post

রাসূলুল্লাহ সা. এবং তাঁর উত্তরসূরিদের সাথে আচরণনীতি

ড. মো. হাবিবুর রহমান

০৮ অক্টোবর ২০২১

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (১) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ (২) إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ (৩) إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ (৪) وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا حَتَّى تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৫) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ (৬) অনুবাদ ১. হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ২. হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের ওপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে, তোমাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না। ৩. নিশ্চয় যারা আল্লাহর রাসূলের নিকট নিজেদের আওয়াজ অবনমিত করে, আল্লাহ তাদেরই অন্তরগুলোকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করেছেন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান। ৪. নিশ্চয় যারা তোমাকে হুজরাসমূহের পিছন থেকে ডাকাডাকি করে তাদের অধিকাংশই বুঝে না। ৫. তুমি তাদের কাছে বের হয়ে আসা পর্যন্ত যদি তারা ধৈর্যধারণ করত, তাহলে সেটাই তাদের জন্য উত্তম হতো। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ৬. হে ঈমানদারগণ, যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোন কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে। (সূরা হুজুরাত : ১—৬)

নামকরণ ও সূরা পরিচিতি পবিত্র কুরআনের ৪৯ তম সূরা এটি। যার আয়াত সংখ্যা ১৮ এবং রুকু (অনুচ্ছেদ) সংখ্যা ২। এ সূরার ৪ নম্বর আয়াত إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ এর মধ্যকার (الْحُجُرَاتِ) শব্দটি নাম হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

নাজিলের সময়কাল বিভিন্ন বর্ণনা ও সূরার বিষয়বস্তু থেকে জানা যায় যে, এ সূরা বিভিন্ন পরিবেশ ও ক্ষেত্রে নাজিল হওয়া হুকুম—আহকাম ও নির্দেশনাসমূহের সমষ্টি। এবং ঐ সব হুকুম—আহকামের বেশির ভাগই মাদানি যুগের শেষ পর্যায়ে নাজিল হয়েছে। যেমন: ৪ নম্বর আয়াত (إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ) সম্পর্কে তাফসিরকারদের বর্ণনা হচ্ছে আয়াতটি বনি তামিম গোত্র সম্পর্কে নাজিল হয়েছিলো। যার প্রতিনিধিদল এসে নবী সা.—এর পবিত্র স্ত্রীগণের হুজরা বা গৃহের বাইরে থেকে তাঁকে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিলো। আর সমস্ত সিরাতগ্রন্থে হিজরি নবম সনকে এই প্রতিনিধিদলের আগমনের সময় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

অনুরূপ ষষ্ঠ আয়াত (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ) সম্পর্কে বহু সংখ্যক হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তা ওয়ালিদ ইবনে উকবা সম্পর্কে নাজিল হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ সা. যাকে নবী মুস্তালিক গোত্র থেকে যাকাত আদায় করে আনতে পাঠিয়েছিলেন। আর একথা সবারই জানা যে, ওয়ালিদ ইবনে উকবা মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হয়েছিলেন। সুতরাং এ সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

আলোচ্য বিষয় এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে, মুসলমানদেরকে এমন আদব—কায়দা, শিষ্টাচার ও আচার—আচরণ শিক্ষা দেয়া যা তাদের ঈমানদারসুলভ স্বভাব চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত ও মানানসই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে যেসব আদব—কায়দা, ও শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এ সূরার প্রথম পাঁচ আয়াতে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, প্রতিটি খবরই বিশ্বাস করা এবং সে অনুসারে কোনো কর্মকাণ্ড করে বসা ঠিক নয়, যদি কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কওমের বিরুদ্ধে কোনো খবর পাওয়া যায় তাহলে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে খবর পাওয়ার মাধ্যম কতটা নির্ভরযোগ্য। নির্ভরযোগ্য না হলে তার ভিত্তিতে কোন তৎপরতা চালানোর পূর্বে খবরটি সঠিক কি না তা যাচাই বাছাই করে নিতে হবে। এরপর বলা হয়েছে, মুসলমানদের দুটি দল যদি কোন সময় পরস্পর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তবে সে ক্ষেত্রে অন্য মুসলমানদের কর্মনীতি কী হওয়া উচিত তার বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর মুসলমানদেরকে একে অপরকে ঠাট্টা বিদ্রƒপ করা, বদনাম ও উপহাস করা, খারাপ নামে আখ্যায়িত করা, খারাপ ধারণা পোষণ করা, অন্যের গোপনীয় বিষয় খেঁাজাখুঁজি ও অনুসন্ধান করা, এসকল সমাজের গর্হিত কাজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতঃপর গোত্রীয় ও বংশগত বৈষম্যের ওপর আঘাত হানা হয়েছে যা সারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও বংশের নিজ নিজ মর্যাদা নিয়ে গর্ব ও অহঙ্কার করা, অন্যদেরকে নিজেদের চেয়ে নিম্নস্তরের মনে করা এবং নিজেদের বড়ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের হেয় করা, এসব জঘন্য খাসলতকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সবশেষে মানুষকে বলা হয়েছে যে, ঈমানের মৌখিক দাবি প্রকৃত জিনিস নয়, বরং সরল মনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মানা, সিদ্ধান্তসমূহকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর পথে জান ও মাল কুরবানি করা।

ব্যাখ্যা ১ নম্বর আয়াত يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”

উক্ত আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট একবার বনি তামিম গোত্রের কিছু লোক রাসূল সা.—এর দরবারে হাজির হয়। এ গোত্রের নেতা কাকে বানানো হবে সে সম্পর্কে তখন আলোচনা চলছিলো। হযরত আবু বকর রা. ইবনে হাকিমের নাম উল্লেখ করলেন, হযরত ওমর রা. আকরা ইবনে হাবসের নাম প্রস্তাব করলেন। এ বিষয়ে আলোচনা চলতে চলতে এক পর্যায় মজলিসেই দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটিতে উন্নীত হয়ে তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে গেল এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয়। (বুখারি) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঐ সকল মুমিনদের সম্বোধন করে বলেছেন, যারা ঈমান আনার পরে আর কোনো সন্দেহ সংশয় পোষণ করেনি বরং ঈমানের দাবিতে সত্যবাদিতার প্রমাণ দিয়েছে, সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত থেকেছে। এসকল ঈমানদারের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ “মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজেদের সম্পদ ও নিজেদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ।” (সূরা হুজুরাত : ১৫) এ আয়াতের মাধ্যমে এই শ্রেণীর ঈমানদারকে বুঝানো হচ্ছে যে, কোনো কথায় ও কাজে রাসূল সা. থেকে অগ্রণী হয়ো না, বরং তাঁর সিদ্ধান্ত ও অনুমতির জন্য অপেক্ষা কর। একজন ঈমানদার ঈমানের ঘোষণা দেয়ার পরে আর রাসূল সা.—এর বিরুদ্ধাচরণ করা, তাঁর সিদ্ধান্তের বিপরীত আমল করা, কুরআন ও সুন্নাহকে অমান্য করা জায়েজ নেই। কারণ রাসূল সা. এর সিদ্ধান্ত অমান্য করা, বিরুদ্ধাচরণ করাই হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূল সা.কে কষ্ট দেওয়ার শামিল। আর যারা রাসূল সা.কে কষ্ট দেয় তাদের মুক্তির কোনো উপায় নেই বরং তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন, وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ رَسُولَ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ “যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।” (সূরা আহযাব : ৬১)

আচার—আচরণের ক্ষেত্রে রাসূল সা.—এর মর্যাদা উপরোক্ত আয়াতের আলোকে রাসূল সা.—এর সামনে উঁচুস্বরে কথা বলা যেমন জায়েয নেই, ঠিক তেমনি রাসূল সা.—এর আগে যাওয়াও জায়েজ নেই। অনুরূপভাবে রাসূলগণের উত্তরসূরি হিসেবে আলেমদের অগ্রণী হওয়া এবং জাতির নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গের সামনে উঁচুস্বরে কথা বলাও জায়েজ নেই। ইমাম কুরতুবী বলেন, “পয়গম্বরগণের উত্তরাধিকারী হওয়ার কারণে পয়গম্বরগণের আগে হাঁটা সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার আওতায় যেমন আলেমগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তেমনিভাবে আওয়াজ উঁচু করারও বিধান তাই। আলেমগণের মজলিসে এত উঁচুস্বরে কথা বলবে না, যাতে তাঁদের আওয়াজ চাপা পড়ে যায়।” (মারেফুল কুরআন)

রাসূল সা.—এর আনুগত্যের মধ্যেই আল্লাহর ভালোবাসা একজন মুমিনের আল্লাহর ভালোবাসা নির্ভর করে রাসূল সা. এর আনুগত্যের ওপরে। অর্থাৎ যে রাসূল সা.—এর পরিপূর্ণ আনুগত্য করবে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন এবং অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ “বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্ল¬াহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান : ৩১)

ইসলামী আন্দোলনে আনুগত্যের মাপকাঠি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত নেই অর্থাৎ শর্তহীন আনুগত্য করতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন— يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ “হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যর্পণ করাওÑ যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।” (সূরা নিসা : ৫৯) তবে দায়িত্বশীলের আনুগত্যের ব্যাপারে শর্ত প্রযোজ্য, ভালো কাজে সহযোগিতা করা এবং অন্যায় কাজে অসহযোগিতা করাই ইসলামের বিধান। আল্লাহ বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ “সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আজাব প্রদানে কঠোর।” (সূরা মায়েদা : ২) আল—হাদিসে বর্ণিত হয়েছে— لاَ طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةٍ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ “আল্লাহর নাফরমানির কাজে কোনোরূপ আনুগত্য নেই। আনুগত্য করতে হয় কেবলমাত্র ন্যায়সঙ্গত কাজে।” (বুখারি ও মুসলিম) আনুগত্যের মাপকাঠিতে যতক্ষণ দায়িত্বশীল অবস্থান করবে ততক্ষণ তার আনুগত্য করা ফরজ। এক্ষেত্রে যদি সে হাবশি গোলামও হয়। একাদশ হিজরিতে রাসূল সা. রোমান বাহিনীর সাথে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু বকর, ‘উমর, সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবী এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। রাসূল সা. উসামা বিন যায়িদকে এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন। তখন তাঁর বয়স বিশের কাছাকাছি। আবু বকর রা. সাধারণ কর্মী হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয়েছেন। (আসহাবে রাসূলের জীবনকথা)

২ নম্বর আয়াত يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের ওপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সে রকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।”

এ আয়াতে ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদেরকে আদব শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। বৈঠকে কথা আস্তে বলা, অনুমতি ছাড়া কথা না বলা। যদি কেউ এটা করে তাহলে তার অজান্তেই তার আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। রাসূল সা.—এর মজলিসে শূরার বৈঠকের আলোচনা চলছিলো সেখানে হযরত আবু বকর ও ওমর রা. এর কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে গেলো আল্লাহ এটা বরদাস্ত করলেন না। সাথে সাথে জানিয়ে দিলেন (أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ) তোমাদের আমল সব নষ্ট হয়ে যাবে, যদি তোমরা আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী কোন কাজ কর।

৩ নম্বর আয়াত إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর রাসূলের নিকট নিজেদের আওয়াজ অবনমিত করে, আল্লাহ তাদেরই অন্তরগুলোকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করেছেন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।”

উপরোক্ত আয়াতে যে সকল মুমিনগণ কুরআনের এ আয়াত নাজিল হওয়ার পরে মেনে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও রাসূল সা.—এর আদর্শের একনিষ্ঠ আনুগত্য করেছে তাদের প্রতিদান ও মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে। একজন ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যখনই তাকে কোনো কল্যাণকর কাজের দিকে আহবান করা হয় এবং অকল্যাণকর কাজ থেকে নিষেধ করা হয় তখন সে কোনো দ্বিধাসংকোচ ছাড়াই ঘোষণা দেয়, শুনলাম এবং মেনে নিলাম। ঈমানদারের এ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ “মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এ মর্মে আহ্বান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার, মীমাংসা করবেন, তাদের কথা তো এই হয় যে, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম। আর তারাই সফলকাম।” (সূরা আন নূর : ৫১) তাই যারা এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে জীবনে আর কোনোদিন রাসূল সা.—এর সামনে অগ্রগামী হয়নি এবং তাঁর সামনে উঁচুস্বরে কথা বলেনি তাদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ তাকওয়ার গুণাগুণ দ্বারা পূরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং এরাই পরকালীন জীবনে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

৪ ও ৫ নম্বর আয়াত إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ (৪) وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا حَتَّى تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৫) “নিশ্চয়ই যারা তোমাকে হুজরাসমূহের পিছন থেকে ডাকাডাকি করে তাদের অধিকাংশই বুঝে না। তুমি তাদের কাছে বের হয়ে আসা পর্যন্ত যদি তারা ধৈর্যধারণ করত, তাহলে সেটাই তাদের জন্য উত্তম হতো। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”

প্রেক্ষাপট ইমাম বগভী ও কাতাদাহ (রহ) বলেন, বনু তামিম গোত্রের লোকজন দুপুরের সময় মদিনায় উপস্থিত হয়েছিলো। তখন রাসূল সা. কোনো এক হুজরায় বিশ্রামরত ছিলেন। তারা ছিলো বেদুঈন এবং সামাজিক রীতি—নীতি সম্পর্কে অজ্ঞ। কাজেই তারা হুজরার বাইরে থেকেই ডাকাডাকি শুরু করলো, اخرج الينا يا محمد (হে মুহাম্মদ তুমি আমাদের কাছে বের হয়ে আসো) এর পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়। এতে এভাবে ডাকাডাকি করতে নিষেধ করা হয় এবং অপেক্ষা করার আদেশ দেয়া হয়। (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমদ)

ব্যাখ্যা এ আয়াতের মাধ্যমে রাসূল সা., তাঁর উত্তরসূরি উলামাদেরকে এবং সম্মানিত কোনো ব্যক্তিকে ঘরের বাইরে থেকে ডাকার পদ্ধতি ও নিয়ম শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ইসলামী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা অংশ নিয়েছে, যারা ইসলামকে জীবনের সর্বাঙ্গীণ সাথী বানিয়েছে তাদেরকে জাহেল—অজ্ঞ লোকদের মতো বাইরে থেকে উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করার পরিবর্তে ঘরের বাইরে বের হয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার ব্যাপারে বলা হয়েছে, মূলত এটাই ইসলামের বিধান।

তবে যারা ভুল করে ফেলেছে তাদেরকেও এ আয়াতে শিক্ষা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, এ যাবৎ যা হওয়ার তা হয়েছে। যদি ভবিষ্যতে এ ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা হয় তবে আল্লাহ অতীতের সব ভুল ক্ষমা করে দেবেন এবং যারা তাঁর রাসূলকে সা. এভাবে কষ্ট দিয়েছে দয়া ও করুণা পরবশ হয়ে তিনি তাদের পাকড়াও করবেন না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ সা.—এর সাথে কথোপকথন বা তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহণের সময় মুমিনগণের বুঝতে সমস্যা হলে তারা বলতেন راعنا ‘রাইনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন এবং ধীরে বলুন। ইয়াহুদিরা তা শুনে শব্দটির আর একটি অর্থ ‘বোকা’ সে অর্থে ব্যবহার শুরু করল এবং নিজেরা হাসি—ঠাট্টা করতে লাগল। তখন আল্ল¬াহ তায়ালা উক্ত দ্ব্যর্থবোধক শব্দটির পরিবর্তে পরিষ্কার অর্থবোধক শব্দ ‘উনজুরনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি নজর দিনÑ শব্দটি ব্যবহার করার নির্দেশ দিলেন। আল কু্রআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انْظُرْنَا وَاسْمَعُوا وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ (১০৪) “হে মুমিনগণ, তোমরা ‘রাইনা’ বলো না; বরং বল, ‘উনজুরনা’ আর শোন, কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব।” (সূরা বাকারা : ১০৪)

৬ নম্বর আয়াত يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ “হে ঈমানদারগণ, যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।”

উক্ত আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট মুসনাদে আহমাদের বরাত দিয়ে ইবনে কাসির বর্ণনা করেন, বনি মুস্তালিক গোত্রের সরদার হারিস ইবনে দিরার ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা: তাকে যাকাত প্রদানের আদেশ দিলেন। তিনি যাকাত প্রদানে স্বীকৃত হলেন এবং তারা গোত্রে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের যাকাত আদায় করে জমা করে রাখবেন বললেন এবং রাসূল সা.কে একটি নির্দিষ্ট তারিখে যাকাতের অর্থ নেয়ার জন্য কোনো দূত পাঠাতে বললেন। কিন্তু নির্ধারিত তারিখ পার হয়ে গেলেও দূতের দেখা না পেয়ে হারিস আশঙ্কা করলেন রাসূল সা. কোনো কারণে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন এবং এ কথা তিনি ইসলাম গ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে প্রকাশ করে রাসূল সা.—এর সাথে সবাই মিলে দেখা করার ইচ্ছা করলেন। এদিকে রাসূল সা. নির্ধারিত তারিখে ওলিদ ইবনে ওকবাকে প্রেরণ করলেন তিনি পথিমধ্যে ধারণা করেন এই গোত্রের লোকদের সাথে তার পুরাতন শত্রুতা আছে। তাকে একা পেয়ে হত্যা না করে ফেলে। তিনি ফিরে আসেন এবং রাসূল সা.—কে বলেন, তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছে। রাসূল সা. রাগান্বিত হয়ে খালিদ ইবনে ওলিদের নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ প্রেরণ করেন। অতঃপর তা জানতে পেরে হারিস ইবনে দিরার রাসূল সা.কে বলেন, তিনি ওলিদ ইবনে উকবাকে দেখেননি। উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (ইবনে কাসির) কোনো কোনো রিওয়ায়েতে আছে— ওলিদ ইবনে উকবা রা. বনু মুস্তালিক গোত্রে পৌঁছেন। গোত্রের লোকেরা অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে বস্তি থেকে বের হয়ে আসে। ওলিদ সন্দেহ করে তারা বোধ হয় পুরাতন শত্রুতার কারণে তাকে হত্যা করতে আসছে। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে এ ধারণা ব্যক্ত করলে রাসূল সা. খালিদ ইবনে ওলিদকে ঘটনা পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দিলেন। তিনি ফিরে এসে সংবাদ দিলেন তারা ঈমানের উপর অটল রয়েছে/যাকাত দিতে প্রস্তুত। উম্মে সালাম বর্ণিত রিওয়ায়েতে ওলিদ ইবনে উকবার নাম ছাড়াই বর্ণিত হয়েছে, নাজুক পরিস্থিতিতে যখন একটি ভিত্তিহীন খবরের ওপর নির্ভর করার কারণে একটি বড় ভুল সংঘটিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, সে মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে এ মৌলিক নির্দেশটি জানিয়ে দিলেন যে, যখন তোমরা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবে যার ভিত্তিতে বড় রকমের কোনো ঘটনা সংঘটিত হতে পারে তখন তা বিশ্বাস করার পূর্বে খবরের বাহক কেমন ব্যক্তি তা যাচাই করে দেখো। সে যদি কোনো ফাসেক লোক হয় অর্থাৎ যার বাহ্যিক অবস্থা দেখেই প্রতীয়মান হয় যে, তার কথা নির্ভরযোগ্য নয় তাহলে তার দেয়া খবর অনুসারে কাজ করার পূর্বে প্রকৃত ঘটনা কী তা অনুসন্ধান করে দেখো।

ব্যাখ্যা ইমাম জাস্সাস আহকামুল কুরআনে বলেন, এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো ফাসেক ও পাপাচারীর খবর কবুল করা এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা জায়েজ নেই, যে পর্যন্ত না অন্যান্য উপায়ে তদন্ত করে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যায়। কারণ এ আয়াতের আর একটি কিরআত হচ্ছে,فتثبتوا অর্থাৎ তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তড়িঘড়ি করো না; বরং অন্য উপায়ে এর সত্যতা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দৃঢ় থাকো। ফাসেকের খবর কবুল করা যখন নাজায়েজ তখন তার সাক্ষ্য কবুল করাও উত্তমরূপে নাজায়েজ। (মারেফুল কুরআন) অত্র আয়াতে ‘নাবা’ শব্দটি সংবাদ, খবর বা তথ্য অর্থে এসেছে। কোনো সংবাদ গ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার নীতিমালা হলো, যদি কোনো ফাসিক ব্যক্তি সংবাদ সরবরাহকারী হয় তাহলে তা ভালোভাবে যাচাই করা। যাতে ভুল সংবাদ গ্রহণ ও তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা কারো কারো জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। উপরোক্ত আয়াতের আলোকে কোনো সংবাদ গ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করা প্রয়োজন। তা হলো:

সংবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা রক্ষা করা যেকোনো তথ্য ও সংবাদকে নিজস্ব চিন্তা কিংবা ব্যক্তি, দল—মতের রঙচঙ মাখিয়ে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে কারোর পক্ষে বা বিপক্ষে উপস্থাপন করা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا “হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।” (সূরা আহযাব : ৭০) যদি কেউ এটা করে সেটা আমানতের খেয়ানত, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এবং এর জন্য তাকে পরকালে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَخُونُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ “হে ঈমানদারগণ, খেয়ানত করোনা আল্লাহর সাথে ও রাসূলের সাথে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে—শুনে।” (সূরা আনফাল : ২৭)

সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খবরের সত্যতা যাচাই করা ইসলামে সততা ও সত্যবাদিতার গুরুত্ব অপরিসীম। মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। তাই কোনো সংবাদ মানুষের কাছে বলার আগে তার সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে বলতে হবে। এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে— سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْكَبائِرِ قَالَ: (الإِشْراكُ بِاللهِ، وَعُقوقُ الْوالِدَيْنِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَشَهادَةُ الزّورِ “রাসূল সা.কে কবিরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, মা—বাবার অবাধ্য হওয়া। কাউকে হত্যা করা আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। (বুখারি)

শোনা কথা বলে বেড়ানো মিথ্যাবাদিতার সদৃশ। এ সম্পর্কে মহানবী সা. অন্য হাদিসে বলেছেন, كَفَى بالمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ “যা শুনবে, তা—ই (যাচাই করা ছাড়া) প্রচার করা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।” (মুসলিম)

ব্যক্তিগত স্বার্থে তথ্য গোপন না করা ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ কিংবা নিজস্ব চিন্তা—চেতনা বিরোধী হওয়ায় প্রাপ্ত তথ্য গোপন করা ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এ কাজকে বড় পাপ কাজের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ “আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী।” (সূরা বাকারা : ২৮৩) এ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন, نضَّرَ الله عبدًا سَمِع مقالتي فوعاها، فبَلَّغها مَن لَم يَسْمعها “আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন; যে আমার কথা শুনে অতঃপর তা হুবহু ধারণ করে অবিকল অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়। (তিরমিজি)

অনুমাননির্ভর সংবাদ পরিবেশন না করা সুস্পষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া শুধু অনুমান ও জনশ্রম্নতি নির্ভর খবর পরিবেশন করা ইসলামী নীতিমালার পরিপন্থী। ইসলাম এটাকে চরমভাবে নিষেধ করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً “যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর— এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৬) ধারণার বশবর্তী হয়ে কাউকে কোনো সংবাদ দেওয়া বা কারো সম্পর্কে কিছু বলা কবিরা গুনাহ। এ সম্পর্কে আল কুরআনের ভাষ্য— يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ “মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ।” (সূরা হুজুরাত : ১২) রাসূল সা. বলেছেন, إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ “তোমরা অহেতুক ধারণা থেকে দূরে থাক। কেননা ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা।” (বুখারি ও মুসলিম) ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ হাসিলে কাউকে দোষারোপ না করা ব্যক্তি ও দলীয় আক্রোশ তাড়িত হয়ে কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে হেয় করার মানসে দোষ খেঁাজা এবং প্রকাশ করা খুবই অন্যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে নীতিবান থাকবে এবং কোনো স¤প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের কখনো যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে।” (সূরা মায়েদা : ৮) ব্যক্তি অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট না হলে কারো দোষ—ত্রুটি জনগণের সামনে তুলে ধরার অনুমতি ইসলাম দেয় না। বরং প্রিয় নবী সা. মানুষের ব্যক্তিগত দোষ—ত্রুটি গোপন রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন। রাসূল সা. বলেন, مَنْ سَتَرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ فِي الدُّنْيَا سَتَرَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান ভাইয়ের দোষ—ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ—ত্রুটি গোপন রাখবেন।” (বুখারি ও মুসলিম) তবে যদি কোন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দোষ—ত্রুটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার দ্বারা অন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাহলে তার অত্যাচার, দুর্নীতি ও প্রতারণা থেকে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে তার আসল চেহারা তুলে ধরতে ইসলাম নিষেধ করেনি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, لاَّ يُحِبُّ اللّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوَءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلاَّ مَن ظُلِمَ “আল্লাহ মন্দ কথার প্রচার—প্রসার পছন্দ করেন না, কিন্তু যার ওপর জুলুম করা হয়েছে (তার কথা ভিন্ন)।” (সূরা নিসা : ১৪৮)

শিক্ষা ১. নবী সা. এখন নাই এজন্য পয়গম্বরদের উত্তরসূরি আলেমদের মজলিসে উপস্থিত হলে কথা আস্তে বলা, অনুমতি ছাড়া কথা না বলা। অনুরূপভাবে ইসলামী আন্দোলনের অথবা সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত হলে পরিচালকের অনুমতি ছাড়া কথা না বলা ও উচ্চস্বরে কথা না বলা। এমনকি রাসূল সা.—এর রওজার সামনে উপস্থিত হয়েও উচ্চস্বরে কথা না বলা। ২. আলেম—উলামা ও ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলা ও বৈঠকে বসার সময় আদব রক্ষা করে কথা বলা। ৩. কারো বাড়িতে পেঁৗছে চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাকাডাকি বা দরজা ধাক্কানো থেকে বিরত থাকা এবং বাড়ির লোকজন বের হয়ে আসা পর্যন্ত বাইরে অপেক্ষা করা। ৪. কোনো সংবাদ পেলে তার সত্যতা যাচাই—বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপরোক্ত গুণাবলি অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির