাকে। ১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোক প্রাণত্যাগ করে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের বেলায় কোনো প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শিত হয়নি। দুর্ভিক্ষ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন পূর্বের বছরের তুলনায় ছয় লক্ষ টাকা অধিক রাজস্ব আদায় করা হয়, বাংলা ও বিহার থেকে পরবর্তী বছর অতিরিক্ত চৌদ্দ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। মানবসন্তানেরা যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল, তখন তাদের রক্ত শোষণ করে পৈশাচিক উল্লাসে নৃত্য করছিল ইংরেজ ও তাদের রাজস্ব আদায়কারীগণ। এসব রাজস্ব আদায়কারী ছিল কলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ, সুদি মহাজন ও ব্যবসায়ীগণ। মানবতার প্রতি এর চেয়ে অধিক নির্মমতা ও পৈশাচিকতা আর কী হতে পারে? (Baden Powel-Land system etc. British Policy & the Muslims in Bengal- A. R. Mallick) আর এর ঘৃণিত পন্থায় এদেশের অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করা হতো। কোম্পানি এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশি তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আট-নয় বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানি ও তার দেশী-বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানিকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো। আবদুল মওদূদ বলেন : পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কী মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদন্ড- এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি। হওয়া সম্ভব নয়। কারণ- কেবল লিখিত বিবরণ থেকে তার কিছুটা পরিমাণ জ্ঞাত হওয়া সম্ভব। কিন্তু হিসাবের বাইরে যে বিপুল অর্থ সাগর পাড়ে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে? ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো- সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। ১৯০০ সালে এর সমমূল্য দাঁড়ায় তিনশো কোটি টাকা। (I. O. Miller, quoted by Misra, p. 15)। মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চিখানা থেকে পাওয়া গেল পনের লক্ষ পাউন্ডের টাকা, অবশ্য বহুমূল্য মণিমানিক্য দিয়ে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ স্থলসেনা ও নৌসেনা পেলো চার লক্ষ পাউন্ড; সিলেক্ট কমিটির ছয়জন সদস্য পেলেন নয় লক্ষ পাউন্ড; কাউন্সিল মেম্বররা পেলেন প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড; আর খোদ ক্লাইভ পেলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড, তাছাড়া ত্রিশ হাজার পাউন্ড বার্ষিক আয়ের জমিদারিসহ বাদশাহ প্রদত্ত উপাধি ‘সাবাত জং’। অবশ্য পলাশী বিজয়ী ক্লাইভের ভাষায় ‘তিনি এতো সংযম দেখিয়ে নিজেই আশ্চর্য’। মীর কাসিম দিয়েছেন নগদ দু’ লক্ষ পাউন্ড কাউন্সিলের সাহায্যের জন্য। মীর জাফর নন্দন নজমদ্দৌলা দিয়েছেন এক লক্ষ ঊনচল্লিশ হাজার পাউন্ড। এ ছাড়া সাধারণ সৈনিক, কুঠিয়াল ইংরেজ কত লক্ষ মুদ্রা আত্মসাৎ করেছে, বলা দুঃসাধ্য। বিখ্যাত জরিপবিদ জেসেম রেনেল ১৭৬৪ সালে বাইশ বছর বয়সে বার্ষিক হাজার পাউন্ডে নিযুক্ত হন, এবং ১৭৭৭ সালে বিলাত ফিরে যান ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে। এ থেকেই অনুমেয়, কোম্পানির কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন। তারা এ দেশে কোম্পানি রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে এবং চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর হোমে প্রত্যাগত হয়ে এরূপ রাজসিক হালে বাস করতেন যে, তাঁরা ‘ইন্ডিয়ান নেবাব্স’ রূপে আখ্যাত হতেন। ক্লাইভ নিজেই স্বীকার করেছেন, “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃঙ্খলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি।” অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ পৃ. ৬০-৬২)। ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের পর মুসলমানদের বিপর্যয় ১৭৫৭ সালে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে এ ভূখণ্ডে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের হাতে মুসলমানদের রাজনৈতিক পরাজয় মুসলমানদের শুধু রাজ্যহারা করেনি, মুসলমানরা সর্বস্ব হারিয়েছিল। এককালীন শাসকশ্রেণী রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার পর তাদের মধ্যে পরাজিতের মানসিকতার সঞ্চার হতে থাকে এবং তারা ইসলাম থেকে অধিকতর দূরে সরে পড়ে। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসে ফাটল ধরতে থাকে এবং তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। জীবনকে দু’ভাবে বিভক্ত করা হয়। একটি দ্বীনদারি, অপরটি দুনিয়াদারি। রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ ও সমাজ পরিচালনা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা প্রভৃতি দুনিয়াদারি মনে করে তা বর্জন করা হয় এবং জীবনের অতি সঙ্কীর্ণ পরিসরে ইসলামের আংশিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু ক্রিয়াকর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাকে দ্বীনদারি মনে করা হয়। এ ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করে সুফিবাদ যা ক্রমশ বেদান্তবাদ, যোগবাদ, খ্রিস্টিয় বৈরাগ্যবাদ প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম উম্মাহর একটা অংশকে মোরাকাবা, মোশাহাদা, রিয়াজাদ, কামালাত, সবর ও হাকিকাত প্রভৃতি জটিল দার্শনিক ব্যাখ্যার গোলকধাঁধায় নিক্ষেপ করে। আকবরের দ্বীনে এলাহি প্রতিষ্ঠা লাভ না করলেও তার বিষক্রিয়া মুসলিম ও নও মুসলিমদের একটা বৃহত্তর অংশে এমনভাবে সংক্রমিত করে যে, কিছুটা মুসলমানি এবং কিছুটা হিন্দুয়ানি এমন এক মিশ্র সভ্যতা, সংস্কৃতির জগাখিচুড়ি তৈরি হয়। মুসলমানদের শাসনক্ষমতা হারানোর মধ্য দিয়ে তারা চরম দরিদ্রতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে মুসলিম জাতি। তাদের সম্মান ও মর্যাদাবোধ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হতে থাকে। গোলামি ও দারিদ্র্যের পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি অতি দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে। ধর্ম, নৈতিকতার গুরুত্ব ও জাতীয় কৃষ্টি ও তমদ্দুনের কদর ও মর্যাদা দিন দিন কমে যেতে থাকে। স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা মুসলমানদের গ্রাস করে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের পদার্পণের প্রথম দিন থেকেই তারা মুসলমানদের শক্তি হরণ করার কাজে মনোনিবেশ করে। বিশেষ করে শিক্ষিত সচ্ছল মুসলমানদের ধ্বংস সাধনে তারা প্রথম থেকেই তৎপর হয়। মুসলিম রাজ্যগুলোর বিলোপ সাধন করা হয় এবং শত শত বছর ধরে যে আইন ও বিচারব্যবস্থা এখানে চালু ছিল তা পাল্টে দেয়া হয়। ইসলামী শাসন রহিত করে ইসলামের মৌল বিশ্বাস ও নীতির সাথে সংঘটিত ইন্ডিয়ান সিভিল অ্যান্ড ক্রিমিনাল কোডস অব প্রসিডিউর এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোড্ প্রবর্তন ও বলবৎ করা হয়। ইংরেজদের পলিসি ছিল যাদের সাহায্যে তারা এ দেশের স্বাধীনতা হরণ করে এখানে রাজনৈতিক প্রভুত্ব লাভ করেছে, তাদেরকে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করে মুসলমানদেরকে একেবারে উৎখাত করা, যাতে করে ভবিষ্যতে তারা আর কখনও স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার কোনো শক্তি অর্জন করতে না পারে। ইংরেজ প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দেয়া এবং জীবিকার সকল দরজা তাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া। মুসলমানদের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন ওয়াকফ ও লাখেরাজ সম্পত্তি তারা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। ফলে এসব জমির ওপর পরিচালিত ইংরেজরা ক্ষমতা দখলের পর প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের প্রথম ধাপেই মুসলিম সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে মুসলমানদের সরিয়ে সেখানে হিন্দুদের বসানো এবং অন্যদিকে নব্য হিন্দু জমিদার ব্যবসায়ী, প্রশাসক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটানো হয়। সকল ছোট বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের সকল জমিদারি, জায়গিরদারি, আয়মা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হয়। ফলে মুসলিম সমাজ চরম ও অবর্ণনীয় দুর্দশায় নিপতিত হয়। তার ফলে কিছু উচ্চ শ্রেণীর কর্মচারীই বেকার হয়ে পড়েনি, বরঞ্চ হাজার হাজার নি¤œ বেতনভুক্ত কর্মচারীও কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। দেশের গোটা রাজস্ববিভাগকে ইংল্যান্ডের পদ্ধতিতে পুনর্গঠিত করার ফলে বহু সংখ্যক মুসলমানের অর্থনৈতিক দুর্গতি দেখা দেয়। এ নীতির ফলে মাত্র দেড় শ’ বছরের মধ্যে পরিস্থিতি এমন হলো যেÑ যে জাতি এক সময়ে এদেশের ধনভাণ্ডারের মালিক ছিল তারা এক মুঠো খাবারের জন্য অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লো। তাদেরকে অর্থ উপার্জনের উৎস থেকে একে একে বঞ্চিত করা হলো। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান অমুসলিম পুঁজিপতির অর্থনৈতিক গোলামিতে লিপ্ত হয়ে পড়লো। অমুসলিম সুদখোর মহাজনের সাথে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের চিরস্থায়ী মৈত্রী গড়ে ওঠে। কৃষক প্রজা জনগণের ওপর ট্যাক্সের পর ট্যাক্সের অত্যাচার, ইংরেজ বণিকদের খাদ্যশস্যের ব্যবসা, অনাবৃষ্টি ও শস্যহানি ইত্যাদি কারণে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের অল্পদিনের মধ্যেই ১৭৬৯ সালের (বাংলা ১১৭৬ সাল) ডিসেম্বরে বাংলার বুকে নেমে এলো এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ বাংলা ১১৭৬ (১৭৬৯-৭০ ইং) সালে সংঘটিত হয়েছিল, তাই ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত। এই দুর্ভিক্ষে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, সে ক্ষতিপূরণ করা পরবর্তী দুই পুরুষকালেও সম্ভব হয়নি। এই দুর্ভিক্ষে বাংলায় ১ কোটি ও বিহারে ৩০ লক্ষাধিক লোক খাদ্য-পথ্য-ওষুধের অভাবে কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণ হারায়। “এসব দুর্ভিক্ষ যতটা না ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর চেয়ে বেশি ছিল ইংরেজ ও হিন্দু বাবুদের সীমাহীন লুণ্ঠন। খাদ্যশস্য মজুদ রেখে অধিক মুনাফা এবং ভারতের বাইরে প্রেরণজনিত কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নিঃস্ব কৃষক জনসাধারণের পক্ষে তা ক্রয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ কৃষকগণ এই খাদ্যশস্যই নামমাত্র মূল্যে মহাজনদের নিকট বিক্রয় করতে বাধ্য হয়।” উইলিয়াম হান্টারের মতে : “১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ এক বছরের দুর্ভিক্ষ ছিল। ১৭৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের সাধারণ শস্যহানি এবং তার আগের বছরের আংশিক শস্যহানিই এই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। ১৭৬৮-৬৯ সালে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু দুর্ভিক্ষ ছিল না; এমনকি ফসলও এত কম হয়েছিল না, যার ফলে খাজনা কমিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হতে পারতো।” উইলিয়াম হান্টারের বর্ণনানুযায়ী : “জনসাধারণের দুর্দশার অন্ত ছিল না। কিন্তু এই দুর্দশার প্রকৃতি যে কিরূপ ভয়াবহ ছিল কেন্দ্রীয় সরকার তা তখন যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। পরে অবশ্য তারা উপলব্ধি করেছিল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ফসল খারাপ হওয়ার ফলে সাময়িকভাবে খাজনা হ্রাস করা তখন একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল, কিন্তু ১৭৬৯-৭০ সালে খাজনা হ্রাস ও মওকুফ করার প্রস্তাব ক্রমাগত করা হলেও অতি অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রেই তা মঞ্জুর করা হয়েছিল। জনসাধারণকে সাহায্য দানের জন্য নানাবিধ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তার মধ্যে অধিকাংশই কার্যকর করা হয়নি। স্থানীয়ভাবে এ ব্যাপারে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তা দুঃখজনকভাবে অপর্যাপ্ত ছিল। এপ্রিল মাসে যে বসন্তকালীন ফসল কাটা হয়েছিল, তার পরিমাণ ছিল খুবই কম এবং মুসলমান অর্থ-উজিরের পরামর্শক্রমে কাউন্সিল পরবর্তী বছরের জন্য শতকরা দশভাগ খাজনা বাড়িয়ে দেন। জনসাধারণের দুর্দশা এত দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল যে, তার ফলে সরকারের সমস্ত হিসাব ও অনুমান ভণ্ডুল হয়ে যায়। দুঃখ-দুর্দশায় নীরবতা অবলম্বন করা বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, কিন্তু এই নীরবতাও একদিন ভেঙে গেল এবং মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের নিদ্রা যখন ভঙ্গ হলো, তখন তারা চারদিকে ব্যাপক ও প্রতিকারের অযোগ্য দুর্ভিক্ষ ও অনশন দেখতে পেলেন। সরকারিভাবে এই সময় উল্লেখ করা হয় যে, মৃত্যুর হার ও ভিক্ষুকের সংখ্যা সকল বর্ণনার ঊর্ধ্বে; এককালে সমৃদ্ধ পূর্ণিয়া প্রদেশে তিন ভাগের এক ভাগেরও বেশি লোক অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে এবং অন্যান্য স্থানেও একই ধরনের মর্মান্তিক অবস্থা বিরাজ করছে।” উইলিয়াম হান্টার আরও বলেন : “১৭৭০ সালের সারা গ্রীষ্মকালব্যাপী লোক মারা গিয়েছে। গৃহস্থরা তাদের গরু-বাছুর, লাঙল-জোয়াল বেচে ফেলেছে এবং বীজ ধানও খেয়ে ফেলেছে; অবশেষে তারা ছেলেমেয়ে বেচতে শুরু করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একসময় আর ক্রেতাও পাওয়া গেল না। তারপর তারা গাছের পাতা এবং মাঠের ঘাস খেতে শুরু করেছে। অনশনে জীর্ণ, রোগে ক্লিষ্ট কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শহরে এসে জমা হতো। বছরের গোড়াতেই সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদে পানি বসন্ত দেখা দেয় এবং বহুলোক এই রোগে মারা যায়। মৃত ও মরণাপন্ন লোক স্তূপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তা পুঁতে ফেলার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। প্রাচ্যের মেথর, কুকুর, শৃগাল ও শকুনের পক্ষেও এত বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছিল।” বিভিন্ন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে দুর্ভিক্ষে যখন বাংলার লক্ষ লক্ষ বনি আদম ধুকে ধুকে মরছে তখনও ব্রিটিশ বেনিয়ারা কোটি কোটি মণ চাল ইংল্যান্ডে পাচার করেছে। এ ছাড়া কাপড়, রেশম, আফিম, সল্টপিটার চিনি ছাড়াও অভ্যন্তরীণ বাজারে লবণ, পান-সুপারির ব্যবসায়ে কোম্পানি সরকার সরকারি মনোপলি কায়েম করে এবং বর্ণহিন্দু জমিদার ও তাদের প্রশাসনিক কর্মচারীদের সহায়তায় বর্ণহিন্দু গোমস্তা, দালাল ও ফরিয়াদের মাধ্যমে ব্যবসা চালাতে থাকে। হিন্দু কর্মচারীরাও মনোপলির সুযোগে কোম্পানির ছত্রচ্ছায়ে ধান-চালের ব্যবসায়ে লাভবান হতে থাকে। বর্ধিত লাভের সাথে সাথে তাদের লোভের মাত্রা এতদূর বৃদ্ধি পায় যে, ১৭৭০ সালের মাঘ মাসেই তারা সারা দেশের ধান-চাল কিনে গুদামজাত করে ফেলে। এমনিতেই কৃষকেরা খাজনার ভয়ে চাষবাস ছেড়ে দেয়ায় সে বছর ফসলের পরিমাণ হ্রাস পায়। তার ওপর মনোপলি। ফলে জ্যৈষ্ঠ মাসেই দেশের নানা স্থানে মানুষ মরা মানুষের গোশত খেতে শুরু করে। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন : “১৭৭০ সালের বর্ষাকালে শুভ সূচনা দেখা যায় এবং সেপ্টেম্বর মাসের আগেই সারা প্রদেশে উৎকৃষ্ট ফসল কাটা হয়। কিন্তু ফসল ভালো হলেও দেশ জনশূন্য হয়ে পড়ার আগে এই ফসল মানুষের ঘরে পৌঁছায়নি। ক্ষুধার্ত ও আশ্রয়হীন মানুষ খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে চরম হতাশার মধ্যে একটি পরিত্যক্ত গ্রাম থেকে অন্য একটি পরিত্যক্ত গ্রামে ঘুরে ফিরেছে। ফলে সারা দেশেই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ... বেঁচে থাকার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করতে করতে ফসল কাটা শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই লক্ষ লক্ষ কঙ্কালসার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাদের কাতর চোখের শেষ চাহনি সম্ভবত ঘন সন্নিবিষ্ট সবুজ ফসলে ঢাকা ক্ষেতের ওপরই নিবদ্ধ ছিল।” “ভাদ্র মাসের দিকে গুদামের শস্য বাজারে আসায় এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। বছর শেষে দেখা যায়, বাংলার প্রায় তিন কোটি অধিবাসীর মধ্যে এক কোটিরও বেশি মারা গেছে।” উইলিয়াম হান্টার অতঃপর লিখেছেন : “বছরের প্রধান ফসলও খুব ভালো হয় এবং তিন মাস পর এই ফসল কাটা হয়। দুর্ভিক্ষ যেমন আকস্মিকভাবে এসেছিল, সারা বাংলাদেশে সমৃদ্ধিও তেমনি তাড়াতাড়ি ফিরে এলো। ফলে ডিসেম্বর মাসের কোনো পান্ডুলিপি দলিল পড়লে গত দশ মাসের ঘটনাবলি যে কল্পনা বা দুঃস্বপ্ন মাত্র ছিল না, তা বিশ্বাস করা রীতিমত কঠিন হয়ে পড়ে। ... এক বছর অনটনের পরে পর পর তিন বছর বিপুল সমৃদ্ধি এসেছিল; এবং প্রকৃতি যে ক্ষতি সাধন করেছিল, তা পূরণ করার জন্য প্রকৃতিই প্রাচুর্য এনে দিয়েছিল।” “কিন্তু এই ক্ষতি যে পুরোপুরিভাবে পূরণ হয়নি, পরবর্তী ত্রিশ বছরের দলিল-দস্তাবেজেই তার প্রমাণ রয়েছে। প্রাচুর্য এসেছিল বটে, কিন্তু প্রদেশ তখন নীরব, জনশূন্য ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বলে সরকারিভাবে হিসাব করা হয়েছিল; জুন মাসে প্রতি ষোল জনের মধ্যে ছয়জন মারা গিয়েছে বলে ধরা হয়েছিল এবং অনুমান করা হয়েছিল যে, অনাহার ও ক্ষুধার তাড়নায় কৃষক ও খাজনাদাতাদের অর্ধেক মারা যাবে। বর্ষাকালে (জুলাই থেকে অক্টোবর) জনশূন্যতা এমন প্রকট হয়ে পড়েছিল যে, সরকার আশঙ্কার সঙ্গে ‘দুর্ভিক্ষে নিহত পরিশ্রমী কৃষক ও পণ্য প্রস্তুতকারীদের সংখ্যা’ সম্পর্কে কোর্ট অব ডিরেক্টরের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। পরের বছর (১৭৭১ সালে) যখন চাষাবাদ শুরু হয়, তখনই জনশূন্যতার বাস্তব প্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে অনুভূতি হয়। এই সময় স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, কৃষকদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে, সমস্ত জমিতে চাষাবাদ করার জন্য তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়।” উইলিয়াম হান্টারের বর্ণনা অনুযায়ী : “১৭৭১ সালের প্রচুর পরিমাণ ফসল হওয়া সত্ত্বেও দেশে আবাদ কমে যেতে লাগলো; এবং বিভিন্ন জেলায় সফরের জন্য ১৯৭২ সালে নিযুক্ত কমিশনারগণ প্রদেশের উৎকৃষ্ট এলাকাগুলোকে ‘দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত, জমি পরিত্যক্ত ও রাজস্ব হ্রাস’ অবস্থায় দেখতে পান।” দুর্ভিক্ষের দুই বছর পর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। তিনি দেশের একটি বিরাট এলাকা সফর করেন এবং সর্বত্র নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুর্ভিক্ষের ফলে মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ‘মোট অধিবাসীদের তিন ভাগের অন্ততপক্ষে এক ভাগ মারা গিয়েছে।” আরও মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’-এ বাংলার তিন ভাগের এক ভাগ লোক নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অধিক সংখ্যক রায়ত মারা যাবার ফলে বহু জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে, চাষাবাদের চরম অবনতি ঘটে, ভূ-স্বামীদের পক্ষে বকেয়া খাজনা আদায় করার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে পড়ে। কোম্পানি সরকারের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তবুও মেটেনি, শোষণ-পীড়ন চলছিল সমান গতিতেই, শকুনের মত লাশের ওপর বসেও কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল মৃতপ্রায় চাষিদের ওপর। ওয়ারেন হেস্টিংস হিসাব কষে এবং কড়া চাপে নির্ধারিত রাজস্বেরও বেশি টাকা আদায় করেছেন। “সত্যিই দেখা যায়, দুর্ভিক্ষের পূর্বে (১৭৬৮ সালে) যেখানে বাংলাদেশের রাজস্ব ১,৫২,০৪,৮৫৬ (এক কোটি বায়ান্ন লক্ষ চার হাজার আট শত ছাপ্পান্ন) টাকা, দুর্ভিক্ষের পর ১৭৭১ সালে সমগ্র দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা যাওয়ার পরও মোট রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ১,৫৭,২৬,৫৭৬ (এক কোটি সাতান্ন লক্ষ ছাব্বিশ হাজার পাঁচ শত ছিয়াত্তর) টাকায়।” কিন্তু “আদায়কৃত রাজস্বের শতকরা একভাগও দুর্ভিক্ষপীড়িত জনসাধারণের দুঃখ মোচনের জন্য খরচ করা হয়নি। বরং বাখরগঞ্জ জেলার ২২,৯১৩ মণ চাল বিক্রয় করে কোম্পানি সরকার ৬৭,৫৯৩ (সাতষট্টি হাজার পাঁচ শত তিরানব্বই) টাকা মুনাফা লুটেছে এবং ঢাকার ৪০,০০০ হাজার মণ চাল বাঁকীপুরে সেনানিবাসে গুদামজাত করেছে।” এই মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ এবং প্রাণহানি সম্পর্কে কোম্পানি সরকারের দায়িত্ব বিষয়ে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন : “১৭৭২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ জনসাধারণ বাংলাদেশকে এমন একটি গুদামঘর বলে মনে করতো, যেখানে একদল ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ বিরাট আকারে বিপুল লাভজনক ব্যবসা করতো। সেখানে যে বহুসংখ্যক লোক বাস করে, তা তারা জানতো বটে, তবে এটাকে তারা একটা আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করতো।... ইঙ্গ-ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রভাবে প্রভাবান্বিত একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ছাড়া এদেশের অন্য কারো মনেই সম্ভবত বর্তমানকালেও এই ঘটনা সম্পর্কে দায়িত্বের প্রশ্ন উদিত হবে না। প্রাণহানিকে শস্যহানির স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত প্রতিক্রিয়া বলে মেনে নেয়া হয়েছিল। জমিতে ফসল হয়নি, অতএব মানুষকে অতি স্বাভাবিক নিয়মেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে একজন ইংরেজ এই মর্মান্তিক কাহিনীর বিবরণ পড়ে এই কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হবেন না। কলকাতার তৎকালীন ইংরেজ কাউন্সিলও সন্তুষ্ট হননি। তারা পূর্বাহ্নেই খাদ্যশস্য গুদামজাত করে রাখার বিরুদ্ধে ঘোষণা প্রচার করেছিলেন এবং এই ঘোষণা কার্যকরী করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টাও করেছিলেন। এই ব্যবস্থা থেকে একটি জিনিস সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, দুর্ভিক্ষের প্রতিষেধক হিসেবেই কর্তাব্যক্তিগণ সজ্ঞানে এই ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিলেন। তারা খাদ্যশস্য অন্যত্র চালান দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন; অতএব দেখা যায় যে, নিজেদের বুদ্ধিবিবেচনা অনুসারে তারা প্রদেশের স্বল্প পরিমাণ খাদ্যশস্য সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ লোকদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহ এবং চাল আমদানির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু এই শ্রেণীর প্রচেষ্টা খুবই অপর্যাপ্ত আকারে চালানো হয়। যে সকল জেলায় প্রতি মাসে কুড়ি হাজার লোক মারা যাচ্ছিলো, সেই সকল জেলার জন্য মাত্র দেড় শ’ টাকা হারে সাহায্য বরাদ্দ করা হয়। তবে প্রাদেশিক কাউন্সিল সাহায্য দানের বিষয়টি গভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করেন এবং উদারতার সঙ্গে চার লক্ষ ক্ষুধার্ত লোকের জন্য প্রতিদিন দশ শিলিং মূল্যের চাল মঞ্জুর করেন। তাছাড়া খাদ্যাভাবে কৃষক ও রাজস্ব দাতাদের অর্ধেক মারা যেতে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারিত হওয়ার পর তিন কোটি লোককে ছয় মাসকাল বাঁচিয়ে রাখার খরচ বাবদ কাউন্সিল কোম্পানির দেয়া অর্থের পরিমাণ চার হাজার পাউন্ড নির্ধারণ করেন। তারা স্থির করেছিলেন যে, এর চেয়ে বেশি খরচ হলে তা দেশীয় সঙ্গতিপন্ন লোকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে। দেশীয় লোকেরা অবশ্য এ ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন। কোম্পানির চার হাজার পাউন্ডের সঙ্গে তারা চার হাজার সাত শত পাউন্ড যোগ করেছিলেন এবং অতিরিক্ত খরচ হলে তাও তারা বহন করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মোট টাকা শেষ পর্যন্ত খুবই অপ্রতুল হয়ে দাঁড়ায় এবং সাহায্য তহবিলের কর্মকর্তাগণ উপলব্ধি করার আগেই বীরভূম ও সীমান্তের অন্যান্য জেলায় সাহায্য বাবদ ৩ হাজার ১শ’ পাউন্ড ছাড়াও খাদ্যশস্য আমদানির জন্য ১৫ হাজার পাউন্ড খরচ হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত খরচের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকে; ফলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে যে ঠিক কত টাকা খরচ করা হয়েছে, তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশীয় রাজাগণ অতিরিক্ত খরচ বহন করতে রাজি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইতোমধ্যেই তারা বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করায় গোপন কমিটি স্থির করেন যে, তাদের কাছে আর টাকার জন্য অনুরোধ জানানো সঠিক হবে না। শেষ পর্যন্ত যাহোক নির্ধারণ করা হয় যে, কোম্পানির তহবিল থেকে মোট ৬ হাজার পাউন্ড খরচ করা হয়েছে। পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোতে আরও ৩ হাজার পাউন্ড খরচ হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে, যদিও এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সাহায্যদানের জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কোর্ট অব ডিরেক্টর যখন রিপোর্ট দাবি করেন, কাউন্সিল সর্বাধিক যা বলতে পেরেছিলেন, তা হচ্ছে এই যে, তারা তিন কোটি লোকের জন্য ৯ হাজার পাউন্ড খরচ করেছেন।” এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মোট ৩ কোটি লোকের প্রতি ১৬ জনের মধ্যে ৬ জন মারা গিয়েছে বলে সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়। “এই নয় হাজার পাউন্ড খয়রাতি সাহায্য বাবদ ও খাদ্যশস্য আমদানি করার জন্য ব্যয় করা হয়েছিল। কিন্তু খাদ্য আমদানির প্রশ্নে যে দুর্নীতি ও হৃদয়হীনতার চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাতে সরকার কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত এই সামান্য পরিমাণ সাহায্য শেষ পর্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের কাছে পৌঁছেছিল কি-না, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধেই ব্যক্তিগত স্বার্থে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা চালানোর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের দেশীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কম দাম দিয়ে কৃষকদের ঘর থেকে স্বল্প পরিমাণ মজুদ ধানও একরকম জোর করে নিয়ে গিয়েছে, অন্যান্য প্রদেশ থেকে যারা ধান আমদানি করতো মাঝ পথে তাদের নৌকা থামিয়ে সমস্ত ধান হস্তগত করেছে; এবং এমনকি গরিব রায়তদেরও তাদের বীজ ধান বেচতে বাধ্য করেছে।” (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির