post

ইতিহাস পাঠ ও নিরীক্ষায় মাওলানা মওদূদীর দৃষ্টিভঙ্গি

জামান আহমেদ

০৫ মে ২০২৪

মাওলানা মওদূদী (রহ.) তাঁর সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে একজন ঐতিহাসিকও ছিলেন। তিনি ইতিহাস ভিত্তিক বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। এগুলো তাঁকে একজন দক্ষ ও সুক্ষ্ম চিন্তার অধিকারী ঐতিহাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সাধারণত ইসলামি বিশ্ব থেকে যারা ইতিহাস চর্চা করেন, তারা তখন অতিমাত্রায় ধর্মপ্রবণ হয়ে পড়েন। ফলে মুসলিম ইতিহাসের ভুলত্রুটি পর্যালোচনায় তারা খুব কম সময় ব্যয় করেন। কিন্তু বিজয়ের সংবাদ প্রচারে তারা ব্যাপক দক্ষ নাবিকের ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়াও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারী ঐতিহাসিকগণ অনেকাংশে ইতিহাসকে হাদিসের মতো করে পাঠ করার প্রতি মন্তব্য জানিয়েছেন। বিশেষ করে, খিলাফত ও তার পরবর্তী সময়কালের ইতিহাস ব্যাখ্যায় তারা হাদিসের মতো করে পরখ করার কথা জানিয়েছেন। এদিক থেকে মাওলানা মওদূদী (রহ.) ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সাহস, গবেষণার স্বচ্ছতা ও সত্য প্রকাশে অনড় অবস্থান তাঁকে ইতিহাসের ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। তিনি ইতিহাসকে সরাসরি হাদিসের মতো করে পরখ করেননি; বরং ইসলামের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকিহ ও মুফাসসিরদের   বরাত দিয়ে তিনি ইতিহাসকে ইতিহাসের স্বতন্ত্র জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি হাদিসের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের উদ্দেশ্য ও কার্যকরণ নিয়ে লিখেছেন, “মুহাদ্দিসরা হাদীস যাচাই-বাছাইয়ের এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন মূলত বিধিবিধানের হাদিসের ব্যাপারে। কারণ, হালাল-হারাম, ফরজ, ওয়াজিব, মাকরুহ ও মোবাহর মতো গুরুত্বপূর্ণ শরিয়ত সংক্রান্ত বিষয়াদির ফয়সালা হয় এরই ওপর। দ্বীনে কোনটি সূন্নাহ আর কোনটি সুন্নাহ নয়, তাও জানা যায় এরই দ্বারা।” [খেলাফত ও রাজতন্ত্র, পৃষ্ঠা : ২৬০]

এ ছাড়াও, ঐতিহাসিক সনদ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যারা জোরকদম চালিয়েছেন, তাদের সমালোচনা করে মাওলানা মওদূদী (রহ.) লিখেছেন, “ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ব্যাপারেও যদি এ সকল শর্ত আরোপ করা হয়, তবে ইসলামের ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায়ের তো প্রশ্নই ওঠে না; বরং প্রথম যুগের ইতিহাসের কমপক্ষে এক-দশমাংশ অনির্ভরযোগ্য বলে পরিগণিত হবে।  আমাদের বিরোধীরা যে সকল শাস্ত্রের শর্ত সামনে রাখে, সে সকল কীর্তিকে প্রনিধানের অযোগ্য বলে আখ্যায়িত করবে- যা নিয়ে আমরা গর্ব করি। কারণ, হাদীসের মূলনীতি এবং আসমাউর রেজাল বা চরিত শাস্ত্র যাচাই-বাছায়ের মানদণ্ডে তার অধিকাংশই উত্তীর্ণ হয় না। এমনকি একেকটি বর্ণনা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি থেকে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সনদ পরম্পরায় বর্ণিত হয়েছে- পরিপূর্ণ, এ শর্তে রাসূলুল্লার পূত-পবিত্র জীবন চরিতও সংগ্রহ করা যায় না।” [খেলাফত ও রাজতন্ত্র, পৃষ্ঠা : ২৬০]

আধুনিককালের স্কলার ও ইতিহাস গবেষকগণ যেভাবে ইতিহাস সনদ নির্ণয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, এতে তাদের অবস্থান যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মারাত্মক ভুল তা বলা বাহুল্য। তাদের সমালোচনায় মাওলানা দেখিয়েছেন ইসলামের প্রথম শতকের মুহাদ্দিস, ফকিহ ও মুফাসসিরগণ তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে হাদিস ও ইতিহাসের বর্ণনার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে ইসলামি বিশেষজ্ঞগণ হাদিসের ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তিকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করলেও আবার একই ব্যক্তির বর্ণনা ইতিহাসের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছেন। যেমন : ইতিহাসে ওয়াকেদি এবং সাইফ ইবনে ওমর এদের মতো অন্যান্য রাবিদের যাচাই-বাছাই শাস্ত্রের সেরা মনীষীদের উক্তি উদ্ধৃত করে জোর দিয়ে এ দাবি করা যায় যে, কেবল হাদীসের ক্ষেত্রেই নয়; বরং ইতিহাসের ব্যাপারেও এদের কোনো বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সে সকল ইমামদের গ্রন্থ থেকে যাচাই-বাছাই করে ইমামদের এ সকল উক্তি উদ্ধৃত করা হয় যে, তাঁরা কেবল হাদিসের ব্যাপারে এদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইতিহাস, যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনি এবং জীবন-চরিতের ব্যাপারে এ সকল আলেম তাঁদের গ্রন্থে যা কিছু লিখেছেন, তারা এদের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। 

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানির কথাই ধরা যাক। তাঁর ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থ থেকে চরিত শাস্ত্রের ইমামদের সমালোচনার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে শুধু ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতেই নয়; বরং বুখারীর ভাষ্য ফতহুল বারীতেও তিনি যখন যুদ্ধের কাহিনি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করেন, তখন তাতে স্থানে স্থানে ওয়াকেদি, সাইফ ইবনে ওমর অন্যান্য দুর্বল বর্ণনাকারীদের উক্তি দেদারসে উদ্ধৃত করেছেন। এমনিভাবে হাফেজ ইবনে কাসীর তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়ায় আবূ মেহনাফ-এর কঠোর নিন্দা করেছেন। তিনি নিজেই ইবনে জারীর তাবারীর ইতিহাস থেকে বহুবার সে সকল ঘটনার উল্লেখও করেছেন, যা তিনি বর্ণনা করেছেন এদেরই উদ্ধৃতি দিয়ে। অন্যদিকে, ইমাম শাফেয়ী একদিকে ওয়াকেদিকে কট্টর মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করেন, অপরদিকে ‘কিতাবুল উম্ম’-এ তিনি যুদ্ধ অধ্যায়ে তাঁর বর্ণনা থেকে দলিল উপস্থাপন করেছেন।

মাওলানা মওদূদী (রহ.) লিখেছেন, ‘বিষয়টা এমন নয় যে, এরা চক্ষু বন্ধ করে এ সকল দুর্বল বর্ণনাকারীদের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। আসলে তাঁরা এদের সমস্ত বর্ণনা প্রত্যাখ্যানও করেননি। আবার সবটুকু গ্রহণও করেননি। আসলে তাঁরা এ সবের মধ্য থেকে যাচাই বাছাই করে কেবল তাই গ্রহণ করতেন, যা তাঁদের নিকট গ্রহণ করার যোগ্য। এর সমর্থনের আরও অনেক ঐতিহাসিক তথ্যও তাঁদের সামনে থাকত। ঘটনা পরম্পরার সাথে সামঞ্জস্যও পাওয়া যেত। এ কারণে ইবনে সাআদ ইবনে আবদুল বার, ইবনে কাসীর, ইবনে জারির, ইবনে আসির, ইবনে হাজার আসকালানি এবং এদের মতো অন্যান্য নির্ভরযোগ্য আলেমরা তাঁদের গ্রন্থে দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে যে সকল বিষয় বর্ণনা করেছেন, তা প্রত্যাখ্যান করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাঁরা দুর্বল এবং ধারাবাহিকতা বহির্ভূত সনদে যেসব বিষয় গ্রহণ করেছেন বা বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন, সেসব নিছক ভিত্তিহীন, কল্পকাহিনি মাত্র, তাই তা ছুড়ে ফেলে দিতে হবে- এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণেও কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।’ [খেলাফত ও রাজতন্ত্র, পৃষ্ঠা : ২৬১]

ইতিহাস ব্যাখ্যার উল্লেখিত অবস্থানকে সামনে রেখে মাওলানা মওদূদী (রহ.) তাঁর ‘খেলাফত ও রাজতন্ত্র’ বইটি লিখেছেন। এই বইতে তিনি দুর্দান্ত ভাষায় দক্ষ হাতে খেলাফতকালীন রাজনৈতিক কাঠামো ও তার পরবর্তী চালু হওয়া রাজতন্ত্রের অবস্থান ও পরিবর্তনের বাস্তবিক কারণ অনুসন্ধান করেছেন। বর্তমান মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে মাওলানার মত হচ্ছে, এটি রাসূল (সা.) ও তাঁর পূণ্য খলিফাদের আদর্শ ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। ইসলামের রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন হয় যখন খেলাফত রাজতন্ত্রে পরিণত হয় এবং ধর্মের সামাজিক ভূমিকাকে সংকুচিত করা হতে থাকে। ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজের ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং একধরনের ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ শুরু হয়। ফলে নেতৃত্বের মধ্যেও বিভাজন দেখা দেয় এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব পৃথক হয়ে পড়ে। মাওলানা মওদূদী (রহ.) মুসলিম সমাজের এই আত্মঘাতী বিবর্তনের কথা খেলাফত ও রাজতন্ত্র গ্রন্থে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।

ইতিহাসের সকল আঙ্গিক পূর্ণতাপ্রাপ্ত  মাওলানার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে, ‘সালজুক রাজত্বের ইতিহাস’। আলোচ্য বই লেখার ক্ষেত্রে মাওলানা মওদূদী (রহ.) সালজুকদের সমকালীন রচিত আকরগ্রন্থসমূহ অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে তারীখে বায়হাকী, যায়নুল আখবার, যুবদাতুন নুসরা, রাহাতুস সুদুর, তারীখুল কামেল, ওয়াফাইয়াতুল আইয়ান, আল মুখতাসার ফী আখবারিল বাশার, তারীখে গুজীদাহ, রওজাতুস সাফাহ, হাবিবুস সিয়ার, মুখতাসারে সালজুকনামা, তারীখে সালাজুকায়ে কিরমান, তবকাতে নাসেরী গ্রন্থসমূহ অন্যতম। তিনি তাঁর বইয়ের শুরুতেই উৎস গ্রন্থগুলোর প্রামাণিকতা নিয়ে আলাপ করেছেন। সালজুকদের শ্রেষ্ঠতম সময়গুলোর সুন্দর উপস্থাপনার পাশাপাশি তাদের চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। পুরো বইটি তিনি সমাপ্ত করতে না পারলেও বইয়ের শুরুতে দীর্ঘ প্রবন্ধ জুড়ে পুরো সালজুক সাম্রাজ্যকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলেন।

এ ছাড়াও, মাওলানা মওদূদীর ‘মোগল সাম্রাজ্য পতনের ইতিহাস’ নামে একটি বই বাংলাদেশে আধুনিক প্রকাশন থেকে বের হয়। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসকরা কয়েক শতাব্দী শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের শাসনামল পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্য ছিল অপরাজেয়। আরওঙ্গজেবের পর এ বংশের শাসকদের অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা ও বিলাসিতার কারণে এ সাম্রাজ্যের ভিতের মাঝে ফাঁটল ধরে। দেখা দেয় বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা। উন্মুক্ত হয়ে পড়ে ধ্বংসের দুয়ার। ছোবল হানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অবশেষে চরম অপমানকর অবস্থায় অবসান ঘটে এই বিরাট সাম্রাজ্যের। মাওলানা মওদূদী জামায়াত গঠনের পূর্বে মুসলমানদের ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ পরিকল্পনারই অংশ তাঁর গ্রন্থ “দক্কিন কী সিয়াসী তারীখ”। পরবর্তী সময়ে ইসলামী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করার কারণে সাইয়েদ মওদূদী (রহ.) তাঁর ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তবে উক্ত শিরোনামে তাঁর লিখিত ইতিহাসের যে অংশটুকু প্রকাশ হয়েছে, তাতে মোগল সাম্রাজ্য পতনের কার্যকারণসমূহ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়।

বিংশশতাব্দীর মুসলিম উম্মাহর প্রভাবশালী স্কলার হিসেবে মাওলানা মওদূদী (রহ.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি একইসাথে বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও রেখেছিলেন বিশাল ভূমিকা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী এখনও বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। একাধারে ধর্মতত্ত্ব, উসুল, তাফসির, হাদিস থেকে শুরু করে দ্বীন ইসলামের সকল গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিভিত্তিক জায়গায় তিনি ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি, একজন ঐতিহাসিকের ভূমিকায়ও তাঁর কলম ছিল সমান সজাগ। বেশ কয়েকটি ইতিহাসের বই নিয়েও তিনি কাজ করেছেন, যার ব্যাপারে ইতোপূর্বে ধারণা দেওয়া হয়েছে। তাঁর সমকালীন ঐতিহ্যিক ধারার আলেমগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমালোচনা পেশ করলেও সেগুলো ছিল সমকালীন বিবেচনায় গুরুত্বহীন বা অবিবেচনা প্রসূত। যদিও তাঁর সমালোচকরাও ছিল ইলমি দিক বড় স্কলার। মাওলানার সাথে তাঁদের প্রধানত পার্থক্য ছিল দৃষ্টিভঙ্গিজাত এবং ভৌগলিক পরিসীমা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

লেখক : চিন্তক ও সংগঠক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির