ইন্নাল হামদা লিল্লাহ। ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহ। ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাঈন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনই হয়েছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে। মহান আল্লাহ বলেন, “আর আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি”। (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)
তিনি সর্বদা উম্মতের কল্যাণ চিন্তা করতেন। তার হাদিসগুলো কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতকে পথের দিশা দেখিয়ে যাবে। মুহাম্মাদ (সা) সর্বকালের সর্বযুগের সেরা আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ও রহমত করে পাঠিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’’ (সূরা আহযাব : ২১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা ও কাজ ছিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ও উন্নত দিকনির্দেশনা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশাল হাদিস ভান্ডার থেকে চয়ন করে উম্মতের জন্য বিশেষ নাসিহা ও উপদেশ এখানে সন্নিবেশন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘দ্বীন হলো উপদেশ’
হযরত তামীম আদ-দারী (রা) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেন, আদ্বীনু নাসিহা ‘দ্বীন হলো নসিহত’ বা উপদেশ।
‘দ্বীন হলো উপদেশ’। আমরা বললাম কাদের জন্য হে রাসূলুল্লাহ (সা)? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য।’ (মুসলিম : ৫৫)
‘দ্বীন হলো উপদেশ’; দ্বীনের মূল কথাই হলো উপদেশ। যেমন হাদিসে বলা হয়েছে ‘হজ্জ হলো আরাফা’ অর্থাৎ হজ্জ হলো আরাফাতে অবস্থান। হজ্জের মূল বিষয় হলো ৯ই যিলহজ্জ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। নসিহত-এর আভিধানিক অর্থ হলো উপদেশ যা দ্বারা কল্যাণমূলক উপদেশ বুঝানো হয়।
‘আল্লাহর জন্য নসিহত’-এর অর্থ হলো আল্লাহর জন্য হৃদয়ে খালেস ঈমান পোষণ করা ও শিরক হতে মুক্ত থাকা। এমনিভাবে যাবতীয় অন্যায়-অশ্লীলতা হতে পবিত্র থাকা। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা, আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্বীকার করা ও তাঁর জন্য কৃতজ্ঞতা পোষণ করা, আল্লাহ বিরোধীদের সাথে জিহাদ করা, সকল কাজ খুলুসিয়াতের সাথে সম্পন্ন করা, মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করা।
‘আল্লাহর কিতাবের জন্য নসিহত’-এর অর্থ হলো আল্লাহর কালাম কোনো মানুষের কালামের মতো নয়। অনুরূপ কালাম রচনা করা কোনো সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহর কিতাবের আদেশ নিষেধ মেনে চলতে হবে ও ‘মুতাশাবিহ’ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াতসমূহের ওপরে ঈমান রাখতে হবে যে, এগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য কেবলমাত্র আল্লাহ-ই জানেন। যা অমুসলিম বিদ্বানদের অহঙ্কার চূর্ণ করার জন্যই নাজিল হয়েছে।
‘রাসূলের জন্য নসিহত’-এর অর্থ হলো রাসূল যে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে যা কিছু নিয়ে আগমন করেছেন, সবটুকুর প্রতি হৃদয়ে খালেস ঈমান পোষণ করা, রাসূলকে যারা ভালোবাসে তাদেরকে ভালোবাসা, তাঁকে যারা শত্রু ভাবে তাদেরকে শত্রু ভাবা, রাসূলের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা ও মৃত সুন্নাতকে জীবিত করা।
‘মুসলিম নেতাদের জন্য নসিহত’-এর অর্থ হলো যাবতীয় ন্যায় কাজে তাদের সহযোগিতা করা, তাদের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বজায় রাখা, দরদের সঙ্গে তাদেরকে হক পথে চলার উপদেশ দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ না করা কিংবা বিদ্রোহে উসকানি না দেওয়া। জনগণকে তাদের প্রতি আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ করা।
‘নসিহত’ করা ফরজে কেফায়াহ। কিছুলোক করলে অন্যদের পক্ষ থেকে তা যথেষ্ট হয়। কিন্তু কেউ না করলে সকলে দায়ী হয়। উহা ‘ফরজে আইন’ হয়ে যায় তখন, যখন অন্যায় বিজয়ী হয় ও ন্যায়নীতি সর্বত্র পরাভূত হয়। একজন পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে পথে আনার জন্য নসিহত হলো সর্বোত্তম পন্থা। নবীগণ এ পথেই জীবনপাত করেছেন। এই নসিহতকেই অন্যকথায় ‘দাওয়াত’ বলা হয়েছে।
হাদিসে ব্যবহৃত ‘নসিহত’ শব্দটি দুনিয়া ও আখিরাতে মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত। এর চেয়ে সুন্দর কোনো শব্দ আরবি ভাষায় নেই। ইসলাম তরবারি দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। ইসলামের নবী (সা) দারোগা হয়ে আসেননি। বরং তিনি এসেছিলেন মানবতার ‘শিক্ষক’ ‘দাঈ ইলাল্লাহ’ হিসাবে, ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হিসেবে।
শিরক না করা
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে শিরক করা। ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় অথবা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।’ শিরক অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অসংখ্য জায়গায় বান্দাকে শিরকের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার আদেশ করেছেন। কুরআন বলছে, ‘‘তোমরা ইবাদাাত করে আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতিাম, মিসকিন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’’ (সূরা নিসা : ৩৬)
শিরক অমার্জনীয় অপরাধ। মহান আল্লাহ শিরককারীকে ক্ষমা করেন না। মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না।” (সূরা নিসা : ৪৮) তাই আমাদের উচিত শিরক থেকে মুক্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এমন কাজ বর্জন করা, যাতে শিরকের আশঙ্কা থাকে।
“আর যখন লুকমান হাকিম তার ছেলেকে বললেন, হে আমার আদরের সন্তান! তুমি আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ।” (সূরা লুকমান : ১৩) আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, “নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন এবং তার বাসস্থান হচ্ছে জাহান্নাম। আর অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা আল-মায়িদাহ : ৭২)
‘সাবধান! আল্লাহর নাফরমানি ও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো, কেননা নাফরমানি দ্বারা আল্লাহর ক্রোধ অবধারিত হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন পাপ বর্জন করো, যারা পাপ করে অচিরেই তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে।” (সূরা আনআম : ১২০)
মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা
পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না, যদি মাতা-পিতা তোমাকে তোমার পরিবার-পরিজন বা ধনসম্পদ ছেড়ে দেওয়ার হুকুমও দেয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো।” (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩)
আলোচ্য আয়াতে এক আল্লাহর ইবাদাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরেই মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হলো, মহান আল্লাহ মানুষের প্রকৃত স্রষ্টা ও প্রতিপালক। কিন্তু মানুষ পৃথিবীতে আসার বাহ্যিক উপায় ও মাধ্যম হলেন মাতা-পিতা। তাই আল্লাহর ইবাদাতের নির্দেশনার পরেই মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, তিন ধরনের মানুষের দিকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন দৃষ্টিপাত করবেন না। মাতা-পিতার অবাধ্য, পুরুষের বেশ অবলম্বনকারী নারী এবং দাইয়ুস। আর তিন প্রকার লোক জান্নাতে যাবে না। মাতা-পিতার অবাধ্য, মদ পানে আসক্ত এবং দানের পর খোঁটাদাতা।’ (মুসনাদ আহমদ : ৬১১)
ফরজ নামাজ না ছাড়া
ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো কোনো ফরজ নামাজ ছাড়া যাবে না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তায়ালা তার থেকে দায়িত্ব উঠিয়ে নেন।
নামাজ বর্জনকারী আল্লাহর নিয়ামত, বরকত ও রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। তার দোয়া কবুল হয় না, তার চেহারার নূর উঠে যায়, তার জীবিকা সংকীর্ণ করা হয়। ফলে সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কষ্ট পায়। রাসূল (সা) ফরজ নামাজ বর্জনকারীর ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করেছেন, জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ ছেড়ে দেওয়া। (মুসলিম, হাদিস : ১৪৮) তাই কোনো মুসলিম ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ত্যাগ করতে পারে না। আল্লাহ আমাদের দোয়া করতে শিখিয়েছেন, “হে আমার রব, আমাকে সালাত কায়েমকারী বানান এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও, হে আমাদের রব, আর আমার দোয়া কবুল করুন।”
নামাজ ছিল সবচেয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। এমনকি তিনি যখন কোনো বিপদে পড়তেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আবার কোনো কারণে কষ্ট বা হতাশা বা চিন্তাগ্রস্ত হলেও তিনি তাৎক্ষণিক নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।
পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নসিহা
একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে সে প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা) কী বলেছেন এবং সে তা জানামাত্র মাথা পেতে গ্রহণ করে নেয়, সেটা তার মন মতো হোক বা না হোক ‘সামি’না ওয়াত্ব’না; শুনলাম এবং মেনে নিলাম’। অথচ কিছু লোক আছে, যাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা শোনানোর পরও তারা নিজেদের মতামতের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে এবং বলে ‘আমার তা মনে হয় না।’
অর্থ উপার্জনের কারণে কেউ যদি আল্লাহর দ্বীনের কাজ করা থেকে বিরত হয়, তবে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার চেয়ে অর্থকে অধিক ভালোবাসে বলে বুঝতে হবে, অতএব সে ভালোবাসার ক্ষেত্রে শিরক করে। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, “দিরহামের গোলামরা অভিশপ্ত” (সহিহ বুখারী)। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন: “তোমাদের কেউই প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার সন্তান, তার পিতামাতা এবং সমগ্র মানবজাতি থেকে তার নিকট অধিক প্রিয় হই।” (সহিহ বুখারী)
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য যত ভালো কাজ আছে, তন্মধ্যে েিন্মাক্ত ৫টি বিষয় হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১। ওসিয়্যত, ২। ঋণ পরিশোধ, ৩। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, ৪। বান্দার হক, ৫। ক্ষমা করা
ওসিয়্যত করা
মানুষের মৃত্যুর পর তার কোনো কাজ করার সুযোগ থাকবে না। দুনিয়ায় আজকে কাজ করার সুযোগ আছে হিসাবের ব্যবস্থা নেই। আখিরাতে কাজ করার সুযোগ থাকবে না শুধু হিসাব আর হিসাব দিতে হবে। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য এমন কোনো কাজ রেখে যাওয়া যা থেকে পৃথিবীবাসী উপকৃত হয়। আর তার প্রতিদান মৃত্যুর পরও ব্যক্তির জন্য অব্যাহত থাকে। ‘ওসিয়্যত’ এমনি একটি সাদাকায়ে জারিয়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোনো মুসলিম ব্যক্তির, যার ওসিয়্যত করার মতো সম্পত্তি আছে, তার কাছে তার লিখিত ওসিয়্যত প্রস্তুত থাকা ব্যতীত পরপর দু’রাত কাটানোর অধিকার তার নেই’ (সহিহুল বুখারী : ২৭৩৮)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তোমাদের মৃত্যুর সময় ওসিয়্যতের বিনিময়ে সাওয়াব বাড়িয়ে দিয়েছেন। এসব প্রমাণের মাধ্যমে ওসিয়্যতের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। এটি সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে ওসিয়্যতকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পরও সুফল পাবে।
ওসিয়্যত দুপ্রকার : ১। ওয়াজিব ওসিয়্যত, ২। উত্তম ওসিয়্যত
ওয়াজিব ওসিয়্যত
ওসিয়্যতকারীর কাছে অন্য লোকের পাওনা বা অন্য লোকের কাছে তার পাওনা সম্পর্কে ওসিয়্যত করা ওয়াজিব; যাতে ওয়ারিশ ও পাওনাদারগণ তাদের অধিকার পায়। ওয়ারিশ হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং গরিব ও অভাবী, নাতি-নাতনী, যারা দাদার আগে পিতার মৃত্যুর কারণে ওয়ারিশ হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দাদার ওসিয়্যতের কারণে তাদের জীবন-যাপন সহজ হবে এবং পিতা হারানোর কষ্ট লাঘব হবে।
উত্তম ওসিয়্যত
ওয়ারিশ নয় এমন আত্মীয়দের জন্য ওসিয়্যত করা। যেমন, মামা, খালা, ফুফু এবং তাদের সন্তানাদি, আলেম-উলামা, সৎলোক। ব্যক্তির মালিকানাধীন সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে কম পরিমাণ ওসিয়্যত হতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ ওসিয়্যত করার অনুমোদন দিয়েছিলেন, তার বেশি নয় (সহিহুল বুখারী : ১২৯৫)। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, আমার সম্পদের প্রযোজ্য অংশ ওসিয়্যত করব এ জন্য যে আমি নিজের হাতে পরকালের জন্য আমার সম্পদকে কাজে লাগাতে চাই। আমি তো জানি না আমার ওয়ারিশগণ আমার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে কোনভাবে ব্যয় করবে? তাই পরকালে শান্তিকামী প্রত্যেক মুসলিমের সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে ‘ওসিয়্যত’ করে যাওয়া উচিত। ওসিয়্যত লিখিত, স্বাক্ষরযুক্ত ও দুজন সাক্ষী দ্বারা লিখতে হয়।
ঋণ পরিশোধ করা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তির জীবন তার ঋণের সাথে ঝুলে থাকে যতক্ষণ সে তা আদায় না করে’ (তিরমিযী : ১০৭৯)। করজে হাসানা ব্যবস্থা ইসলামের উঁচু মাপের একটি সামাজিক ব্যবস্থা। ধনী ও গরিবের সম্পর্কের সেতুবন্ধ। সাময়িক আর্থিক সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে সক্ষম ব্যক্তি ঋণ দিয়ে তার ভাইয়ের সহযোগিতা করা মুসলিম সমাজের একটি অনন্য প্রয়াস। এ জন্য ইসলামে এ মহৎ কাজের জন্য রয়েছে সাদাকাহ করার সমপরিমাণ প্রতিদান। আল্লাহর পথে দান করা হলে, তা আল্লাহকে করজে হাসানা দেওয়া হয়। করুণাময় আল্লাহ তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে তাকে তা ফেরত দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে দুবার ঋণ দেয় তা একবার সাদাকাহ করার সমান।’ (ইবনে মাজাহ : ১৯৮৭)
ইসলামী শরিয়তে দুটি শর্তে কর্জ নেওয়া অনুমোদিত; (১) শরিয়তে বৈধ এমন প্রকৃত প্রয়োজন পূরণের জন্য কর্জ নেওয়া। ভোগ-বিলাসের জন্য কর্জ নেওয়া বৈধ নয়, (২) ঋণ পরিশোধ করতে পারবে এমন বিশ্বাস ও প্রবল ধারণা থাকা। এ দুটি শর্ত পূরণ না হলে ঋণ নেওয়াটা শরিয়তে নিষিদ্ধ। এমনকি তা হারাম পর্যন্ত গড়ায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের ব্যাপারে কঠিনভাবে সাবধান করেছেন। এমনকি তিনি ঋণী ব্যক্তির জানাজা পড়তেন না। জাবির (রা) বর্ণিত হাদিসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কোনো এক জানাজায় উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে, এ ব্যক্তি কি ঋণগ্রস্ত? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। তিনি বলেন, ‘তোমরা তার জানাজা আদায় করো’ (তিরমিযী, হাদিস নং ১০৬৯, সহিহ হাদিস)। এমনকি আল্লাহর পথে শহীদ ব্যক্তির সকল গুনাহ ক্ষমা করা হলেও ঋণ ক্ষমা করা হয় না। নবী (সা) বলেন, ‘শহীদের ঋণ ব্যতীত সকল গুনাহ ক্ষমা করা হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৮৮৬)
ঋণ নিয়ে যে ব্যক্তি সততা ও নিষ্ঠার সাথে তা আদায় করার সংকল্প করে আল্লাহ তার ঋণ পরিশোধের তাওফিক দান করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ (কর্জ হিসেবে) নিয়ে তা আদায় করার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে, আল্লাহ তার পক্ষ থেকে আদায় করার ব্যবস্থা করেন। আর যে ব্যক্তি তা নষ্ট করার ইচ্ছায় নেয় আল্লাহ তার সম্পদ ধ্বংস করেন’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৩৮৭)। অন্য আরেকটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করার ইচ্ছা করে না, সে চোর হিসেবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে।’ (সহিহ ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৪১০)
মনে রাখতে হবে যে, মানুষের সম্পদ অবৈধ ও অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির ঋণ আদায়ে দীর্ঘসূত্রিতা করা জুলুম’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৪০০)। তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ আদায়ে সক্ষম ব্যক্তির টালবাহানার কারণে ঋণদাতা কর্তৃক তার সম্মান নিয়ে কথা বলা এবং শাস্তির আওতায় আনা বৈধ’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৬২৮, হাদিসটি হাসান)। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি উত্তম যে উত্তম উপায়ে ঋণ পরিশোধ করে’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৩৯২)। জাবির (রা) বলেন, নবী (সা) আমার কাছে ঋণ নিয়েছিলেন, তিনি আমাকে তা পরিশোধ করেন এবং আরো বেশি প্রদান করেন।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৪৪৩)
তবে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি বাস্তবিকই অসচ্ছল হয় তাহলে তাকে সময় দেওয়া কিংবা ক্ষমা করে দেওয়া অনেক বড় মাপের ভালো কাজ। কুরআনে কারিমে আছে যে, “সে যদি অসচ্ছল হয় তাহলে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দেওয়া।” (সূরা আল-বাকারাহ : ২৮০) নবী (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি অসচ্ছল ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধে অবকাশ দেবে অথবা তার ঋণ ক্ষমা করে দেয় আল্লাহ তাকে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩০০৬)। তাই ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করা অপরিহার্য। ঋণ নিয়ে মৃত্যু বরণ করা কিংবা আমার ওয়ারিশগণ আদায় করে দেবেন এমন আশায় ঋণ পরিশোধে উদাসীন থাকা পরকালের জন্য চরম ক্ষতি।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা
ইসলামী দায়বদ্ধতার উদাহরণ হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে ‘সিলায়ে রেহেম’ বা রক্ত-সম্পর্কিত সম্পর্ককে বুঝায়। এর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করো” (সূরা আন-নিসা : ১)। হাদিসে এর গুরুত্ব, মর্যাদা এবং সম্পর্ক ছিন্নের শাস্তির হুমকি রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘যার রিজিক প্রশস্ত হোক কিংবা যার মৃত্যু বিলম্ব হোক, এটা যে চায় সে যেন তার রক্ত-সম্পর্ককে বজায় রাখে’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২০৬৭)। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা সালাম ছড়িয়ে দাও, লোকদেরকে খেতে দাও, রক্ত-সম্পর্ক বজায় রাখো, রাতে সালাত আদায় করো লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস নং ৩২৫১, হাদিস সহিহ)
অপর দিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গুনাহ। এর জন্য কঠিন শাস্তির হুমকি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, “সুতরাং তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে হতে পারে তোমরা জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এরাই তারা যাদের প্রতি আল্লাহ লানত করেছেন” (সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রক্ত সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৫৯৮৪)। রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, আল্লাহ তায়ালা রক্তের সম্পর্ককে বলেন, ‘যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। এটাই তোমার প্রাপ্তি।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৪৮৩০)
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার মানে হলো:
১) আত্মীয়দেরকে নসিহত করা, সঠিক পথ দেখানো ও স্মরণ করানো। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভের পর নিজের বংশের লোকদেরকে আগে সাবধান করেছিলেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৫৩)
২) অভাবী হলে দান সাদাকাহ করা, যেমন আবু তালহা (রা) তার প্রিয় বাইরুহা বাগান আত্মীয়দেকে দান করেছিলেন। (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৪৬১)
৩) হাদিয়া দেওয়া, যেমন নবী (সা) মাইমুনাকে (রা) পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তুমি যদি তোমার মুক্ত করা দাসীটিকে তোমার মামাদেরকে দিতে তাহলে অধিক পরিমাণ প্রতিদান লাভ করতে।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৫৯২)
৪) সম্পর্ক ছিন্নের বিপরীতে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং খারাপ আচরণের বিপরীতে ভালো আচরণ করা। (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৫৯৯১)।
৫) খালার সাথে সদাচরণ করা ও সম্পর্ক বজায় রাখা। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘মায়ের বিকল্প হলো খালা।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৬৯৯)।
৬) আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাতের সময় শরয়ী পর্দা রক্ষা করা।
সুতরাং আত্মীয়দের বিশেষ করে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়দের সাথে সকল অবস্থায় সম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য। অন্যথায় কঠিন পরিণতির শিকার হতে হবে। “আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্র (আল্লাহ তায়ালার নকিট) উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না” (আহমদ, হাদিস নং ১০২৭৭)। “সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসাবে গণ্য হবে না। যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে। বরং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী সে ব্যক্তি, যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলেও তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে” (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৯৯১)। “অন্ততপক্ষে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে হলেও তোমরা তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো।” (বাজ্জার, হাদিস নং ১৮৭৭)
মানুষের অধিকার রক্ষা করা
সহিহ হাদিসে আছে যে, ‘তুমি প্রত্যেককে তার হক দিয়ে দাও।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৯৬৮) ‘করুণাময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাঁর হক আদায়ে কমতি হলে মাফ করতে পারেন। কিন্তু বান্দার হক নষ্ট হলে তা ক্ষমা হয় না। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন, (সূরা বনি ইসরাইল ১৭: ৭০) মানুষের সকল প্রকার হক যথাযথভাবে আদায় না হলে মানুষের অধিকার নষ্ট হয়। মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা আমানাতসমূহকে এগুলোর হকদারের কাছে আদায় করে দাও।” (সূরা আন-নিসা ৪: ৫৮) নবী (সা) বলেন, ‘একজন মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের ছয়টি হক রয়েছে; সালাম দেওয়া, দাওয়াত কবুল করা, উপদেশ দেওয়া, হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে তার উত্তর দেওয়া। অসুস্থজনের সেবা-শুশ্রƒষা করা এবং মারা গেলে তার অনুসরণ করা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২১৬২)
নবী (সা) বলেন, ‘কিয়ামাতের দিন তোমাদের হকসমূহ অবশ্যই আদায় করে দেওয়া হবে, এমনকি শিংবিহীন ছাগলের পক্ষে শিংবিশিষ্ট ছাগল থেকে প্রতিশোধ নেয়া হবে’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৮২)। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘যার কাছে তার অপর ভাইয়ের সম্মান বা কোনো হক নষ্টের দায় রয়েছে, সে যেন দুনিয়ার জীবনেই তা থেকে মুক্তি নেয়। কারণ সেদিন তার নষ্ট করা হক পরিমাণ সাওয়াব তার নেক আমল থেকে নেওয়া হবে। আর সওয়াব না থাকলে তার সাথীর পাপগুলো নিয়ে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৪৪৯)
রাসূলুল্লাহ (সা) ‘মুফলিস’ বা নিঃস্ব ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে সাহাবীগণকে বলেন, নিশ্চয় আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম এবং জাকাতসহ উপস্থিত হবে। আর এমন ব্যক্তিও আসবে, সে এ ব্যক্তিকে গালি দিয়েছে, অপরের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, আরেক ব্যক্তির সম্পদ ভক্ষণ করেছে, ওর রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং একে মারধর করেছে। তখন হক নষ্ট ব্যক্তিকে তার পুণ্য থেকে প্রদান করা হবে, আর ওকেও তার পূণ্য থেকে দেওয়া হবে। এভাবে তার দায় শোধ করার পূর্বেই যখন তার পুণ্য শেষ হয়ে যাবে, তখন তাদের গুনাহগুলো নিয়ে তার ওপরে ফেলা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৮১)। তাই মানুষের হক নষ্ট করা যাবে না। এ হক নষ্টের একটি সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে, ভাইদের কর্তৃক বোনদেরকে সম্পদের ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করা।
ক্ষমা ও মার্জনা করা
উত্তম চরিত্রের আরেকটি গুণ হচ্ছে মানুষকে ক্ষমা করা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী ও মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি ক্ষমা করাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করুন আর সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন” (সূরা আল আরাফ : ১৯৯)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর তারা যেন অবশ্যই ক্ষমা করে দেয় এবং মার্জনা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুক’ (সূরা আন নূর ২৪: ২২)। আল্লাহ বলেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় ব্যয় করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল, আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৪)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সাদাকাহ সম্পদ হ্রাস করে না, বান্দাকে ক্ষমা করার বিনিময়ে আল্লাহ কেবল ব্যক্তির সম্মানই বৃদ্ধি করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৮৮) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক ক্ষমাপ্রদর্শন ও মার্জনাকারী ছিলেন। সহিহ বুখাীরতে তাওরাতে তার গুণাগুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘তিনি মন্দ দিয়ে মন্দ প্রতিহত করেন না বরং তিনি মার্জনা করেন এবং ক্ষমা করেন’ (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২১২৫)। মাক্কী জীবনে যারা তাকেসহ তার সাহাবীগণকে প্রচণ্ড রকমের অত্যাচার নির্যাতন করেছে, সাথীদেরকে হত্যা করেছে এবং তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে, মক্কা বিজয়ের পর তিনি তাদের প্রতি প্রতিশোধ না নিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন যে, ‘তোমরা চলে যাও, তোমরা মুক্ত।’ (সিরাত ইবন হিশাম ৪/২৭)
জনৈক বেদুঈন নবী করিম (সা)-কে মরুভূমিতে গাছের নিচে একাকী ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তিনি টের পেয়ে যান, তারপর সাহাবীগণের সামনে তার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ আসে। কিন্তু তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ২৯১৩)। তায়েফ এলাকায় অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করেছেন (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৩৪৭০)। আল্লাহ তায়ালার নিষ্ঠাবান বান্দাদের অন্যতম গুণ হচ্ছে, ক্ষমা ও মার্জনা করা। এটি সর্বজনবিদিত যে, প্রতিশোধ নেওয়া বা শাস্তি দেওয়ার শক্তি থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেওয়াকে ‘ক্ষমা’ বা ‘মার্জনা’ বলা হয়। তবে ক্ষমার মাধ্যমে যদি ব্যক্তি পরিশুদ্ধ না হয়, তার অপরাধ যদি ক্ষমার অযোগ্য এবং শরিয়তের স্বার্থে শাস্তির প্রয়োজন হয়, তাহলে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার পরও তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, “অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে।” (সূরা আশ-শুরা : ৪০)
রাসূল (সা) সাহাবীদের বললেন-
‘তোমাদের মাঝে এখন আসবে একজন জান্নাতি মানুষ।’ দুদিনের মতো তৃতীয় দিনও রাসূল (সা) বললেন সে একই কথা। এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা)। নবীজি তাকে খুব মহব্বত করতেন। তিনিও নবীজিকে ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম শত্রুর বিরুদ্ধে তীর নিক্ষেপ করেছেন। অনেক হাদিস বর্ণনা ও সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বদর, উহুদসহ বড় বড় যুদ্ধে নবীজির সাথে অংশগ্রহণ করেছেন।
মজলিস শেষে হযরত সাদ (রা) যখন বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন তখন সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) তাঁর সাথে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তিন রাত কাটালেন। রাতে ঘুম ভাঙলেই পাশ ফেরার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন; এরপর ফজরের সময় হলে নামাযের জন্য উঠতেন।
রাসূল (সা) সাহাবীদের বললেন, ‘একজন জান্নাতি মানুষের আগমন ঘটবে’ তিনবারই দেখা গেল সে লোক আপনিই। তখন থেকেই আমি সংকল্প করেছি, ‘আপনার আমল মোতাবেক আমল করে আমিও জান্নাতি হব।’ হযরত সা‘দ (রা) বললেন, ‘আমার তেমন কোনো আমল নেই। আমি কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কোনো কুচিন্তা ও হিংসা পোষণ করি না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সকলকেই ক্ষমা করে দিই।’ সাহাবি বলেন হয়তো এ কারণেই আল্লাহ তাকে জান্নাতি বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ ৩/১৬৬)
সুতরাং মানুষদেরকে ‘ক্ষমা’ ও ‘মার্জনা’ করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক : সাবেক এমপি ও নায়েবে আমীর,
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
আপনার মন্তব্য লিখুন