post

সৃষ্ট জগতে মানুষের মর্যাদা

১৬ জুন ২০১৩

সাইয়েদ কুতুব শহীদ

ইতিহাসের সকল স্তরেই আল্লাহর দ্বীন একই ধরনের বাণী পেশ করছে। এ দ্বীনের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের অর্থ মানুষকে আল্লাহর অনুগত ও ফরমাবরদার করা এবং মানুষের দাসত্ব থেকে তাদেরকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিয়োজিত করা; মানুষের সার্বভৌমত্ব থেকে মানব রচিত জীবনবিধান ও মূল্যবোধের অক্টোপাশ থেকে মানবসমাজকে উদ্ধার করে জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, কর্তৃত্ব ও আইন-বিধান প্রবর্তন করা। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এ উদ্দেশ্য নিয়েই দুনিয়ায় এসেছিলেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণেরও ঐ একই দায়িত্ব ছিল। সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি আল্লাহ তায়ালার আইন-শাসন মেনে চলছে এবং মানুষ বিশ্বপ্রকৃতিরই একটি ক্ষুদ্রাাতিক্ষুদ্র অংশ হিসেবে প্রাকৃতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য। মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যে আইন মেনে চলছে তার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য ব্যবহারিক জীবনেও বিধানদাতা আল্লাহর আইন-শাসন মেনে চলা অপরিহার্য। মানুষ কখনো এ আইনের শাসন প্রত্যাখ্যান করে নিজের জন্যে একটি পৃথক ব্যবস্থা বা জীবনযাপনের ভিন্ন পন্থা আবিষ্কার করতে পারে না। মানুষের দেহে পুষ্টি সাধন, তার রোগ ও সুস্থতা, জীবন ও মরণ সবকিছুই আল্লাহর আইনের নিকটে সম্পূর্ণ অসহায়। বিশ্বজগতে বিরাজমান আল্লাহর বিধান পরিবর্তনের কোনো শক্তিই মানুষের নেই। তাই জীবনের যে অংশে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার বিধান মানা বা না মানার অধিকার দান করা হয়েছে, সে অংশেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে জীবনে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন দরকার। জাহেলিয়াতের অক্টোপাশ থেকে মুক্তির উপায় জাহেলিয়াত প্রকৃতপক্ষে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বেরই অপর নাম। তাই এটা প্রাকৃতিক জগতে প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। জাহেলিয়াতের আদর্শ গ্রহণের ফলে মানুষ জীবনের যে অংশ প্রাকৃতিক বিধান মেনে চলতে বাধ্য সে অংশের সাথে ব্যবহারিক জীবনে সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীগণ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার বাণী প্রচার করে উপরোক্ত জাহেলিয়াতের উপরই আঘাত হেনেছিলেন। জাহেলিয়াত একটি মতবাদ মাত্র নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তার কোনো মতবাদই নেই। জাহেলিয়াতের সর্বত্রই একটি প্রতিষ্ঠিত সমাজের রূপধারণ করে এবং একটি সক্রিয় আন্দোলন সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত সমাজের রূপধারণ করে এবং একটি সক্রিয় আন্দোলন সর্বদাই তার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এ সমাজ তার নিজস্ব নেতৃত্ব, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, স্বভাব-প্রকৃতি ও চিন্তা-ভাবনা প্রবর্তন করে। জাহেলিয়াত সুসংগঠিত। এ সমাজের লোকেরা পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা, সংগঠন ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয় যে, সমগ্র সমাজ নিজেদের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে ঐ সমাজব্যবস্থা সংরক্ষণের জন্যে সমভাবে তৎপর থাকে; তার অস্তিত্বের জন্যে যারা অনিষ্টকারী বিবেচিত হয় তাদেরকে সে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সরিয়ে দেয়। জাহেলিয়াত যখন একটি মতবাদ মাত্র না হয়ে একটি সক্রিয় আন্দোলনের রূপ ধারণা করে তখন তাকে উৎখাত করে মানবসমাজকে পুনরায় আল্লাহ তায়ালার বন্দেগীর অধীনে আনয়নের জন্য ইসলামী আদর্শকে নিছক একটি মতবাদ হিসেবে পেশ করে কখনো সফলতা অর্জন করা যাবে না। জাহেলিয়াত বস্তুজগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং একটি সক্রিয় সংগঠন তার পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বদা সক্রিয় রয়েছে। এমতাবস্থায় শুধু মতবাদের সাহায্যে তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই করা তো দূরের কথা তার সামনে দাঁড়ানোও সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয় যে, প্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াতের আদর্শকে উৎখাত করে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও রীতিনীতি বিশিষ্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের লক্ষ্য এবং জাহেলিয়াত একটি সুসংগঠিত সমাজ ও সংগঠন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে তাকে উৎখাত করার অভিযানও একটি সুসংগঠিত আন্দোলনের রূপ ধারণ করেই রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে। আর এ নতুন আন্দোলন জাহেলিয়াতের তুলনায় অধিকতর সংগঠিত এবং আন্দোলনকারীদের পারস্পরিক সম্পর্ক অধিকতর দৃঢ় ও শক্তিশালী হতে হবে। ইসলামী সমাজের আদর্শিক ভিত্তি ইসলামী ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে যে আদর্শিক বুনিয়াদের উপর তার নিজস্ব সমাজ রচনা করেছে তা হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার সাক্ষ্য দান। এ কালেমার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ-ই প্রভু, তিনিই বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপক, তিনিই প্রকৃত শাসক এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। মন-মস্তিষ্ক তাঁরই একত্বের নূরে উদ্ভাসিত হতে হবে। ইবাদাত-বন্দেগীতে তাঁর একত্বের প্রমাণ পেশ করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনের রীতিনীতি আইন-কানুনে তাঁর একত্বের পরিস্ফুরণ হতে হবে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য এরূপ পরিপূর্ণ সার্বিক পন্থা ব্যতীত বাস্তব ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রকারে দেয়া যেতে পারবে না। শরীয়তের দিক দিয়েও এ ধরনের সাক্ষ্যই হবে নির্ভরযোগ্য। এ পূর্ণাঙ্গ সার্বিক পন্থা মৌখিক সাক্ষ্যকে এমন এক কার্যকর ব্যবস্থার রূপদান করে যার ভিত্তিতে এ সাক্ষ্যদানকারীকে মুসলিম এবং এর প্রত্যাখ্যানকারীকে অমুসলিম বলা যেতে পারে। আদর্শের দিক দিয়ে এ ভিত্তি স্থাপনের অর্থ এই যে, মানব জীবনকে পুরোপুরি আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেও মানুষ নিজেই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। বরং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাঁরই আনুগত্য করবে। আল্লাহর নির্দেশ জানবার একটি মাত্র উপায় আছে এবং তাহলো আল্লাহর রাসূল (সা)। কালেমায়ে শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশে এ উপায়কে ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ বলা হয়েছে। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহÑ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল। এ হলো সেই আদর্শিক বুনিয়াদ যার উপরে ইসলামী প্রাসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এটাই হলো ইসলামের প্রকৃত প্রাণবস্তু। এ ভিত্তি মানবজীবনের পূর্নাঙ্গ জীবনবিধান রচনা করে যা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করতে হবে। এ জীবনবিধান প্রতিটি সমস্যার সমাধান করে। সে সমস্যা দারুল ইসলামে উদ্ভুত হোক অথবা তার বাইরে। মুসলিম সমাজের সাথে সম্পৃক্ত সম্পর্ক সন্বন্ধের বেলায় হোক অথবা মুসলিম সমাজ ও অমুসলিম সমাজের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের বেলায়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির