post

আখিরাতে সফল নারী-পুরুষের গুণাবলি

ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম

أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّـيْطٰنِ الرَّجِيْمِ  .بِسۡمِ اللهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِيۡمِ.

وَقَرۡنَ فِىۡ بُيُوۡتِكُنَّ وَلَا تَبَـرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِيَّةِ الۡاُوۡلٰى وَاَقِمۡنَ الصَّلٰوةَ وَاٰتِيۡنَ الزَّكٰوةَ وَاَطِعۡنَ اللّٰهَ وَرَسُوۡلَهٗ ؕ اِنَّمَا يُرِيۡدُ اللّٰهُ لِيُذۡهِبَ عَنۡكُمُ الرِّجۡسَ اَهۡلَ الۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيۡرًا ۚ‏ ﴿۳۳﴾  وَاذۡكُرۡنَ مَا يُتۡلٰى فِىۡ بُيُوۡتِكُنَّ مِنۡ اٰيٰتِ اللّٰهِ وَالۡحِكۡمَةِؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ لَطِيۡفًا خَبِيۡرًا‏ ﴿۳۴﴾  اِنَّ الۡمُسۡلِمِيۡنَ وَالۡمُسۡلِمٰتِ وَالۡمُؤۡمِنِيۡنَ وَالۡمُؤۡمِنٰتِ وَالۡقٰنِتِيۡنَ وَالۡقٰنِتٰتِ وَالصّٰدِقِيۡنَ وَالصّٰدِقٰتِ وَالصّٰبِرِيۡنَ وَالصّٰبِرٰتِ وَالۡخٰشِعِيۡنَ وَالۡخٰشِعٰتِ وَالۡمُتَصَدِّقِيۡنَ وَ الۡمُتَصَدِّقٰتِ وَالصَّآٮِٕمِيۡنَ وَالصّٰٓٮِٕمٰتِ وَالۡحٰفِظِيۡنَ فُرُوۡجَهُمۡ وَالۡحٰـفِظٰتِ وَالذّٰكِرِيۡنَ اللّٰهَ كَثِيۡرًا وَّ الذّٰكِرٰتِ ۙ اَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمۡ مَّغۡفِرَةً وَّاَجۡرًا عَظِيۡمًا‏ ﴿۳۵﴾

সরল অনুবাদ:

(৩৩) নিজেদের গৃহ মধ্যে অবস্থান করো এবং পূর্বের জাহেলি যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না। নামায কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। আল্লাহ তো চান, তোমাদের নবী পরিবার থেকে ত্রুটি দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে।

(৩৪) আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের যেসব কথা তোমাদের গৃহে শুনানো হয় তা মনে রেখো। অবশ্যই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী ও সব বিষয়ে সম্যক অবহিত। 

(৩৫) একথা সুনিশ্চিত যে, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম, মুমিন, হুকুমের অনুগত, সত্যবাদী, সবরকারী, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকাদানকারী, রোযা পালনকারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী। আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত এবং প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। (সূরা আহযাব)

নামকরণ

এ সূরাটির ২০ নং আয়াত يَحْسَبُونَ الْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوا এর ‘আহযাব’ শব্দ থেকে সূরাটির নাম গৃহীত হয়েছে।

সূরা নাযিল হওয়ার সময়কাল ও সূরার মূল আলোচ্য বিষয়

এ সূরাটি ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে নাযিল হয়। এতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। 

এক. আহযাব যুদ্ধ। এটি ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়। 

দুই. বনি কুরাইযার যুদ্ধ। ৫ হিজরির যিলকাদ মাসে এটি সংঘটিত হয়। 

তিন. হযরত যয়নবের (রা) সাথে নবী (সা)-এর বিয়ে। এটি অনুষ্ঠিত হয় একই বছরের যিলকাদ মাসে। এ ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মাধ্যমে সূরার নাযিল হওয়ার সময়-কাল যথাযথভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়।

প্রাগুক্ত আয়াতের আলোচ্য বিষয়

৩৩ এবং ৩৪ নম্বর আয়াতে নবীর স্ত্রীদের জন্য উপদেশ ও বিশেষ বিধান প্রদান করা হয়েছে এবং ৩৫ নম্বর আয়াতে মুমিনদের বিশেষ গুণাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

তাফসির 

৩৩ নং আয়াত : وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ

আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, ‘নারীর আসল অবস্থানক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। কেবল প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে গৃহের বাইরে বের হতে পারে’ (ইবনে কাসির, মুয়াসসার)। আয়াতের শব্দাবলি থেকেও এ অর্থ প্রকাশ হচ্ছে এবং নবী (সা)-এর হাদিস একে আরো বেশি সুস্পষ্ট করে দেয়। মুজাহিদ তো তখনই স্থিরচিত্তে আল্লাহর পথে লড়াই করতে পারে যখন নিজের ঘরের দিক থেকে সে পূর্ণ নিশ্চিত থাকতে পারবে, তার স্ত্রী তার গৃহস্থালি ও সন্তানদের আগলে রাখবে এবং তার অবর্তমানে তার স্ত্রী কোনো অঘটন ঘটাবে না, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকবে। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এ নিশ্চয়তা দান করবে সে ঘরে বসেও তার জিহাদে পুরোপুরি অংশীদার হবে। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, “নারী পর্দাবৃত থাকার জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটতর হয় যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে।” (সহিহ ইবনে খুযাইমাহ ১৬৮৫, সহিহ ইবনে হিব্বান ৫৫৯৯)

وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ

আরবী ভাষায় ‘তাবাররুজ’ মানে হচ্ছে উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া এবং সুস্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যাওয়া। দূর থেকে দেখা যায় এমন প্রত্যেক উঁচু ভবনকে আরবরা ‘বুরুজ’ বলে থাকে। দুর্গ বা প্রসাদের বাইরের অংশের উচ্চস্থান থেকে দেখা যায় বলে তাকে ‘বারজা’ বলা হয়, নারীর জন্য তাবাররুজ শব্দ ব্যবহার করা হলে তার তিনটি অর্থ হবে। 

এক. সে তার চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য লোকদের দেখায়।

দুই. সে তার পোশাক ও অলঙ্কারের বহর লোকদের সামনে উন্মুক্ত করে। 

তিন. সে তার চাল-চলন ও চমক-ঠমকের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। 

অভিধান ও তাফসির বিশারদগণ এ শব্দটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। মুজাহিদ, কাতাদাহ ও ইবনে আবি নুজাইহ (রহ) বলেন, ‘তাবাররুজের অর্থ হচ্ছে, গর্ব ও মনোরম অঙ্গভঙ্গি সহকারে হেলেদুলে ও সাড়ম্বরে চলা।’ মুকাতিল বলেন, ‘নিজের হার, ঘাড় ও গলা সুস্পষ্ট করা।’ আল মুবাররাদের উক্তি হচ্ছে: ‘নারীর এমন গুণাবলি প্রকাশ করা যেগুলো তার গোপন রাখা উচিত।’ আর উবাইদাহর ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘নারীর শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য এমনভাবে উন্মুক্ত করা যার ফলে পুরুষেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।”

এ ব্যাখ্যা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ নারীদেরকে যে কার্যধারা থেকে বিরত রাখতে চান তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে গৃহ থেকে বের হওয়া। তিনি তাদের আদেশ দেন, নিজেদের গৃহে অবস্থান করো। কারণ, তোমাদের আসল কাজ রয়েছে গৃহে, বাইরে নয়। কিন্তু যদি বাইরে বের হবার প্রয়োজন হয়, তাহলে এমনভাবে বের হয়ো না যেমন জাহেলি যুগে নারীরা বের হতো। প্রসাধন ও সাজ-সজ্জা করে, সুশোভন অলঙ্কার ও আঁটসাঁট বা হালকা মিহিন পোশাকে সজ্জিত হয়ে চেহারা ও দেহের সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করে এবং গর্ব ও আড়ম্বরের সাথে চলা কোন মুসলিম সমাজের নারীদের কাজ নয়। এগুলো জাহেলিয়াতের রীতিনীতি। ইসলামে এসব চলতে পারে না। 

সুতরাং বর্তমানে যে নারীরা নিজকে প্রদর্শন করে, শরীর উন্মুক্ত রেখে চলাফেরা করেন তারা প্রকারান্তরে জাহিলি জীবনের অনুসরণ করেন। তবে তাদেরকে সামাজিক কালচার বা সোশ্যাল সিকিউরিটির ইস্যু বিবেচনায় এমন চলাফেরা থেকে নিবৃত্ত করা যায়।

৩৪ নং আয়াত : وَاذۡكُرۡنَ مَا يُتۡلٰى فِىۡ بُيُوۡتِكُنَّ مِنۡ اٰيٰتِ اللّٰهِ وَالۡحِكۡمَةِؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ لَطِيۡفًا خَبِيۡرًا‏ 

মূলে اذْكُرْنَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দুটি অর্থ : মনে রেখো এবং বর্ণনা করো। প্রথম অর্থের দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য এই দাঁড়ায়: হে নবীর স্ত্রীগণ। তোমরা কখনো ভুলে যেয়ো না যে, যেখান থেকে সারা দুনিয়াকে আল্লাহর আয়াত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দেওয়া হয় সেটিই তোমাদের আসল গৃহ। তাই তোমদের দায়িত্ব বড়ই কঠিন। লোকেরা এ গৃহে জাহিলিয়াতের আদর্শ দেখতে থাকে, এমন যেন না হয়।

দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হয় : হে নবীর স্ত্রীগণ ! তোমরা যা কিছু শোনো এবং দেখো তা লোকদের সামনে বর্ণনা করতে থাকো। কারণ রাসূলের সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থানের কারণে এমন অনেক বিধান তোমাদের গোচরীভূত হবে যা তোমাদের ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে লোকদের জানা সম্ভব হবে না।

এ আয়াতে দুটি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। 

এক. আল্লাহর আয়াত 

দুই. হিকমাত বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। 

আল্লাহর আয়াত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কিতাবের আয়াত। কিন্তু হিকমাত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। সকল প্রকার জ্ঞানের কথা এর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো নবী (সা) লোকদেরকে শেখাতেন। আল্লাহর কিতাবের শিক্ষার ওপরও এ শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র তার মধ্যেই একে সীমিত করে দেবার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কুরআনের আয়াত শুনানো ছাড়াও নবী (সা) নিজের পবিত্র জীবন ও নৈতিক চরিত্র এবং নিজের কথার মাধ্যমে যে হিকমাতের শিক্ষা দিতেন তাও অপরিহার্যভাবে এর অন্তর্ভুক্ত।

إِنَّ اللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا

অর্থাৎ মানুষ কোথা থেকে বের হয় সে ব্যাপারে মহান আল্লাহ সূক্ষ্মভাবে জানেন এবং সে কোথায় থাকে, তার অবস্থানস্থল কোথায় এ ব্যাপারেও মহান আল্লাহ সূক্ষ্মভাবে অবগত। (ইবনে কাসির) আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী অর্থাৎ গোপনে এবং অতিসংগোপনে রাখা কথাও তিনি জানতে পারেন। কোনো জিনিসই তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখ যেতে পারে না। (তাফহীম)

৩৫ নং আয়াত : اِنَّ الۡمُسۡلِمِيۡنَ وَالۡمُسۡلِمٰتِ وَالۡمُؤۡمِنِيۡنَ وَالۡمُؤۡمِنٰتِ وَالۡقٰنِتِيۡنَ وَالۡقٰنِتٰتِ وَالصّٰدِقِيۡنَ وَالصّٰدِقٰتِ وَالصّٰبِرِيۡنَ وَالصّٰبِرٰتِ وَالۡخٰشِعِيۡنَ وَالۡخٰشِعٰتِ وَالۡمُتَصَدِّقِيۡنَ وَ الۡمُتَصَدِّقٰتِ وَالصَّآٮِٕمِيۡنَ وَالصّٰٓٮِٕمٰتِ وَالۡحٰفِظِيۡنَ فُرُوۡجَهُمۡ وَالۡحٰـفِظٰتِ وَالذّٰكِرِيۡنَ اللّٰهَ كَثِيۡرًا وَّ الذّٰكِرٰتِ ۙ اَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمۡ مَّغۡفِرَةً وَّاَجۡرًا عَظِيۡمًا

এখানে মুমিনদের বিশেষ গুণাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একদা উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালমা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, কুরআন কারিমে আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের কথা উল্লেখ করেছেন, আর আমরা স্ত্রীলোক, আমাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি কেন? হযরত উম্মে সালমা (রা) বলেন, একদিন আমি আমার ঘরে বসে আমার মাথার যত্ন করছিলাম এমন সময় মিম্বর হতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শব্দ শুনতে পেলাম। তখন আমি আমার চুলগুলো ঐ অবস্থায় জড়িয়ে নিলাম এবং কক্ষে বসে তার কথাগুলো শুনতে লাগলাম। ঐ সময় তিনি মিম্বরে এই আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন।

আগের দুই আয়াতে যে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূল (সা)-এর পবিত্র স্ত্রীগণকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র তাঁদের জন্যই নির্দিষ্ট নয় বরং মুসলিম সমাজের সামগ্রিক সংশোধন কাজ সাধারণভাবে এসব নির্দেশ অনুযায়ীই করতে হবে। অথবা কোন কোন কাজ করলে মুমিন নারী-পুরুষ সমান মর্যাদার অধিকারী হবে, আখিরাতে সফলতা লাভ করবে তার কথা বলা হয়েছে।

এতে মহিলাদের মন জয় করা হয়েছে। তাছাড়া সকল আহকামে পুরুষদের সাথে মহিলারাও শামিল, শুধু তাদের কিছু বিশেষ আহকাম ছাড়া যা তাদেরই জন্য নির্দিষ্ট। এই আয়াত ও অন্যান্য আয়াতসমূহ দ্বারা পরিস্ফুটিত হয় যে, ইবাদাত ও আল্লাহর আনুগত্য এবং পরকালের মান-মর্যাদায় পুরুষ ও নারীর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের জন্য একইভাবে সে ময়দান খোলা আছে এবং উভয়েই বেশি বেশি নেকি ও সওয়াব অর্জন করতে পারে। কেবল জাতিভেদে তাদের মাঝে কোনো কম-বেশি করা হবে না। এছাড়া মুসলমান ও মুমিনের পৃথক পৃথক বর্ণনা করায় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, এই দুয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। ঈমানের স্থান ইসলামের ঊর্ধ্বে; যেমন কুরআন ও হাদিসের অন্যান্য দলিল দ্বারা তাই প্রমাণ হয়। (তাফসিরে আহসানুল বায়ান)।

এখানে যত গুণাবলির কথা বলা হয়েছে যেমন: মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যনিষ্ঠ পুরুষ ও সত্যনিষ্ঠা নারী,  ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীলা নারী, বিনয়ী পুরুষ ও বিনয়ী নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী, রোযাপালনকারী পুরুষ ও রোযাপালনকারীনি নারী, যৌনাঙ্গের সুরক্ষাকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গের সুরক্ষাকারীনি নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারীনি নারীদের জন্য মহান আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান। এ সকল গুণের অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। এত বিশদ বর্ণনা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। এ জন্য وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারীনি নারীদের কী করণীয় হতে পারে তা আলোকপাত করা হলো।

আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে, জীবনের সকল কাজেকর্মে সমস্ত ব্যাপারেই সবসময় যেন মানুষের মুখে আল্লাহর নাম এসে যায়। মানুষের মনে আল্লাহর চিন্তা পুরোপুরি ও সর্বব্যাপী আসন গেড়ে না বসা পর্যন্ত এ ধরনের অবস্থা তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। মানুষের চেতনার জগৎ অতিক্রম করে যখন অচেতন মনের গভীরদেশেও এ চিন্তা বিস্তৃত হয়ে যায় তখনই তার অবস্থা এমন হয় যে, সে কোন কথা বললে বা কোন কাজ করলে তার মধ্যে আল্লাহর নাম অবশ্যই এসে যাবে। আহার করলে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করবে। আহার শেষ করবে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে। আল্লাহকে স্মরণ করে ঘুমাবে এবং ঘুম ভাঙবে আল্লাহর নাম নিতে নিতে। কথাবার্তায় তার মুখে বারবার বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ এবং এ ধরনের অন্য শব্দ ও বাক্য বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে।

প্রত্যেক ব্যাপারে বারবার সে আল্লাহর সাহায্য চাইবে। প্রত্যেকটি নিয়ামত লাভ করার পর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। প্রত্যেকটি বিপদ আসার পর তার রহমতের প্রত্যাশী হবে। প্রত্যেক সঙ্কটে তার দিকে মুখ ফিরাবে। কোনো খারাপ কাজের সুযোগ এলে তাঁকে ভয় করবে। কোনো ভুল বা অপরাধ করলে তাঁর কাছে মাফ চাইবে। প্রত্যেকটি প্রয়োজন ও অভাবের মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে। মোটকথা উঠতে বসতে এবং দুনিয়ার সমস্ত কাজকর্মে আল্লাহর স্মরণ হয়ে থাকবে তার কণ্ঠলগ্ন এ জিনিসটি আসলে ইসলামী জীবনের প্রাণ। অন্য যে কোনো ইবাদাতের জন্য কোনো না কোনো সময় নির্ধারিত থাকে এবং তখনই তা পালন করা হয়ে থাকে এবং তা পালন করার পর মানুষ তা থেকে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু এ ইবাদাতটি সর্বক্ষণ জারি থাকে এবং এটিই আল্লাহ ও তাঁর বন্দেগির সাথে মানুষের জীবনের স্থায়ী সম্পর্ক জুড়ে রাখে। মানুষের মন কেবলমাত্র এসব বিশেষ কাজের সময়েই নয় বরং সর্বক্ষণ আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট এবং তার কণ্ঠ সর্বক্ষণ তাঁর স্মরণে সিক্ত থাকলেই এরই মাধ্যমেই ইবাদাত ও অন্যান্য দ্বীনি কাজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। মানুষের মধ্যে যদি এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার জীবনে ইবাদাত ও দ্বীনি কাজ ঠিক তেমনিভাবে বুদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে যেমন একটি চারাগাছকে তার প্রকৃতির অনুকূল আবহাওয়ায় রোপণ করা হলে তা বেড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে যে জীবন আল্লাহর এ সার্বক্ষণিক স্মরণ শূন্য থাকে সেখানে নিছক বিশেষ সময়ে অথবা বিশেষ সুযোগে অনুষ্ঠিত ইবাদাত ও দ্বীনি কাজের দৃষ্টান্ত এমন একটি চারাগাছের মতো যাকে তার প্রকৃতির প্রতিকূল আবহাওয়ায় রোপণ করা হয় এবং নিছক বাগানের মালীর বিশেষ তত্ত্বাবধানের কারণে বেঁচে থাকে। এ কথাটিই নবী (সা) একটি হাদিসে এভাবে বর্ণনা করেছেন। 

“মুআয ইবনে আনাস জুহানি বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিদান লাভ করবে কে? তিনি জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে স্মরণ করবে। তিনি নিবেদন করেন, রোযা পালনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিদান পাবে কে। জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করবে। আবার তিনি একইভাবে নামায, যাকাত, হজ্জ ও সাদকা আদায়কারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে নবী করিম (সা) বলেন, “যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে।” (মুসনাদে আহমাদ)

আয়াতসমূহের শিক্ষা

১.  নারীদের জন্য সবসময় ঘরে অবস্থান করা উত্তম।

২. অতি প্রয়োজন না হলে নারীদের ঘরের বাইরে বের না হওয়া।

৩. নিজ ঘরকে কুরআন এবং হাদিস চর্চার মারকাজ বানানোর চেষ্টা করা। 

৪. নারীরা বাইরে বের হলেও কোনোভাবেই পুরুষের নজরে পড়ে এমন সাজসজ্জা না করা।

৫. অল্পে তুষ্ট, সত্যবাদী, ধৈর্যশীল এবং মহান আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করার মাধ্যমে আখিরাতে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা।

মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন এবং আখিরাতে সফলতা অর্জনের মতো গুণাবলি দান করুন।

 লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির