post

শহীদ আবদুল মালেক বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের মহানায়ক

মোবারক হোসাইন

১৯ জুলাই ২০১৮
শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মূলত মানুষের আত্মা, আধ্যাত্মিক ও মানসিক বিকাশ ঘটায়। যে শিক্ষা মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধের চেতনাকে জাগ্রত করতে ব্যর্থ সে শিক্ষা জাতির কোনো কল্যাণে তো আসেই না বরং একটি জাতিসত্তাকে দুর্বল করে ফেলবে খুব সহজেই। এমন একটি ক্রান্তিকালে ১৯৬৯ সালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে পেরে শহীদ আবদুল মালেক এগিয়ে আসেন একটি সুন্দর সমাজ ও সুন্দর মানুষ তৈরির মেন্যুফেস্টো নিয়ে। জাতির সামনে পেশ করেন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা। শহীদ আবদুল মালেক দৃঢ়তার সাথে উদ্বেলিতকণ্ঠে গোটা জাতির কাছে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অবশেষে কুপোকাত হয় ইসলামবিদ্বেষীদের সকল রাশভারী ষড়যন্ত্র ; বিজয়ী হয় শহীদ আবদুল মালেকের স্বপ্ন। সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজও এদেশের মানুষ শহীদ আবদুল মালেককে খুব অনুভব করছেন। শহীদ আবদুল মালেককে হত্যা করে ঘাতকরা আবদুল মালেকের আদর্শকে মুছে দিতে পারেনি বরং শহীদ আবদুল মালেক আজ লক্ষ-কোটি ছাত্র- জনতার হৃদয়ের মানুষে পরিণত হয়েছেন। একটি আদর্শিক জাতি উপহার দিতে হলে শহীদ আবদুল মালেকের প্রস্তাবিত সেই শিক্ষানীতির অনুসরণ সময়ের অনিবার্য দাবি হয়ে উঠেছে। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে অবস্থানের যৌক্তিকতা ও শাহাদাতের প্রেক্ষাপট: ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান দেখা দেয়। ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করেন। এরই একপর্যায়ে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়। ছাত্রসমাজের একটি অংশ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবি তুলে। ১৯৬৯ সালে শহীদ আবদুল মালেকসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এয়ার মার্শাল নুর খানের সাথে সাক্ষাৎ করে দেশে সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। শহীদ আবদুল মালেকের প্রতিনিধিদলের পর দেশের অন্যান্য আরও সংগঠনও একই দাবি তোলে। সবার দাবির মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এটি ছিল পাকিস্তান আমলের গঠিত সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন। গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতিও ঘোষণা করে। ঘোষিত শিক্ষানীতিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তাতে বাদ সাধে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা। তারা এ শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানায়। এমনই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কী হবে তা নিয়ে জনমত জরিপের আয়োজন করা হয়। জনমত জরিপের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২রা আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নিপা) ভবনে (বর্তমান ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ) এ শিক্ষানীতির ওপর একটি আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনাসভায় বামপন্থীদের বিরোধিতামূলক বক্তব্যের মধ্যে শহীদ আবদুল মালেক মাত্র ৫ মিনিট বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। অসাধারণ মেধাবী বাগ্মী শহীদ আবদুল মালেকের সেই ৫ মিনিটের যৌক্তিক বক্তব্যে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে। ফলে সভার মোটিভ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়। জাতির শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তির বিষয়ে তিনি সেদিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন, "চধশরংঃধহ সঁংঃ ধরস ধঃ রফবড়ষড়মরপধষ ঁহরঃু, হড়ঃ ধঃ রফবড়ষড়মরপধষ াধপঁঁস- রঃ সঁংঃ রসঢ়ধৎঃ ধ ঁহরয়ঁব ধহফ রহঃবমৎধঃবফ ংুংঃবস ড়ভ বফঁপধঃরড়হ যিরপয পধহ রসঢ়ধৎঃ ধ পড়সসড়হ ংবঃ ড়ভ পঁষঃঁৎধষ াধষঁবং নধংবফ ড়হ ঃযব ঢ়ৎবপবঢ়ঃং ড়ভ ওংষধস. ডব হববফ ঈড়সসড়হ ংবঃ ড়ভ পঁষঃঁৎধষ াধষঁবং, হড়ঃ ড়হব ংবঃ ড়ভ পঁষঃঁৎধষ াধষঁবং. তার বক্তব্যের এ ধারণাটিকে তিনি যুক্তিসহকারে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। উপস্থিত শ্রোতা, সুধীমণ্ডলী এবং নীতিনির্ধারকরা শহীদ আবদুল মালেকের বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে একটি সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। আবদুল মালেকের তত্ত্ব ও যুক্তিপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ক্ষিপ্ত করে দেয় ইতঃপূর্বে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে বক্তব্য রাখা বাম, ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামবিরোধী বক্তাদের। সকল বক্তার বক্তব্যের মাঝ থেকে নীতিনির্ধারক এবং উপস্থিত শ্রোতা-সুধীমণ্ডলী যখন আবদুল মালেকের বক্তব্যকে পূর্ণ সাপোর্ট দেয় তখন আদর্শের লড়াইয়ে পরাজিত বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ে শহীদ আবদুল মালেকের ওপর। নিপার আলোচনা সভায় বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে জনমত তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ডাকসুর নামে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষে প্রস্তাব পাস করানোর উদ্দেশ্যে দশ দিনের ব্যবধানে অর্থাৎ ১২ আগস্ট ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে শহীদ আবদুুল মালেকসহ কয়েকজন ইসলামী শিক্ষার ওপর কথা বলতে চাইলে তাদের সুযোগ দেয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। সভার একপর্যায়ে জনৈক ছাত্র নেতা ইসলামী শিক্ষার প্রতি কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখে। তখন উপস্থিত শ্রোতারা এর তীব্র বিরোধিতা করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে স্লোগান দেয়। আবদুল মালেক তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে টিএসসির আলোচনা সভাস্থলেই তার প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদ সংঘর্ষে রূপ লাভ করে। সংঘর্ষ একপর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আবদুল মালেক ও তার কতিপয় সঙ্গীর ওপর টিএসসির মোড়ে সেকুলারপন্থীরা হামলা করে এবং রেসকোর্সে এনে তার মাথার নিচে ইট দিয়ে ওপরে ইট ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করে মারাত্মকভাবে জখম করে এবং অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে এ পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দান করে। আবদুল মালেক ভাইকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ আগস্ট তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতে শোকাহত সমগ্র জাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবত আবদুল মালেক ভাইয়ের মতো মেধাবী ছাত্রনেতার শাহাদাত এর আগে ঘটেনি। ফলে আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতে গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সর্বমহলে এই ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জাতির এই শ্রেষ্ঠসন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদপত্র তার সাক্ষী। আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সভাপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্রনেতারা আবদুল মালেকের শাহাদাতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও সকল জাতীয় নেতা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাত কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শহীদ আবদুল মালেকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। আওলাদে রাসূল (সা) সাইয়েদ মোস্তফা আল মাদানী জানাজার ইমামতি করেন। জানাজার পূর্বে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “শহীদ আবদুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) তার শোকবাণীতে মন্তব্য করেন, “এক মালেকের রক্ত থেকে লক্ষ মালেক জন্ম নেবে।” তার এ মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) বলেছিলেন, ‘আবদুল মালেক এদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।’ এক আবদুল মালেককে শহীদ করে শত্রুরা শত শত আবদুল মালেক সাপ্লাই করেছে আন্দোলনে। এক আবদুল মালেকের শাহাদাতের ফলে আন্দোলন শত শত আবদুল মালেককে পেয়েছে যারা তার মতো মনে-প্রাণে শাহাদাত কামনা করে। শহীদ আবদুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তব্ধ করা যায়নি। অনুপ্রেরণার মিনার শহীদ আবদুল মালেক অতুলনীয় মেধার স্বাক্ষর যখন তুমি এসেছিলে ভবে / কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। / এমন জীবন তুমি করিও গঠন মরণে হাসিবে তুমি / কাঁদিবে ভুবন। Ñ কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪৭ সালে বগুড়া জেলার ধুনটের খোকসাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী শহীদ আবদুল মালেক ছিলেন ঈর্ষণীয় মেধার অধিকারী। এসএসসি এবং এইচএসসি-তে তিনি রাজশাহী বোর্ডে যথাক্রমে একাদশ ও চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নের ছাত্র আবদুল মালেক এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ক্যারিয়ার নিয়ে কখনও ভাবতেন না। সবসময় বিচলিত থাকতেন ইসলামী আন্দোলন নিয়ে। তিনি বলেতেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের চাইতে ইসলামী ছাত্রসংঘের অফিস আমার কাছে অধিক বেশি গুরত্বপূর্ণ।” ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল। মাত্র ২২ বছর। এই ছোট্ট জীবনে শহীদ আবদুল মালেকের একেকটি কর্ম যেন একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে। তার কর্মময় জীবন ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর জন্যই অনুপ্রেরণা। তিনি জীবনে যেমন একটি সুন্দর ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন, তেমনি ইসলমী আন্দোলনের প্রয়োজনে সে ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাছে সকল বাধা তুচ্ছ, সকল পিছুটান নিঃস্ব। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হওয়ার কারণে ক্ষণে ক্ষণে তার মত পাঞ্জেরির প্রয়োজনও অনুভব করেছি। সহজ-সরল জীবনযাপন শহীদ আবদুল মালেক অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। পোশাক বলতে ছিল একটি কম দামি সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায় না। রাতের বেলায় নিজ হাতে তিনি তা পরিষ্কার করতেন। যেন পরের দিনের সূচনায় তা আবার পরা যায়। অনেকের মত নূর মুহাম্মদ মল্লিকও লিখেছেন, “সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তাঁর নিজের হাতে ক্লান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা-পাঞ্জাবি ধোয়া রুটিন কাজের কথা। কোন এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবি আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে যোগ দিতে। মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাদাসিধে ছিল, দিলটাও তেমন সাদাসিধে শুভ্র মুক্তার মত ছিল। প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের সহকর্মী আবু শহীদ মোহাম্মদ রুহুল এক সাক্ষাৎকারে আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে বলেছেন, “একদা আমরা একসাথে চকবাজারে কালেকশনে যাই। তখন তাঁর অতি সাধারণ ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি-পায়জামা এবং চপ্পল দেখে এক সুধী মালেক ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় বলে মনে করেন। এতে সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ হলে মালেক ভাই আমাদেরকে এ বলে সান্ত্বনা দেন যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কি না তা আল্লাহই ভালো জানেন। আমি আমার জন্য যে মানের পোশাক প্রয়োজন মনে করেছি সে মানের পোশাকই পরিধান করেছি। কে আমার পোশাক দেখে কী ভাবল তাতে আমার কোনো ভাবনা নেই।” সংগ্রামী জীবন ইসলামী নেতৃত্ব সংগ্রাম, সঙ্ঘাত ও কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। শহীদ আবদুল মালেক তাঁর সংগ্রামী জীবনের পদে পদে সেই পরীক্ষাই দিয়ে গেছেন। সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন। আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল একটি পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। তাই জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকেও তিনি ছিলেন বঞ্চিত। সেই কচি বয়সে যখন তাঁর মায়ের কোলে থাকার কথা, তিনি থেকেছেন বাড়ি থেকে অনেক দূরে লজিং বাড়িতে। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে তাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা, অমানুষিক পরিশ্রম কিংবা দুঃখ-কষ্টের দিনযাপন কোন কিছুই পিচ্ছিল করতে পারেনি তাঁর চলার পথ। জনাব নূর মোহাম্মদ মল্লিক এক সময়ে কোন এক কারণে বেশ কিছু দিনের জন্য মালেক ভাইয়ের মেহমান হয়ে ছিলেন। তাকে মেহমানদারি করতে গিয়ে নীরবে নিভৃতে শহীদ আবদুল মালেক কিভাবে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটিয়েছেন তার চোখ ভেজানো বর্ণনা দিয়েছেন তিনি তার ‘চিরভাস্বর একটি নাম’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে : “স্কলারশিপের টাকায় তাঁর সবকিছু চলতো। কিছু টাকা মায়ের কাছেও পাঠাতেন। বাকি টাকা খাওয়া পরা ও আন্দোলনের জন্য খরচ করতেন। বেশ কয়েকদিন থাকার পর আমি লক্ষ্য করলাম মালেক ভাই ডাইনিং হলে খাচ্ছেন না। মনে করলাম মজলিশে শূরার বৈঠকের জন্য হয়তো তাঁদের সকলে একসঙ্গে খান সময় বাঁচানোর জন্য। শূরার বৈঠক শেষ হলো। এরপরও তাকে দেখি না। এরপর একদিন দেখলাম তিনি রুটি খাচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, শরীর খারাপ। আমার সন্দেহ হলো, আমার জন্যই বোধ হয় তাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। সামান্য ক’টি টাকাতে হয়তো তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না এবং এ জন্য বিশেষ করে আমার ভার বহনের জন্যই তাকে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে বুঝতে পেরে তাঁর কাছ থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম।” কর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস আজ মালেক ভাইয়ের মতো দায়িত্বশীল সত্যিই কর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস। নিবিড় তত্ত্বাবধানকারী দায়িত্বশীল হিসাবে মালেক ভাইয়ের দৃষ্টান্ত ছিল অনন্য। নামাজ কাজা বন্ধ করার জন্য ফজলুল হক হল থেকে কর্মীর হোস্টেলেই গিয়ে তিনি ডেকে তুলেছিলেন। দায়িত্বশীল যে একজন সেবক তার প্রমাণ মালেক ভাইয়ের চরিত্রে সমুজ্জ্বল। বাড্ডায় টিসিতে টয়লেট মজবুত নয় মর্মে ইহতেসাবের পর তিনি নিজেই রাতে পানিতে নেমে টয়লেট ঠিক করেছেন। পরিচালকের জন্য ইহতেসাব গ্রহণের এ দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। মেহমান এলে নিজে বই মাথায় দিয়ে শুয়ে মেহমানকে ওপরে শুইতে দিতেন। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম লিখেছেন- “শহীদ আবদুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা জোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল। তাঁর জীবনালেখ্য রচয়িতা ইবনে মাসুম লিখেছেন : “কর্মীদের তিনি ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ-বেদনার সাথী। ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন। প্রতিটি কর্মীর ব্যাপারে নিজের ধারণা লেখা থাকতো তাঁর ডায়েরিতে। ফলে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মালেক ভাই, একজন অভিভাবক, একজন নেতা।” তিনি কিশোর ও তরুণদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের নিয়ে আগামী দিনের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। তাইতো তিনি আহবান জানিয়েছিলেন, “আমরা চাই দুনিয়ার বুকে একটা ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করতে। আমাদের সেই স্বপ্নের কাফেলায় তোমরাই হবে নিশানবরদার, তোমরাই হবে তার সিপাহসালার।” ইকামাতে দ্বীনের কাজকে অগ্রাধিকার “পৃথিবীর হাজারও কাজের ভিড়ে ইকামাতে দ্বীনের এ কাজ যেন, সবচেয়ে প্রিয় হয়। আর কোন বাসনা নেইতো আমার কবুল করো তুমি হে দয়াময়।” - আবু তাহের বেলাল হ্যাঁ, সত্যিই পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের কাজকেই সবচেয়ে বেশি প্রিয় করে নিয়েছিলেন শহীদ আবদুল মালেক। দ্বীনকে তিনি অন্যতম নয় বরং একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হিসেবে যা কিছু সামনে এসেছে তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। স্কুলজীবনে তিনি লজিং থাকতেন মৌলভী মহিউদ্দিন সাহেবের বাসায়। মহিউদ্দিন সাহেব গাইবান্ধায় এক সেমিনারে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুর রহীম আলোচিত “জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত” বিষয়টি সকলকে বুঝানোর সময় অনুসন্ধিৎসু শহীদ আবদুল মালেক প্রশ্ন করেছিলেন ‘চাচা, এ পথের সন্ধান কিভাবে পাওয়া যায়? হ্যাঁ এ পথের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন বলেই বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তি হয়েই বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন, “বাড়ির কথা ভাবি না, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ, দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না, শুধু মাত্র যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।” কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেন তখন তার এ সঙ্কল্প আরও দৃঢ় হলো। তাইতো ফজলুল হক হলের তার রুমের দরজার ওপর লিখে রেখেছিলেন শহীদ সাইয়েদ কুতুবের সেই বিপ্লবী বাণী “আমরা ততদিন পর্যন্ত নিস্তব্ধ হব না, নীরব হব না, নিথর হব না, যতদিন না কোরআনকে এক অমর শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাই। আমরা এ কাজে হয় সফলতা অর্জন করব নয় মৃত্যুবরণ করব।” দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল শহীদ আবদুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। এ ব্যাপারে সাবেক আমিরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শহীদ আবদুল মালেক ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘আমার প্রিয় সাথী’তে লিখেছেন, “সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের। বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলাভবন, হোসেনি দালান ও সিটি ল কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনোমতে ফজলুল হক হলে গেলাম। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কী করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে কথা ওঠার আগেই আবদুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবদুল মালেক ওগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন। তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাক্ষুষ প্রমাণটুকু আমার পক্ষে কোনোদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মীবৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো। অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোনো কর্মীই ছিল না। আমার তো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনেরো মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছু বুঝিয়ে দেয়া। আবদুল মালেকের সুদক্ষ পরিচালনায় সংগৃহীত অর্থের নিখুঁত হিসাব পেলাম। সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসেবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন। এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আবদুল মালেক অল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বণ্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন। সেদিন আবদুল মালেককে স্বচক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজ হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু সান্ত¡না দিতে পারতাম।” জবাবদিহির অনুভূতি ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের জন্য সংগঠন পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শহীদ আবদুল মালেক ভাই ছিলেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অগ্রপথিক। তৎকালীন সময়ে ঢাকা মহানগরীর সভাপতি অধ্যাপক ফজলুর রহমান মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন ঢাকা মহানগরীর সভাপতি, মালেক ভাই তখন ছিলেন শাখা সেক্রেটারি। একদিন রাতের বেলায় অফিসে গিয়ে দেখলাম মালেক ভাই মোম জ্বালিয়ে খাতা-কলম নিয়ে হিসাব করছেন। আমি ঢুকে সাংগঠনিক কথা শুরু করলে তিনি হঠাৎ মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন। মোমবাতি নেভানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বন্যার্ত মানুষের জন্য সংগৃহীত রিলিফের টাকা দিয়ে মোমটি কেনা হয়েছে। রিলিফের টাকায় কেনা মোম দিয়ে সাংগঠনিক কাজ করা ঠিক নয়। পরে তিনি সংগঠনের টাকায় কেনা মোম জ্বালালেন। বন্যাটি ছিল ১৯৬৭ সালের। এ থেকে তার অত্যধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিচয় পাওয়া যায়।” অনুকরণীয় মডেল শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (রহ) আবদুল মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন জিঞ্জিরা (কেরানীগঞ্জ) পিএম হাইস্কুলে আয়োজিত এক শিক্ষাশিবিরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মালেক ভাই। আমিও যোগদান করেছিলাম সেই শিক্ষাশিবিরে। আমার মনে হয় সেখানে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ কর্মী। রাতে খাবার পর হাত ধৌত করার সময় মালেক ভাইকে দেখলাম তিনি নিজে থালাবাসন পরিষ্কার করছেন। এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমি আরো একটি শিক্ষাশিবিরে অংশ নিয়েছিলাম। শহীদ আবদুল মালেক ভাই সেই শিক্ষাশিবিরের পরিচালক ছিলেন। রাতে মালেক ভাইয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ১১২ নম্বর কক্ষে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। আমার সাথে আমার এক সঙ্গীও সেখানে ছিল। রাতে প্রোগ্রাম শেষে আমরা শয়ন করলাম মালেক ভাইয়ের সিটে। লক্ষ্য করলাম অনেক রাতে তিনি শুইতে এলেন। অতঃপর মাথায় পত্রিকার কাগজ দিয়ে ফ্লোরে একটি চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। এক রাতের ঘটনা। আমার সঙ্গীটি হঠাৎ বিছানা থেকে পড়ে গেলেন। আর মালেক ভাই নিচে থেকে তাকে পাঁজাকোলে ধরে ফেললেন। ফলে সেই ভাইটি কোনো ব্যথা পায়নি। জামালপুরে আশেক মাহমুদ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন একদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠে দেখি ছাত্রাবাসে আমার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি হালকা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে মালেক ভাই। আবেগে অভিভূত হয়ে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। খুব অভিমানে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ দাঁড়িয়েছেন, ডাক দিলেন না কেন? তিনি জবাবে বললেন, তিনটার দিকে পৌঁছেছি। ভাবলাম সকালে তো ফজরের নামাজ পড়তে উঠবেই। তা ছাড়া চিন্তা করলাম অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়েছ, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে লাভ কী? দুইজনের বদলে একজন কষ্ট করাই ভালো। তাই এখানে দাঁড়ালাম। আমার কিছু অসুবিধা হয়নি। দৃঢ়তা ও আপসহীনতা শহীদ আবদুল মালেক জানতেন যে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মানেই কঠিন পরীক্ষাকে মাথা পেতে নেয়া। সেটা জেনে পথ চলার কারণেই কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর পথ আগলে রাখতে পারেনি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন, নির্ভীক। পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সম্মুখ পানে। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (রহ) এক সময় শহীদ আবদুল মালেক ভাই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন : “আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দিলাম তখন এক কর্মী শিক্ষাশিবিরে ঢাকায় এলাম। আবদুল মালেকের কথা শুনেছি কিন্তু তাঁকে তখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষাশিবিরের ব্যবস্থাপক। কিন্তু প্রায় তাঁকে দেখা যেত না। শেষ দিনে এসে তিনি একটা ছোট্ট বক্তব্য দিলেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল এ রকম, “আমরা তো জেনে বুঝেই এ পথে এসেছি। এই পথ থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে অনেক দূর পথ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সামনের দিকে তাকালে মনে হবে আমাদের আরও অনেক পথ চলতে হবে। এই পথে চলতে গিয়ে যদি আমরা দ্রুতগামী কোনো বাহন পাই তাহলে সেটাতে সওয়ার হয়েই মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছবো, যদি তেমনটা না পাই তাহলে শ্লোথ কোনো বাহনে করে হলেও আমরা সেই মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করবো।” দাওয়াতি চরিত্র দ্বীনের দাওয়াতি কাজে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন শহীদ আবদুল মালেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের সেরা ছাত্র হয়েও তিনি কিভাবে দাওয়াতি তৎপরতায় শামিল ছিলেন এবং দাওয়াতি কাজের প্রতি তাঁর পেরেশানি কেমন ছিলো। এরূপ কয়েকটি ঘটনা : হ মাসের ১ তারিখেই তিনি লিস্ট করে ফেলতেন কোন কোন ছাত্রের কাছে তিনি দাওয়াত পৌঁছাবেন। লিস্ট অনুসারে বেরিয়ে পড়তেন কাজে। হ আবদুল মালেক ভাই সবাইকেই সালাম দিতেন। এক নাস্তিক তাকে একদিন বলল, আমি সালাম নেই না তবুও আপনি আমাকে বার বার সালাম দেন কেন? তিনি বললেন, সালাম মানে তো শান্তি কামনা করা। আমি কেন আপনার শান্তি কামনা করব না? এভাবেই কথা শুরু। অবশেষে একদিন এই নাস্তিকটিও ইসলামী আন্দোলনের পথে এসেছিলেন আবদুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতি তৎপরতার কারণে। হ আবদুল মালেক ভাই গভীর রাতে জায়নামাজে বসে কাঁদতেন নিজের গুনাহ মাফের জন্য, ইসলামী আন্দোলনের জন্য, বিশ্ব মুসলিমদের জন্য। আর একটি বিষয় নিয়েও কাঁদতেন। সেটি হলো তার দাওয়াতি কাজের সফলতার জন্য। যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর চিন্তা করতেন তাদের নাম ধরে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে হেদায়েতের জন্য দোয়া করতেন। হ দাওয়াতি কাজ ছিল শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের প্রাণ। সে কারণেই তিনি বলেছিলেন, “আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব আমার ডান হাত দিয়ে, ইসলামের শত্রুরা যদি আমার ডান হাত কেটে ফেলে তাহলে বাম হাত দিয়ে ডাকব, ওরা যদি আমার বাম হাতও কেটে ফেলে, দুটো পা দিয়ে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ডাকব। ওরা যদি আমার দুটো পা-ও কেটে ফেলে তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ছেলেকে ইসলামের দিকে ডাকব। ওরা যদি আমার চলার গতিকে স্তব্ধ করে দেয়, তাহলে আমার যে দু’টি চোখ বেঁচে থাকবে সে চোখ দিয়ে হলেও ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব, আমার চোখ দু’টিকে যদি উপড়ে ফেলে তাহলে আমার হৃদয়ের যে চোখ রয়েছে তা দিয়ে হলেও আমি আমার জীবনের শেষ গন্তব্য জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকবো।” পরিশ্রমপ্রিয়তা শহীদ আবদুল মালেক ভাই ছিলেন অনেক বেশি পরিশ্রমী। নূর মুহাম্মদ মল্লিকের ভাষায়, “তাঁকে দেখতাম সারাদিন এবং অধিকাংশ রাতভর কত কাজ করতে। ক্লাস করছেন, সময় পেলে পড়ছেন। এরপর আন্দোলনের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করছেন। রাতে হয়তো পোস্টারও লাগাচ্ছেন কর্মীদের সাথে। মনে পড়ে মালেক ভাই অনেক সময় পোস্টার লাগাবার পর অন্যদের কাজ শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত একটু সময় পেতেন, তখন সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে অথবা পিচঢালা নির্জন পথে একটু বসে বিশ্রাম নিতেন।” বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বিকাশের জন্য করণীয় বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের লালন ও বিকাশ একটি অগ্রসরমান ও সম্ভাবনাময় আন্দোলনের জন্য একান্ত প্রয়োজন। এই বিকাশের লক্ষ্যে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি কর্মীর ব্যক্তিগতভাবে যেমন কিছু করণীয় রয়েছে তেমনি আন্দোলনের পক্ষ থেকেও কার্যকর ভূমিকা পালনের প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ১.প্রচুর অধ্যয়ন : জানতে হলে পড়তে হয়। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। শহীদ আবদুল মালেক এ বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আন্দোলনী কর্মকাণ্ডের শত ব্যস্ততা মালেক ভাইয়ের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তিনি নাশতার পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতেন, সংগঠনের এয়ানত দিতেন। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া এই দেশের ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকর্মীই এক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে পিছিয়ে আছেন। ২.পরিকল্পিত অধ্যয়ন : আমাদের আন্দোলনের যেসব ব্যক্তি মোটামুটি লেখাপড়া করে থাকেন তাদের অনেকের অবস্থা এ রকম যে, হাতের কাছে যা পান তাই-ই পড়তে শুরু করেন। এ ধরনের অধ্যয়ন খুব একটা ফলদায়ক হয় না। প্রয়োজন মাফিক পরিকল্পিত অধ্যয়ন খুবই দরকার। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের জীবন ছিল যথেষ্ট গোছালো। এই পরিকল্পনার ছাপ ছিল তাঁর অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও। শ্রদ্ধেয় কৃতী শিক্ষাবিদ ড. কাজী দীন মুহম্মদের স্মৃতিচারণ থেকে আমরা জানতে পারি, শত ব্যস্ততার মাঝেও জ্ঞানপিপাসু আবদুল মালেক দীন মুহম্মদ স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন জ্ঞানের অšে¦ষায়। এ ক্ষেত্রে বইভিত্তিক অধ্যয়নের চেয়ে বিষয়ভিত্তিক অধ্যয়নের অভ্যাস করা উচিত। এমতাবস্থায় কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভের জন্য একই বিষয়ে বিভিন্ন পুস্তকের নানা অধ্যায় পাঠ ফলপ্রসূ হতে পারে। ৩.নির্দিষ্ট বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন : ইসলামী আন্দোলন করতে হলে নানা বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। তবু সব ব্যক্তি সব বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হয় না বা হওয়া সম্ভব নয়। অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের পছন্দ ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে একটি নির্দিষ্ট বিষয় বেছে নেয়া এবং সে বিষয়ে ক্রমাগত অধ্যয়ন, চিন্তা-গবেষণা ও আলোচনার মাধ্যমে ব্যুৎপত্তি অর্জন। যেমন কুরআন-হাদিস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং-বীমা, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি নানা বিষয়ের মধ্যে থেকে যে কোন একটিকে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জনের জন্য বেছে নেয়া যেতে পারে। শহীদ আবদুল মালেক সম্পর্কে আমরা জানতে পারি যে, তিনি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ-খবর রাখতেন এবং পত্রিকার পাতায় এ বিষয়ে নিয়মিত লিখতেন। মরহুম আব্বাস আলী খান এ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে বলেন : ‘বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পাকা হাতের লেখা পড়তাম মাসিক পৃথিবীতে। বয়স তখন তাঁর উনিশ-বিশ বছর। একেবারে নওজোয়ান। কিন্তু তাঁর লেখার ভাষা ও ভঙ্গি বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্ক তাঁর তীক্ষè ও গভীর জ্ঞান তাঁর প্রতি এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে।’ আমাদের আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের খুব অভাব। এ অভাব পূরণের ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ৪.আন্দোলন ও কর্মকৌশল নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা : প্রতিটি অগ্রসর কর্মীকে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি, কর্মসূচি ও কর্মকৌশল নিয়ে প্রতিনিয়ত গভীরভাবে ভাবতে হবে। এই ভাবনা হতে হবে গঠনমূলক ও ফলদায়ক যেমন ভাবতেন শহীদ আবদুল মালেক। মতিউর রহমান নিজামী লিখেছেন, কোন সফর থেকে রাজধানীতে ফিরে এলেই শহীদ মালেক ছুটে যেতেন তাঁর কাছে। খোঁজখবর নিতেন বিভিন্ন শাখা ও কর্মীদের সম্পর্কে। জানতে চাইতেন সেখানকার কাজের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে। পরামর্শ দিতেন প্রয়োজনমতো। ৫.অধিক হারে সেশন ওয়ার্কশপ : আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময়ান্তর ওয়ার্কশপ, ব্রেইন স্টর্মিং ও মতবিনিময় সভা করা প্রয়োজন। এর ফলে দায়িত্বশীলদের মধ্যে আন্দোলনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হবে। প্রত্যেকে আন্দোলনকে নতুন করে ভাববার প্রেরণা ও পথ পাবে। জ্ঞান-বিতরণী আলোচনা সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে দায়িত্বশীলদের যোগদান উপস্থিতি বাড়াতে হবে। ৬.নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি : আন্দোলনের সর্বস্তরে বুদ্ধিচর্চার ব্যাপারে আগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে। পুরাতন ইসলামী সাহিত্যকে অবলম্বন করে নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্যাকে সামনে রেখে ইসলামী সাহিত্যে নতুন উপাদান ও মাত্রা যোগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে উন্নয়নের নামে কেউ যেন হঠকারিতা করার সুযোগ না পায়। সমস্যাকেন্দ্রিক গবেষণাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। ৭.যোগ্যতর উত্তরসূরি নির্বাচন : সম্ভাবনাময় বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও চৌকস কর্মী ও দায়িত্বশীলদের অধিকতর সতর্কতা ও যতেœর সাথে আরো অগ্রসর করতে হবে। একজন সফল দায়িত্বশীল তিনি যিনি তার উত্তরসূরি তৈরি করতে পারেন। প্রত্যেক দায়িত্বশীলের টার্গেট থাকবে তার চেয়ে উত্তম কোনো ভাইকে তার স্থলাভিষিক্ত করার। মালেক ভাই তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষাই আমাদের দিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বিকাশের জন্য যা করণীয় ৮.বুদ্ধিভিত্তিক ও মানসিক শক্তি, ৯.সমকালীন রাজনীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা, ১০.উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী, ১১.দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞাবান হওয়া ১২.বৈরী শক্তির মোকাবেলায় বিজ্ঞানসম্মত পন্থা উদ্ভাবন, ১৩.উত্তম কৌশল অবলম্বন করা, ১৪.সময়ানুবর্তিতা, ১৫.বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার সম্পর্কিত জ্ঞান। আঁধার কেটেই আসবে আলোর ভোর: এ কাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার ওপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোন দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ) এমন এক চরিত্রের সফল মানুষ হতে পেরেছিলেন শহীদ আবদুল মালেক। বড় অসময়ে তিনি কাণ্ডারির ভূমিকা রেখেছিলেন। পিছপা হননি দুনিয়ার মোহে বিন্দুমাত্র। শহীদ আবদুল মালেককে নিয়ে কবি মতিউর রহমান মল্লিক লিখেছেন- মালেক মালেক শহীদ মালেক আমাদের সেনাপতি ঘন দুর্যোগে শত দুর্ভোগে নির্ভীক এক চির অবিকল ভাস্বর সভাপতি। বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ শহীদ আবদুল মালেক ভাই ছিলেন খুবই আশাবাদী একজন মানুষ। তিনি বলতেন Shangha will rise, surely rise অর্থাৎ বিপ্লবের নতুন সূর্য উদিত হবেই, অবশ্যই সেটা হবে। শহীদ আবদুল মালেক ছিলেন একজন জীবন্ত ইতিহাস। তাই প্রিয় আবদুল মালেক ভাইয়ের সংগ্রামী চেতনাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাই নতুনের স্বপ্ন বুনে। লেখক : সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির