post

বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকার সরকারের বিকল্প নেই । হারুন ইবনে শাহাদাত

০৭ জানুয়ারি ২০১৯

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে।গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। এই মতামত প্রকাশের জন্য প্রয়োজন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ এবং প্রভাবমুক্ত ফলাফল প্রকাশ। ফলাফল প্রকাশের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য উল্লেখিত প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। জনগণ ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত হয়ে নির্ভয়ে সব সময় তাদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া এদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ইতিহাস নেই। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশের কয়েকটি নির্বাচন এই ফর্মুলা অনুসারে হওয়ার পর শ্রীলংকা, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেক দেশ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বাংলাদেশে আজ এই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের ক্ষমতালিপ্সার কারণে বাতিল হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সনে সর্বপ্রথম অধ্যাপক গোলাম আযম সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘কেয়ারটেকার সরকার’ সংক্রান্ত একটি সুচিন্তিত রূপরেখা জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিবেশনে পেশ করেন। কর্মপরিষদে অনুমোদনের পর ১৯৮০ সনের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান ঢাকার রমনা গ্রিনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কেয়ারটেকার সরকার শিরোনামে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা পেশ করেন। পরবর্তীতে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ ডান বাম সব রাজনৈতিক দল এই ফর্মুলা গ্রহণ করে। কোন কোন প্রভাবশালী দলে ও ব্যক্তি নিজেরা এই ফর্মুলার উদ্ভাবক বলে দাবিও করে। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতায় তা টিকে না। কিন্তু তারপরও নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ দাবিতে এক সাথে আন্দোলন শুরু করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ৭ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ৮ দলীয় জোট, জামায়াতে ইসলামী ও বামপন্থীদের ৫ দলীয় জোটের তুমুল আন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে এদেশে প্রথম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ গঠিত হয়। ১৯৯১ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন আন্দোলনের প্রথম সাফল্য। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাটিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রূপান্তরিত না করায় জটিলতা দেখা দেয় এবং বিএনপি সরকারের অধীনে মাগুরার উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো এই সময় ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার মূল প্রবক্তা জামায়াত হলেও আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থাটিকে তার মূল কর্মসূচির অংশ বানিয়ে নেয়। শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতৃবৃন্দ এর মূল প্রবক্তায় পরিণত হন। এই আন্দোলনেরই একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ ‘‘কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন’’ এই শিরোনামে দৈনিক ভোরের কাগজে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এ নিবন্ধটির প্রথম কিস্তি ২৩.১০.৯৪ এবং শেষ কিস্তি ২৪.১০.৯৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে তিনি তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন : ‘‘আজকে যদি দেশ ও জাতির স্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী ৩/৪/৫টা নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করাই তা হলে আমার মনে হয় আমরা একটা সিস্টেমে যেতে পারবো অর্থাৎ আমাদের এই আন্দোলন হচ্ছে সাংবিধানিক একটি ভিত্তি দাঁড় করানোর জন্য। আজকাল যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন তারা দ্বিতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, তৃতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, চতুর্থবার কিভাবে ক্ষমতায় থাকবেন সে লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে প্রশাসনকে দলীয়করণ করেন। তারা দলকে দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত করেন। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে নষ্ট করেন। দলতত্ত্ব কায়েম করতে গিয়ে এমনভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেন, সরকার তখন আর জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে চান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলকথা জবাবদিহিতা। আজকে পার্লামেন্টে আমরা যখন দুর্নীতির প্রশ্ন তুলি, অন্যান্য প্রশ্ন উত্থাপন করি কিন্তু তার কোনও অর্থবহ আলোচনা হয় না। সেখানে কোনও জবাবদিহিতা নেই। কারণ এ সরকার মনে করে আগামী নির্বাচন যেহেতু তাদের অধীনে হবে, সেহেতু বাংলাদেশের মানুষ তাকে প্রশ্ন করবে না ক্ষমতায় গিয়ে ভালো করেছে কি করেনি, ওয়াদা রক্ষা করেছে কি করেনি। কিন্তু কোন সরকার যদি দেখে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তা হলে অবশ্যই সে সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কারণ তখন সরকার দুর্নীতির আশ্রয় নিতে, নিজের পরিবার-পরিজনকে বিত্তশালী করতে প্রশাসনকে দলীয়করণ করতে ভয় পাবেন এবং এমন কতগুলো কাজ সরকার করবেন যা ভালো কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। যার ফলে জনগণ তাকে ভোট দেবে। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন আমরা তুলেছি।’’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। কেয়ারটেকার সরকারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও এক ও অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আশির দশকের শেষ ভাগ এবং নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তিনি এই সরকারের পক্ষে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন সর্বত্র একটি কথাই বলেছেন এবং তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে দলীয়করণ করে সর্বদাই ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তার ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনে। তিনি সর্বদা এ কথাই বলেছেন যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নাই এবং কেয়ারটেকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন কখনো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। তিনি সর্বদা জোর দিয়ে বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকারের যেহেতু ক্ষমতায় যাবার অভিলাষ নেই সেহেতু এই ব্যবস্থাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র গ্যারান্টি। ১৯৯৪ সালের ১৫ জুন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ সংস্থার সম্পাদকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। এতে তার দলীয় নেতাদের মধ্যে জনাব আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ, আমীর হোসেন আমু ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উপস্থিত ছিলেন। এতে দৈনিক ইত্তেফাক, ইনকিলাব, বাংলার বাণী, বাংলাদেশ অবজারভার, ফাইন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং ইউএনবির প্রধান সম্পাদক/সম্পাদকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৬-০৬-১৯৯৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী, মতবিনিময়কালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমি প্রধানমন্ত্রী হবো এই ভয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। প্রয়োজনে আমি নির্বাচন করবো না। তবুও যতদিন গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করবে ততদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হোক না কেন তাতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন অহিংস থাকেনি। সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল। বন্দর অচল হবার ফলে আমদানি-রফতানি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা এসেছিল। যানবাহন তথা বাস, ট্রাক, ট্রেন ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সম্পদ হানি ছাড়াও সারাদেশে মোট ৭১ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে এবং পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল কয়েক সহস্র। এই সম্পদ ও প্রাণের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানে অঙ্গীভূত করে নেয় এবং এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে শেখ হাসিনার দল এবং একটিতে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। এতে সবাই একমত সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকার ও তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল প্রহসনমূলক। সাংবিধানিক বিধান মেনে এই কেয়ারটেকার সরকারটি গঠিত হয়নি এবং তা ছিল এক-এগারোর সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার। এই সেনাসমর্থিত সরকারের ব্যর্থতার দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে ব্যবস্থাটির কবর রচনা করে আওয়ামী লীগ আবার দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপথগামী করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করার পেছনে যে যুক্তি প্রদর্শন করছেন তা হচ্ছে, এই ব্যবস্থাকে বেআইনি ঘোষণা করে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের রায়। উল্লেখ্য, আদালত ২০১১ সালের ১০ মে এই রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাস করে আওয়ামী লীগ। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করেছিলে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এই বিল পাস হয়। যদিও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। ৩৪২ পৃষ্ঠার রায়টিতে স্বাক্ষর করে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে দিয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এতে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সকলে অর্থাৎ সাতজন মাননীয় বিচারপতি স্বাক্ষর করেছেন ১৪ সেপ্টেম্বর। মাঝখানে পার হয়ে গেছে দীর্ঘ ১৬ মাস চার দিন। এই দীর্ঘ সময় পর জাতি জানতে পারে যে, সাতজনের মধ্যে চারজন কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। বাকি তিনজনের মধ্যে দু’জন বিরোধিতা করেছেন এবং একজন বিষয়টিকে জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। প্রকাশিত রায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। নানা প্রশ্ন যেমন উঠেছে তেমনি সৃষ্টি হয়েছে বিতর্কেরও। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, প্রথমত ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের’ আকারে রায়টি ঘোষণা করা হয়েছিল পরবর্তীতে অর্থাৎ ২০১১ সালের ১০ মে। এর সাত দিনের মধ্যে অবসরে গিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। দায়িত্ব যেখানে ছিল অবসরে যাওয়ার আগেই সকলের স্বাক্ষরসহ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে যাওয়া সেখানে তিনি নিজে স্বাক্ষর করতেই সময় নিয়েছেন দীর্ঘ ১৬ মাস তিন দিন। সে কারণে রায়ে স্বাক্ষর দেয়ার অধিকার নিয়ে তো বটেই, অমন কোনো রায়ের বৈধতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে প্রবীণ আইনজীবী ও সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অবসরে যাওয়ার পর রায়টিতে স্বাক্ষর দেয়ার এখতিয়ারই নেই সাবেক প্রধান বিচারপতির। স্বাক্ষর দিলে রায়টি বৈধতা হারাবে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও বৈধতার প্রশ্ন তুলেছিলেন। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ কিংবা বিতাড়িত হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজকাল তা কদর বেড়েই চলছে। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থার সুফল ইতোমধ্যে পেয়েছে পাকিস্তান, নেপাল ও বুলগেরিয়া। আর এখন তা তুরস্ক ও গ্রিসে গৃহীত হয়েছে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথিকৃৎ মনে করা হয় বাংলাদেশকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ এক সময় বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ কৃতিত্ব দাবি করলেও এ দলটিই আবার এ ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে, যার জের ধরেই বাংলাদেশ চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেও নেপাল, পাকিস্তনসহ বহু দেশই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প নেই। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে আবার এই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। তা না হলে অবিশ্বাস অনাস্থা দূর হবে না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির