post

জ্বালানি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

১২ আগস্ট ২০২২

বাংলাদেশের মানুষ এখন অতিমাত্রিক বিপদ আর বহুমুখী সঙ্কটের সম্মুখীন। প্রতিটি সূর্যোদয়ের সাথে তাদের সামনে হাজির হচ্ছে এক একটি নতুন সঙ্কট। মানুষ এমনিতে দ্রব্যমূল্য, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহন, লোডশেডিং সমস্যায় জর্জরিত। এর ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে জ¦ালানি তেলের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি। জীবনযুদ্ধে আশাহত নাগরিকদের গল্পগুলো আজ বড়ো করুণ আর্তি হয়ে বাতাসে গুঞ্জরণ তোলে। এখানে কেউ আশার বাণী শোনাতে পারছে না। চারিদিকে ঘনঘোর আঁধারের মাঝে আলোকের দেখা মেলার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। একটি দুঃসংবাদের সাথে আরো দশটি কঠিন সংবাদ তাদের জীবনকে বড় কঠিন করে তুলছে। জীবনের রুঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে নিরীহ মানুষগুলো। বড় আজব এবং বিচিত্র এ দেশের মানুষের সহ্যশক্তি। তাদের প্রতিবাদের ভাষাগুলো বোবা হয়ে গেছে। জনৈক মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। আমি জানি না, মন্ত্রীর বেহেশত সম্পর্কে কতটুকু  ধারণা আছে। তবে তিনি এ দেশের মানুষের অনুভূতি শক্তিগুলো আত্মস্থ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়! চারিদিকে হাজারো সমস্যার পাহাড়। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ে, গ্যাসের মূল্য বাড়ে, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি হয়, তেলের মূল্য দফায় দফায় বাড়ে। জ্বালানির মূল্য এক লাফে দেড়’শ গুণ বাড়ে। তার সাথে বেড়ে চলে গাড়ি ভাড়া এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। দেশ চলছে, সরকার চলছে, রাষ্ট্র চলছে। কোথাও যেন কোনো সমস্যা নেই। দিনের ভোট রাতে হচ্ছে, কেউ তো প্রতিবাদ করছে না। যারা প্রতিবাদ করছে তাদেরকে সাধারণ মানুষ ভাবতে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কষ্ট হয়। প্রতিবাদী মানুষগুলো, বিএনপি, জামায়াত কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী-ওরা সাধারণ জনগণের অভিধায় পড়ে না। আসলেই মানুষ বেহেশতে আছে? 

জাতীয় কবির বিখ্যাত কবিতার একটি লাইন সবারই জানা ‘জাহান্নামে বসিয়া আমি হাসি পুষ্পের হাসি’। কবি এই জাহান্নাম বলতে যেমন পরজগতের কঠিন শাস্তির জায়গাকে বোঝাননি। এমনিভাবে মন্ত্রীও অবশ্যই বেহেশত বলতে পরজগতের মহা পুরস্কারের স্থানকে বোঝাননি। দুনিয়াতে আমরা যখন জান্নাত আর জাহান্নাম শব্দটি ব্যবহার করি তখন তার অর্থ হয় অতি কষ্টের স্থান এবং অতি সুখের স্থান। তবে দুনিয়ার জীবনের অতি সুখ আর অতি দুঃখের সাথে পরবর্তী জীবনের সেই জান্নাত জাহান্নামের তুলনা চলে না। আমাদের প্রেরণা ও জাতীয় জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দ্রোহের গান গেয়ে জাতিকে জাগ্রত করেছিলেন। ব্রিটিশের অবৈধ দখলদারিত্ব আর জুলুমের বিরুদ্ধে জাতীয় কবির দ্রোহ জাতিকে গোলামির জিঞ্জির ভাঙার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। ব্রিটিশরা আমাদের শোষণ করেছে, শাসন করেছে, আমাদের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। আমাদের কথা বলার অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছিলো। আজ ব্রিটিশের শাসনের চেয়ে কতটুকু ভালো আছি আমরা? তখন বিদেশীরা শাসন করতো এখন দেশী লোকেরা শাসন করছে। আমাদের দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে তারা ব্রিটেনে নিয়ে গিয়ে তা জমা করেছে এখন সুইস ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে।

দেশের মানুষের অর্থ লুণ্ঠন হয় নানাভাবে, নানা আয়োজনে। কখনো উন্নয়নের নামে, কখনো সেবার নামে, কখনো বাণিজ্যের নামে, কখনো প্রকল্প বরাদ্দের নামে। এগুলো জায়েজ করার জন্য আবার নিত্যনতুন প্রকল্প হাজির করা হয়। রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ধারী অনেকেই ক্ষমতার স্পর্শে কোনো ব্যবসা এবং পরিশ্রম ব্যতীতই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ অর্থ রাখার জন্য তাই অনেকেই কানাডার বেগমপাড়া আর সুইস ব্যাংককে নিরাপদ স্থান ভাবছে। সুইস রাষ্ট্রদূত নাতালিয়া চুয়ার্ড এক সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। অবশ্য তিনি এটি বলতে ভুল করেননি যে, সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাংকই অবৈধ অর্থ রাখার নিরাপদ স্থান নয়। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে তারা অবশ্যই সেই অর্থ বৈধ করার জন্য কোনো মেকানিজম ব্যবহার করেছেন। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রা।  বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। এক বছরে যদি এই পরিমাণ অর্থ জমা হয়, তবে গত এক দশকে কী পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে তা বোঝার জন্য বড় মাপের অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়। এ অর্থ কিভাবে কার নামে জমা হয়েছে তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে যেমন নেই, সরকারের তথ্য সংগ্রহের আগ্রহও নেই। তাই হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু করেছে। 

রাজনীতি নামক সেবার জায়গাটি এখন কিছু দুর্নীতিবাজ আর লুটেরার অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। পাড়ার উঠতি বয়সের মাস্তান যখন দলীয় কোনো পদ বাগিয়ে নিতে পারে, বিনা পরিশ্রমে অল্প দিনে সে গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে যায়। জেলা পর্যায়ের ছাত্রসংগঠনের নেতা হাজার কোটি টাকা পাচারের দায়ে গ্রেফতার হয় এ দেশে। অনু-রুপমের টাকার গোডাউন তো দেশবাসী মিডিয়ার কল্যাণে দেখেছে। ছাত্রসংগঠনের নেতা মার্সিডিজ হাঁকায়। শাহেদ-পাপিয়ারা কত হাজার কোটি টাকার মালিক তা জানা যায় তারা গ্রেফতারের পর। এমন হাজারো অনু-রুপম আর শাহেদ প্রতিটি জেলা উপজেলায় জন্ম নিয়েছে। মন্ত্রী সত্যি বলেছেন, মানুষ বেহেশতে আছে। যারা বেহেশতে আছে, তারা বেশ ভালোই আছে। তারা কিন্তু শতকরা ২-৩% এর বেশি হবে না। যারা জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসছে মন্ত্রী কি তাদের খোঁজ নিয়েছেন? 

নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনে মরু ঝড় আর টর্নেডোর আঘাত তাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে। জীবনযাত্রায় বারবার পরিবর্তন আনার পরও যেন দিন চলে না। আগে মানুষ হিসাব করতো কোন খাতে খরচ কত কমালে আয়-ব্যয় সমন্বয় করা যাবে। এখন মানুষ হিসাব করে কোন কোন খাত বাদ দেওয়ার পর দিন পার করে দেওয়া যাবে। কিন্তু এরপরও যেন জীবন চলে না। নগরজীবনে অভ্যস্ত মানুষ, যারা জীবনের প্রয়োজনে কর্মসংস্থান আর সন্তানের লেখাপড়ার জন্য এক সময় শহরমুখী হয়েছিলেন তাদের অনেকেই আবার গ্রামমুখী হয়েছেন। এতে কি সমস্যার সমাধান হয়েছে?  

বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য কমছে সরকার তখন জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করেছে। বৃদ্ধির মাত্রাটি এতো বেশি যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। জ্বালানির নতুন দর অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ১১৪ টাকা, যা এত দিন ছিল ৮০ টাকা। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৪ টাকা। ডিজেল এবং কেরোসিনের মূল্য সমান হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। পেট্রোল বর্তমানে প্রতি লিটার ১৩০ টাকা, যা এত দিন ৮৬ টাকা ছিল, এ ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা। অকটেন প্রতি লিটার ১৩৫ টাকা, এত দিন অকটেন বিক্রি হতো ৮৯ টাকায়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকার নিজেদের মতো একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে যে, লোকসান সমন্বয় করার জন্য মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রশ্ন আসে, আসলেই কি বর্তমানে জ্বালানি আমদানিতে লোকসান দিতে হচ্ছে? সরকারের তথ্যমতে বিপিসি বর্তমানে একটি লাভজন প্রতিষ্ঠান। বিপিসির দেওয়া তথ্যমতে ২২ মে-২০২২ পর্যন্ত তাদের লাভের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রায়। 

এই ৫০ হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল? আন্তর্জাতিক বাজারে ২০১৩ সাল হতে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফায় কমেছে। বাংলাদেশের একটি সংস্কৃতি হচ্ছে কখনো কোনো জিনিসের দাম বাড়লে তা আর কমে না। এই না কমার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে সে মূল্য সমন্বয় করা হয়নি। যার কারণে বিপিসির লাভের পরিমাণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে গত ৮ বছরে জাতীয় বাজেটের বরাদ্দে বিপিসিকে কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্যমতে, গত অর্থবছরে ২০২২ সালের ২২ মে পর্যন্ত বিপিসি মুনাফা করেছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। জনগণের প্রশ্ন এ লাভের টাকা গেল কোথায়?

লাভ আর উন্নয়নের জোয়ারের মাঝে কিছু তো অবশ্যই শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। মেগা প্রকল্প মানে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ। এ উচ্চাভিলাষের সাথে আছে বহুমাত্রিক আয় রোজগারের ফাঁক-ফোকর। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। রিজার্ভ ফাঁকা হয়। ট্রেজারি ভল্ট লুট হয়। শেয়ারবাজারের টাকা হাওয়ায় মিশে যায়। এতো কিছুর পরেও কিছু মানুষ তো সুখেই থাকে। তারা বেহেশতের স্বপ্ন দেখে। এ স্বপ্নের মাঝে সাধারণ জনগণের জীবন নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তাদের? সমাজের বিভেদ রেখাগুলো মোটাদাগে আরো বড় হচ্ছে। বাজার আর বাজেটের ঊর্ধ্বমুখী প্রতিযোগিতায় নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা জীবনের হিসাব মেলাতে পারে না। নানা টানাপড়েন তাদের জীবনকে কঠিন হতে কঠিনতর করে তুলছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য নানান আরোপিত কর। সব মিলিয়ে প্রভাব পড়ে সাধারণ জনগণের জীবন যাপনে। যাপিত জীবনে তারা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। বিদ্যুতের লোডশেডিং বৃদ্ধির পর বললো জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর বললো একান্ত বাধ্য হয়ে তারা এ কাজ করেছে। সরকার না হয় একান্ত বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছে কিন্তু এর প্রভাব কি বাধ্যবাধকতা মানবে? 

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সব স্থানে লাগবে-এটাই স্বাভাবিক। কৃষি উৎপাদন বহুলাংশে নির্ভর করে ডিজেল ও বিদ্যুতের ওপর। একদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং অপর দিকে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। কৃষি উৎপাদন, কৃষিপণ্য পরিবহনসহ সকল কিছুতে এর প্রভাব সরাসরি জড়িত। কৃষি অর্থনীতি এবার আরো একটি বড় ধাক্কা খাবে। খাদ্যপণ্যের দাম আর এক দফা বেড়ে গেছে। ডিজেলচালিত বাষ্পইঞ্জিন যে সকল কারখানায় সেগুলোতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পরিবহনের সকল সেক্টরে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশের জ্বালানির ৬৫ শতাংশের ক্রেতা পরিবহন খাত। গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানের প্রায় পুরোটাই ডিজেলনির্ভর। বাস, লঞ্চ, ট্রাক, ট্রেন, কাভার্ডভ্যান, পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযান সবই চলে ডিজেলে। গণপরিবহনের মূল ব্যবহারকারী নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বল্প আয়ের মানুষ। নতুন এ মূল্যবৃদ্ধি তাদের দুর্ভোগকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে।

অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা অতি বেশি। চার কোটি বেকারের সাথে আরো কিছু বেকারের সংখ্যা বাড়বে। পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে বাজারে প্রতিটি পণ্যের অগ্নিমূল্যে আরো একবার ঘি ঢালা হলো। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর সরকার যে সকল যুক্তি দাঁড় করিয়েছে তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার বলছে, পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে  মূল্য সমন্বয়, রিজার্ভ ধরে রাখা, পাচার রোধ এবং লোকসান কমানোর জন্য তারা এ কাজ করেছে। কিন্তু সরকারের এ যুক্তিগুলো যে খোঁড়া যুক্তি তা বোঝাই যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ম. তামিম, ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, সিপিডির মোয়াজ্জেম হোসেনসহ সকল অর্থনীতিবিদই বলেছেন, যে সরকারের যুক্তিগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

যুক্তি আর খোঁড়া যুক্তির ঘেরাটোপে বন্দী যাদের জীবন তারা যাবে কোথায়? মানুষের জীবন এখন একটি চেইন প্রক্রিয়ার মতো। একটির মূল্য বাড়লে তার প্রভাব পড়ে সকল কিছুতে। তেল, গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ এর সাথে অর্থনীতির প্রতিটি ধাপ জড়িত। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এর ধাক্কা লাগে। সরাসরি ফলাফল হচ্ছে বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। মন্ত্রীর ভাষায় বেহেশতি খাবার যারা ভক্ষণ করছে তারা না হয় ভালোই আছে। দ্রব্যমূল্যের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়া সাধারণ নাগরিকরা যাবে কোথায়? বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর দু’বেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই এখন বড় দায়। কষ্টের লোবানে পোড়া তাদের জীবন যন্ত্রণা শুধু বেড়েই চলছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সাথে প্রতি কেজি চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ টাকা। আটা ময়দা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকার ঘর ছুঁয়েছে। আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন মহল্লার দোকানগুলোতে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়, এক মাস আগে যা ছিল ৩০ টাকা। প্রতি কেজি রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা, এক মাস আগেও যা ৩০০ টাকায় পাওয়া যেত। সাগরে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়লেও নিম্নবিত্ত মানুষেরা তা কেনার চিন্তা করতে পারে না। সবজির বাজারে যেন আগুন লেগেছে। প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়। প্রতি কেজি বেগুন, করলা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৬০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ঢেঁরস বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগে প্রতি কেজি পটোল ৪০ টাকা বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা করে। শিশুখাদ্য এবং গুঁড়োদুধের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। দফায় দফায় বাড়ছে ঔষধের দাম। 

করোনাকালীন সময়ে গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিতে এক বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বহু মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। নিঃস্ব, কপর্দকহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষেরা দিন দিন শুধু সমস্যা আর সঙ্কটকে মোকাবিলা করে জীবন সংগ্রামে হেরে যাওয়ার হতাশা নিয়ে দিন গুজরান করছে। মানুষ অভাবের তাড়নায় সন্তান বিক্রি করার জন্য হাটে তুলছে। খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় অভাবের তাড়নায় এক মা তার সন্তানকে বিক্রি করার জন্য হাটে তুলেছিলেন যদিও পরবর্তীতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে সেই মা সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। পটুয়াখালীতে এক অভাবী পিতা তার ১৫ দিন বয়সী কন্যাসন্তানকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। মানুষ যখন ভাতের অভাবে সন্তান বিক্রি করে তখন আমরা উন্নয়নের ডুগডুগি বাজাই। কোনটি আগে তথাকথিত উন্নয়ন নাকি জনগণের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানো? এ প্রশ্নের সমাধান করা সর্বাগ্রে জরুরি। সরকার বলছে দেশে কোনো অভাব নেই, কোনো মানুষ না খেয়ে থাকছে না। মন্ত্রীদের বক্তব্য সকল প্রশ্নের সমাধান নয়। বাতাসে অসহায় মানুষের কান্নার গোঙ্গানি। মানুষের দীর্ঘশ্বাস আকাশের আবির রঙের সাথে ঢেউ খেলে আর কেউ কেউ বাংলাদেশকে বেহেশত বানিয়ে দিবা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখা ভালো, আমরাও স্বপ্নকে সাথী করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত একটি কল্যাণময় শান্তি সুখের বাংলাদেশে এ দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের একান্ত কামনা। কিন্তু বাস্তবতা বড় করুণ। মাটিতে কান লাগান, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মানুষের দুঃখ, ক্ষোভ আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছু শুনতে পাবেন না। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, তারা একান্ত বাধ্য হয়ে তেলের দাম বাড়িয়েছেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়েছেন, বিদ্যুতে লোডশেডিং দিচ্ছেন। এখন তাদের কাছেই একটিই সুপারিশ। মানুষের জীবন বাঁচলে রাষ্ট্র বাঁচবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাস্তবতাকে ধারণ করে একান্ত বাধ্য হয়েই তেলের মূল্য কমান। বিদ্যুতের লোডশেডিং নীতি পরিহার করুন। দ্রব্যমূল্য ক্রয়সীমায় নিয়ে আসুন। এতে যে যে খাতে ভর্তুকি আর রেশন দেওয়া দরকার তা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। 

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির