ভূমিকা :
প্রকৃতিগত দিক থেকে অধিকাংশ মানুষই দুনিয়াকে বেশি বেশি ভালোবাসে। সাধারণত তারা আখিরাতের জীবনকে প্রাধান্য দিতে তেমন একটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না। তা ছাড়াও আমাদের অনেকেই দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ, দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করতে পছন্দ করে অথবা হেনতেনভাবে দ্বীন পরিপালন করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। কেউবা রয়েছি প্রবৃত্তির দাসত্বে বাঁধা। কাউকে-বা শয়তান আচ্ছামতো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। আবার আমাদের সারাটি সমাজজুড়ে অনেক উপকরণ আছে, যা পাপকে উসকানি দেয়। এসবের অনিবার্য পরিণতিতে পৃথিবীর আকাশ বাতাস পাপ-পঙ্কিলতায় বিষাক্ত হয়ে ওঠে। আর এ অবস্থা থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে হলে অবশ্যই সৎ কাজের চর্চা আর অসৎ কাজের জানালা ভালোভাবেই রুদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম এ ধরনের একটি বাস-উপযোগী সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের লক্ষ্যে সৎকাজের আদেশ দেওয়া আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছে। আরবিতে এ সৎ কাজের আদেশ দেওয়া আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করাকে “আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার” বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা আর তাঁদের নিষেধকৃত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকাটাই হচ্ছে (মা’রুফ) বা উত্তম কাজ। আর আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত কর্মকাণ্ড সম্পাদন না করা আর তাদের নিষেধকৃত কর্মকাণ্ড করে যাওয়াটাই হচ্ছে (মুনকার) বা নিকৃষ্ট কাজ। পৃথিবীকে পাপমুক্ত করে গড়ে তোলার মোক্ষম এক মাধ্যম হচ্ছে, এই “আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার”-এর কার্যক্রম সব সময় চালু রাখা।
‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ ও ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর মধ্যে পার্থক্য
সাধারণত ইসলামের দিকে আহ্বান করাকে বা দাওয়াত দেওয়াকে আরবিতে ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ বলা হয়। ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ ও ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ এ দুয়ের উদ্দেশ্য কিন্তু একই; আর তা হচ্ছে, মানুষদেরকে ভালোর পথে নিয়ে আসা। আর এ দুটি কাজই কিন্তু মুসলিমদের করণীয় কর্মকাণ্ডেরই অংশ বলে গণ্য। তবে ‘আল আমর বিল মারুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’ এবং ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’-এর বাস্তবায়নের ধরন ও উদ্দেশ্য এক হলেও এ দুয়ের মধ্যে বেশ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে কাউকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করলে আর খারাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেওয়াই ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’। এ অবস্থায় যাকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে, তাকে ভালো কাজ করতে কিংবা খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয় না। এ বিষয়ে করা হয় না কোনো জোর জবরদস্তি। পক্ষান্তরে কাউকে ভালোর কাজে দিকে আহ্বান করলে আর খারাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেওয়ার সাথে সাথে তাকে ভালোটি কার্যকর করতে আর খারাপটি বর্জন করতে বাধ্য করা হলে তাকেই ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ বলা হয়। তাহলে বাধ্যবাধকতা থাকা না থাকার কারণেই একটি ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান নাহি আনিল মুনকার’ আর অপরটি ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ভালোটি করা ও খারাপটি বর্জনে বাধ্য করলে তা ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’। আর এটিকে বাধ্য না করলে বরং শুধু এর আহ্বান পৌঁছে দিলে সেটিকে ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ বলা হয়। অন্য দৃষ্টিতেও এ দুয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক রয়েছে। ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ দাওয়াতেরই অংশ, তবে ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’ এর অংশ নয়। সুতরাং এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে, ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ সাধারণত একটু ব্যাপক অর্থাৎ দাওয়াত তারও অন্তর্ভুক্ত। আর ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। সেই দৃষ্টিতে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ যিনি করেন, তিনি একজন দাওয়াত দানকারীও। তবে যিনি শুধু দাওয়াত দেন, তিনি ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ সম্পাদনকারী নন। আসলে ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ ব্যতীত ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ হয়ই না। ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ এর প্রথম সূত্রপাতই হয় এই ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’-এর মাধ্যমে। আর এর চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো হয় ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ কার্যকর করে।
‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ ভালো কাজ সন্দেহ নেই, তবে ইসলাম সম্প্রসারণে ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’- এর কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতাধররা ক্ষমতার মসনদে বসে একটি নির্দেশনার মাধ্যমে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-কে কার্যকর করে যে কাক্সিক্ষত ফল অর্জন করতে পারে, হাজারো দাঈ শত চেষ্টা করেও তা পারে না। ‘সালাত আদায় করো, সালাত কায়েম করো’-বারবার ঘোষণা দিয়েও মানুষকে মাসজিদমুখী করা না গেলেও এ বিষয়ে সংক্ষেপে একটি রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করলে দেখা যাবে, মাসজিদে আর লোক ধরছে না। সুতরাং কোনোকিছু কার্যকর করতে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ প্রয়োগ করে যে ফল পাওয়া যায়, ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’-এর মাধ্যমে তা সচরাচর পাওয়া যায় না। তার অর্থ এটি নয় যে, আমরা ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’-এর কাজ একেবারেই বন্ধ করে দেবো। মোটেও না, এটি অবশ্যই চলমান রাখতে হবে। তবে যেখানে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ চর্চা করার সুযোগ থাকবে, সেখানে শুধু ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’-এর প্রয়োগ করে দ্বীন সম্প্রসারণের সম্ভাবনাময় ফলাফল লাভে ঘাটতি সৃষ্টি বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমাদের লক্ষ্য হবে, দ্বীনী কাজের যথাযথ সম্প্রসারণ। এর জন্য যেটি যখন উপযুক্ত, সেটি তখন প্রজ্ঞার সাথে ঝোপ বুঝে কোপ দেওয়ার মতো মোক্ষমভাবে প্রয়োগ করাই হবে একজন দক্ষ সমাজ সংস্কারকের কাজ।
যাই হোক ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ যে আহ্বান করা কাজকে জোরজবরদস্তি করে কার্যকর করতে বাধ্য করে না, সে প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বাণী অত্যন্ত স্পষ্ট-
‘অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগকারী নও।’[১] সুতরাং যদি ইসলামকে কারো কাছে তুলে ধরা ব্যতীত দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ওই কাজটি করতে কিংবা বর্জনে বাধ্য করার সক্ষমতা দাওয়াত দানকারীর না থাকে, তাহলে শুধু দাওয়াত দিলেই তার দায়িত্ব শেষ। তার ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর স্তরে তার নজর দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এ আয়াত সেদিকেই ইঙ্গিত করে। এ বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করে--
‘আর তুমি তাদের উপর কোনো জোরজবরদস্তিকারী নও। সুতরাং যে আমার ধমককে ভয় করে, তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও।’[২] তিনি আরও ইরশাদ করেন-
‘তুমি তো কেবল সতর্ককারী, আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে হিদায়াতকারী।’[৩] একই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন-
‘দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে।’[৪] সুতরাং এসব আয়াতের পরিচ্ছন্ন শিক্ষা হচ্ছে, ইসলামের দাওয়াতে জোরজবরদস্তির প্রয়োজন নেই। কারণ জোরজবরদস্তি তো হয় মূলত সেসব বিষয়ে, যার প্রভাব অস্পষ্ট ও অজানা থাকে। অথবা যা করতে মানুষের অনাগ্রহের কারণ হয়। পক্ষান্তরে ইসলাম তো হচ্ছে সহজ সরল ওই জীবনব্যবস্থার নাম, যা যেকোনো বিবেক দিয়েই উপলব্ধি করা সম্ভব। এর বিশুদ্ধতা সর্বজনবিদিত। এর শাশ্বত সত্য দিবালোকের মত উদ্ভাসিত। বিভ্রান্ত থেকে এর পরিচ্ছন্ন রাস্তা একেবারেই আলোকোজ্জ্বল। সুতরাং বিশুদ্ধ চিন্তার ধারকদের জন্য এ জীবনব্যবস্থা গ্রহণে জোরজবরদস্তি করার ন্যূনতম প্রয়োজন পড়ে না। তবে কিছু বক্র চিন্তার লোক রয়েছে; প্রবৃত্তির দাসত্বই তাদের উৎসাহিত করে, শয়তান তাদের উসকানি দেয়। তখন প্রয়োজন পড়ে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের অর্থাৎ ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ এর। সুতরাং ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ যেমন ক্ষেত্র বিশেষ প্রয়োগযোগ্য, তেমনি ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’ও ক্ষেত্রবিশেষ কার্যকর প্রয়োজন।
এখানে আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কোনো অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণে কোনো প্রকার জবরদস্তি করা কিন্তু বৈধ নয়; এমনকি কেউ যদি জবরদস্তির কারণে ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে তার উপর ততক্ষণ মুসলিম হওয়ার নিয়মনীতি প্রয়োগযোগ্য বিবেচিত হবে না, যতক্ষণ না সে স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে প্রমাণিত না হবে। সুতরাং জোর করে কাউকে মুসলিম বানানোর কোনো পথ ইসলামে খোলা নেই। আলোচ্য এ আয়াত ‘দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই’-প্রমাণস্বরূপ সেই বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছে। তবে মুসলিম জনপদে অমুসলিমদের প্রকাশ্যে মদ খাওয়া, শূকরের গোশত ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ইসলামের নিষেধাজ্ঞা আর ব্যভিচার ও অশ্লীলতার মতো সমাজকে কলুষিত করার মতো কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি ‘নাহি আনিল মুনকার’ অবশ্যই কার্যকর থাকবে। ইসলাম এগুলো থেকে তাদেরকে বিরত থাকতে বাধ্য করবে, এটিই স্বাভাবিক। মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে কোনোভাবেও এসব করতে তাদেরকে অনুমতি দেবে না। এসব বিষয়ে ইসলাম তাদের জন্য শুধু দাওয়াত দান যথেষ্ট মনে করে না; বরং এসব বর্জনে তাদেরকে অবশ্যই বাধ্য করে থাকে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে তাদের ওপর ‘নাহি আনিল মুনকার’-এর প্রয়োগ অপরিহার্য বলে গণ্য হবে। এ তো গেল অমুসলিমদের প্রসঙ্গ। তবে মুসলিমদের ব্যাপারে কিন্তু বিষয়টি একবারেই ভিন্ন। ইসলাম গ্রহণের পর সকল ইসলামী বিধিবিধান পরিপালন তাদের জন্য বাধ্যবাধকতার আওতায় চলে আসে। তখন কিন্তু তাদের ওপর পরিপূর্ণভাবে ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ প্রয়োগযোগ্য বিবেচিত হয়। একজন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়ে জবরদস্তির শিকারে পরিণত হওয়া বৈধ না হলেও এমন অবস্থায় কোনো মুসলিম ইসলাম থেকে বের হয়ে গেলে তাকে জবরদস্তি তো অবশ্যই; এমনকি তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসারও বিধান রয়েছে। সুতরাং মানুষের ধর্মীয় অবস্থার প্রকারভেদে ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ প্রয়োগের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে একপ্রকার অর্থাৎ জবরদস্তি নেই আর মুসলিমদের ক্ষেত্রে ভিন্ন অন্য প্রকারের অর্থাৎ জবরদস্তির সাথে সাথে শাস্তির নিয়মও কার্যকর হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’
ফসলের ক্ষেতে যথাযথ ফসল উৎপন্ন হওয়ার জন্য যেমন আগাছা পরিষ্কার অপরিহার্য, তেমনি সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের জন্য ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর মাধ্যমে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বাঁধা পাপাচারগুলোকে নির্মূল করাও অপরিহার্য। আমাদের জনপদে গজিয়ে ওঠা পাপাচারের আগাছা পরিষ্কারের জন্য ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ কার্যকর ছাড়া একটি কাক্সিক্ষত সমাজ প্রতিষ্ঠা একবারেই অসম্ভব। ক্ষেতের আগাছা যেমন নিজের থেকেই পরিষ্কার হয় না, এর জন্যে দক্ষ কৃষকের হাতের ছোঁয়ার প্রয়োজন হয়। তেমনি সমাজের পাপাচার নিজের থেকে নিজেই নির্মূল হয় না, কাক্সিক্ষত সমাজ বিনির্মাণে দক্ষ কারিগরের নিরলস পরিশ্রম ব্যয়ের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব হয়। সেজন্য ইসলাম বিশেষ করে মুসলিম জনপদে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কার্যক্রম বলবৎ রাখতে প্রকৃত মুসলিমদেরকে কখনো-বা উৎসাহিত করেছে, আবার কখনো-বা তাদের উপর এটিকে অপরিহার্য করেছে। মোটকথা ইসলাম এ কাজকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করে একে অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছে। একে বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। এটির জন্য ইসলামের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে-
এটি সওয়াব অর্জনের মাধ্যম
একটি হাদিসে অনেকগুলো সওয়াব অর্জনের মাধ্যমের কথা উল্লেখ করে তন্মধ্যে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কথাটিও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এ কাজকে সাদাকার মতো সওয়াবের বলে বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
আবু যর (রা.) নবি (সা.)-সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন-‘আমর বিল মা’রুফ (সৎ কাজের আদেশ) সাদাকা, নাহি আনিল মুনকারও (অসৎ কাজের নিষেধ) সাদাকা।’[৫]
এ প্রসঙ্গে যেমন আরো বর্ণিত হয়েছে-
হুযায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘মানুষ নিজের পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পাড়া-প্রতিবেশীদের ব্যাপারে যে ফিতনায় পতিত হয়-সালাত, সিয়াম, সাদাকা, (ন্যায়ের) আদেশ ও (অন্যায়ের) নিষেধ তা দূরীভূত করে দেয়।[৬] তাহলে স্পষ্ট যে, ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট সাদাকার মতো সওয়াব অর্জনের মাধ্যম হিসেবেই গণ্য। ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার রক্ষাকবচ হিসেবেও বিবেচিত হয়।
ধ্বংস থেকে পরিত্রাণের উপলক্ষ্য
যে সমাজে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ স্থবির হয়ে পড়ে, সে সমাজ পাপ-পঙ্কিলতায় হাবুডুবু খেতে থাকে। আর পাপ-পঙ্কিলতার চূড়ান্ত পরিণতিই হয় ধ্বংস। তাহলে স্পষ্ট যে, ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজই এ ধ্বংস থেকে সমাজকে বাঁচাতে পারে। আর যদি এ কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে জনপদ কঠিন শাস্তির মাধ্যমে ধ্বংস হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। বিশেষ এক জনপদের লোকদের অবস্থাই হয়েছিল এমনটি। সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
‘অতঃপর যে উপদেশ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, যখন তারা তা ভুলে গেল। তখন আমি মুক্তি দিলাম তাদেরকে, যারা মন্দ হতে নিষেধ করে। আর যারা জুলুম করেছে, তাদেরকে কঠিন শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম। কারণ তারা পাপাচার করত।’[৭] এ আয়াতে দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, যারা নাহি আনিল মুনকার’ তথা মন্দ কাজ হতে নিষেধ করার কাজে নিমগ্ন ছিল, তারাই মূলত শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল। পক্ষান্তরে যারা এ কাজ থেকে বিরত ছিল, তারা মারাত্মক শাস্তির মুখোমুখি হলো। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হলো যে, ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজই ধ্বংস থেকে পরিত্রাণের উপলক্ষ্য হিসেবে ভূমিকা রাখে। যতক্ষণ কোথাও এ কাজ চলমান থাকে, সেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়লা কোনো শাস্তি প্রেরণ করেন না। যেমন তিনি ইরশাদ করেন-
‘আর তোমার রব এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে জনপদসমূহ ধ্বংস করে দেবেন, অথচ তার অধিবাসীরা সংশোধনকারী।’[৮] অর্থাৎ ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর মাধ্যমে কোনো জনপদে যখন সংশোধনের কাজ অবিরত চলতে থাকে, সে জনপদ কখনো ধ্বংসের মুখোমুখি হয় না।
‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’-এর কাজ বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে পাপাচার বৃদ্ধি পায়। আর এ ধরনের পাপাচার সমাজকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
জায়নাব বিনতে জাহাশ (রা.)-সূত্রে বর্ণিত, নবি (সা.) একদিন ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়তে পড়তে তাঁর গৃহে প্রবেশ করলেন এবং বলতে লাগলেন-অচিরেই একটি দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি হবে। এতে আরবের ধ্বংস অনিবার্য। ইয়াজুজ ও মাজুজের দেয়ালে এতটুকু পরিমাণ ছিদ্র হয়ে গিয়েছে, এ কথা বলে দুটি আঙুল গোলাকৃতি করে দেখালেন। জায়নাব (রা.) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি ধ্বংস হয়ে যাব? অথচ আমাদের মাঝে অনেক সৎকর্মশীল লোক রয়েছে। নবি (সা.) বললেন- ‘হ্যাঁ, যখন অশ্লীলতা (ফিসক, কুফর এবং ব্যভিচার) বেড়ে যাবে।[৯] সুতরাং সৎকর্মশীলদের উপস্থিতিতেও যদি পাপাচার বিস্তৃতি লাভ করে, তাহলে ধ্বংসই হয় সে জনপদের করুণ পরিণতি। তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো যে, ধ্বংস থেকে পরিত্রাণের বিশেষ উপলক্ষ্য হচ্ছে, এই ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কর্মপন্থা।
শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার কারণ
অন্য কোনো কাজের বিনিময়ে নয়, ঈমান আনার সাথে সাথে এই ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’ তৎপরতায় নিয়োজিত থাকার কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই উম্মতকে অন্যান্য উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মতের মর্যাদায় স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই অধিষ্ঠিত করেছেন। যেমন তিনিই ইরশাদ করেন-
‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। (কারণ) তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’[১০] তাহলে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’- এর কাজ যে এ উম্মতকে অন্যান্য উম্মত থেকে বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে, বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে; তা কিন্তু এ আয়াতে অত্যন্ত স্পষ্ট। আর এর কারণ হচ্ছে, এই ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর প্রয়োগের মাধ্যমে এ উম্মতকে অন্যান্য উম্মতের চেয়ে জ্ঞান-গরিমা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী হওয়ার বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয় হয়ে গড়ে ওঠার পথনির্দেশ করে। অসাধারণ এক স্বাতন্ত্র্য গুণে তাদেরকে গুণান্বিত করে। সে কারণেই ইসলামে এ কাজের এত গুরুত্ব। যাই হোক, যদি এ উম্মত এই ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে নিমগ্ন থাকে, তাহলেই শুধু তারা এই শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারবে। আর যদি এ কাজ থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার এ বিশেষণ তাদের থেকে অবশ্যই বিলুপ্ত হতে বাধ্য। তারা এ কাজ আঞ্জামও দেবে না, আবার শ্রেষ্ঠ উম্মতের তকমা লাগিয়ে বসে থাকবে, তা কিন্তু হওয়ার নয়। সমগ্র পৃথিবীতে আজ শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে তারা যে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার, তার অনিবার্য কারণ হচ্ছে এই ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর তৎপরতা থেকে দূরে থাকা। তারা যতদিন তাদের এ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে শ্রেষ্ঠ উম্মতের বৈশিষ্ট্য পুনরায় অর্জন না করতে পারবে, তাদের অবস্থা ভালো হওয়ার আশা একবারেই অবান্তর। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত দাবি করতে হলে এই ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’ এ কাজে সক্রিয় থাকা ছাড়া সম্ভব নয়। এ কাজে আমাদের অবহেলা করার কারণে সারাটি সমাজ পাপাচারে ডুবে থাকবে আর আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মতের অলীক দাবিতে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলব, তা কোনোভাবেও যৌক্তিক নয়। নির্মোহভাবে মুসলিম জনপদের দিকে তাকিয়ে দেখুন-এমন কোন অপরাধ-অন্যায় রয়েছে, যা মুসলিম জনপদকে আচ্ছন্ন করেনি? চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, আত্মসাৎ, সুদ, ঘুস, মারামারি, হত্যা, অন্যের হক বিনষ্ট করা, মোটকথা এহেন কোনো পাপ নেই, যা সেখানে হচ্ছে না। এরপরও কী আমরা নির্লজ্জভাবে দাবি করব, আমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত!
ঈমানের সক্ষমতা পরিমাপের একটি মাপকাঠির মর্যাদা দান
বিশুদ্ধ হাদিসে এ ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে অংশগ্রহণের সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তার ওপর ঈমানের স্তর নির্ভর করে বলে উল্লেখ হয়েছে-
তারিক ইবনে শিহাব (রা.) সূত্রে বর্ণিত, এটি আবু বকর (রা.)-এর হাদিস। তিনি বলেন- ঈদের সালাতের পূর্বে মারওয়ান ইবনে হাকাম সর্বপ্রথম খুতবা প্রদান আরম্ভ করেন। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, খুতবার আগে হবে সালাত। মারওয়ান বললেন, এ নিয়ম রহিত করা হয়েছে। এতে আবূ সাঈদ (রা.) বললেন, এ ব্যক্তি তো (প্রতিবাদের মাধ্যমে) কর্তব্য পালন করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি- তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে সে যেন হাত দ্বারা এর সংশোধন করে দেয়। যদি এর ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখের দ্বারা। যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর দ্বারা (উক্ত কাজকে ঘৃণা করবে)। আর এটাই ঈমানের নিম্নতম স্তর।[১১] এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, যে মুমিন ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে যত বেশি সক্রিয় থাকবে, তার ঈমান তত মজবুত বলে প্রমাণিত হবে। আর এ কাজে যার দুর্বলতা যত বেশি হবে, তার ঈমান তত দুর্বল বলেই প্রমাণিত হবে। সুতরাং ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ ঈমানের সক্ষমতা পরিমাপের একটি মাপকাঠি।
সুপ্রিয় পাঠকসমাজ, আসুন না এ হাদিসের আলোকে নিজের ঈমানের স্তরটি একটু পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখি। আমার পরিবার, সমাজ, গ্রাম-গঞ্জ, দেশ-রাষ্ট্র ও সমগ্র পৃথিবী যেসব পাপাচার বা মুনকারে আকণ্ঠ ডুবে আছে, সে বিষয়ে আমার অবস্থানটি কেমন? আমার শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী এসব পাপাচার বন্ধ করার জন্য আমি কী আমার সম্ভাব্য শক্তি প্রয়োগ করেছি, না পাছে লোকে কিছু বলে- এই ধারণা করে নিশ্চুপ থেকেছি। নিজের হালুয়া-রুটি বন্ধ হওয়ার ভয়ে কি আমি এসব পাপাচারের সাথে আপস করছি না? অবশ্যই করছি। তারপরও বলুন তো কোন সাহসে আমি নিজেকে পাক্কা ঈমানদার বলে দাবি করছি? আসলে আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। সত্য উপলব্ধি করার সক্ষমতাও যেন দিনদিন লোপ পাচ্ছে। বিশ্বাস করুন, ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কর্মতৎপরতায় আমাদের যে অবস্থান, তাতে আদৌ ঈমানের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট রয়েছে কী না, তা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আমরা যদি এই মুহূর্তেই সতর্ক না হই, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাত দুই কুলই আমাদের কিন্তু হারাতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সমাজে নিষিদ্ধ কাজ প্রতিরোধের ব্যবস্থা না থাকলে নিষিদ্ধ কাজে যারা লিপ্ত নয়, তারাও কিন্তু ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পায় না। একটি হাদিসে প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য উপমার মাধ্যমে বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে-
নুমান ইবনে বাশির (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবি (সা.) বলেছেন- “যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমালঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিলো। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচতলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়) কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙিয়ে যেত। তখন নিচতলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই (তবে ভালো হতো) এমতাবস্থায় তারা যদি এদেরকে আপন ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়, তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা তাদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে), তবে তারা এবং সকলেই রক্ষা পাবে।”[১২] সুতরাং নিষিদ্ধ ক্ষতিকারক কাজ প্রতিহত না করলে যারা সেটি করে আর যারা দেখেও তা করতে নিষেধ করে না, সকলে একই সাথে ধ্বংস হতে বাধ্য হয়। এজন্য কোনোভাবেই ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’- এর কাজে কোনো বুদ্ধিমানের নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ নেই। এ হাদিস আরও প্রমাণ করে যে, নিষিদ্ধ ছোটো কাজকে প্রতিহত করা অব্যাহত না থাকলে তা সম্প্রসারিত হয়ে সমাজের সকলকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। এ দ্বারা আরও বোঝা যায় যে, একটি সমাজকে পাপমুক্ত রাখতে হলে একদল লোককে অবশ্যই এই ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে আত্মনিয়োগ অপরিহার্য।
শ্রদ্ধেয় পাঠক বন্ধুরা, এ হাদিসের আলোকে আমরা আমাদের সমাজের চিত্রটা একটু যাচাই করতে পারি। সমাজে অপকর্মের পাহাড় জমে আছে, সাধারণ লোকের তো বটেই; এমনকি আমরা যারা কিছুটা দ্বীন সম্পর্কে সচেতন, তাদেরও কিন্তু এসব অপকর্ম নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা দেখা যায় না। যারা এসব অপকর্মের হোতা, তাদের সাথে আবার সম্পর্কের অবনতি ঘটে কিনা, সেই ভয়ে আমরা উচ্চবাচ্য কিছুই করি না। তাদের অপকর্মের কারণে আমাদের জাহাজরূপী এই সমাজ ছিদ্র হয়ে যে আমাদের সবাইকে নিয়ে সমুদ্রের গহিন তলদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে, সেই সত্যটি আমাদের আর কবে উপলব্ধিতে আসবে? ডুবে মরার পরে? ধিক আমাদের এ বিবেককে, এ উপলব্ধিকে!
এ কাজ থেকে বিরত থাকা দুআ কবুলের পথ রুদ্ধ করে দেয়
আমাদের সমাজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মাসজিদে মাসজিদে এত্থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। তারপরও এর ধ্বংসলীলা থেকে আমরা বাঁচতে পারি না। এর অন্যতম কারণ ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে গাফিলতি। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে-
হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.)-সূত্রে বর্ণিত যে, নবি (সা.) বলেছেন-“যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার শপথ! তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে থাকো, নতুবা অচিরেই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর তাঁর শাস্তি নিপতিত করবেন। তখন তোমরা তাঁর নিকট দুআ করবে, কিন্তু তিনি তোমাদের দুআ কবুল করবেন না।”[১৩] সুতরাং একটি সমাজকে বিভিন্ন ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা করার অন্যতম মাধ্যম এই ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে সক্রিয় থাকা। তাহলে দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনা। একে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
সফলতা লাভের অন্যতম উপলক্ষ্য
একে অনন্ত কিয়ামতে সফলতার অন্যতম উপলক্ষ্য বলেও আল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে-
“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়-যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।”[১৪] আমরা সকলেই সফলকাম হওয়ার স্বপ্ন দেখি। তবে ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ মোটেও কিন্তু করি না। কেউ সামান্য ‘আমর বিল মা’রুফ’-এর কাজ করলেও কারো বিরাগভাজন হতে হবে এই ভয়ে ‘নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে একবারেই নির্লিপ্ত থাকি। এ ধরনের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মার্কা কাজ করে সফলতার আকাক্সক্ষা কতটুকু সংগত, তা বিচারের ভার পাঠক বন্ধুদের ওপরই অর্পণ করলাম। উল্লেখ্য, এ কাজকে কিছু লোকের জন্য যে অত্যাবশ্যক করে দেওয়া হয়েছে, এ আয়াতে কিন্তু সে বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। সুতরাং বিষয়টিও প্রমাণিত হলো যে, এই উম্মতের মধ্যে কিছু লোক হলেও যাতে সর্বদা এ কাজে নিয়োজিত থাকে, সেই বিষয়টি ইসলাম গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছে। আমদের একটা বদভ্যাস আছে, সফলতার আকাক্সক্ষায় বুক বাঁধি ঠিকই, তবে সফলতার শর্ত পূর্ণ করি না। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল পেতে হলে ভালো প্রস্তুতির কি কোন বিকল্প আছে? নিশ্চয় নেই। তাহলে সাফলতার অন্যতম শর্ত যদি এ আয়াত অনুযায়ী ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের অবস্থাটা কী? মনে মনে কী এই আশাই করছি যে, এ কাজ না করেই সফলতা লাভে ধন্য হব! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার শপথ! এ কাজে কোমর বেঁধে নামলেই সেই সফলতা আশা করা যাবে, অন্যথায় নয়।
সৎকর্মশীল হওয়ার জন্য এ কাজে অংশগ্রহণ অপরিহার্য
নিঃসন্দেহে সৎকর্মশীল হওয়া একটি মহৎ গুণ। একটি আয়াতে এ ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজের মাধ্যমেও যে সৎকর্মশীল হওয়ার পথ সৃষ্টি হয়, সেই সত্যটি ফুটে উঠেছে। যেমন আল্লাহ ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেন-
“তারা সমান নয়। আহলে কিতাবের মধ্যে একদল ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তারা সিজদাহ করে। তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।”[১৫] এ আয়াতে অন্যান্য আরও কয়েকটি কাজের সাথে সাথে ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর বিষয়টিও উঠে এসেছে, যে কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে একজন মুমিন সৎকর্মশীল হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে। সুতরাং এ কাজের যে অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে, এখানে সেই সত্যটিই বিকশিত হয়েছে।
‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’ বর্জনে অভিসম্পাত অনিবার্য হয়
নিশ্চয় পূর্বের আলোচনা থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-কে ইসলাম বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছে। এ কাজ সম্পাদনের জন্য যাদের কাছে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, তাদেরকে কোনোভাবেও এত্থেকে বিমুখ হওয়ার সুযোগ নাই; বরং একটি বর্ণনায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ কাজ না করলে তার জন্য অভিসম্পাতপ্রাপ্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে বলে উল্লেখ হয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
আবদুল্লাহ ইবনে (রা.)-সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “সর্বপ্রথম বনু ইসরাঈলদের মাঝে খারাবি এভাবে সৃষ্টি হয় যে, যখন তাদের এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে মিলিত হতো, তখন বলত-আল্লাহকে ভয় করো এবং খারাপ কাজ পরিহার করো। কেননা তোমার জন্য এরূপ করা উচিত নয়। এরপর সে ব্যক্তি পরদিন তার সাথে মিলিত হতো, কখনো সে তাকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে না বলে বরং সে তার খাদ্য-পানীয় ও বৈঠকে শরিক হতো।
যখন তারা এরূপ করল, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরকে পরস্পরের সাথে মিশ্রিত করে দেন। এরপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন-“মহান আল্লাহ বানু ইসরাঈলদের মাঝে যারা কুফুরি করেছে, তাদের ওপর দাউদ ও ঈসা (আ.)-এর ভাষায় অভিসম্পাত করেছেন।” এরপর তিনি বলেন-তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। তোমরা অত্যাচারীর দু’হাত ধরে তাকে জুলুম থেকে সত্যের প্রতি সেরূপ ফিরিয়ে দেবে, যেরূপ ফিরিয়ে দেওয়া উচিত এবং তাদেরকে সত্যের ওপর সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করবে।”[১৬] এ হাদিস জলজ্যান্ত সাক্ষী যে, বানু ইসরাঈল ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে শিথিলতা দেখানোর কারণে তাদের ওপর দাউদ ও ঈসা (আ.)-এর পক্ষ থেকে অভিসম্পাত দেওয়া হয়েছিল। যারা আজও এ কাজে শিথিলতা দেখাবে, তাদের ওপর সেই অভিসম্পাত বর্ষিত হতে থাকবে।
ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ
মূলত একটি বর্ণনায় এ কাজকে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
হুজাইফা (রা.) নবি (সা.)-সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-“ইসলামের আটটি অংশ রয়েছে। ইসলাম একটি অংশ, সালাত একটি অংশ, জাকাত একটি অংশ, কাবা ঘরে হজ করা একটি অংশ, সিয়াম একটি অংশ, আমর বিল মা’রুফ একটি অংশ, নাহি আনিল মুনকার একটি অংশ, জিহাদ একটি অংশ। সে-ই ব্যর্থ হলো, যার কোনো অংশ নেই।”[১৭] এ বর্ণনা দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’ কার্যক্রমে অংশীদার না হলে অবশ্যই ব্যর্থতায় পর্যভূষিত হতে হবে। সুতরাং দিবালোকের মতো পরিষ্কার হলো যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি ‘আনিল মুনকার’ কোনো হেনতেন বিষয় নয়; বরং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা এ উম্মাতের প্রতি সদস্যের কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
উল্লেখ্য, এ কাজে সফলতার জন্যে ধৈর্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যেমন আল্লাহ তায়ারা ইরশাদ করেছেন-
“হে আমার প্রিয় বৎস! সালাত কায়েম করো, সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে, তাতে ধৈর্য ধরো। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।”[১৮] এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে, ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজ সহজ কোনো কাজ নয়। এ কাজে বিপদ ও বাধা আসাটাই স্বাভাবিক। আর সে বাধা উত্তরণের জন্য ধৈর্যই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
উপসংহার
মূলত এ উম্মতের প্রতিটি সদস্যই ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কর্মী। প্রকৃত ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে কোনো তালবাহানা করে বা ওজর-আপত্তি তুলে এ কাজ ত্থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। স্রােত যেমন নদীকে বাঁচিয়ে রাখে, স্রােত রুদ্ধ হয়ে গেলে নদী তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। ইসলামী সমাজকেও ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’ বাঁচিয়ে রাখে। এই ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে নিঃসন্দেহে ইসলামী সমাজও তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে দেউলিয়া হয়ে যাবেই যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং আর বসে থাকা নয়, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে যার যেমন যোগ্যতা, তার সবটুকু উজাড় করে ‘আল আমর বিল মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল মুনকার’-এর কাজে আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন। অন্যথায় কিয়ামতে জবাবদিহির জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে লজ্জিত হতে হবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচার আর কোনো পথ থাকবে না। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে ‘আমর বিল মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার’-এর হক আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র :
১. সূরা আল-গসিয়াহ : ২১-২২
২. সূরা কাফ : ৪৫
৩. সূরা আর-র’দ : ০৭
৪. সূরা বাকারা : ২৫৬
৫. মুসলিম, ২য় খণ্ড, ১৫৮পৃ.
৬. মুসলিম, ২য় খণ্ড, ৩৫০পৃ.
৭. সূরা আ’রাফ : ১৬৫
৮. সূরা হূদ : ১১৭
৯. বুখারি, ১১ খণ্ড. ১৩৩ পৃ.
১০. সূরা আলে ইমরান : ১১০
১১. মুসলিম, ১ম খণ্ড, ৫০ পৃ.
১২. বুখারি, ৮ম খণ্ড, ৩৯৯ পৃ.
১৩. তিরিমিজি, ৪র্থ খণ্ড, ৩৮ পৃ.
১৪. সূরা আলে ইমরান : ১০৪
১৫. সূরা আলে ইমরান : ১১৩-১১৪
১৬. আবূ দাঊদ, ৪খ. ২১৩পৃ.
১৭. আল বাযযার, ৭ খণ্ড, ৩৩০পৃ.
১৮. সূরা লুকমান : ১৭
আপনার মন্তব্য লিখুন