post

৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ঊনচল্লিশ বছর আমাদের পথচলা

মো: আতিকুর রহমান

২০ জানুয়ারি ২০১৬
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। নানান সমস্যায় জর্জরিত এই দেশের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে বারবার স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বিশেষত বাঙালি মুসলমানরা সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম ভারতে দুর্নিবার ওয়াহাবি আন্দোলন (১৭৮৬-১৮১৩ খ্রি:), তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলিম সাধারণ সমাজের বিশেষ করে রায়তের অধিকার আদায়ের আন্দোলন (১৮৩০-৩২), প্রায় একই সময়ে হাজী শরিয়ত উল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন এবং ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা রক্তক্ষয়ী সিপাহি বিদ্রোহসহ (১৮৫৭) এসব আন্দোলন ও সংগ্রামের লক্ষ্য ছিলো বাংলার সাধারণ মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা। এরপর বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১), ভারত-পাকিস্তান নামে পৃথক রাষ্ট্রগঠনও (১৯৪৭) এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি এবং প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে পারেনি। আবারো ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয় এ দেশের সাধারণ জনগণ। কিন্তু যে প্রত্যাশায় সংঘটিত হয়েছিল এসব আন্দোলন সংগ্রাম, স্বাধীনতার চার দশক পরও সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে ওঠেনি আজও। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এখনও অধরাই রয়ে গেছে। গণতন্ত্র রয়ে গেছে কার্যত তাত্ত্বিকপর্যায়ে। সুশাসন তো দূরের কথা, প্রচলিত আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। আর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, জবরদখলসহ নানান সব নেতিবাচক দিকই ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত হলেও তার বিকাশ রুদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা রাখছে না। কৃষক তাদের উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। মেধাবীদের মেধার যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না বরং দলীয় লেজুড়বৃত্তি বেড়ে চলেছে ক্রমশ। মাদকদ্রব্য ও নেশাজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে মূল্যবোধ ও নীতির সর্বগ্রাসী অবক্ষয় তরুণসমাজকে বিপথগামী করছে। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতির সামনে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা একটি স্বাধীন দেশের সরকারের অন্যতম দায়িত্ব¡। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাব্যবস্থার যখন এই অবস্থা তখন একদিকে চলছে প্রশ্নফাঁস আর অন্যদিকে নিয়োগবাণিজ্য ও কোটাপদ্ধতি, সঠিক মেধাযাচাই ও মেধার যথার্থ মূল্যায়নের অভাব। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে  নৈতিকতার চর্চা না থাকার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নানাবিধ ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে। এই ব্যাধি-আক্রান্ত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দিয়ে ভালো রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্র আশা করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। বাস্তব ও কার্যকরী যুগোপযোগী শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় ও  নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার বিকাশে কার্যকর শিক্ষানীতি এখন সময়ের দাবি। দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান, ইংরেজি-বাংলা-মাদরাসা তিন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই ধারার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে শিক্ষাবৈষম্য দূরীকরণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা বিধান করা। একই সাথে রাষ্ট্রকে ব্যক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখার নিশ্চয়তা দেয়া। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তাই আমাদের দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীকে দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও বিরোধী মত দমনের অপব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিচারিক হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার ও তা নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা, সার্বভৌমত্ব, ধনসম্পদসহ সব কিছুর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রকৃত আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্র ক্রিয়াশীল থাকলে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, জনপ্রতিনিধিদের শাসন নিশ্চিত হলে, কমে যাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের অধিকার ও সাম্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধানতম আয়ের উৎসসমূহ রেমিট্যান্স,  তৈরী পোশাক শিল্প, কৃষি, ওষুধ, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ  তৈরি একান্ত জরুরি। এর জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অন্যতম পূর্বশর্ত। তথ্যপ্রযুক্তিসহ প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা, কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, গার্মেন্টস এবং সেবা খাতের রফতানিকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এসব খাতে অর্থের জোগান ও রফতানি সহায়তা করতে হবে। বাণিজ্যিক লেনদেন, যোগাযোগ ও ই-কমার্সের পরিধি বৃদ্ধি করা দরকার। ব্যাংকিং খাতকে আরও গতিশীল ও সহজসাধ্য করা এখন সময়ের দাবি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ প্রয়োজন। কৃষককে তার উৎপাদনের জন্য ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ, প্রয়োজনীয় ভর্তুকি ও পরামর্শ প্রদান করতে হবে। জাকাত ফান্ডকে কার্যকর করার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের নির্ধারিত অংশ রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। এই তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় খাতে তা ব্যয় করে দারিদ্র্য নির্মূল করতে হবে। দেশের অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসকল ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বারবার বলে আসছে। পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হবে সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করে প্রতিবেশী দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতনতা বজায় রাখা উচিত। বাণিজ্যঘাটতি, সীমান্তে বিচারবহির্ভূত হত্যা, আন্তঃনদী পানিবণ্টন কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পারস্পরিক সমঝোতার ক্ষেত্রে নিজ দেশের বৃহত্তম স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হওয়া ও তা আদায়ে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ। তাই মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। শাসনতন্ত্রের গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ সংশোধন করতে হবে এবং বিচার বিভাগ, কর্মকমিশন, নির্বাচন কমিশন ও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলসমূহ বিধিবদ্ধ ও জবাবদিহিমূলকভাবে স্বচ্ছতাসহ গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। এ জন্য জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে হবে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এ দেশের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিল তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির আশায়। তাই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অঙ্গীকার, সংবাদপত্র ও মিডিয়ার স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রোগীদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণ, সন্ত্রাস-যানজট-লোডশেডিং-মাদক থেকে নিষ্কৃতি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, রাজনীতিকে গণমুখীকরণ, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করাসহ বিভিন্ন জরুরি প্রসঙ্গ, যেকোনো সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থার জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার, বিরোধী দলসহ সব সামাজিক শক্তি-সংস্থার একযোগে কাজ করা একটি অনিবার্য দায়িত্ব। অপশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে দেশের চলমান সঙ্কট নিরসনের জন্য বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তাই বরাবরের মতোই সরকারের প্রতি আহ্বান করে আসছে। একটি দেশে যেমন বিভিন্ন মতাবলম্বী বা ভিন্ন আদর্শের অনুসারীসহ সকলের অবস্থানের অধিকার রয়েছে, তেমনি ক্যাম্পাসগুলোতেও সুশৃঙ্খলতার সাথে সকল মতাবলম্বী শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণ, অবাধ চলাফেরা এবং অবস্থানের অধিকার রয়েছে। এটি প্রকারান্তে একটি সাংবিধানিক অধিকার। সরকারি দলের অনুসারী ছাত্ররা ক্যাম্পাসগুলোতে অবস্থান করে বিরোধী দল বা ভিন্ন আদর্শের অনুসারী ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়নের যে অপসংস্কৃতি চালু আছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসগুলোতে সকল মতের ছাত্রের সহাবস্থানের আহ্বান করে আসছে। সাধারণ ছাত্রসমাজ চায় একটি সন্ত্রাসমুক্ত সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ, যেখানে ছাত্রসংগঠনগুলো সমভাবে অবস্থান নেয়ার সুযোগ পাবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দিতে যোগ্য হয়ে উঠবে। ছাত্রশিবির তাদের নৈতিক অবস্থান থেকেই ক্যাম্পাসে সকল ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণসমাজের ওপর। কিন্তু দিন দিন এ যান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তরুণরা অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়ছে। এই হতাশাগ্রস্ত তরুণসমাজ আস্তে আস্তে নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, ধ্বংস হচ্ছে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। ইসলামী ছাত্রশিবির মাদক ও নেশামুক্ত একটি নৈতিকসমাজ গঠনের জন্য প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তরুণদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। দেশকে আগামীর সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব সরবরাহের দৃঢ় প্রত্যয়দীপ্ত কাফেলা হিসেবে এ সংগঠন মাদকবিরোধী সচেতনতা  তৈরিতে নানাবিধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে নিয়মিত। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমরা শতভাগ নেশা ও মাদকমুক্ত সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রসমাজকে কুরআন-হাদিস শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করার মধ্য দিয়ে দেশের সব প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। যুবসমাজ, তরুণ ছাত্রসমাজকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নৈতিকতার অনুশীলনে উৎসাহ প্রদান করছে। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি নৈতিকতাসম্পন্ন সমাজগঠনে ছাত্রশিবির বদ্ধপরিকর। ১৯৫২, ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০ এ ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছিল ঐতিহাসিক। এই লক্ষ্যে ছাত্রশিবিরের অন্যতম কর্মসূচি হলো দেশ ও জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব  তৈরি করা, যারা পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য রাহবার হিসেবে কাজ করবে। ছাত্রশিবির মেধাবী ছাত্রদেরকে সত্য ও সুন্দরের সহযাত্রী হতে অনুপ্রাণিত করতে মেধাবী সংবর্ধনা, ক্যারিয়ার গাইডলাইন প্রোগ্রাম, গরিব মেধাবী ছাত্রদের জন্য স্টাইপেন্ড চালুর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাদক ও ইভটিজিং-বিরোধী অভিযানসহ নানাবিধ কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়াও বিনামূল্যে মেধাবী ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা-উপকরণ বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড ডোনেশন, ব্লাড গ্রুপিং, ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প, পথশিশুদের জন্য ভ্রাম্যমাণ শিক্ষাকার্যক্রম চালু, কুরআন প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, উন্মুক্ত জলাশয়ে ও নদী-নালায় মাছের পোনা ছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগিয়ে আসা ইত্যাকার নানামুখী সামাজিক কল্যাণকর কাজে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা সমগ্র দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট। প্রতিভা বিকাশের জন্য ছাত্রশিবির বছরব্যাপী কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপশাখা পর্যন্ত আয়োজন করে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার। এসবের মধ্যে কুইজ প্রতিযোগিতা, মেধাযাচাই, ক্যারিয়ার গাইডলাইন কনফারেন্স, বিজ্ঞানমেলা, প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, আইডিয়া কন্টেস্ট, সাধারণ জ্ঞানের আসর, বিতর্ক ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, ক্রিকেট ও ফুটবল প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অন্যতম। দেশের সকল রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা সব সময়ই ছিল গঠনমূলক।  স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারপ্রক্রিয়ায় ছাত্রশিবিরের ভূমিকা ছিল অগ্রণী ও বলিষ্ঠ। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে বিশাল ছাত্রজমায়েত ও আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার অন্যতম সংগঠক ছাত্রশিবির। স্বৈরশাসকের হাতে বহু নেতাকর্মী নিহত ও নির্যাতিত হলেও ছাত্রশিবির কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে পিছপা হয়নি। শিবিরের বিশাল সমাবেশ ও মিছিল ছাত্র-জনতার প্রাণে নতুন আশা ও প্রেরণা সঞ্চার করেছে সব সময়। আত্মঘাতী ট্রানজিট ইস্যু, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও নির্বিচারে গুলি করে অপহরণ-ধর্ষণ-হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাপ্রত্যাহার, পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনে শিবির ছিল অগ্রগণ্য। চলমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে ছাত্রশিবির আলোচনা সভা, মানববন্ধনের আয়োজন করে। ছাত্রশিবির আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সব সময়ই নীতিগতভাবে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সকলের প্রতি বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে সচেতন। ছাত্রশিবির যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আদর্শিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে দেশের জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে কাজ করে সাধারণ ছাত্রদের প্রিয় সংগঠনে পরিণত হচ্ছে ঠিক তখনই আদর্শিক লড়াইয়ে পরাজিত কিছু ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর নানামুখী নির্যাতন চালানো শুরু করে। খুন, গুম ও নির্যাতন করেও যখন ছাত্রশিবিরের গতিপথ রুদ্ধ করা যাচ্ছে না ঠিক তখন অপপ্রচারকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে অবলম্বন করে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে তারা। এসব অপপ্রচার চালাতে গণমাধ্যম ও প্রশাসনকে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করেছে সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। মিথ্যা অভিযোগে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা মোকদ্দমায় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে। ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার করতে গিয়ে অসংখ্য সাধারণ ছাত্রকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্রশিবির এ সকল অশুভ কাজের নিন্দা জানায় এবং আটক সকল নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের মুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানায়। ঘুণেধরা সমাজে দিগভ্রান্ত যুবকদের পথের সন্ধান দিতে ছাত্রশিবির একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে চলেছে। তরুণদের জাগতিক দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করার পাশাপাশি অহির জ্ঞানে আলোকিত মানুষ হিসেবে  তৈরি করাই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ। তরুণদের সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক ও হেরার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত, নির্ভীক মানুষ গড়ার অদম্য স্পৃহায় ছাত্রশিবিরের পদযাত্রা। বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের প্রত্যাশিত ও আল্লাহর রঙে রঙিন মানুষ গড়াই ছাত্রশিবিরের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ছাত্রশিবির প্রত্যাশিত মানুষ তৈরি করে চলেছে অবিরত। ইসলামী ছাত্রশিবির স্বপ্ন দেখে সৎ দক্ষ তরুণরাই আগামীতে দেশ-জাতির নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে তার প্রত্যাশিত লক্ষ্যে উন্নীত করতে সক্ষম হবে। সময় এখন তরুণদের। সুতরাং তাদেরই সামনে এগিয়ে আসতে হবে। তারুণ্যই পারে দেশ ও সমাজের সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে। আমাদের তারুণ্য ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর সব দেশে তাদের কৃতিত্ব ও নৈপুণ্যে ভাস্বর। আমাদের জাতীয় চরিত্রের বড় দিক বা গুণ হচ্ছে, ঝলসে ওঠার ক্ষমতা, এক বয়সে জীবনের এক পর্বে আমরা তা করে দেখাতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ। দেশ-জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য মানুষ হিসেবে তরুণদের বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র যুক্তি ও নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি। সুতরাং এই বাস্তবতায় যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথে যে অন্তরায়গুলো রয়েছে সেগুলো আগে দূর করা দরকার। দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন দেশপ্রেমিক ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তেমনই দরকার দক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ জনপ্রশাসক। দিকনির্দেশক আলেমসমাজ, মেধাবী শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যাংকার, শিল্পী-সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ, বিভিন্ন সেক্টরে সাধারণ কর্মী সবই প্রয়োজন এ দেশের জন্য। আর সর্বক্ষেত্রেই দরকার দক্ষ, যোগ্য, কর্ম ও নীতিনিষ্ঠ মানুষের সমাবেশ। সেই কাক্সিক্ষত সুন্দর দিন তখনই আমরা আশা করতে পারি, যখন আমরা সব জায়গায় সেমুখী অনুকূল পরিবেশ  তৈরি করতে পারব। তরুণসমাজ যদি নিজ নিজ প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশের পথ খুঁজে পান এবং তারা যদি যথোপযুক্ত হয়ে ওঠেন, তাহলে আল্লাহ চাহেন তো সমাজের প্রত্যাশিত পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আগামীর বাংলাদেশকে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব উপহার দেয়ার মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমাদের ভিশন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সুখী সমৃদ্ধশালী স্বপ্নের সঠিক পথে, ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এই প্রত্যাশাই করে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির