সৃষ্টির ধর্মই হলো ইসলাম। পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, গ্রহ-তারা-নক্ষত্র, জীব-জানোয়ার এই বিশ্বে যা কিছু আছে এমনকি আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবকিছুই মুসলিম, আর মুসলিম না হয়ে উপায়ও নেই। অর্থাৎ প্রকৃতির রাজ্যে সবাই আল্লাহর বিধান মেনে চলছে। শুধু মানুষের রয়েছে ভিন্ন আর একটি সত্তা যেটাকে বলা হয় নৈতিক সত্তা অর্থাৎ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ-উপলব্ধি এবং এ কারণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ। মানুষের মাঝে বিবেকবোধের পাশাপাশি দান করা হয়েছে কিতাব ও রাসূল যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেওয়া হয়নি। সবাই আল্লাহর দেওয়া নিয়মের অধীন। আল্লাহর সকল সৃষ্টি ও আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা আল্লাহ মানুষকেই কেবল দান করেছেন। এসব সৃষ্টিকে কল্যাণ ও অকল্যাণ সকল কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। যদি আল্লাহর নাফরমানি বা অকল্যাণকর কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে জমিনসহ অন্যান্য সৃষ্টি এবং হাত-পা-জিহবা, চোখ-কান আল্লাহর আদালতে সাক্ষ্য দিবে, কারণ আল্লাহই তাদেরকে সেই নির্দেশ প্রদান করবেন।
আল্লাহপাক তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন যার কারণে মন্দ কাজে বিবেক তিরস্কার করে। বিবেক-বুদ্ধির পাশাপাশি দান করেছেন নবী ও রাসূল। আদম (আ) প্রথম মানুষ হওয়ার সাথে সাথে ছিলেন একজন নবী। সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীরা ছিলেন মুসলিম। মুসলিম অর্থ অনুগত অর্থাৎ যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলে তারা মুসলিম (অনুগত) এবং যারা অমান্য করে তারা কাফের (অমান্যকারী)। আমরা নিজেদের পরিচয় দেই ‘মুসলিম’ বলে অর্থাৎ আমরা আল্লাহর অনুগত এবং এই মুসলিম নামকরণ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। তাঁর বাণী, ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হও। আল্লাহ তোমাদের নামকরণ করেছেন ‘মুসলিম’ পূর্বেও এবং এই কিতাবেও, যাতে করে এই রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হয় আর তোমরাও সাক্ষী হও মানবজাতির উপর।’- (সূরা হজ : ৭৮)।
হজরত ইবরাহিম (আ) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ)-কে সাথে নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের দু’জনকেই তোমার প্রতি ‘মুসলিম’ (অনুগত-আত্মসমর্পিত) বানাও, আর আমাদের বংশধরদের থেকেও তোমার প্রতি একটি ‘মুসলিম উম্মাহ’ (অনুগত জাতি) বানাও’- (সূরা বাকারা : ১২৮)। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সবাই ইবরাহিম (আ)-এর বংশধর কিন্তু আল্লাহপাক ইবরাহিম (আ)-কে উপস্থাপন করেছেন এভাবে- ‘ইবরাহিম ইহুদিও ছিল না, নাসারাও (খ্রিষ্টান) ছিল না, বরং সে ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’- (সূরা আলে ইমরান : ৬৭)। সর্বাবস্থায় নিজের পরিচয় এভাবে প্রদান করা হয়েছে, ‘বলো, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই। এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমিই প্রথম মুসলিম’- (সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩)।
নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী সবাই নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ঈসা যখন তাদের থেকে কুফরি অনুভব করলো, তখন তাদের বললো, আল্লাহর পথে কারা হবে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারিরা বললো, আমরা হবো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম। তুমি সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী)’- (সূরা আলে ইমরান : ৫২)। তিনি আরো বলেন, ‘ঐ ব্যক্তির চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে এবং নিজে আমলে সালেহ করে আর বলে, নিশ্চয়ই আমি একজন মুসলিম (আল্লাহর অনুগত)’- (সূরা হামিম আস সাজদাহ : ৩৩)।
আল্লাহপাক সতর্ক করে দিয়েছেন, মুসলিম না হয়ে যেন তাঁর কাছে ফিরে না আসা হয়। তাঁর বাণী, ‘হে ইমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যেভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত এবং মুসলিম না হয়ে মরিও না।’- (সূরা আলে ইমরান : ১০২)। সাথে সাথে তাঁর অনুগত (মুসলিম) বান্দাদের জান্নাতের ওয়াদা প্রদান করেছেন। তাঁর বাণী, ‘যারা আমার আয়াতসমূহের উপর ঈমান এনেছিলে এবং মুসলিম হয়েছিলে, সেদিন তাদের বলা হবে, হে আমার বান্দারা, আজ তোমাদের কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুঃখও আজ তোমাদের স্পর্শ করবে না। তোমরা দাখিল হও জান্নাতে তোমাদের স্ত্রী/স্বামীকে নিয়ে আনন্দচিত্তে।’- (সূরা যুখরুফ : ৬৮-৭০)। ঈমানদার জনগোষ্ঠীর একটিই প্রার্থনা, তাদের মৃত্যু যেন হয় মুসলিম অবস্থায়। জাদুকরদের ঈমান আনার পর ফেরাউন বলেছিল, আমি বিপরীত দিক থেকে তোমাদের হাত ও পা কেটে দেবো, সেই শাস্তি ঘোষণার পর জাদুকরদের দোয়া ছিল, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের সবর করার শক্তি দাও এবং আমাদের মৃত্যু দান করো মুসলিম হিসেবে।’- (সূরা আ’রাফ : ১২৬)। ইউসুফ (আ)-এর দোয়া ছিল, ‘এই পৃথিবীর জীবনে এবং আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক! মুসলিম হিসেবে আমাকে মৃত্যু দান করো এবং আমাকে সাথি বানিয়ে দাও সালেহ লোকদের।’ (সূরা ইউসুফ : ১০১)।
মুসলিম হিসেবে নামকরণ, মুসলিম পরিচয় দান, মুসলিম না হয়ে মরার ক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শন, মুসলিম হিসেবে মৃত্যু কামনা করা, মুসলিমদের সুসংবাদ দান ইত্যাদি নানা বিষয়ে অসংখ্য আয়াতের মধ্য থেকে এখানে কুরআনের কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হয়েছে। মূলত আল্লাহপাক তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের মুসলিম হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন এবং এটিই আমাদের পরিচয়। এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। আমাদের মাঝে নানা ফেরকা ও বিভক্তি সবই শয়তানের চালবাজি। দুর্ভাগ্য, আজ আর আমরা মুসলিম পরিচয়ে গর্ববোধ করি না। আমরা এখন পরিচয় দেই: শিয়া-সুন্নি, আহলে কুরআন, আহলে হাদিস, হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি, হাম্বলি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, আরো কত কী? শুধুই কি তাই? মসজিদগুলো পর্যন্ত পৃথক করে ফেলেছি। আমরা একটু ভেবে দেখি, আমাদের এই বিভক্তি কী নিয়ে? ফরজ-ওয়াজিবে আমাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য সুন্নাত-মুস্তাহাব নিয়ে। মুস্তাহাব আমলের মাঝে পার্থক্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা.-এর আমলেই ছিল। উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তি হলো নামাজ। আল্লাহর বাণী, ‘তারা যদি তওবা করে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।’ (সূরা তওবা : ১১)। কোনো ব্যক্তি তওবা করে এবং দু’টি মৌলিক ইবাদত নামাজ ও জাকাত পালন করে তাহলে সে ইসলামী সমাজে অন্যান্য মুসলমানের মতো সামাজিক ও আইনগত সকল অধিকার ভোগ করবে।
নামাজে সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হলো মুসলমানদের মাঝে পরস্পর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে এসে ইমামের পেছনে আদায়ের মাধ্যমে প্রমাণ করে যে তাদের মাঝে আছে শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও ভ্রাতৃত্ব। নামাজে মুক্তাদির কোনো ভুল নেই, ভুল তখনই হবে যদি ইমামের আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটে। আবার ইমামের ভুল হতে পারে। সেই ভুলের সহনীয় মাত্রা কতখানি। ফরজে ভুল হলে নামাজ পুনরায় আদায় করতে হবে। ওয়াজিব ছুটে গেলে ইমাম সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে এবং সহু সেজদার মাধ্যমে তা সংশোধন করতে হবে। এরপরে সুন্নাত-মুস্তাহাবের ভুল অতটা ধর্তব্য নয় অর্থাৎ নামাজ হয়ে যাবে। অথচ যত বিরোধ সেই সুন্নাত-মুস্তাহাব নিয়ে এবং তা নামাজিদের মধ্যেই। বেনামাজির কোনো ভুল নেই এবং তাদের মাঝে ঝগড়া-ঝাঁটিও নেই। যেসব আমল নিয়ে দলাদলি বা মতপার্থক্য করে সেগুলি পালনে বড়জোর সুন্নাতের সওয়াব পাবে কিন্তু দলাদলি ও অনৈক্যের কারণে কুফরির গুনাহ হবে।
মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও দলাদলি আল্লাহপাকের বড়োই অপছন্দ। তাঁর ভাষায়, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে। যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদেরকে বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই অস্বীকৃতির বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫-১০৬)। দলাদলি, ফেতনা-ফাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, একেবারে কুফরির অপরাধ। কোনো উপলব্ধি নেই। হাত বাঁধা, আমিন জোরে বা আস্তে বলা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন নামাজিরা। কিন্তু নামাজ আদৌ না পড়া, ঘুষ ও সুদের সাথে জড়িত হওয়া, ওজনে কম ও ভেজাল দেওয়া-এসব নিয়ে কোনো বিবাদ নেই বা মসজিদ থেকে বের করে দেওয়ার কথাও শোনা যায় না। সকল মাজহাব ও আহলে হাদিস সত্যাশ্রয়ী এবং দলিলভিত্তিক। যেহেতু অমৌলিক বিষয় সেহেতু দলাদলি না করে এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ছাড়াই নিজ নিজ পছন্দমতো মাজহাব অনুসরণ করা যায়, এমনকি নিজ মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুসরণ করারও সুযোগ রয়েছে।
আল্লাহপাক চান তাঁর অনুগত (মুসলিম) বান্দা পুরোপুরি তাঁকে মেনে চলুক। আংশিক মানা অর্থ তাঁকে মানার পাশাপাশি শয়তানকেও মানা। তাঁর বাণী, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা : ২০৮)। আমাদের সমাজে নিরেট নাস্তিকের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। মানুষ মূলত শিরক করে থাকে। আল্লাহকে মানার পাশাপাশি তার নফস, মানবরূপী শয়তানসহ আরো অনেককে মানে। অথচ আল্লাহর দাবি, ‘আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো।’ (সূরা নাহল : ৩৬)। আংশিক মানা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি দ্বীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখেরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব।’ (সূরা বাকারা : ৮৫)। আমরা এখন রয়েছি ভয়াবহ জিল্লতির মধ্যে। আমরা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতকেই মনে করি দ্বীন। অথচ আমাদের ব্যবহারিক জীবনটা একেবারেই কদর্যপূর্ণ। আমাদের চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে ইসলাম সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আমাদের নেতা-নেত্রী, আইন-আদালত ও ব্যবসায়ী শ্রেণি অনর্গল মিথ্যা বলে। অথচ আমাদের নবী সা. বলেছেন, মিথ্যা সকল পাপের মা। তিনি আরো বলেছেন, আমার উম্মতেরা সব পারে কিন্তু মিথ্যা বলতে পারে না ও বিশ^াসঘাতকতা করতে পারে না। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানত রক্ষা এ জাতি ভুলেই গেছে। এই যাদের চরিত্র তাদেরকে মুসলিম মনে করার প্রশ্নই উঠে না। নিরেট মুনাফিক বৈ আর কিছু নন। আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ হবে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। দুর্ভাগ্য, তারা সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক না হয়ে হয়েছে ঘৃণার পাত্র।
আল্লাহপাক এই মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রাখবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)। আদেশ দান করতে হলে কর্তৃত্বের অধিকারী হতে হয়। আল্লাহ ঈমানদারদের নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান। নবীর সা. উত্তরাধিকার হিসেবে ঈমানদারদের একই দায়িত্ব এবং সেটি হলো দ্বীন কায়েম করা। আকিমুস সালাত যেমন নামাজ কায়েম করা ফরজ তেমনি আকিমুত দ্বীনও (দ্বীন কায়েম) ফরজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সে বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নুহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহি করে পাঠিয়েছি, উপরন্তু যার আদেশ আমি ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম, তোমরা এ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না।’ (সূরা শূরা : ১৩)।
দ্বীন কায়েমের প্রশ্নে কোনো মতপার্থক্য করার সুযোগ নেই। দ্বীন কায়েমের কাজ একাকী বা বিচ্ছিন্নভাবে করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। সংঘবদ্ধতার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে করা উচিত আর মুসলমান না হয়ে মরো না। তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০২-১০৩)। প্রশ্ন উঠতে পারে, আলেমরা এতো বিভক্ত এবং এতগুলো ইসলামী দল- মানুষ কোন দলে যাবে? নবীর সা. নেতৃত্বে একাধিক দলের কোনো সুযোগ ছিল না এবং সেখানে দল ছিল একক। কিন্তু নবীর অনুপস্থিতিতে একাধিক দল থাকতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আখেরাতে নাজাত যদি জীবনের লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে পরস্পর সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি থাকতেই হবে। যারা উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করবে তাদের কুফরির পরিণতি ভোগ করতে হবে (সূরা আলে ইমরান : ১০৫-১০৬)। আর ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর দিকে যদি আহবান জানানো হয় তাহলে আল্লাহর বাণী স্মরণ করতে হয়, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইবে, তার থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)।
মুসলিম (অনুগত বান্দা) সেই যে ইসলামকে আল্লাহপাক প্রদত্ত একমাত্র দ্বীন হিসেবে বিশ^াস করে, সর্বোত্তম জীবনাদর্শ হিসেবে মেনে চলে এবং দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালায়। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো আদর্শের অধীন একটি মুহূর্তও সন্তুষ্ট জীবন যাপন করে না। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, দান-খয়রাত সব আছে কিন্তু এই হতভাগা ইসলামের বিজয় চায় না বা ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তার কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টাও নেই, সেই ব্যক্তি নিরেট মুনাফিক বৈ আর কিছু নন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূলুল্লাহ সা.-এর পেছনে নামাজ পড়েছে এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিও করেছে, কিন্তু হৃদয়ে ছিল ইসলামের শত্রুতা। তাই সে হলো মুনাফিক সরদার। আল্লাহপাক ঈমানদার ও কাফেরকে স্পষ্টভাবে চিত্রায়িত করেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে, আর যারা কুফরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। সুতরাং তোমরা লড়াই করো শয়তানের বন্ধুদের সাথে। নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল।’ (সূরা নিসা : ৭৬)। দু’টি পক্ষ স্পষ্ট, মাঝামাঝি কোনো পক্ষ নেই, যদি থাকে তাহলে সেটা হবে সুবিধাবাদী। এই চরিত্রের মানুষগুলো সময়ে থাকে ঈমানদারদের সাথে আবার থাকে কাফেরদের সাথে, এরাই মূলত মুনাফিক। আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ
আপনার মন্তব্য লিখুন