post

গণকমিশনের শ্বেতপত্র ও বাংলাদেশের আলেমসমাজ

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

১৩ জুন ২০২২

বিতর্কিত সংগঠন ঘাদানিক এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক ককাসের উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে ‘গণকমিশন’ নামে একটি কথিত কমিশন শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। ‘বাংলাদেশে  মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক কথিত শ্বেতপত্রটি গত ১২ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোড়ক উন্মোচন করেছেন। এর দুই মাস পরে গত ১২ মে দুপুর ১২টায় এই শ্বেতপত্রটি দুদক চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রকাশের সাথে জড়িতদের ভাষ্যমতে এখানে ১১৬ জন আলেম ও ১০০০ মাদরাসা সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়েছে।  দেশের শীর্ষস্থানীয় ১১৬ জন আলেমের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং তাদের ভাষ্যমতে ধর্মব্যবসায়ীদের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

ঘাদানিক ‘গণকমিশন’ গঠন করে সম্মানিত নাগরিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের উপরে তদন্ত করেছে বলে দাবি করছে। বিষয়টি লক্ষণীয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ২৭ মতে দেশের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। আইনের আশ্রয় লাভের সমান অধিকারী। ধারা ৩২ মতে কোনো নাগরিককে জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ধারা ৪৩ মতে প্রত্যেক নাগরিক তল্লাশি থেকে ও যোগাযোগমাধ্যমের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারী। এই ধারাসমূহ ও সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ধারা ২৬ থেকে ধারা ৪৭ এ বর্ণিত মৌলিক অধিকার অংশের মূল বক্তব্য হলো, নাগরিকের স্বাধীনতা, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে রাষ্ট্র বাধ্য। সংবিধানের দাবিমতে, দেশের কোনো নাগরিক অন্য কোনো নাগরিকের উপরে অনুসন্ধান, গোয়েন্দাগিরি ও তদন্ত করতে পারে না। তাদের কার্যক্রমের নাম তারা দিয়েছে ‘তদন্ত’। কিন্তু তদন্ত সংক্রান্ত কোড অফ দ্য ক্রিমিনাল প্রসিডিউর- (১৮৯৮) এর ধারা ৪ এর ১ উপধারা অনুসারে তদন্ত করার জন্য কোন অথরাইজড ব্যক্তি প্রয়োজন। এই বিবেচনায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও তুরিন আফরোজ গং যা করেছেন তা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক ধারণার স্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সাথে তারা কোনো অথরাইজড পারসন বা সংস্থা না হয়েও ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ শিরোনামে কিছু প্রকাশ করার মাধ্যমে আইনগত অনধিকার চর্চা করেছেন; যা নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ এবং জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। আদতে তাদের এই শ্বেতপত্র প্রকাশ সংবিধানবিরোধী। নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতার  ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত মানবিক মর্যাদা নীতির প্রতি অশ্রদ্ধা। এই কথিত কমিশনের তদন্ত ও শ্বেতপত্রের নৈতিক ও আইনত কোনো ভিত্তি নাই। বরং এটা সংবিধান, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা মানবিক মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অপরাধ।

কথিত শ্বেতপত্রের প্রধান উপজীব্য করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসকে এবং সে জন্য দায়ী করা হয়েছে উলামায়ে কেরামকে। এখানে বিবেচ্য বিষয় দু’টি। এক. বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা আসলেই বিরাজমান কিনা এবং দুই. সাম্প্রদায়িক সংঘাতের নামে যা দেখানো হয় তাতে আদৌ ধর্মের কোন সংযোগ আছে কিনা এবং ওলামায়কেরাম সেখানে কোন ধরনের ভূমিকা পালন করেন কি না? সত্যনিষ্ঠ যে কেউ স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব নেই। এখানে হাজার বছর ধরে মন্দির-মসজিদ একসাথে অবস্থান করছে। হাজার বছর ধরে সকল ধর্মের ধর্ম-কর্ম পাশাপাশি পালিত হয়। এখানে এটা চিরসত্য। হ্যাঁ, কালে-ভদ্রে সম্প্রদায়কেন্দ্রিক কিছু অশান্তি দেখা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও সত্য হলো, এর প্রতিটিতে স্থানীয় রাজনীতি, ভূমি ও স্বার্থের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট সংঘাতকে ধর্মীয় চেহারা দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী যে, প্রতিটি ঘটনায় ওলামায়েকেরাম বরাবরই শান্তির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এসব সর্বজনস্বীকৃত। দেশের সরকার, সত্যনিষ্ঠ মিডিয়া এমনকি বিশ্বশক্তিসমূহও এ ব্যাপারে একমত। তারপরও চিহ্নিত কিছু গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে দেশের প্রধান ইস্যু করে তোলে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করতে চায়। বৈশ্বিক হানাদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। আলোচ্য শ্বেতপত্রটি তারই একটি বর্ধিত অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন।

শ্বেতপত্র প্রকাশকারীরা অনেক আগে থেকেই জাতির কাছে ইসলামবিদ্বেষী, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, অনৈতিক ও দেশ-বিদেশী ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়নকারী হিসেবে পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। কথিত ভুঁইফোঁড় সংগঠন গণকমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একজন বিতর্কিত নীতিহীন ব্যক্তি হিসেবে জাতির কাছে পরিচিত। তিনি নিজেই বলেছেন, ইসলাম সম্পর্কে তার তেমন জ্ঞান নেই। তাহলে এমন অজ্ঞ মানুষ কিভাবে বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামদের ধর্মব্যবসায়ী বলে আখ্যায়িত করতে পারে তা বিবেকবান মানুষের বোধগম্য নয়। তিনি বিচার বিভাগের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। জাতীয় সংসদে তাকে নিয়ে তুমুল সমালোচনা করেছে এই সরকারের এমপিরাই। তাকে একজন সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান স্যাডিস্ট বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি অবসরে যাওয়ার পরে রায় লেখার মতো বিচারিক অনৈতিকতার সাথে জড়িত। বিমানের বিজনেস ক্লাস না পাওয়া নিয়ে তুলকালাম করা, অবসরে যাওয়ার পরেও সরকারি বাড়ি দখল করে রাখার মতো বেআইনি, অনৈতিক ও নিম্ন রুচির কাজ তিনি করেছেন। তিনি নৈতিকতার চূড়ান্ত বলি দিয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি ব্রিটেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

অন্যদিকে তার সাথে থাকা আরেক বিতর্কিত ও গণধিকৃত মুখ ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। যিনি প্রশ্নবিদ্ধ আওয়ামী ট্রাইব্যুনালের পিপি ছিলেন এবং পিপি থাকা অবস্থায় অনৈতিক কাজে জড়িত থাকা প্রমাণ হওয়ার পর বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে একজনকে ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির চেষ্টা করেছিলেন। এরপরই তাকে আওয়ামী লীগের বানানো যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি তুরিন আফরোজের মা নিজের মেয়ের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে সম্পত্তি দখল, মাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া, হুমকিধমকি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাসায় গোপনে বহু পুরুষ সমাগমের অভিযোগ করে বিচার চেয়েছিলেন। 

ঘাদানিক এত আয়োজন করে বিশাল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, ঘাদানিককে অর্থায়ন করে কারা? কোন স্বার্থে কোন শক্তি ঘাদানিক পোষে? ঘাদানিকের আয়-ব্যয়ের হিসাব কী কোথাও প্রকাশিত হয়েছে বা আদৌ কি তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনতা জানে? এ প্রশ্নের জবাব ঘাদানিককে দিতে হবে। ঘাদানিক প্রজাতন্ত্রের মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশের এসপিদের বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে বলে জোর গলায় বলে আসছে। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে বা কোনো তদন্ত করতে হলে রাষ্ট্রীয় অনুমতি প্রয়োজন হয়। প্রশ্ন হলো, ঘাদানিক কি আদৌ কোনো অনুমতি নিয়েছে? যদি নেয় তাহলে তারা সেই অনুমতি পায় কি করে? আর যদি অনুমতি না নিয়ে থাকে তাহলে কোন সাহসে তারা রাষ্ট্রীয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নজরদারি ও তদন্ত করে। ঘাদানিকের এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময়, প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু বিবেচনায় এটাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই একটি গোষ্ঠী জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করে এবং বৈশ্বিক হানাদার শক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করার অপচেষ্টা চালায়। ঘাদানিকের এই প্রচেষ্টাকে তারই একটি বর্ধিত অংশ আকারে বিবেচনা করা যায়। জাতি বিস্মিতবোধ করছে যে, এ রকম একটা অনৈতিক ও আইনি ভিত্তিহীন প্রতিবেদন যেখানে দেশের সম্মানীয় নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের মানহানি করা হয়েছে, তা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোড়ক উন্মোচন করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এমন একটা অসাংবিধানিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী একটা প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন। কেউ এর আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি, এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করছেন না। এটা জাতিকে হতবাক করেছে।

মৌলবাদী তৎপরতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সাথে এ দেশের আলেম-ওলামাদের কখনো কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং এখনো নেই। দেশের আলেমসমাজ সর্বদাই দেশ ও জাতির পক্ষে। তারা ঈমান, ইসলাম, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ইসলামী সংস্কৃতির পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। দেশে একযোগে বোমা হামলা করে যখন নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, তখন আলেমসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। 

আলেম-ওলামারা ধর্মীয় ও সামাজিক খেদমতসহ বিভিন্ন অঙ্গনে যে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে, তা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওলামায়েকেরাম ধর্মীয় শিক্ষা, ইসলামী সভ্যতা, ঈমান-আকিদা এবং কুরআন সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে সৎ, চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক ও সুনাগরিক তৈরি করার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো একটি কুচক্রী মহল স্বাধীনতার পর  থেকেই আলেমদের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে আসছে। 

ওয়াজ মাহফিল এ দেশের হাজার বছরের একটি সংস্কৃতি। ওয়াজ মাহফিল শান্তি-সমৃদ্ধি, আদর্শ সমাজ গঠন ও সমাজ সংস্কারের অন্যতম মাধ্যম। এর মাধ্যমে মানুষকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করা হয়। সমাজের সকল অনাচার, অন্যায় এবং ভুল থেকে ফিরিয়ে মানুষকে সৎপথে ও কল্যাণের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ইসলামী আলোচকগণ ধর্মের বিশুদ্ধ বার্তা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বহুমুখী ত্যাগ তিতিক্ষা করে থাকেন। এ সংস্কৃতি ধ্বংস করতে যারা কাজ করছে তারা আর যাই হোক, দেশপ্রেমিক হতে পারে না।

বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা হাজার বছর ধরে চলমান স্বীকৃত একটি শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার পাশাপাশি দেশপ্রেম, সৃষ্টির সেবা, সবর, শোকর, আত্মিক গঠন, ইনসাফ, ন্যায়পরায়ণতা, উম্মাহবোধ, উত্তম চরিত্র গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা শেষ করা আলেমগণ বছরজুড়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে সাধারণ মানুষকে ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে পরকীয়া, ধর্ষণ, নারীবিদ্বেষ, নারী নির্যাতন, দুর্নীতিসহ নানাবিধ অপরাধ নির্মূল করতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

মাদরাসা শিক্ষা ইসলাম প্রচার ও সামাজিক পুঁজি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান  রেখে আজ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। যার ফলে দেশবিরোধী একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে এই শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। যারই অংশ হিসেবে গণকমিশন নামীয় সংগঠন  মাদরাসার তালিকা করে গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। 

বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা নিয়ে এক শ্রেণির অ্যালার্জি নতুন কিছু নয়। কিন্তু মাদরাসাসমূহের বিরুদ্ধে  কোন অভিযোগ অতীতে কখনো প্রমাণ করতে পারেনি। আলোচিত শ্বেতপত্রে ১০০০ মাদরাসার উপরে তদন্ত করেছে। জাতি চায় এই তদন্ত প্রতিবেদন জনসাধারণে উপস্থাপন করা হোক। তাহলে  দেখা যাবে, মাদরাসাগুলো কত অল্প খরচে সততার সাথে হাজারো শিক্ষার্থীর দায়িত্বভার বহন করে চলছে। দেখা যাবে কতটা স্বচ্ছতার সাথে মাদরাসাগুলো সোশ্যাল সেফটিনেটের কাজ করে যাচ্ছে। দেখা যাবে কতটা অল্প বাজেটে কত বেশি মানুষকে কার্যকরভাবে সেবা দেওয়া যায় তার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। কওমি মাদরাসা নিয়ে অ্যালার্জিগ্রস্ত গোষ্ঠীকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাদের অসততা, মিথ্যাচার, হিং¯্রতা, বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা ও একচোখা দাজ্জালীয় দৃষ্টিভঙ্গি বারংবার প্রমাণিত।


দুদকের বক্তব্য 

বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়ন, ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো, অর্থপাচার, ওয়াজের নামে টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ইসলামপন্থী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ১১৬ জনকে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকে যে শ্বেতপত্র দিয়েছে ‘গণকমিশন’- তা নিয়ে এখনই কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না দুদক।

কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান ১৮ মে’ ২০২২ বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে, শ্বেতপত্রটি পর্যালোচনার পর কোনো উপাদান পাওয়া গেলে তা নিয়ে তদন্তের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 

সাঈদ মাহবুব খান বলেছেন, ‘গণকমিশন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু তথ্য উপাত্ত দিয়েছে আর শ্বেতপত্রটিও বিশাল। এগুলো পর্যালোচনা করে সেখানে দুদকের আইনে অর্থ পাচার বা কর ফাঁকিসহ অন্য কোনো অপরাধ প্রতীয়মান হলে তখন তদন্ত করে দেখা হবে।’


এনায়েত উল্লাহ আব্বাসীর বিরুদ্ধে মামলা

গত ১৪ মে সোমবার ফেসবুকের একটি টকশোতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন প্রকাশিত ২ খণ্ডের শ্বেতপত্র নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল ‘১১৬ জন আলেম নিয়ে অভিযোগ বিশ্লেষণ’। টকশোতে হাজির ছিলেন এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী, সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সদস্যসচিব (গণকমিশন) ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার। ভার্চুয়াল সংযোগের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত টকশোটি ফেসবুকে প্রচারিত হয়। সেখানে ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গির সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দেওয়ায় ইসলামী বক্তা ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। ১৭ মে মঙ্গলবার রাতে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন। ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী বক্তব্যের এক পর্যায়ে জঙ্গি শব্দটা ‘জাং’ থেকে এসেছে জানিয়ে শাব্দিক অর্থে মুক্তিযোদ্ধারাও যে এক অর্থে জঙ্গি বলে মন্তব্য করেন বলেই এই মামলা করা হয়েছে। মামলায় ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসীকে এক নম্বর অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক সাইফুর রহমানকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। 

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সন্তানদের জঙ্গির সঙ্গে তুলনা করে ধৃষ্টতা দেখিয়ে এনায়েত উল্লাহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের  চেতনার বিরুদ্ধে স্পষ্ট  প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালিয়েছেন। বীর মুক্তযোদ্ধাদের ও তাদের অবদানকে অপমান ও অপদস্থ করেছেন। যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২১/২৮/২৯/৩৫ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ।


গণকমিশনের শ্বেতপত্রের বিরুদ্ধে ইসলামী দল ও আলেমসমাজের প্রতিবাদ

দুর্নীতি দমন কমিশনে গণকমিশনের ইসলামী বক্তাদের নাম দেওয়া ও তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠন।

১২ মে এক বিবৃতিতে হেফাজত আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, “ঘাদানিকের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত গণকমিশন নামে এ ভুঁইফোঁড় সংগঠনটি বরাবরের মতোই নিজেদের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে। তাদের এ শ্বেতপত্র যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্যে ভরপুর, এটি পুরো দেশবাসীর সামনে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন প্রকাশিত ২ খণ্ডের শ্বেতপত্রটিকে ‘ভুলে ভরা’ ও ‘সত্যের অপলাপ’ বলে মন্তব্য করেছে শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা।’ ১৮ মে বুধবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, ৫ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এই শ্বেতপত্রটি নিরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা। এতে তারা দেখতে পেয়েছেন, গত ২ দশকের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমেই প্রায় ৯০% তথ্য এখানে সঙ্কলিত করা হয়েছে; এবং এক্ষেত্রে চূড়ান্ত অসততা ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে এসব পুরাতন তথ্য যাচাই, সম্পাদনা বা হালনাগাদও করা হয়নি। ফলে এই শ্বেতপত্রের পাতায় পাতায় অসংখ্য ভুল তথ্য, অর্ধসত্য ও নানা রকম অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়েছে।

জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি নুরুল হুদা ফয়েজী মন্তব্য করেন,  ‘গণকমিশন’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক শ্বেতপত্র ভিত্তিহীন এবং সংবিধানের মৌলিক ধারণার স্পষ্ট লঙ্ঘন। ১৬ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘গণকমিশন’ কর্তৃক দেশের সম্মানিত ১১৬ জন আলেম ও ১০০০ মাদরাসার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং ইসলাম ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের প্রতিবাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি জননেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেছেন, আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে অবস্থান মূলত ইসলাম ও দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। তথাকথিত গণকমিশন কর্তৃক দেশের শীর্ষ আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১৭ মে মঙ্গলবার রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান ফুলবাড়িয়ায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ। বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন।

১৪ মে রাতে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামের রায়গঞ্জ হাইস্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমুদ্রে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, দেশের খ্যাতিমান ওলামায়ে কেরামদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বলে গালিগালাজ করে দেশবিরোধী ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী গণকমিশন দেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। ওলামায়ে কেরাম জাতির জাগ্রত বিবেক। তিনি বলেন, দুর্নীতি করে যারা নিজেদের কলাগাছ নয়, বটগাছে পরিণত করেছে এবং দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে, বিদেশে পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এতে সহজেই অনুমেয় যারা আলেম ও মাদরাসার বিরুদ্ধে কাজ করছে, তারা ইসলাম, দেশ ও মানবতার শত্রু। এদের বয়কট করতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

১৩ মে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি শায়খুল হাদিস আল্লামা মনসুরুল হাসান রায়পুরী বলেছেন, ‘গণকমিশন গণদুশমন’। তারা এদেশের ইসলামপ্রিয়, দেশপ্রেমিক ও শান্তিপ্রিয় উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে দুদকে শ্বেতপত্র জমা দিয়ে এদেশের সকল শান্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে দুশমনি  ঘোষণা করেছে।

১৫ মে জাতীয় তাফসীর পরিষদ গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলেছে, ওলামাদের বিরুদ্ধে গণকমিশনের ভূমিকা দেশে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করবে।

১৪ মে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল রাজিবুর রহমান এক যৌথ প্রতিবাদবার্তায় জানান- চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী, দুর্নীতিগ্রস্ত, চাঁদাবাজ ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের কর্তৃক জঙ্গিবাদে অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কাল্পনিক অভিযোগ এনে ১১৬ বরেণ্য আলেমের তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দেওয়ার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। 

এছাড়াও গণকমিশন কর্তৃক ১১৬ জন ওয়ায়েজিন ও বিশিষ্ট আলেমদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ, ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ ও নাস্তিক-মুরতাদ নির্মূল কমিটিসহ অনেক ইসলামী দল। 

এই শ্বেতপত্র প্রকাশ সংবিধানবিরোধী। নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত মানবিক মর্যাদা নীতির প্রতি অশ্রদ্ধা। এই কথিত কমিশনের তদন্ত ও শ্বেতপত্রের  নৈতিক ও আইনত কোনো ভিত্তি নেই। তাই যারা কথিত শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে দেশের সম্মানিত আলেমদের সম্মানহানি করেছে, আলেমদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, দেশবাসীর সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে; তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে চায় তাদের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। 

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির