post

বিদ্যুৎ নিয়ে দিশেহারা মানুষ

৩০ মার্চ ২০১২
জুবায়ের হুসাইন শীত মওসুম শেষ হবার সাথে সাথেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করেছে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই সমালোচনামুখর হয়েছেন খোদ সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাই। সংশ্লিষ্ট দপ্তর অবশ্য দাবি করছে, গত তিন বছরে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন দেশে এখন গড়ে প্রতিদিন ৫,১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তবে গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষই বলছেন অধিকাংশ সময় সেখানে বিদ্যুৎ থাকে না। এতে সেচকাজ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন সরকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতির যে পরিসংখ্যান তুলে ধরছে সেটি সত্য নয়। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। ২১ মার্চ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এ নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করে। কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে তারা আদেশ দেবেন। পত্রিকাগুলো জানাচ্ছে, পাইকারি ও খুচরা গ্রাহক উভয় পর্যায়েই বিদ্যুতের দাম বাড়বে। পাইকারিপর্যায়ে প্রতি ইউনিট ৩১ পয়সা ও খুচরা গ্রাহকপর্যায়ে অন্তর্বর্তী আদেশে পাঁচ শতাংশ দাম বাড়াতে পারে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কমিশনের কাছে আবেদন করেছে ভূতাপেক্ষ আদেশে ১ মার্চ থেকেই যেন দাম বাড়ানো হয়। বর্তমান সরকারের তিন বছর মেয়াদে ইতোমধ্যে চার বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের দাম বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানির এক দিন পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বোরো মওসুমে সেচসুবিধা স্বাভাবিক রাখতে দেশের সব শিল্পকারখানায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সিএনজি পাম্প বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হবে, যাতে সিএনজিচালিত যানবাহন ওই সময় গ্যাস নিতে না পারে। বোরো মওসুমে অবশ্যই সেচসুবিধা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে, এতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। সেচসুবিধা দিতে গিয়ে দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে একেবারে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না দেয়ার ফলে শিল্পোৎপাদনে কতটা প্রভাব পড়বে তা কি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে? বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় স্বাভাবিকভাবে অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে। অনেক কারখানা মালিক এর ফলে শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে আনবেন। পরিণতিতে হাজারো শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। রফতানি আয়েও এর প্রভাব পড়বে। অপর দিকে সিএনজিচালিত যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখায় রাজধানীর পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তা আরো বাড়লেও কৃষকের বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বার্থে মানুষ তা না হয় মেনে নেবে। কিন্তু সেটাও কি নিশ্চিত করা গেছে? একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের হেডলাইন পড়লেই বিষয়টি খোলাসা হবেÑ রাতের লোডশেডিংয়ে হুমকিতে বোরো চাষ। সেখানে সংবাদের শুরুতে বলা হয়েছে : বোরো সেচে সরকার প্রতিশ্রুত রাত ১১টা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না কৃষক। এ কারণে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বোরো ক্ষেতে সুষ্ঠুভাবে সেচ দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না বলে চাষিরা অভিযোগ করেছেন। বোরো চাষিদের অভিযোগ, দিনদিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। মওসুমের শুরুতে ভোল্টেজ স্বাভাবিক থাকলেও কয়েকদিন ধরে শুরু হয়েছে লো-ভোল্টেজে বিদ্যুৎ সরবরাহ। যে কারণে বিদ্যুৎ থাকলেও অনেক সময় মোটর দিয়ে পানি উঠছে না। এছাড়া লোডশেডিংয়ে মানুষের দুর্ভোগ, বিভিন্ন শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, মোমবাতি জ্বালিয়ে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খবর তো আছেই। মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ এই সঙ্কট থেকে মুক্ত না হলেও দফায় দফায় বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। আরো এক দফা দাম বাড়ানো হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এবং সেটা এই জুনের মধ্যেই। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে এক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। গত ৩ মার্চ সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বি মিয়া তার বক্তব্যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, সকালে বিদ্যুৎ ছিল না। এ জন্য পাম্প দিয়ে বাসায় পানি তুলতে পারিনি। ফলে বাথরুম ব্যবহার করতে পারিনি, গোসল করতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে ঝুঁকি নিয়ে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করেছেন, তা কোথায়? এত বিদ্যুৎ যাচ্ছে কোথায়? বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার পরও এত লোডশেডিং হচ্ছে কেন? তিনি বলেন, কৃষকদের ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দেয়া হবে বলে তার স্থলে ৩ ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা করে দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে। আমরা মানুষের কাছে আর প্রশ্নবিদ্ধ হতে চাই না। তাই বিদ্যুতের অবস্থা কী তা জানাতে এই মহান সংসদে মন্ত্রীর কাছে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দাবি করছি। আরো কয়েকজন সেখানে একই রকম বক্তব্য প্রদান করেন। তাদের বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা হলোÑ সেচ মওসুমে কৃষকদের রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার কথা থাকলেও রাত ২-৩টার দিকে বিদ্যুৎ দেয়া হয়। আবার তা ৬টার আগেই চলে যায়। বিদ্যুতের অভাবে দিন দিন ধানের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে কৃষকেরা ধান বাঁচাতে পারবেন না। বক্তব্যে এ কথাও উঠে আসে যে, বিদ্যুৎসঙ্কট নিরসনের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। তারপরও বিদ্যুতের অভাবের কারণে গোটা অর্থনীতি ধাক্কা খাচ্ছে। সরকারিভাবে বারবার বলা হচ্ছে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখছে বিদ্যুৎ নিয়ে তারা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। বরং এই খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। জনগণের করের টাকা দিয়ে সেই ব্যয় মেটানো হচ্ছে। এবারের গ্রীষ্ম মওসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ঘাটতির মধ্যে ব্যবধান হবে প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নানা সমস্যা, জ্বালানিস্বল্পতা ও বিতরণব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এই ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। পরিস্থিতি এখন এতটাই খারাপ হয়েছে যে বিদ্যুৎ চলে যায় না, মাঝে মধ্যে আসে। দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নতির জন্য ক্ষমতাগ্রহণের পর সরকার ম্যাজিক কৌশল নিয়েছিল। ঘোষণা দেয়া হয়, ২০১২ সালের পর দেশে আর কোনো বিদ্যুৎসঙ্কট থাকবে না। এর অংশ হিসেবে একের পর এক ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তি করতে থাকে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন একটি ভালো ব্যবসায় পরিণত হয়। ফলে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, ফার্নিচার ব্যবসায়ী সবাই বিদ্যুৎ ব্যবসায় নেমে পড়েন। এই ব্যবসায়ের সুবিধা হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য যে জ্বালানি লাগবে অর্থাৎ ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল, তা ভর্তুকি দামে সরবরাহ করবে সরকার। আবার এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বেশি দামে কিনবে সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার দুই ভাগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেÑ জ্বালানি বিদেশ থেকে ভর্তুকি দিয়ে আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দিতে হচ্ছে। আবার পিডিবির উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। একই সাথে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহে যদি সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে আবার সরকারকে জরিমানাও দিতে হবে। এত ঝুঁকি সত্ত্বেও স্থায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেয়ে এই কুইক রেন্টালের দিকে সরকারের ঝোঁক বেশি। কারণ সরকারি মাল দরিয়ায় গেলে কার কী? নিজের লোকজন তো লাভবান হচ্ছে! বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কুইক রেন্টাল ও ভাড়াভিত্তিক ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সই করা হয়। এর মধ্যে ১৭টি চালু হয়েছে। বাকি তিনটি এ মাসেই চালু হবে। এ ছাড়া সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানি তেলে চলে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন সাড়ে ১৭ কোটি টাকার তেল লাগে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য দরকার হয় ২০ লাখ টন জ্বালানি তেল। এই জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সরকারকে দিতে হচ্ছে বিপুল ভর্তুকি। তেল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখতে এ খাতে কম করে হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হবে। বিপুল লোকসান দেয়ার পরও সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মেগাওয়াটের কোনো হিসাব পাচ্ছে না। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিচুক্তির পর কত হাজার কিউসেক পানি পাওয়া যাচ্ছে তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণার শেষ ছিল না। কিন্তু পরের শুকনো মওসুমে পানি আগে যা পাওয়া যেত তার চেয়েও কম পাওয়া গেছে। অনেকে তখন রসিকতা করে বলতেন- পদ্মাপাড়ের কোনো কৃষকের নাকি কিউসেক ভেজেনি। এখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টাসহ সরকারের মন্ত্রীরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে মেগাওয়াটের হিসাব দিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখছেন বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে মেগাওয়াট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ নিয়ে তাই জনগণ দিশেহারা। এর পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় বাড়ছে বিদ্যুতের দাম, জনগণকে সেটা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মেনে নিতেই হচ্ছে। কিন্তু তারপরও তো তার নাগাল পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। প্রয়োজন তাই আশু সমাধানের পথ খুঁজে বের করার।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির