post

রক্তাক্ত বাংলাদেশ ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা

লাবিব আহসান

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
আমরা সম্ভবত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর একটি সময় অতিবাহিত করছি। চারদিকে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার আবহ বিরাজমান। কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। গুম, হত্যা, ধর্ষণ, জুলুম, নিপীড়ন, ধরপাকড় আর বিরোধী মত দমনের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আপনজন হারানো স্বজনের হাহাকার আর আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বাংলার মুক্তিকামী জনতা প্রতি মুহূর্তে মুক্তির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। নব্য স্বৈরাচারের দুঃশাসনের করাল গ্রাসে আটকে পড়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন। গণতন্ত্রকে কাফনের কাপড় মুড়িয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে। মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা পদদলিত, নিষ্পেষিত। সাহসী সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের ভাষায়, “বাংলাদেশ আজ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক কারাগারে পরিণত হয়েছে। ষোল কোটি মানুষ এখানে জেলে আছে।” এমন বাংলাদেশকে দেখে আশির দশকে লেখা কবি শামসুর রাহমানের অমর কবিতা, “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ” এর কথা মনে পড়ে যায়। কবি শামসুর রাহমান স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের আমলে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। কবি যে প্রেক্ষাপটেই কবিতাটি লিখে থাকুন না কেন, আজকের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার এই শিরোনামটি অসম্ভব রকম সাযুজ্যপূর্ণ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার আগ্নেয়াস্ত্রের ঔরস এবং ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হয় ওয়ান-ইলেভেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। অতঃপর ওয়ান-ইলেভেনের ফসল হিসেবে ২০০৮ সালের ২৯ শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতায় বসেই আওয়ামী লীগ পিলখানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা করে। বিডিআরের মতো দেশপ্রেমিক একটি বাহিনীকে অত্যন্ত সুকৌশলে রাতারাতি পরিণত করা হয় একটি প্রতিবন্ধী বাহিনীতে। অথচ এই ‘বিডিআর’ নামটির সঙ্গে কতো সাহসী জওয়ানের সীমান্তে জীবন দানের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে! ৫৭ সেনা অফিসারের স্বজনদের কান্না আজও থামেনি। “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা” প্রবাদটির বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বিডিআরকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের সঙ্গে অনেক নিরপরাধ বিডিআর জওয়ান বছরের পর বছর জেল খাটছেন। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করার যোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। বিচারের বাণী প্রতিনিয়ত নিভৃতে কেঁদেই চলেছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমরা। ১৫ বছর বয়সী এক গরিব কিশোরীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকতে দেখেছে পুরো পৃথিবী। ভোর ছয়টার দিকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের জওয়ান অমিয় ঘোষ গুলি করে হত্যা করে ফেলানী নামের সেই কিশোরীকে। ফেলানী ফিরছিল তার বাবার সাথে। বাবা নুরুল ইসলাম এর ভাষ্যমতে ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তাই তার বিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে ফিরছিলেন তিনি ভারত থেকে। ‘ফেলানী’ নামটিই বলে দেয় কতটা প্রান্তিক এই ছোট্ট কিশোরী। যেখানে প্রজন্মান্তের আমাদের বোনদের, সন্তানদের নামগুলো কথিত আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে, সেখানে সে ‘ফেলানী’ই রয়ে গেছে। অনুবাদে যার নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘যে ফেলে দেয়ার যোগ্য’। রাষ্ট্র রাষ্ট্র খেলার বলি এই দরিদ্র কিশোরীর মৃত্যু আমাদেরকে অপরাধী হিসেবে দাঁড় করায় বিবেকের কাঠগড়ায়। ফেলানীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট (The Economist) Felanis last steps শিরোনামে এক প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা Human Rights Watch এর বরাতে বলা হয়েছে- “গত দশ বছরে বিএসএফ বাংলাদেশ-ভারত ২৫৫০ মাইল সীমান্তজুড়ে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এতে প্রতি চারদিনে একজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়।” দ্য ইকোনমিস্ট একই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, “এই হত্যার সংখ্যা স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ‘ইনার জার্মান বর্ডার’ অতিক্রমকালে নিহত লোকের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি।” বাংলাদেশ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই এর জন্য দায়ী। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে যতো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, ভারতের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের সীমান্তে এতো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। এমনকি ভারতের চির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃত পাকিস্তানের সঙ্গেও নয়। ফেলানী হত্যার ৮ বছর হতে চললেও হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো হয়নি। ঘাতক অমিয় ঘোষের অট্টহাসি আর ফেলানীর ঝুলন্ত দেহ যেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হরণেরই অশনিসঙ্কেত। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনিকে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাদের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় ঐ বাসায় থাকা তাদের একমাত্র শিশুসন্তান মাহি সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর সরকার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিদেরকে গ্রেফতার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। সেই ৪৮ ঘণ্টা আদৌ কবে শেষ হবে আমরা জানি না। শিশু বয়সে বাবা-মাকে হারানো ছোট্ট মেঘের গভীর রাতের অভিমানের ভাষা কি রাষ্ট্র পড়তে পারে? তার ছোট্ট বুকের দীর্ঘশ্বাস কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুনতে পান? বিএনপির-নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিনে-দুপুরে খুন হন গরিব দর্জি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাস। অনেকগুলো ক্যামেরার সামনেই ওই ঘটনা ঘটে এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যার দৃশ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। বিব্রতকর এক পরিস্থিতির মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই হত্যার এক বছর পর ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনালে মামলার রায়ে ২১ জনের মধ্যে আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছিলো। অবশেষে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে ছয়জনকে খালাস দেন। বিচার বিভাগের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া খুনিদের পৈশাচিক হাসি বিশ্বজিতের পরিরারের মর্মযাতনা আরও বেশি বাড়িয়ে তুলবে প্রতিনিয়ত। প্রতিনিয়ত জানান দিয়ে যাবে, বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা এখন সুদূর পরাহত। এভাবে ২০১৩ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হওয়া রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। কিন্তু এর জন্য দায়ী রানা প্লাজার মালিক রানা কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় বেঁচে যায়। এতোগুলো মানুষকে হত্যার পরও তাকে ফাঁসির রশিতে ঝুলতে হয় না। বিচারহীনতার অদ্ভুত এক দেশ আমাদের প্রিয় স্বদেশ। তনু, রুপা কিংবা বিউটিকে হত্যার বিচার আজো আলোর মুখ দেখেনি। হয়তো আর দেখবেও না। তাদের স্বজনদের এই কষ্ট এই যন্ত্রণা বুকে চাপা দিয়েই হয়তো বাকি জীবন কাটাতে হবে। আমাদের দেশে গুম এক ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গুম এখন একটা অন্যতম আতঙ্কের নাম। গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের স্বজনের কষ্ট যন্ত্রণা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মানুষদের স্বজনের কষ্ট যন্ত্রণার চেয়েও বেশি। এক ধরনের প্রতীক্ষা, অনিশ্চয়তা এবং হাহাকারের ভিতর দিয়ে তাদের স্বজনদের দিন কাটে। গুম হওয়া একজনের বাবা একটি অনুষ্ঠানে এসে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মিনতি করে বলছিলেন, “আমার ছেলেকে যদি মেরেই ফেলে থাকেন, অন্তত লাশটা ফেরত দিন। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু একটু দোয়া করবো।” হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্য থেকে ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরে এসেছেন ১৯৫ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৪৮ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজের সংখ্যা আরও বেশি। এর মধ্যে অনেক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে টাকার জন্যও মানুষ গুম ও খুনের ঘটনা আছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এর বড় উদাহরণ। গত আট বছরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একটা বড় অংশ রাজনৈতিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে কেবল ঢাকা থেকে গুম হয়েছেন বিএনপির এমন ২৫ জন নেতাকর্মীর নাম প্রকাশ করেছে দলটি। ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাবি, তাদের ২৯ জন নেতাকর্মী নিখোঁজ আছেন। এ ছাড়াও জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আল আযমী এবং সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য শহীদ মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম আরমানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁরা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ভয়াবহ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সারাদেশের সমস্ত ক্যাম্পাসগুলোসহ গোটা বাংলাদেশে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বেশ কিছুদিন আগে সংঘটিত কোটা সংস্কারের মতো একটি যৌক্তিক আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর নগ্ন হামলা চালিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূরুর ওপরে ঢাবি ক্যাম্পাসে পৈশাচিক হামলা চালিয়ে তাকে মারাত্মক আহত করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র তরিকুলকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েছে ছাত্রলীগ নেতা মামুন। গত ২২ জুলাই কুষ্টিয়া কোর্টে একটি মামলার জামিন নিতে গিয়ে ৪ ঘন্টা অবরুদ্ধ থাকার পর ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন নির্ভীক এবং সাহসী সাংবাদিকতার প্রতীক মাহমুদুর রহমান। সম্পূর্ণ পুলিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাঁর ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলাকারীরা তাঁর কাছে আদর্শিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত হয়েছে। এ ঘটনার পর তিনি অজস্র মানুষের দোয়া এবং ভালোবাসা পেয়েছেন। আজ মাহমুদুর রহমান শুধু একটি নাম নয়; মাহমুদুর রহমান একটি ইতিহাস। একটি আন্দোলন, একটি জাগরণ ও বিশ্বাসের গগনজোয়ারি কণ্ঠস্বর। সাহস ও মননের এক দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকা। কোটি কোটি মজলুম বনি আদমের হৃদয়রাজ্যের এক মুকুটহীন সম্রাট। ন্যায় ও সত্যপ্রতিষ্ঠার অকুতোভয় সিপাহসালার। মাহমুদুর রহমান আজ ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়া এক বীরসেনানীর নাম, সময়ের এক সাহসী উচ্চারণ। যখন শাহবাগে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ থেকে রাসূল (সা:) কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছিলো, তখন তিনি সাহসিকতার সাথে এই হীনচক্রান্তের প্রতিবাদ করেন। রেল কেলেঙ্কারির মাধ্যমে আমাদের রেল ব্যবস্থাকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো তখন তিনি জাতির সামনের সেই রহস্যময় জটের মুখোশ উন্মোচন করেন। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে যখন রাস্তার বসানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত, কথিত সুশীলরা তখন মুখে কুলুপ এঁটে ঘরে বসে ছিলেন, সেসময় তিনি সাহসী ভূমিকা রেখেছেন দেশ মাতৃকার টানে। হলমার্ক আর পদ্মাসেতুর দুর্নীতি ইস্যুতে তাঁর সাহসী লেখনী ওদের বুকে যে দগদগে ঘা সৃষ্টি করেছিলো, রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো, এই আঘাত তার কাপুরুষোচিত প্রতিশোধস্পৃহারই বহিঃপ্রকাশ। রাজপুত্রের দুর্নীতির গুমর ফাঁস, ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজশাহীতে মহাসমাবেশ, টিপাইমুখে বাঁধের প্রতিবাদে লংমার্চ কিংবা ভারতকে করিডোর দেয়ার বিরোধিতা করার জন্য কলিজা থাকতে হয়। এই কলিজা এখন খুব অল্প মানুষের আছে। মাহমুদুর রহমান তাদেরই একজন। স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস এবং বিচারিক হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, তা ইতিহাসে তাঁকে সাহসী মানুষের প্রতীক হিসেবে অমরত্বের মর্যাদা দিবে। এ ছাড়াও গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষার সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করে ঢাকার রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া ও করিম। সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রশ্ন করলে তিনি আকর্ণবিস্তৃত হাসি উপহার দেন। এই জনতা কবে বুঝবে মৃত্যু সংবাদ শুনে দাঁতের পাটি বের করে হাসা মানুষগুলো জনগণের রাজনীতি করতে আসেনি, এসেছে নিজেদের ভাগ্য গড়তে! এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ গোটা দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। প্রত্যেক গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে রাষ্ট্রের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়,“তোমরা যেটা পারো নি আমরা সেটা পেরেছি।” শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি নিয়ে রাস্তায় শান্তিপূর্ণ “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলন চালানোর সময় কয়েক শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মী মাথায় হেলমেট পরিধান করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এমনকি ৪ জন ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগও ওঠে। এই স্কুল-কলেজ-পড়ুয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো আমাদের বিবেকের কলার চেপে ধরে শিখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে অধিকার আদায়ের প্রশ্নে রাজপথে নামতে হয়। কিভাবে সহপাঠীর হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদের হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে হয়। তাদের সেই বিখ্যাত স্লোগান, “যদি তুমি ভয় পাও/তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/ তবে তুমিই বাংলাদেশ” আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য এক নীরবতা পেয়ে বসেছে আমাদের! দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু মানুষ বাড়ছে না। স্বার্থপরতার অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। এ জন্যই হয়তো ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “মানুষ খুঁজিয়া ফিরি জনতায়, মানুষ কই?” চারদিকে অদ্ভুত এক আঁধার জেঁকে বসেছে। আমার নীরবতা সেই আঁধারে যোগ করেছে বাড়তি নিস্তব্ধতা। আইনস্টাইন বলেছিলেন, “এই পৃথিবী খারাপ মানুষদের অপকর্মের কারণে ধ্বংস হবে না। এই পৃথিবী ধ্বংস হবে ভালো মানুষদের অপকর্ম দেখে ও নিশ্চুপ থাকার জন্য।” হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা)-এর সেই হাদসি, “তোমার সামনে কোনো অন্যায় হতে দেখলে সুযোগ থাকলে হাত দিয়ে প্রতিবাদ করো। না পারলে মুখ দিয়ে করো। সেটাও না পারলে অন্তত মন থেকে সেটা ঘৃণা করো। এটা হলো ন্যূনতম ঈমানের পরিচয়।” (সহিহ মুসলিম) বাংলাদেশের মানুষের অন্যায় আর জুলুম দেখেও নীরব থাকার প্রবণতা দেখে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান তাঁর “আত্মঘাতী নির্লিপ্ততা” শিরোনামের কলামে লিখেছেন, “সমাজে ঘোরাফেরা করলে একটি বক্তব্য এখন প্রায়ই শোনা যায়। আমরা ভাই ছাপোষা মানুষ, রাজনীতির বাইরে আপন পরিবার নিয়ে থাকতে পারলেই খুশি। ভোট, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এসব বড় বড় কথা যারা দেশ চালান তারাই বুঝবেন। আমরা কোন দল-টল করতে চাই না।” পুরো জাতির মধ্যে কখন যেন এক প্রকার ভীরু, পরাজিত, দাসসুলভ মানসিকতা গভীরে ঢুকে গেছে। আমাদেরকে এই আত্মকেন্দ্রিকতার জিঞ্জির থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সকল অন্যায়, জুলুম আর প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। নইলে স্মরণ করুন জার্মান কবি মার্টিন ন্যিমোলারের সেই বিখ্যাত কবিতা- “যখন নাৎসিরা কমিউনিস্টদের হত্যার জন্য এসেছিলো, তখন আমি নীরব ছিলাম; কারণ, আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না। যখন তারা শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করতে এসেছিলো, আমি কিছুই বলিনি; কারণ, আমি শ্রমিক সংগঠক ছিলাম না। যখন তারা ইহুদিদের হত্যার জন্য এসেছিলো, আমি নিশ্চুপ ছিলাম; কারণ, আমি ইহুদি ছিলাম না। আর তারা যখন আমাকে হত্যার জন্য এলো, তখন প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না।’ লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির