post

স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত : গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী

হারুন ইবনে শাহাদাত

০৪ মে ২০১৭
নানান মত-পথের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সমাজ। বিভিন্ন মত-পথের অমিলকে মিলিয়ে এক পতাকার নিচে নিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দূর করে উন্নয়নের মহাসড়ক রচনা করার জন্যই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচনকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। বর্তমান সরকারের আগে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন না। তাই প্রশাসনে দলীয়করণের প্রভাব তাদের ওপর খুব একটা পড়তো না। তারা স্থানীয় সমস্যা সমাধানে জনগণকে সাথে নিয়ে সরকার-প্রশাসনের সাথে দর কষাকষি করতেন। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতেন। এখনো তারা হয়তো এর ব্যতিক্রম করেন না। কিন্তু সরকার বিরোধী আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধিতার পর্যায়ে ফেলে কিংবা তার দলের লোকদের তারা সংঘটিত কোনো ঘটনার কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে ফৌজদারি মামলার আসামি পর্যন্ত করা হচ্ছে। ফলে তারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সেতুবন্ধের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যেমন ধরুন, বিরোধী দলের কোনো নিরীহ সমর্থক-কর্মী, কিংবা সাধারণ কোন নাগরিককে পুলিশ সন্দেহবশে গ্রেফতার করলো, বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনকে বুঝাতে থানায় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ নিরীহ ব্যক্তির পরিবার-পরিজন তার কাছেই সাহায্য চাইবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বিরোধী দলের হলে পুলিশ তাকেও গ্রেফতার করছে। ফলে সাধারণ জনগণের সাথে সরকার ও প্রশাসনের দূরত্ব বাড়ছে। একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনে জনগণ পিষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা সরকার ও প্রশাসনের সাথে সাধারণ নিরীহ জনগণের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। কারণ সাধারণ জনগণ ক্ষমতার গরমের কাছে বড় বেশি অসহায়। ক্ষমতাবানদের কাছে সরাসরি পৌঁছার কিংবা নালিশ করার সাহস কোনোটাই এককভাবে তাদের কাছে থাকে না। ক্ষমতার গরমের উত্তাপে যেন সমাজের নিরীহ মানুষ শুধুমাত্র ভিন্নমত পোষণের কারণে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত না হয়, তা থেকে বাঁচার জন্যই সমাজবিজ্ঞানীরা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে সারাদেশে নির্যাতিত ব্যক্তিদের তালিকায় ভিন্নমতের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরাই এক নম্বরে আছেন। যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং ভিন্ন মত পোষণ করার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের নির্বাচনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় নির্বাচন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে এবং সরকারের অবৈধ প্রভাবের পরও তাদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিদেরকে বিভিন্ন ছল-ছুতায় বরখাস্ত করে কারাগারে পাঠাচ্ছে সরকার। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত সাড়ে তিন বছরে এ ধরনের প্রায় চার শ’ প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চারজন সিটি মেয়র, ৩৫ পৌর মেয়র, ৫৬ কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৯, ভাইস চেয়ারম্যান ৬৬, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৯১ ও মেম্বার ৭৪ জনসহ মোট ৩৭৫ জন বরখাস্ত হয়েছেন গত সাড়ে ৩ বছরে। এদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বন্ধ করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার আন্দোলনে অংশ নেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে আগুন, পুলিশের ওপর হামলাসহ রাজনৈতিক সহিংসতা মামলার আসামি করা হয়েছে তাদের। এক কথায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার আসামি তারা। রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমল থেকে এমন মামলা হয়ে আসছে। তখন তাদেরকে বলা হতো রাজবন্দী। কিন্তু এবারের মতো নির্বাচিত এ জনপ্রতিনিধিদের পদে বসতে না পারায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের এমনভাবে সেবাবঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলেও জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে নেতাদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হতো। আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত কর্তৃক চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে। তবে অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্যই তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের অপব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে রাজশাহী, সিলেট ও হবিগঞ্জের মেয়রকে দ্বিতীয় দফায় বরখাস্তের পর সরকারের মনোভাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, সরকার বড় ধরনের ভুুল করছে। এটা এখন বন্ধ করা উচিত বলে তারা মনে করছেন। অবশ্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২ এপ্রিল রোববার বলেছেন, রাজশাহী ও সিলেট সিটি মেয়রসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, আইন অনুযায়ীই বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বেআইনিভাবে কাউকে বরখাস্ত করা হয়নি। আইন মেনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনটি নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করছে। তারা এটিকে কালো আইন হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তাদের মতে, চূড়ান্ত সাজার আগেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে এ আইনের সুযোগ নিয়ে বরখাস্ত করা হচ্ছে। আইনের অজুহাত দেয়া হলেও সরকারের অগোচরে কিছু হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে পদচ্যুত করার মতো কাজ করে সরকার ভুল করছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওপর এ ভুলের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য দাবি করেছেন, বিএনপির দুই সিটি মেয়র ও এক পৌর মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে। সোমবার ঢাকার ডেমরায় একটি সড়ক উদ্বোধনে গেলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মেয়র বরখাস্তের বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এ সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়েছে। এর পেছনে যুক্তি কী, কারণ কী- এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। তবে আমি যতটুকু জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানেন না। সর্বশেষ কুমিল্লার নবনির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা অবশেষে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু সমর্থকদের আশঙ্কা সত্যি হলো। কুমিল্লার নবনির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে ১১ হাজার ভোটে পরাজিত করে দ্বিতীয় বারের মতো কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাক্কু মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর মামলার জালে আটকে যেতে পারেন, গেজেট-শপথ হলেও আদৌ চেয়ারে বসতে পারবেন কিনা? গ্রেফতার হতে পারেন যেকোনো সময় এমন আশঙ্কা ও গুঞ্জন ছিল বিএনপিতে। মেয়র সাক্কু নিজেও এমন আশঙ্কা করেছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার ১৯ দিনের মাথায় মঙ্গলবার সাক্কুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার একটি আদালত। এ খবর তাৎক্ষণিকভাবে সব টিভি চ্যানেল, পত্রিকা ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর কুমিল্লাজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ভাইরাল হয়ে যায়। সাক্কু যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন কিংবা যেকোনো সময় তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হতে পারে- এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে নগরীতে। দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বিরুদ্ধে ১৮ এপ্রিল মঙ্গলবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন মহলের লোকজন মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়ে কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ও কুসিকের সাবেক প্যানেল মেয়র আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। তদন্ত ও বিচারে মনিরুল হক সাক্কু দোষী হলে বিচার হওয়া উচিত। এর বেশি তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া বলেন, সাক্কু জনপ্রিয় ও নির্বাচিত মেয়র। তার বিরুদ্ধে এ মামলাটি দুদক বাদি হয়ে বিতর্কিত ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের ১/১১ সরকারের সময়ে দায়ের করেছিল। ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসনসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অনুরূপ মামলা করা হয়েছিল। মামলাটি হয়রানিমূলক। তিনি বলেন, সরকারের উচিত কুসিকের ভোটারদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি আলী আকবর মাছুম বলেন, সাক্কু কুমিল্লা সিটির সদ্য নির্বাচিত মেয়র। তিনি এখনো শপথ গ্রহণ করেননি বা কমিশন এখনো গেজেট প্রকাশ করেনি। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ করে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি জনমনে বিভ্রান্তি কিংবা নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করতে পারে। চলতি বছরের ৩০ মার্চ কুসিকের দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও অধ্যক্ষ আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। এ নির্বাচনে সাক্কু পান ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট এবং আঞ্জুম সুলতানা সীমা পান ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। বিশেষজ্ঞদের অভিমত সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনের ধারাগুলো সরকার খড়গ হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি হতে থাকলে যে কোনো জনপ্রতিনিধি সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য। এ ধরনের আইনের সুযোগে রাজনৈতিক সরকারগুলোও সামরিক শাসকদের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা সম্ভব নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে আইনের অজুহাতে এসব করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেটকে ভণ্ডুল করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সরকার এগুলো থেকে বিরত না হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে এবং এর পরিণতি শুভ হবে না। বিষয়গুলো বুমেরাং হয়ে এক সময় সরকারের দিকেই ফিরে আসতে পারে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে এগুলো বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘সারা দেশেই আমাদের সমর্থিত সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্ত হচ্ছেন। পরিকল্পিতভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলায় অভিযোগপত্র দিয়ে এরই মধ্যে সাড়ে তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে ক্ষমতাসীন সরকার। আরও কয়েক শ’ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে এর দাঁতভাঙা জবাব দেবে জনগণ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান বলেন, “সরকার জনগণের  ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নানাভাবে হয়রানি করছে। তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। কার্যালয় থেকে পুলিশ অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি করে ও অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে সরকার মূলত জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।” তিনি আরো বলেন, জনপ্রতিনিধিদের গ্রেফতার করে সরকার প্রমাণ করেছে গণতন্ত্র ও জনরায়ের প্রতি তাদের সামান্যতম সম্মানবোধ নেই। আমি সরকারের এ অন্যায়, অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের  টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোনো অপরাধে মামলা হলে তার শাস্তি হতেই পারে। কিন্তু বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে ও রাজনৈতিক ময়দান থেকে দূরে রাখতে মিথ্যা মামলা দেয়া ঠিক নয়। রাজনীতির এ চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটি গণতন্ত্রচর্চার জন্য সুখকর নয়। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চাইলে বিদ্যমান আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার সুবিধা-অসুবিধাগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অবসান হতেই হবে চেয়ারে বসার পর ফের বরখাস্ত হচ্ছেন আবার আদালতের রায়ে দায়িত্ব ফিরে পাচ্ছেন এমন ঘটনা ঘটছে রাজশাহী, সিলেট, হবিগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়রের ক্ষেত্রে। সরকারের বিমাতাসুলভ এমন আচরণে কোনো রাখঢাক নেই। কারো প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, ক্ষমতার জোরই একমাত্র যুক্তি। যা করা হচ্ছে তা যেন পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। বেপরোয়াভাবে করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক নির্বাহী আদেশ উচ্চ আদালতে বাতিল বা খারিজ হয়েছে। এরপরও আদালতের রায়সূচক দৃষ্টান্তগুলো সরকার আমলে নিচ্ছে না। তিন মেয়রের মধ্যে দু’জন দীর্ঘ দিন কারাগারে কাটিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ে কাজে যোগদানের জন্য দফতরে পৌঁছেই আবার নির্বাহী আদেশের কারণে কাজ করতে পারলেন না। এ ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও দলান্ধ ভাবনার বিলুপ্তি চায় জনগণ। নির্বাহী বিভাগকে এ ধরনের অনভিপ্রেত আচরণ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব না হলে স্থানীয় প্রশাসনে জনগণের অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট থাকবে না। এর ফলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আরো ভূলুণ্ঠিত হবে। যে আইনের দোহাইতে নির্বাচিত মেয়রদের সাময়িক বরখাস্তের সুযোগ নিচ্ছে দলীয় সরকার, সেই আইন সংশোধন করাও জরুরি ভাবতে হবে। কারণ, এ ধরনের আইন গণতন্ত্রের মৌলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। জনগণের সাথে সরকার ও প্রশাসনের সেতুবন্ধের অন্তরায়। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির