post

মিসরে ইসলামী আন্দোলন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন

২০ নভেম্বর ২০১২

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

islami-andolon(গত সংখ্যার পর) রাজনৈতিক দিক থেকে আরব বিশ্বে মিসর বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বে ওমান থেকে পশ্চিমে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত, সুদীর্ঘ আরব জগতের ভৌগোলিক কেন্দ্রে মিসরের অবস্থান। জনসংখ্যার দিক থেকে মিসর বৃহত্তর আরব দেশ। সৌদি আরবের তিন গুণ মানুষের বাস মিসরে। দেশটি বহু বছর ধরে চরম মার্কিনপন্থী তথা পাশ্চাত্যের অতি ঘনিষ্ঠ। একই সাথে আরব বিশ্ব ও আফ্রিকা মহাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ময়দানে মিসর খুব গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। আরব লিগের সদর দফতর মিসরে রাজধানী কায়রোতে। হোসনি মোবারকের পতন বিশেষত উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার বিস্তৃীর্ণ ভূভাগের দেশে দেশে প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সুগঠিত এবং বৃহত্তম নেটওয়ার্কের অধিকারী ইসলামী আন্দোলন ও রাজনৈতিক দল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্র্্র মিসরেই। এ কারণে মিসরের ক্ষমতামঞ্চে পরিবর্তন পাশ্চাত্যকে বেকায়দায় ফেলেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। মিসরে ক্ষমতার পালাবদল ও ইসলামী শক্তির উত্থান তাদের জন্য সমস্যার হবে, এটা ভেবে ইঙ্গ-মার্কিন জুটি সমেত ইহুদিবাদের পশ্চিমা মুরুব্বিরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। মিসরের যে ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং যে প্রভাব আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাতে হোসনি মোবারকের পতন সঙ্কটাকীর্ণ একটা বিরাট অঞ্চলের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের দোসর ইসরাইলের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। এ প্রসঙ্গে সবিশেষ গুরুত্ববহ একটি বিষয় ছিল মিসরের মসনদ উল্টে গেলে তা আঞ্চলিকে তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলবে। কারণ ওপেকের প্রভাবশালী সদস্য মিসর অন্যতম প্রধান তেল রফতানিকারক দেশ। একজন ভাষ্যকার বলেছেন, হোসনি মোবারকের পতন আরব স্বৈরশাসকদের জন্য বিশেষ বার্তা। এটা হবে তিউনিসিয়ায় জয়নাল আবেদিন বেন আলির পতনের চেয়ে অনেক বেশি নাটকীয়। ... এভাবে আরব জগতে জনগণের ক্ষমতার নয়া যুগের সূচনা হয়েছে বলেই মনে করা হবে। পাশ্চাত্যের কথিত অন্ধকার মহাদেশ আফ্রিকার মিসর সুদূর অতীতেও ছিল সভ্যতার আলোয় আলোকিত। অবশ্য বারবার তা আগ্রাসন, কুশাসন, লুণ্ঠন, শোষণের স্বৈরাচারিতার কালোছায়ায় হয়েছে কলঙ্কিত। বহু বছর পর নীল বিপ্লব আবার মুক্তির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে স্বৈরশাসনের অবসানমুখী গণজাগরণের ঝঞ্ঝায়। মিসরে প্রথমে অর্থনৈতিক ইস্যুতে গণ-আন্দোলনের সূচনা হয় কিন্তু অচিরেই তা এক দফা এক দাবি, স্বৈরাচারী একনায়ক কবে যাবি-তে উন্নীত হয়। মিসরের জনগণের অর্থনৈতিক বঞ্চনা শিগগিরই রাজনৈতিক বিদ্রোহের বিস্ফোরিত রূপ পরিগ্রহ করে। মার্কিন-ইসরাইল তাঁবেদার হোসনি মোবারক শাসিত দেশ মিসরে স্বৈরাচারীর বিলাসী জীবনযাত্রার বিপরীতে সাধারণ মানুুষ দীর্ঘদিন শোষণ, নিপীড়ন, অবজ্ঞা ও বঞ্চনার চরম দুর্ভোগের শিকার ছিল। শাসকমহলের ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান অপব্যবহার বাড়িয়েছে নির্যাতন। আর তাদের দুর্নীতি যত বেড়েছে, ততই বেড়ে গেছে দারিদ্র্য। এই পরিস্থিতিতে বেকারত্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্রব্যমূল্যের ইস্যু দ্রুতগতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র কায়েমের অভিন্ন দাবিতে। মিসরে নীল বিপ্লবের বড় দিক হলো দীর্ঘ স্বৈরশাসন এবং তার বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহ। এখানে উল্লেখ্য যে, মিসর প্রাচীন সভ্যতার কারণে সুপরিচিত। মিসর পিরামিড ও স্ফিঙ্কসের ফারাও আমল আর সভ্যতার পাদপীঠ। মিসরের আল আজহার মুসলিম বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। মিসর ভূমধ্যসাগর-তীরবর্তী দেশ এবং এ দেশ দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ছিল। মিসর রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নাম ‘প্রজাতন্ত্র’ হলেও আধুনিক প্রজাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন কখনই কায়েম হয়নি। মিসরের সামরিক স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী আরব জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে সেকুলার চরিত্রের নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। নীল বিপ্লবের মাধ্যমে বিতাড়িত মিসরীয় একনায়ক হোসনি মোবারক ছিলেন সামরিক বাহিনী থেকে আসা ক্ষমতালোলুপ স্বেচ্ছাচারী রাজনীতিক। মিসরের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী ছিল। অথচ এর সুফল জনগণ পায়নি বৈষম্যমূলক ও নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে। সৌদি আরবের পর মিসর হচ্ছে আরব জগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় প্রহসনমূলক গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে স্বৈরন্ত্রের নিষ্ঠুর মুখ। মিসরের একনায়কেরা নিজ দেশের নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কর্মরত ইসলামী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে এবং নেতা ও কর্মীদের ওপর নির্মম নির্যাতন জারি রেখেছিল দুঃশাসনের প্রতি হুমকি হিসেবে গণ্য করে। অথচ মিসরে ইসলামপন্থীরাই শক্তিশালী। ইখওয়ানুল মুসলিমুন বিশ্বব্যাপী বহুল পরিচিত ও আলোচিত সংগঠন। মিসরে ইসলামী সমাজ ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ দলটির মূল নাম মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমুন। মিসরের সামরিক বাহিনী থেকে আসা সামরিক স্বৈরশাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের পর অচিরেই এই আদর্শবাদী দলকে তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের পথে কাঁটা হিসেবে সাব্যস্ত করে অবর্ণনীয় দমন পীড়নে মেতে ওঠে। ইখওয়ানুল মুসলিমুুনকে নির্মূলের অভিযান চালানো হয়। ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে ধ্বংসের পরিকল্পিত প্রয়াস নাসেরের পর সাদত ও মোবারক আমলেও অব্যাহত থাকে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইখওয়ানুল মুসলিমুন নানা কৌশল অবলম্বন করে ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বারবার তৎপর ছিল। তাদের কার্যক্রম সরকারিভাবে বেআইনি হলেও জনমনে ‘ওপেন সিক্রেট’ এই আন্দোলনের প্রভাব সব সময়েই স্বৈরতন্ত্রী সরকারের জন্য একটা বিরাট উদ্বেগের কারণ। কারণ এটি এখন স্পষ্ট যে, মিসরের সর্বপ্রধান রাজনৈতিক দল ইখওয়ানুল মুসলিমুনই। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন ও সংগ্রামে সরব থাকার চেষ্টা করে গেছে। ১৯৮০ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন মিসরীয় রাজনৈতিক মূলধারায় প্রত্যাবর্তন করেছে। স্মর্তব্য, ১৯৪৮ সালের প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কর্মীরা সরাসরি লড়াই করেছিলেন ইহুদিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। জামাল আবদুন নাসের তা ভালো করেই জানতেন। (চলবে) লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির