post

অর্জিত ‘তাকওয়া’র ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন

জাফর আহমাদ

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

‘তাকওয়া অর্জন’ (To achieving Takwa) শিরোনামে সিয়াম নামক ক্যাম্পে এক মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়েছিল সারা বিশ্বের মুসলিম প্রশিক্ষণার্থীরা। এই তো সবেমাত্র শেষ হলো সেই প্রশিক্ষণ। প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থী ভাই-বোনকে একটি মাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তর করা হয়েছে। ক্রমাগত একটি মাস তাক্ওয়ার অনুশীলনে প্রতিটি প্রাণ এখন উজ্জীবিত। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে পৃথিবী এখন তাকওয়ার বাস্তব প্রয়োগ ও প্রতিফলন দেখবে। রমাদান এমন খাঁটি মুত্তাকি তৈরি করেছে যারা তাকওয়ার পথে পথ চলবে। এটিই ইসলামের প্রত্যাশা, এটিই রমাদানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। বাস্তব প্রতিফলন বা তাকওয়ার পথে পথ চলতে হলে তো ভালো-মন্দের পার্থক্য জানা চাই। প্রশিক্ষণার্থী ভাই-বোনদের মনে থাকার কথা, ঐ প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে আমাদেরকে তাকওয়ার পথে সঠিকভাবে চলার জন্য একটি গাইড বুকও (synopsis) দেওয়া হয়েছিল সেটির নাম হলো আল কুরআন। “রমাদান তো সে মাস যাতে এ কুরআন নাজিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সূরা বাকারা : ১৮৫) তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়ে ভালো-মন্দ, হক-বাতিল, সত্য-মিথ্যা মোট কথা আল্লাহর পথ ও তাগুতের পথ বাছাই করে চলা। কুরআন সেই পার্থক্যের পথ দেখাবে। সুতরাং তাকওয়ার বাস্তব প্রয়োগের জন্য আল কুরআনে প্রাত্যহিক অধ্যয়ন ও অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। কুরআন অনুযায়ী নিজের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে এটিই হবে তাকওয়ার ধারাবাহিকতা, এটিই হবে তাকওয়ার বাস্তব প্রতিফলন। 

তাকওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা একজন প্রকৃত তাকওয়াদারি বা মুত্তাকির অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, রমাদানের পর যদি তাকওয়ার ধারাবাহিকতা না থাকে, তবে বুঝতে হবে তাঁর রমাদানের সারাদিনের ক্ষুধা, কিয়ামুল লাইল, রাত্রি জাগরণ, ইবাদাত কবুল হয়নি অর্থাৎ তার প্রশিক্ষণ ভেস্তে গেছে। একটি মৌলিক কথা হলো, যে কোনো কাজ পূর্বের কাজের সঠিকতার উপর পরবর্তী কাজটি নির্ভর করে। আল্লাহর ইবাদতের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। একটি ভালো কাজ কবুল হওয়ার লক্ষণ হলো, ভালো কাজের পর আরেকটি ভালো কাজ করা। একটি ভালো কাজ করার পর আবার ভালো কাজ করা মানে প্রথমটি কবুল হওয়ার আলামত। ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আল্ল­­াহর কাছে অতি প্রিয়। বুখারির একটি হাদিস থেকে তাই জানা যায়। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহহ সা, বলেছেন, “যে কাজ কেউ সর্বদা (নিয়মিত) করে, সেটিই আল্লাহর নিকট প্রিয়তম।” (বুখারি-৪৩, কিতাবুল ঈমান, বাব আহাব্বুদ দ্বীন, সংক্ষেপিত) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় একজন ইসলামী স্কলার বলেছেন, ‘মুমিনের সমস্ত কাজই একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন হওয়া উচিত। আল্লাহর দ্বীনের সমস্ত কাজই বেশ সাজানো গুছানো। আল্লাহর নিজের সমস্ত কাজের মধ্যেও পরিপূর্ণ নিয়ম-শৃঙ্খলা বিরাজমান। দ্বীনের কাজ কখনো খুব বেশি করা কখনো খুব কম করা অথবা না করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। অল্প হলেও সব কাজ সাজিয়ে গুছিয়ে রুটিন অনুযায়ী সর্বদা নিয়মিতভাবে করা আল্লাহ পছন্দ করেন। এতে তিনি বরকত দেন। আর এভাবে বাস্তব জীবন সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত হয়।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, “অবধারিত মৃত্যু আসা পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগি করে যেতে থাকো।” (সূরা হিজর : ৯৯)

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, রমাদান আসে, রমাদান যায়, আমরা যেখানটায় ছিলাম সেখানটায় থেকে যাই। কোনো পরিবর্তন বা কোনো প্রতিফলন তো আমাদের চোখে পড়ে না। এর কারণ কী? এটি কি প্রশিক্ষণের ত্রুটি? না কি প্রশিক্ষণার্থীর ত্রুটি? প্রকৃত কারণ হলো, না বুঝে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা। প্রশিক্ষণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা রয়েছে। সেই বিষয়গুলো হলো, রমাদান, তাকওয়া ও আল কুরআন। সেই ভুলটি হলো, রমাদান থেকে আমরা কুরআন ও তাকওয়াকে আলাদা করে চিন্তা করি। যিনি অন্ধ তার কাছে টর্স লাইটের আলোর কোনো মূল্য নাই এবং এ আলো তাকে পথ দেখাতে পারে না। এমনিভাবে আমরা যারা রমাদানের রোজাকে আল কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি এবং আল কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে ও মানতে এবং তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে চাই না। তাদেরকে রোজা ও আল কুরআন যৌথভাবে তাকওয়ার পথে পরিচালিত করতে পারছে না। আমাদের দৈনন্দিনের প্রতিটি ইবাদত এবং আল-কুরআনের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে আমরা সস্তা সওয়াবের ডিজিট গণনায় মত্ত হয়ে আছি। 

প্রথমেই বলা হয়েছিল যে, রমাদান এলে আল্ল­­াহর রহমতের বারিধারা মুষলধারে বর্ষিত হতে থাকে। কোথাও মুষলধারে বৃষ্টি হলে যেমন মাঠ-ঘাট, নদী-নালা ও খাল-বিল প্রত্যেকটির ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পানি ধরে রাখে। যার গভীরতা যতো বেশি, তার ধারণ ক্ষমতাও ততবেশি। কিন্তু সমতল ভূমিতে পানি তেমন একটা আটকায় না। বৃষ্টি পড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পানিশূন্য হয়ে যায়। কারণ সেখানে পানি ধারণ করার মতো কোনো গভীরতাই নেই। গভীরতা না থাকার কারণ কী? কারণ হলো এগারোটি মাস গভীরতা সৃষ্টির জন্য চেষ্টা-সাধনা করা হয়নি। ফলে যতোটুকু গভীরতা ছিল তাও ভরাট হয়ে গেছে। রমাদানে মানুষের যতোটুকু গভীরতা সৃষ্টি হয় তা ক্রমাগত ড্রেজিং তথা তাকওয়ার পথে না চলার কারণে পরবর্তী রমাদানে সেখানে তাকওয়া নামক আল্লাহর রহমত আটকায় না অর্থাৎ তাকওয়া তার মধ্যে কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না। রমাদানের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত কোনটিই তার ভাগ্যে জুটে না। যদি জুটতো তাহলে পরবর্তী এগারোটি মাসেও সে অবশ্য অবশ্যই আল্লাহর রহমত দ্বারা সিক্ত হতো। সবুজ সমারোহে তার প্রতিটি কার্যক্ষেত্র ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে যেতো। সমতল ভূমির ন্যায় সিয়াম শুধু ক্ষুধা এবং কিয়ামুল লাইল শুধু রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কোনো ফায়দাই দিতে পারে নাই। 

রাসূল সা. বলেছেন, “অনেক রোজাদার এমন রয়েছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া ভাগ্যে অন্য কিছুই জোটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদাতকারী অনেক মানুষও এমন রয়েছে, যারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।” অন্য হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না তার শুধু খানা-পিনা করায় আল্ল­­াহর কোনো প্রয়োজন নেই।”    

রমাদানের তাকওয়ার ধারাবাহিকতা চালু রাখার জন্য যেই কাজটি করতে হবে তা হলো, নিজের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। এটাই তাকওয়া বা আল্ল­­াহর ভয়। কিন্তু মানুষের যদি এ জ্ঞানই না থাকে কিসে তার ক্ষতি কিসে তার ভালো, তবে সে কিভাবে সেই পার্থক্য নিরূপণ করবে? তাই ভালো-মন্দ যাচাই করার জন্য দরকার একটি কষ্টিপাথর। আল-কুরআনই হলো সেই কষ্টিপাথর যার মাধ্যমেই একমাত্র হক ও বাতিল, ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাক্ওয়া গুণ সৃষ্টি করা, আল্-কুরআনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাক্ওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া। আল্ল­­াহ তায়ালা বলেন, “আলিফ-লাম-মিম। (এই নাও) সেই কিতাব (আল-কুরআন) তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই, ইহা মুত্তাকি লোকদের পথ দেখাবে।” (সূরা বাকারা : ১-২) তাহলে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, আল কুরআনের কাজ হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে সৈন্যবাহিনীতে লোক নিয়োগদান করে রমাদানের রোজার হাতে ছেড়ে দেওয়া এবং রমাদানের রোজা একটি মাস তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা তথা দক্ষ সৈনিকে রূপান্তর বা তৈরি করে আবার কুরআনের হাতে সোপর্দ করবে। এবার আল কুরআন তাকে সামনে পথ চলার কর্মসূচি বাতলে দেবে। কুরআন বলবে কোনটি আল্ল­­াহর মর্জির পথ, আর কোনটি তাগুতের পথ। আল্ল­­াহর মর্জির পথ হলো তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর জমিনে তাঁরই অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করা। এটিই রমাদান, তাক্ওয়া ও কুরআনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। 

আল কুরআন হলো রমাদানের মধ্যমণি। রমাদান ফরজ করা হয়েছে আল কুরআনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করার ট্রেনিং হিসেবে। শুধুমাত্র রমাদান নয় এমনিভাবে আমরা যতোগুলো ইবাদাত পালন করে থাকি, যেমন: নামাজ, জাকাত ও হজ্জ প্রতিটি ইবাদতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো সেই একটিই, আর  তা হলো, আল-কুরআন অনুশীলনের সংগ্রামে একজন আদর্শ সৈনিকে পরিণত করা। 

রমাদান, কুরআন ও তাক্ওয়া এ তিনটি পরিভাষা একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চক্রাকারে আমাদের মাঝে আবর্তিত হয়। আর সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো ইসলামী সমাজ উপযোগী সৎ নাগরিক তৈরি করা। 

সুতরাং রমাদান চলে গেলে এ পবিত্র মাসে আমাদের মধ্যে তাকওয়ার যে শক্তি অর্জিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। যেই তাকওয়া আমাদেরকে আল্লাহর দেওয়া জীবন-বিধান এবং কুরআনের মিশনকে পুরো করার যোগ্য করে তুলতে পারে। সেজন্য কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এ পবিত্র মাসের রোজাসহ সবকিছুই কুরআনের সাথে কেন্দ্রীভূত করে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ সময় আমাদেরকে কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য তা বুঝে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত: কুরআনের প্রতি এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কুরআনই একমাত্র পারে ব্যক্তি, সমাজ ও যুগকে পাল্টে দিয়ে একটি কল্যাণমুখী ও সোনালি সূর্যের সন্ধান দিতে। এছাড়া অন্য কোনো মত বা পথে দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতে মুক্তির কোনো সম্ভবনাই নেই। এ মহাগ্রন্থ আল কুরআন ছাড়া মানুষের মুক্তির চিন্তা করা একটি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নহে। বর্তমান এ বিপর্যস্ত পৃথিবীটাই এর প্রধান সাক্ষী। সারা পৃথিবী জুড়ে মানব রচিত বা মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি আইন-কানুন দিয়ে শান্তি আনয়নের চেষ্টা বা সাধনা করা হচ্ছে। কিন্তু শান্তি তো দূরের কথা, বরং মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। 

আসুন তাকওয়ার অনুশীলনের জন্য কুরআনকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করি। একটি তাকওয়া সম্পন্ন জাতির উন্নয়নে আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিনের দ্বার খুলে দেন। এটি আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনতো ও তাক্ওয়া বা ভয় করতো তাহলে আমি তাদের উপর আসমান জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।” (সূরা আরাফ : ৯৬)   

লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির