মানবজাতিকে আল্লাহ তা‘আলা আশরাফুল মাখলূক্বাত হিসেবে স্বাধীন চিন্তাশক্তি দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। ফলে তার মাঝে তিন প্রকার নফসের সম্মিলন ঘটেছে; নফসে আম্মারাহ, নফসে লাউওয়ামাহ এবং নফসে মুতমাইন্নাহ। এর মধ্যে নফসে আম্মারাহ বা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে জৈবিক কামনা-বাসনা ও দুনিয়ার লোভ-লালসার প্রতি আকৃষ্ট করে মন্দ কাজের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ। কিন্তু সে মন নয়, আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন।’ [সূরা ইউসুফ : ৫৩]
অধিক হারে মন্দকাজ বান্দার অন্তরকে কঠিন করে তোলে এবং ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন বান্দা কোনো পাপ করে, তখন তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। যখন সে তওবা করে, তখন সেটা তুলে নেওয়া হয়। আর ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তরকে পরিষ্কার করা হয়। আর যদি পাপ বাড়তেই থাকে, তাহলে দাগও বাড়তে থাকে। আর এটাই হলো মরিচা। যেমন আল্লাহ বলেন, “বরং তাদের কৃতকর্মের ফলেই মনের ওপর মরিচা জমে গেছে।’” [সূরা মুতাফফিফীন : ১৪]
দুনিয়াতে প্রতিটি মানবসত্তাই মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। তাই তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আত্মসমালোচনা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদিন মানুষ নিজেই নিজের পাপের হিসেব নেওয়ার মাধ্যমে পুনরায় ওই পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। এছাড়া ব্যক্তির মাঝে যে পাপবোধ সৃষ্টি হয়, আত্মসমালোচনা তাকে ক্ষমা লাভের উপযুক্ত করে তোলে। নিম্নোক্ত এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো :
আভিধানিক অর্থে আত্মসমালোচনা হলো নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা। একে আরবিতে বলা হয়- অর্থাৎ স্বীয় আত্মার হিসেব গ্রহণ করা। লিসানুল আরব অভিধানে বলা হয়েছে, ‘মুহাসাবা’র শাব্দিক অর্থ হলো গণনা করা বা হিসেব করা। সুতরাং ‘মুহাসাবাতুন নাফস’-এর অর্থ হচ্ছে আত্মার হিসেব গ্রহণ করা। ইংরেজিতে একে বলা হয় Self Criticism বা আত্মসমালোচনা।
পারিভাষিক অর্থে আত্মসমালোচনা বলতে বোঝায় সচেতনভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করা বা পরিত্যাগ করা, যাতে কৃতকর্ম সম্পর্কে নিজের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। সুতরাং যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ হয়, তবে তা নিষ্ঠার সাথে পালন করা। আর যদি তা আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কাজ হয়, তবে তা থেকে সর্বতোভাবে বিরত থাকা। সাথে সাথে নিজেকে সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ তথা ইবাদতে মশগুল রাখা।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আত্মসমালোচনার অর্থ হচ্ছে নিজের করণীয় এবং বর্জনীয় পৃথক করে ফেলা। অতঃপর সর্বদা ফরয ও নফল কতর্ব্যসমূহ আদায়ের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার ওপর সুদৃঢ় থাকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘আত্মসমালোচনার অর্থ হলো প্রতিটি কাজে সর্বপ্রথম আল্লাহর হক্বসমূহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। অতঃপর সে হক্বগুলো যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কিনা, সেদিকে লক্ষ্য রাখা।’ [আল ফাওয়ায়েদ]
‘মুহাসাবাতুন নাফস’ বা আত্মসমালোচনাকে প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামীকালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কি প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক।’ [সূরা হাশর : ১৮]
ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলছেন, “তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা কর্তব্য যে, আগামীদিনের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ, তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে নাকি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।“’ অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। [সূরা আ‘রাফ : ২০১]
আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে ওমর রাদিআল্লাহু আনহুর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসেব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসেব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসেব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসেব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।‘
অনুরূপভাবে হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করবে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের হিসেব হালকা হবে। আর যারা এ থেকে বিরত থাকবে, কিয়ামতের দিন তাদের হিসেব কঠিন হবে।’ ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি সে, যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে দুনিয়া তাকে পরিত্যাগ করার পূর্বেই। কবরকে আলোকিত করে কবরে বসবাস করার পূর্বেই। স্বীয় প্রভুকে সন্তুষ্ট করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের পূর্বেই। জামায়াতে সালাত আদায় করে তার ওপর জামায়াতে সালাত (অর্থাৎ জানাযার সালাত) পঠিত হবার পূর্বেই। নিজের হিসেব নিজেই গ্রহণ করে হিসেব দিবসে তার হিসেব গ্রহণ করার পূর্বেই।’
মালেক বিন দীনার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর রহম ওই বান্দার প্রতি, যে তার নফসকে (কোনো মন্দ কাজের পর) বলে, “তুমি কি এর সাথী নও? তুমি কি এর সঙ্গী নও?” অতঃপর তাকে নিন্দা করে, অতঃপর তার লাগাম টেনে ধরে, অতঃপর আল্লাহর কিতাবের ওপরে তাকে আটকে রাখে। তখন সে হয় তার পরিচালক।’ মাইমুন বিন মিহরান বলেন, ‘কোনো বান্দা প্রকৃত মুত্তাকী হতে পারে না, যতক্ষণ না অন্তরের হিসেব করে, এমনকি অংশীদারের চেয়েও বেশি শক্ত করে হিসেব করে।‘
আত্মসমালোচনার কতিপয় উপকারিতা
১. নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভালো কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে।
২. আত্মসমালোচনা দ্বীনের ওপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে।
৩. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নিয়ামত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে এর শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
৪. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরকালীন জবাবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। মাইমুন বিন মিহরান বলতেন, ‘মুত্তাকী ব্যক্তি সে-ই, যে নিজের জবাবদিহিতা এমন কঠোরভাবে গ্রহণ করে, যেন সে একজন অত্যাচারী শাসক।‘
৫. আত্মসমালোচনা জীবনের লক্ষ্যকে সবসময় সজীব করে রাখে। এর মাধ্যমে আমরা অনুভব করতে পারি— আমাদেরকে এই পৃথিবীর বুকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। পার্থিব জীবন শুধু খাওয়া-দাওয়া, হাসি-ঠাট্টার নয়। এ জীবনের পরবর্তী যে অনন্ত এক জীবন, তার জন্য আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে; আত্মসমালোচনা সর্বক্ষণ তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৬. মুহাসাবার ফলে কোনো পাপ দ্বিতীয়বার করতে গেলে বিবেকে বাধা দেয়। ফলে পাপের কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মুহাসাবা পরিত্যাগ করার অর্থ কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলা। এতে মানুষের অন্তর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।’ অর্থাৎ মুহাসাবা পরিত্যাগ করার ফলে দ্বীনের প্রতি তার শিথিলতা চলে আসে, যা তাকে নিশ্চিতভাবেই দুনিয়াবী জীবন ও পরকালীন জীবনে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
কেবলমাত্র আত্মগর্বী, প্রতারিত আত্মাই মুহাসাবা পরিত্যাগ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে সে কোনোকিছুর পরিণাম চিন্তা করে না। সমস্ত পাপ তার কাছে অত্যন্ত সহজ বিষয় হয়ে যায়। অবশেষে একসময় পাপ থেকে বেরিয়ে আসাটা তার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কখনও যদি সে সৎপথের সন্ধান পায়ও, তবুও সে তার অন্যায় অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করে।
আত্মসমালোচনা দুইভাবে করা যায়
১) কোনো আমল শুরু করার পূর্বে মুহাসাবা করা। অর্থাৎ কোনো কাজের সংকল্প করার পূর্বেই সে কাজটি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে যে, কাজটি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য উত্তম, না ক্ষতিকর? কাজটি কি হারাম, না হালাল? কাজটিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে, না অসন্তুষ্টি? অতঃপর যখন কাজটি উত্তম হবে, তখন আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে কাজে নেমে পড়তে হবে। আর কাজটি খারাপ হলে একইভাবে পূর্ণ একনিষ্ঠতা ও তাওয়াক্কুলের সাথে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিদিন সকালে আন্তরিকভাবে প্রত্যয়দীপ্ত হতে হবে, যেন সারাদিন সৎ আমলের সাথে সংযুক্ত থেকে অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা যায়।
২) আমল শেষ করার পর মুহাসাবা করা। এটা তিনভাবে করা যায় :
(ক) আল্লাহর আদেশসমূহ আদায়ের ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করা
আমাদের ওপর নির্দেশিত ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফলগুলি পর্যালোচনা করা। নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে, আমি কি আমার ওপর আরোপিত ফরযগুলি আদায় করেছি? আদায় করলে সাথে সাথে নফল বা মুস্তাহাবগুলি কতটুকু আদায় করেছি? কারণ ফরযের কোনো অপূর্ণতা হলে নফলগুলি সেটা পূরণ করে দেয়। সাথে সাথে খেয়াল করতে হবে— উক্ত ইবাদতসমূহে আল্লাহর হক্ব পরিপূর্ণ আদায় করা হয়েছে কিনা?
উল্লেখ্য যে, ইবাদতে আল্লাহর হক্ব ছয়টি। যথা— আমলের মধ্যে খুলুসিয়াত থাকা, তার মাঝে আল্লাহর জন্য নাসীহা থাকা (আল্লাহর একত্বের প্রতি সঠিক বিশ্বাস পোষণ করা), রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আনুগত্য থাকা, একাগ্রতা থাকা, নিজের ওপর আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পূর্ণ উপলব্ধি থাকা, অতঃপর এ সকল বিষয়াদির প্রতিটিতে নিজের ত্রুটি হচ্ছে, এই অনুতপ্তভাব থাকা! এ সকল হক্ব পূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে কিনা, আমল সম্পন্ন করার পর তা চিন্তা করতে হবে।
(খ) অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিত্যাগ করা
দ্বীনী দৃষ্টিকোণে যে হালাল কাজ করার চেয়ে না করাই বেশি উত্তম মনে হয়, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। কোনো নির্দোষ কিন্তু গুরুত্বহীন কাজ করে থাকলে তা থেকেও নিজেকে সাধ্যমত নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ আগামীতে কেন এটা করব? এর দ্বারা কি আমি আল্লাহর পথে আরও অগ্রসর হতে পারব? এর দ্বারা কি দুনিয়াবী ও পরকালীন জীবনে আমার বা মানবসমাজের কোনো লাভ হবে? তা অন্য কোনো লাভজনক কাজ থেকে আমাকে বিরত করছে কি? ইত্যাদি প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেলে সে পথে আর অগ্রসর না হওয়া।
(গ) ক্ষমা প্রার্থনা করা ও সৎআমল করা
পূর্ণ সতর্কতার পরও যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ হয়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তওবা করা। সাথে সাথে সৎআমল দ্বারা এই অপরাধের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই ভালোকাজ মন্দকাজকে দূর করে দেয়, আর এটা স্মরণকারীদের জন্য স্মরণ।’ [সূরা হূদ : ১১৪] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তুমি যেখানেই থাকো, আল্লাহকে ভয় কর। কোনো পাপ কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে সাথে সাথে সৎআমল কর যাতে তা মিটে যায়।‘
আনাস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি একবার উমর রাদিআল্লাহু আনহুর সাথে বের হলাম। পথিমধ্যে একটি বাগানে ঢুকলেন তিনি। এমতাবস্থায় আমার ও তাঁর মধ্যে বাগানের একটি দেয়াল আড়াল হয়েছিল। তখন তাঁকে নিজেকে সম্বোধন করে বলতে শুনলাম, ‘উমর ইবনুল খাত্তাব! আমীরুল মুমিনীন সাবাস! সাবাস! আল্লাহর শপথ! হে ইবনুল খাত্তাব! অবশ্যই তোমাকে আল্লাহর ভয়ে ভীত হতে হবে। অন্যথা তিনি তোমাকে শাস্তি দিবেন।’
উসমান রাদিআল্লাহু আনহু যখন কোনো কবরের নিকট দাঁড়াতেন, তখন তিনি কাঁদতেন। ফলে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাকে বলা হলো, ‘জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনায় আপনি কাঁদেন না, অথচ কবর দেখলে আপনি কাঁদেন কেন?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কবর হলো পরকালের পথের প্রথম মনযিল। যদি এখানে কেউ মুক্তি পায়, তাহলে পরের মনযিলগুলো তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর যদি এখানে মুক্তি না পায়, তাহলে পরেরগুলো আরও কঠিন হয়ে যায়।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কবরের চাইতে ভয়ংকর কোনো দৃশ্য আর দেখিনি।’ বারা বিন আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একদল লোককে দেখতে পেয়ে বললেন, “ওরা কি উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে?” একজন বললেন, “ওরা একটি কবর খুড়ছে।” একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আতংকিত হয়ে পড়লেন এবং সঙ্গী-সাথীদের আগে দ্রুতবেগে কবরের নিকটে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তিনি কি করছেন, তা দেখার জন্য আমি তাঁর মুখোমুখি বসলাম। তিনি কেঁদে ফেললেন, এমনকি অশ্রুতে মাটি ভিজে গেল। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে বসে বললেন, “হে লোকেরা! এরকম দিবসের জন্য রসদ প্রস্তুত রেখো।”’
হানযালা আল উসাইদী থেকে বর্ণিত। একদা তিনি কাঁদতে কাঁদতে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে হানযালা! তোমার কি হয়েছে?’ হানযালা বললেন, ‘হে আবু বকর! হানাযালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। আমরা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে অবস্থান করি এবং তিনি আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম স্মরণে নাসীহা করেন, তখন মনে হয় যেন আমরা সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখছি। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং অনেককিছুই ভুলে যাই।‘
আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমাদেরও তো একই অবস্থা। চলো আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে নিকটে যাই।’ অতঃপর আমরা সেদিকে রওয়ানা হলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হানযালা! কি খবর?’ তখন উত্তরে তিনি অনুরূপ বক্তব্যই পেশ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমরা যে অবস্থায় প্রস্থান করো, সর্বদা যদি সেই অবস্থায় থাকতে; তাহলে ফেরেশতারা অবশ্যই তোমাদের মজলিসে, বিছানায় এবং পথে-ঘাটে মুসাফাহা করত। হে হানযালা! সেই অবস্থা তো সময় সময় হয়েই থাকে।’
এই হাদীসগুলো থেকে আত্মসমালোচনায় গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আবশ্যকতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। পরিশেষে বলব- আত্মসমালোচনা আমাদের পার্থিব জীবনে দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে, পরকালীন জবাবদিহিতার চিন্তা বৃদ্ধি করে এবং বিবেককে শাণিত করে। করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সাহায্য করে। সর্বোপরি জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার কাজে সর্বদা প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করে।
আত্মসমালোচনা অন্যের ত্রুটি ধরার পূর্বে নিজের ত্রুটি ধরতে আমাদের শিক্ষা দেয়। অন্যের নিন্দা করার পূর্বে নিজের মধ্যে বিদ্যমান খারাপ দূর করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর দ্বারা আমরা নিজেদেরকে যেমন সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারব, তেমনি অন্যের মাঝে ভুল দেখতে পেলে ভালোবাসা ও স্নেহের সাথে তাকেও শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারব। এভাবে সমাজ পরিণত হবে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভালোবাসা আর সৌহার্দ্যে পূর্ণ এক শান্তিময় সমাজ।
অতএব আসুন! আমরা নিজেদেরকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে, প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে ফেলি। নিজেকে সচ্চরিত্রবান, নীতিবান ও আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলি। এর মাধ্যমে সমাজের আরও দশটা লোক আমাদের দ্বারা প্রভাবিত হবে। আর এভাবেই গড়ে উঠবে আদর্শ পরিবার, আদর্শ সমাজ থেকে আদর্শ রাষ্ট্র। আল্লাহ আমাদেরকে সে তাওফিক দান করুন, আমীন।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক।
আপনার মন্তব্য লিখুন