জগতে ঈদের মতো এমন নির্মল উৎসব দ্বিতীয়টি নেই। অন্যকোনো জাতির তো নেই-ই, মুসলমানদেরও নেই। আনন্দ এবং আধ্যাত্মিকতার এ এক বিস্ময় সমাবেশ। ঈদ এমন একটি উৎসব, যে উৎসবে সহসা হেসে ওঠে মানুষ। সহজে আনন্দ প্রকাশ করে। একজন আরেকজনের সাথে মিলেমিশে প্রকাশ করে সুখ, হয়ে যায় একাকার। সকল কাজকর্মকে ছুটি দিয়ে কেবল ঈদের আনন্দে জেগে ওঠার বিষয়টিই অন্যরকম।
‘ঈদ’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আনন্দের ঘ্রাণ! শব্দটি দেখা বা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনের আকাশে হেসে ওঠে একফালি নতুন চাঁদ। স্বচ্ছ আকাশ কিংবা মেঘের ফাঁকে সরু, বাঁকা চাঁদটি গোটা দুনিয়ার মুসলিম সমাজে খুশির নোটিশ! মুহূর্তে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। রোজাদার বয়সীরা তো বটেই, শিশু-কিশোররা আরও বেশি মাত্রায় উৎসবমুখর। হোক এশিয়া, হোক ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা আফ্রিকার কোনো দুর্গম অঞ্চল। শাওয়ালের নতুন চাঁদ আকাশে উঁকি দিলেই হেসে ওঠে মুসলিম সমাজ। শুরু হয় আনন্দের মহা ধুমধাম। সন্ধ্যা থেকেই অপেক্ষা একটি সকালের। কোন সে সকাল? সকালটি হলো ঈদের সকাল। এ অপেক্ষাটি জাগিয়ে দেয় শাওয়ালের চাঁদ। ঈদের চাঁদটিই আনন্দের ইঙ্গিত!
মাসজুড়ে রমজানের সাওম পালন করা চোখ যখন চাঁদের মুখে পড়ে, ভেতর জগতটি এক অপার্থিব সৌরভে ভরে ওঠে। নিজেকে মনে হয় ভীষণ ভাগ্যবান! শ্বাসের সাথে মহান রবের প্রতি বেরিয়ে আসে গভীর কৃতজ্ঞতার স্বর- আলহামদুলিল্লাহ্! কারণ সকল প্রশংসা কেবল তাঁরই হবে, যিনি অনুগ্রহ করে সিয়ামের মাস দিয়েছেন, দিয়েছেন সিয়াম সাধনার সুযোগ। মাসব্যাপী রোজা পালন শেষে যখন ঈদ আসে, মনে হয়- আহা জীবন কত সুন্দর! কত আনন্দের! কত মায়াবী! একটি অপার্থিব পবিত্র ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সবার মাঝে সেই ভালোবাসার ছায়া বিস্তৃত হয়ে ওঠে। ফলে জীবনকে নতুন করে দেখার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। মন বড়ো হয়ে ওঠে। হৃদয়টি হয়ে পড়ে উন্মুক্ত। তখন যেন মনের দশ দিগন্ত খুলে খুলে যায়।
ঈদ শব্দের সঙ্গে যে ঘ্রাণ লুকিয়ে আছে, একে শুঁকলেই ভরে ওঠে মন। ভরে ওঠে বুকের গহীন। আমরা ঈদের ঘ্রাণ শুঁকি। শুঁকে শুঁকে হৃদয়-মন ভরে তুলি। ভরপুর হয় আমাদের ভেতর জগৎ। বলে উঠি- এই তো ঈদ এসেছে আমাদের কাছে, আমাদের পরিবার ও সমাজের কাছে। আজ আমরা ঈদের নির্মল পবিত্র আনন্দে নিজেদের এগিয়ে নেবো আরও একধাপ। ঈদের ঘ্রাণ কোনো ফুলের ঘ্রাণের মতো নয়! এটি ফুলহীন এক বিস্ময় ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমরা একটি মাস সিয়াম সাধনা করি। সিয়ামের আধ্যাত্মিক সৌরভ আমাদের জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিকার মহান রবের বান্দা হয়ে ওঠার মাধ্যম হলো সিয়াম সাধনা। সেই সিয়ামের শেষ সীমানায় অবস্থান করে ঈদ। ঈদের আগমনের সাথে সাথে ইতি ঘটে সিয়ামের। শুরু হয় ঈদের সন্ধ্যা এবং পবিত্র রজনী। পবিত্র ঘ্রাণে আমরা মুখর হই। সজীব হয় আমাদের জীবন। উজ্জীবিত হয় পরিবার ও সমাজ। গোটা জীবনের ওপর যেন ছড়িয়ে পড়ে ঈদের সুখ। ‘ঈদ’ শব্দটিই আমাদের একটি আনন্দ ধ্বনি! এ ধ্বনির ভেতর রয়েছে পবিত্রতা, রয়েছে আধ্যাত্মিক চৈতন্যের উচ্ছ্বাস, রয়েছে মুসলিম জাতির এক আধ্যাত্মিক আনন্দের চেতনা।
ঈদ আসলে কি? ঈদ হলো আনন্দের ঢেউ, সুখের উত্তাপ, দিনগুলোর মধ্যে একটি উত্তম দিন। নির্মল নিষ্কলুষ এক উৎসব। ঈদ কেনো এলো আমাদের কাছে? প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। না, আমি ঈদের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বর্ণনা করছি না। মূলত ঈদ হলো মানুষের প্রতি মহান রবের একটি অসাধারণ উপহার। এ উপহার এমনই সৌন্দর্য ছড়ায়, যার সাথে আর কোনো উৎসবের মিল নেই। এতটা বিস্তারও নেই আর কোনো উৎসবের। এত ব্যাপক এর পরিধি এবং প্রভাব, যা সহজে আঁচ করা যায়। ছোটো-বড়ো,নারী-শিশু, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ধনী-গরীব, এতিম-মিসকিন, ফকির, মুসাফির কেউ কি বাদ যায়? এমনকি কেউ অসুস্থ থাকলেও নিজেকে শরীক করে ঈদ আনন্দে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এত ব্যাপক প্রভাবের মাধ্যমে ঈদ কি দেয় আমাদের? ঈদ আমাদের দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি দেয়। পরস্পরের মাঝে ঈমানী ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। দূর করে হিংসা-বিদ্বেষ। যদি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়; তো সে পরিবেশ হবে জান্নাতী পরিবেশ। এমনটি হলে তবেই আমাদের ঈদ পালন ইবাদতে গণ্য হবে। আল্লাহ তায়ালার আদেশেই আমরা ঈদের আনন্দ উদযাপন করি। সুতরাং ঈদ শুধু আনন্দের নয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও। যদি ঈদ উদযাপন নির্মল হয়, যদি মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য হয় ঈদ উৎসব; তবে এ আনন্দই ইবাদত।
এবার প্রশ্ন হতে পারে- ঈদ সংস্কৃতি কি? ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি শুনলেও একটি অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠে। অনুভূতিটা একটি পরিশীলিত সৌন্দর্যের, একটি নান্দনিক ঐশ্বর্যের, একটি সুস্থ নির্মল জীবনের রূপ। একই সাথে সংস্কৃতি হলো- জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার-ব্যবহার-রুসম বা নিয়ম, রুচিশীল জীবনের ধারা। সংস্কৃতি উন্নত বিশ্বাসের নাম, যে বিশ্বাস মানুষকে মানুষ করে তোলে। যে বিশ্বাস সকল কিছুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মহান স্রষ্টার দিকে একনিষ্ঠ হয়। প্রকৃত অর্থে মহান রবের রঙে রাঙা হওয়ার নামই উন্নত সংস্কৃতি।
লেখক : বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার।
আপনার মন্তব্য লিখুন