post

আনুগত্য আর ইবাদতে ভালোবাসার অবস্থান

অনুবাদ : জাকির হুসাইন

০৬ এপ্রিল ২০২২

[শাইখ ডক্টর আকরাম নাদভী ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত প্রসিদ্ধ ইসলামিক স্কলার যিনি বিগত ৩০ বছর ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন। তাঁর অসামান্য ইসলামী চিন্তাধারার জন্য তিনি আল্লামা ইকবাল পুরস্কার পেয়েছেন এবং তিনি আল-সালাম ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা। 

ডক্টর নাদভী নাদওয়াতুল উলামা (লক্ষনৌ, ভারত) থেকে ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়সমূহে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং লক্ষনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজে রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগদান করার জন্য আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলি নাদভী তাকে প্রতিনিধি করে ইংল্যান্ডে পাঠান। তারপর থেকে তিনি ইসলামের জ্ঞানশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করে চলেছেন নিরলসভাবে, বিশেষত হাদিসশাস্ত্রে তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ করছেন। তাঁর বিখ্যাত কাজসমূহের মধ্যে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘আল-মুহাদ্দিসাত: ইসলামের নারী স্কলার’ অন্যতম, যা ৪৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধটি আল-সালাম ইনস্টিটিউটের একটি ক্লাসে দেয়া লেকচারের অংশবিশেষ।]

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘আনুগত্যের’ চেয়েও অনেক বেশি কিছু হলো ভালোবাসা। মূলত মানুষ যখন ভালোবাসার কথা বলে তা হৃদয়কেন্দ্রিক ব্যাপার স্যাপারই বোঝায়। প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা দুই রকমের- (ক) চাহিদা, কেউ যখন অন্য একজনের আকর্ষণীয় চেহারা দেখে কিংবা বাহ্যিক অবয়ব দেখে যে টান অনুভব করে সেটা কিছুতেই ভালোবাসা নয়, এটা চাহিদা মাত্র। আর এই প্রকৃতির ভালোবাসার বৈশিষ্ট্য হলো নিম্নগামিতা; অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে এটা কমে যাবে এটাই বাস্তবতা। (খ) প্রকৃত ভালোবাসা, অন্তরের সংযোগেই এই প্রকৃতির ভালোবাসার অস্তিত্ব। 

প্রকৃত ভালোবাসা আসে দুটো জিনিস থেকে- (১) কামাল বা কুদরাহ এবং (২) রাহমাহ। শব্দ দুটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে গুরুত্বের সাথে। আমরা যদি সহজেই এই দুটো জিনিস বুঝতে চাই তাহলে উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যেমন ধরেন, আমি মহাকবি ফেরদাউসিকে ভালোবাসি; তাই বলে আমি কি তাকে আনুগত্য করতে যাবো? মোটেও না। আমি তো তাকে কখনো দেখিইনি, আমি জানি না তিনি কেমন ছিলেন দেখতে; তারপরও আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তার কবিতাকে পছন্দ করি আর তাই তার জন্যও আমার অন্তরে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে। আসলে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবে এই ব্যাপারটা দিয়েছেন যে, যখনই আমরা কারো মধ্যে কোনো ক্ষমতার বা যোগ্যতার প্রকাশ দেখি তখন আমরা তার জন্য হৃদয়ে ভালোবাসা লালন করি। এটা এক ধরনের প্রকৃত ভালোবাসা। 

আবার আমরা ভালোবাসি এমন কাউকে যিনি আমার প্রতি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ তার সেরকম কোনো ক্ষমতা বা যোগ্যতা নেই, যেমনটা ফেরদাউসির উদাহরণ দিয়ে বলেছি উপরে। তারপরও তাকে আমরা ভালোবাসি উক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা উপকৃত হই অর্থাৎ, তার রাহমাহ এর জন্য এই ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে। হতে পারে কেউ আপনাকে তৃষ্ণার সময় এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো বা অর্থনৈতিক সঙ্কটে কিছু টাকা ঋণ দিলো। এই উপকারের কারণেও তার জন্য অন্তরে ভালোবাসার তৈরি হয়। এটাও এক ধরনের প্রকৃত ভালোবাসা।

এই কামাল বা কুদরাহ আর রাহমাহ এর কারণে যে ভালোবাসার সৃষ্টি হয় তাকে আমরা বলতে পারি ‘আল হুব্বুল আকল’ অর্থাৎ, এই ভালোবাসার উৎপত্তিতে অবশ্যই ‘কারণ’ আছে। অপর দিকে চাহিদা থেকে যে ভালোবাসার উৎপত্তি তা কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা কিংবা কারণের কথা চিন্তা করে উদয় হয় না। যখন কেউ আরেকজনের আকর্ষণীয় চেহারা, হাত-পা, বা এ জাতীয় ব্যাপার দেখে ভালোবাসার কথা বলে এটা কিছুতেই প্রকৃত ভালোবাসা হতে পারে না। এখানে তো কোনো চিন্তাভাবনা কিংবা যৌক্তিক কারণ উপস্থিত নেই। 

তাই প্রকৃত ভালোবাসা হলো ‘আল হুব্বুল ফিক্বরি ওয়াল ফিতর’ অর্থাৎ, আমাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের সাথে, চিন্তাভাবনা আর কারণের সাথে যে ভালোবাসার উৎপত্তি তাই হলো সুস্থ ও সুন্দর ভালোবাসার ধরন। 

যে আলাপ থেকে শুরু করেছিলাম এবার সেখানে আসি। ভালোবাসা আর আনুগত্য এই দুটো বিষয় নিয়ে শুরু করেছিলাম। তো ভালোবাসার সাথে আনুগত্যের সম্পর্ক কেমন তা বুঝতে হলে আমাদেরকে আরো গভীরে ভাবতে হবে। 

আমরা আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ভালোবাসি আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তায়ালার কুদরাহ এর দিকে আমরা যখন খেয়াল করি- তিনি এই আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন, মানুষসহ সব কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। এটা তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা তৈরি করে। আবার আল্লাহ তায়ালার রাহমাহ আমাদের প্রতিটি ক্ষণের জন্য আগলে রেখেছে। সেটা যখন আমরা চিন্তা করি, আলোচনা করি, বিবেচনা করি তখন তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা বাড়তেই থাকে। এই ভালোবাসা কখনোই কমার নয়। যতই আমরা আল্লাহর কুদরাত আর রাহমাহ নিয়ে ভাবতে থাকবো ততই এই ভালোবাসা হু হু করে বাড়তে থাকবে। এটা আমাদের মায়েদের ক্ষেত্রেও একই কথা। মায়ের রাহমাহ আমার প্রতি যে কত প্রগাঢ় তা যখন আমরা ভাবি তখন তার প্রতি ভালোবাসা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায়। এবং সেই ভালোবাসার মানুষ যখন কিছু চায় তখন আমরা দিতে থাকি, কোনো দ্বিধা ছাড়াই। আমরা দিয়েই তখন আনন্দ পাই। ভালোবাসার কাউকে কিছু দিতে পারা, ত্যাগ স্বীকার করাটা ভালোবাসারই প্রকাশ সেটা আমাদের কাছে এই প্রকৃত ভালোবাসার সময় পরিষ্কার হয়ে যায়। 

ভালোবাসা আনুগত্যের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আনুগত্যই ভালোবাসা নয় তবে ভালোবাসার সামান্য প্রকাশ। এরকম কখনোই ঘটবে না, আপনি কাউকে ভালোবাসবেন আর তার আনুগত্য করতে পিছপা হবেন। এটা একদমই বেমানান কথা। আনুগত্য ভালোবাসার অংশ, ভালোবাসা এই আনুগত্য করাকে সহজ করে দেয়। 

তো যখন আপনি বুঝতে পারছেন, আল্লাহ কতো রকমের উপায়ে আপনাকে সহায়তা করে যাচ্ছেন, কতো উপায়ে আপনাকে তাঁর রহমের চাদরে আগলে রাখছেন তখন ভোরবেলা যদি আপনাকে জেগে উঠতে বলা হয় তখন আপনি কি তাঁর নির্দেশ মতে সেই ভোরে জেগে উঠবেন না? এত খারাপ আপনি! রাহমাহ এবং কুদরাহ থেকে যে ভালোবাসার উৎপত্তি আপনার মধ্যে, সেই ভালোবাসার দাবিতে যদি আপনি সৎ হয়ে থাকেন তাহলে আপনি অবশ্যই সেই ভোরবেলা জেগে উঠে তাঁর নির্দেশ পালন পারবেন। 

ভালোবাসা এই আনুগত্যকে সহজ করে দেয়। আর ভালোবাসা প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হবে আল্লাহ তায়ালাকে চেনার মাধ্যমে, তাঁর কুরআন বোঝার মাধ্যমে, তাঁর এই সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা (তাফাক্কুর) করার মাধ্যমে। 

এই রকমের ভালোবাসা অবশ্যই চাহিদা থেকে উৎপন্ন ভালোবাসার চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি স্থায়ী এবং সুস্থ-সুন্দর। চাহিদার ভালোবাসা তো নিম্নগামী, চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে ক্রমশ কমে যেতে থাকে।

আপনাদেরকে ‘হাওয়া’ এবং ‘মুহাব্বাহ’ এর মধ্যে পার্থক্য বলি। আমরা এতক্ষণ যে ভালোবাসা নিয়ে আলোচনা করছি তার জন্য আরবিতে ‘মুহাব্বাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। আর সাধারণত নারী, সম্পদ, খাবারের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা তাকে আরবিতে বলা হয় ‘হাওয়া’। আরবি ভাষায় যেসব ব্যাপার খুবই ক্ষীণ বা বিনা কষ্টে অর্জিত হতে পারে সেসব শব্দের মাঝখানের হরফে ‘কাসরা’ থাকে। যেমন ‘সামিয়া’ কোনো কিছু শোনা। শুনতে কোনো কষ্ট করতে হয় না। কেউ কিছু বললে অনায়াসে বিনা কষ্টে আমরা তা শুনি। 

‘হাওয়া’ এসেছে ‘হাউইয়া’ থেকে যার অর্থ হলো নিম্নগামী হওয়া। ঠিক একই রকম ভাবে, চাহিদা তৈরি হওয়ার পর এটা যখন পূরণ হয়ে যায় তখন এটা আপনা আপনিই হ্রাস পেয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন আমরা ক্ষুধার্ত হই তখন খাবারের চাহিদা অনুভব করি, যখন খাবার খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলি তখন আর মোটেও সেই খাবারের প্রতি আকর্ষণ থাকে না। তা ওখানেই শেষ। এটাই ‘হাওয়া’। অধিকাংশ মানুষ ‘হাওয়া’ কেন্দ্রিক ভালোবাসার কারণে কোনো জিনিস গ্রহণ করে; একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছুবার পর সেই ভালোবাসা আর থাকে না, নিম্নগামী হয়। যেমন, কেউ যদি কোনো নারীকে বিয়ে করে শুধুমাত্র তার রূপের কারণে তাহলে বিয়ের পর যখন তার হওয়া শেষ হবে অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর যখন ঐ নারীর সৌন্দর্যে ঘাটতি পড়তে থাকবে তার ভালোবাসায়ও ঘাটতি পড়ে যেতে থাকবে। কারণ এটা প্রকৃত ভালোবাসা ছিলো না, ছিলো তো ‘হাওয়া’ বা চাহিদা মাত্র। 

আর যখন কেউ কোনো নারীকে তার ‘জ্ঞান’, ‘ধার্মিকতা’ কিংবা ‘সততা’র জন্য বিয়ে করবে তখন সে বিয়ের পরে যতই তার সেই গুণগুলো খেয়াল করতে থাকবে ততই তার প্রতি তার ভালোবাসা বাড়তেই থাকবে। এটাই ‘মুহাব্বাহ’ আর মুহাব্বাহ তো তার বৈশিষ্ট্যগত+ভাবে বাড়তেই থাকে। এর প্রকৃতিই হলো ঊর্ধ্বগামিতা। যার উৎপত্তি ‘কামাল’ বা ক্ষমতা-যোগ্যতার কারণে।

আর আল্লাহর ক্ষেত্রে আমাদের ভালোবাসা হলো সীমাহীন; কারণ, ‘কামাল বা কুদরাহ’ এবং ‘রাহমাহ’ দুটোই আমরা প্রতিনিয়তই আবিষ্কার করতে থাকি আমাদের যাপনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। যতই আমরা ‘তাফাক্কুর’ বা চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তার ‘কুদরাহ’ এবং ‘রাহমাহ’ সম্পর্কে অবগত হতে থাকবো ততই তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা শুধু বাড়তেই থাকবে বাড়তেই থাকবে। সুতরাং আমরা যখন আল্লাহর জন্য ‘মুহাব্বাহ’ শব্দটির ব্যবহার করবো তখন এর অর্থ হবে- ‘আল হুব্বুল আক্বলিয়্যুল ফিতরি’। ‘ফিতরাত’ বা সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আমরা যার ওপর নির্ভরশীল থাকি তাকেই আমরা ভালোবাসি আর ‘আক্বলি’ হলো যুক্তির নিরিখে ভালোবাসার উৎপত্তি।  

লেখক : আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার

অনুবাদক : শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির