নতুন করে শাহবাগী চেতনার ন্যারেটিভের বয়ান শোনা যাচ্ছে রাজনীতির মাঠে। এই চেতনার বয়ানের ওপর ভিত্তি করেই শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেশের সার্বভৌমত্ব-বিরোধী শক্তির তৈরি করা চেতনার বয়ান ও ট্যাগিং সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে আধিপত্যবাদীরা জাতিকে বিভক্ত রাখতে এই বয়ান ও ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল। এসব ন্যারেটিভ ও বয়ান স্বাধীনতার পর থেকেই ফেরি করেছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের অনুগত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা। ৫ আগস্ট অভ্যূত্থানের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে কেউ পালিয়ে গেছে, কেউ লুকিয়ে আছে লোকচক্ষুর আড়ালে।
স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ও কথিত চেতনার ন্যারেটিভ জাতিকে বিভক্তই শুধু নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই ন্যারেটিভের ফেরিয়ালারা যখনই রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়েছে, তখনই কায়েম হয়েছে ফ্যাসিবাদ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর একই ন্যারেটিভ ঘুরে-ফিরে সামনে আনা হচ্ছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ছিল এই ন্যারেটিভের ওপর ভর করে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভের ফ্যাসিবাদী রূপ কেমন হতে পারে, শেখ হাসিনার শাসন চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়ে গেছে।
স্বাধীনতা লাভের পর সার্বভৌম, স্বনির্ভর দেশ গঠন করাই মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশকে দেখতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালী ফ্যাসিবাদ। মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল নানাভাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য ছিল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শেখ মুুজিবুর রহমানের ফ্যাসিবাদ হেঁটেছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উলটো পথে। সাম্যের পরিবর্তে বৈষম্য আরও কঠিনরূপে বিস্তৃত হয়েছিল। মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবের ফ্যাসিবাদী শাসনে। সামাজিক ন্যায়বিচার তখন কল্পনাও করা যেত না। এসব কিছুই হয়েছে একটা ন্যারেটিভে ভর করে।
শেখ মুজিবের পতন হলেও এই ন্যারেটিভের বয়ান থেমে যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে এ ন্যারেটিভ কাজে লাগানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তৈরি করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামের নানা সংগঠন। রাজনীতির প্রত্যক্ষ ছায়ায় গড়ে ওঠা এসব সংগঠন মাঠে-ময়দানে শ্রুতিমধুর কথাবর্তা দিয়ে ন্যারেটিভের ফেরি করেছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বয়ানে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করার সর্বশেষ বড়ো আয়োজন ছিল শাহবাগের কথিত গণজাগরণ মঞ্চ। এর আগে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক), সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি সংগঠনে ঘুরে ফিরে দেখা গেছে একই মুখগুলো। তাদের কাজ ও লক্ষ্য একটাই- জাতিকে বিভক্ত করতে শ্রুতিমধুর বয়ান ফেরি করা।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ। হঠাৎ করেই শাহবাগে জড়ো হতে থাকে একদল লোক। বলা হয়- তারা ব্লগার। অর্থাৎ ওয়েবসাইট বা ব্লগে লেখালেখি করে তারা। নিজেদের চিন্তা ও বিশ্বাসের বয়ান প্রচার করে এসব ব্লগে। এই ব্লগারদের প্রত্যেকেই ইসলাম-বিদ্বেষী আধিপত্যবাদের স্বঘোষিত দালাল। তাদের প্রচারিত বয়ানের মূল টার্গেট ছিল ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেশকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বয়ানের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে জাতিকে বিভক্ত করতে পারলে তাদের কাজটা সহজ হয়।
শাহবাগে জড়ো হওয়া কথিত এই ব্লগারদের প্রথম স্লোগান ‘ফাঁসি চাই’, দোষী বা নির্দোষ বিচার্য নয়। তাদের টার্গেটেড রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতেই হবে। জড়ো হওয়া কথিত ব্লগারদের জন্য অদৃশ্য শক্তির পক্ষ থেকে শুরু হয় পোলাও-বিরিয়ানি সরবরাহ। বাড়তে থাকে তাদের অনুসারীদের আনাগোনা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কাজে লাগিয়ে কয়েক স্থরের নিরাপত্তা বেষ্টনিও তৈরি করা হয় তাদের জন্য। তাদের শ্লোগানের এরিয়া সম্প্রসারিত হতে থাকে। ফাঁসি চাই স্লোগানের সঙ্গে ‘একটা-দুইটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জ-বা-ই কর’ স্লোগানও উঠতে থাকে। ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই কর’ স্লোগান চরম ফ্যাসিবাদী চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। তাদের স্লোগানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে- ভিন্নমত বলতে কিছুই থাকবে না। এটাই ফ্যাসিবাদ।
এক পর্যায়ে দেখা গেল- এতেও সীমাবদ্ধ নেই তারা। তাদের চরম ফ্যাসিবাদী সেøাগানের বিরোধিতা যারা করছেন, তাদের দমনের আওয়াজ উঠল তখন। বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যম যখন তাদের উস্কানি দিচ্ছে, তখনই দৈনিক আমার দেশ তাদের প্রধান শিরোনাম করল- ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি।’ আর দেরি নেই! ফ্যাসিবাদীরা এবার আমার দেশ বন্ধ এবং সম্পাদককে গ্রেফতারের স্লোগান দেওয়া শুরু করল শাহবাগের কথিত গণজাগরণ মঞ্চ থেকে। দৈনিক আমার দেশ বন্ধ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবিতে পত্রিকাটির অফিস অভিমুখে লাঠি মিছিল কর্মসূচিও ঘোষণা করা হলো।
বিচার না চেয়ে ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই কর’, সম্পাদক গ্রেফতার ও পত্রিকা বন্ধের স্লোগান ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিবাদকেই কেবল উস্কে দেয়নি, সেøাগানে ছিল চরম হিং¯্রতার বহিঃপ্রকাশ। সেøাগানে ও কন্ঠে যে হিংস্রতা ছিল, নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- ভারতের পদলেহী এক শ্রেণির কথিত রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্টের বছরের পর বছর সযতেœ ফেরি করা ন্যারেটিভ যেন পূর্ণতা পেয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে।
সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সাধারণ চিত্র ছিল- দাড়ি-টুপিওয়ালা ছাত্র আক্রান্ত হলে সেটাকে জায়েজ করার জন্য বলা হতো ‘স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি’। যেন দাড়ি-টুপিওয়ালা কাউকে নির্যাতন, নিপীড়ন এমনকি হত্যাও বৈধ! কথায় কথায় ভিন্নমতের লোকদের ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ বা ‘রাজাকার’ ট্যাগ দিয়ে নিপীড়নের অলিখিত সামাজিক ইনডেমনিটি দেয় এই ন্যারেটিভ। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও কলামিস্টদের ফেরি করা চেতনার ন্যারেটিভের বয়ানে তৈরি হওয়া ট্যাগিং সংস্কৃতি কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, সেটা গত ১৫ বছর দেখেছে দেশের মানুষ।
ফ্যাসিবাদী ন্যারেটিভ যেভাবে তৈরি হয়
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেন শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধের ময়দান থেকে ছিলেন বহুদূরে। যুদ্ধ শুরুর আগেই তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদের লেখা ‘নেতা ও পিতা’ বইয়ে আত্মসমর্পণের পুরো বর্ণনা রয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী বাড়িতে আসবেন তাঁকে নিয়ে যেতে, সেজন্য আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কীভাবে শেখ মুজিবের জন্য তাঁর স্ত্রী ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন, সে বর্ণনাও তাজউদ্দিনের ডায়েরি থেকে দিয়েছেন শারমিন আহমদ। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার যুদ্ধাপরাধী খুঁজতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করল।
এই তদন্ত কমিশন অনুসন্ধান ও যাছাই-বাছাই করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে তাদের কেউ বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন না। তারা সকলেই ছিলেন পাকিস্তানের ইউনিফর্ম পরিহিত সেনাবাহিনীর সদস্য। শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাধারণ ক্ষমতা ঘোষণা করলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে সমঝোতা হলো। এই সমঝোতা ‘সিমলা চুক্তি’ নামে খ্যাত। চুক্তির আওতায় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং নিজ দেশে চলে যান। শেখ মুজিব তখন অহংকার করেই বলেছিলেন, ‘বাঙ্গালি জাতি জানে- কীভাবে ক্ষমা করতে হয়।’ এই ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে তিনি একরকম মহত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। চিহ্নিতদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দেশে আর যুদ্ধাপরাধী বলে কিছু থাকার কথা নয়। এই ইস্যুর সেখানেই সমাপ্তি ঘটার কথা।
কিন্তু না, নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বয়ান জিয়ে রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই বয়ানের ওপর ভর করে দুঃশাসন, রক্ষ্মীবাহিনীর অত্যাচার, একদলীয় বাকশাল গঠন, সকল পত্রিকা ও মিডিয়া বন্ধ ঘোষণার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে। এই ফ্যাসিবাদ এক চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাকে। সাধারণ মানুষের একটি দুঃসহ দমবন্ধ নাভিশ্বাস অবস্থায় রক্তক্ষয়ী অভ্যূত্থান-পালটা অভ্যূত্থান ঘটতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর। মাত্র ২ মাস ২২ দিনে দেশে ৩টি অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। তৃতীয় অভ্যূত্থানটি ছিল একটু ব্যতিক্রম। প্রথম দুটি অভ্যূত্থানে শুধু সামরিক শক্তি জড়িত ছিল। তৃতীয়টিতে সেনা সদস্যদের সাথে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। সবার মুখে ছিল ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান। ৭ নভেম্বরের অভ্যূত্থান ইতিহাসে ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার সম্মিলিত বিপ্লবে ‘নারায়ে তাকবীর’-এর স্লোগান দেশকে আলোর দিশা দেখিয়েছিল। ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে পরাজিত হয়েছিল আধিপত্যবাদী শক্তি। দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত করেছিল এই বিপ্লব।
বিপ্লবের পর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে মনোযোগী হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভ বলে কিছুই ছিল না তখন। তাঁর সরকারে সকল মতের মানুষকে জড়ো করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের তৈরি করা বাকশালী সংবিধানের মূলনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনেন জিয়াউর রহমান সরকার। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা, চার মূলনীতি থেকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে সকল কাজে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধান যুক্ত করা ছিল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এছাড়া সংবিধানে গণভোটের বিধান সংযোজন, বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদান, শেখ মুজিব কর্তৃক নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভ ছুড়ে ফেলে দিয়ে সকলে মিলে দেশ গড়ার একটি স্পষ্ট বার্তা দিলেন শহীদ জিয়া।
তাঁর অল্পদিনের শাসনে ডান-বামের ঐক্যে দেশ এগিয়ে যেতে শুরু করে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ফিরে পায় রাজনীতি করার অধিকার। এতেই বার্তা ছিল- আর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নয়, দেশ গড়তে হবে সবাই মিলে। এই অবস্থায় হঠাৎ করেই তাঁর শাহাদাত বরণ দেশকে আরেকবার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের সরকারের সময়ের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরশাদের শাসনে আবারও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভের বয়ান জোরেশোরে ছাড়া হয় মাঠে।
এরশাদ-পরবর্তী ট্যাগিংয়ের রাজনীতির নবরূপে আবির্ভাব
স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ট্যাগিংয়ের রাজনীতি এরশাদের স্বৈরশানের আমলে নতুন করে সূচনা হলেও ডালপালা গজায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটে। তাঁর পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে এককভাবে ১৪০ আসনে বিজয়ী হয় বিএনপি। কিন্তু সরকার গঠন করতে হলে তাদের তখনও আরও ১১ আসনের সমর্থন প্রয়োজন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকার গঠন করতে লাগে ১৫১ আসন। আওয়ামী লীগ ৮৮ আসন ও জাতীয় পার্টি ৩৫ আসনে বিজয়ী হয় তখন। জামায়াতে ইসলামী চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে পেয়েছিল ১৮টি আসন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) ৫, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি ৫, ইসলামী ঐক্যজোট ১, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ- শাজাহান সিরাজ) ১, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফফর) ১, গণতন্ত্রী পার্টি ১, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি আসনে বিজয়ী হয়।
আওয়ামী লীগ তখন চেয়েছিল জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসন নিয়ে জোট করতে। এতে বড়ো দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ২০০১ সালে বিজয়ের পর জাতীয় সংসদে এক ভাষণে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের সে প্রচেষ্টার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি ভাষণে জানিয়েছিলেন- আওয়ামী লীগ তাদেরকে মন্ত্রিত্বের অফার দিয়ে ঐক্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রস্তাব নাকচ করে দেয় জামায়াতে ইসলামী। দলটি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপিকে নিঃশর্ত সমর্থন দেয় তখন।
এতে সরকার গঠনের জন্য বিএনপিকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হতে অনায়াসে ১৫৮ আসনের সমর্থন পান বেগম খালেদা জিয়া। জামায়াতে ইসলামীর নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এই স্বপ্নভঙ্গের পর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা বিরোধী দলের আসনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- ঝাঁকুনি দিয়ে গণতন্ত্র শেখাবেন। এক মুহূর্তের জন্যও সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। শেখ হাসিনা তার প্রতিহিংসাপরায়ণ চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটান স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ট্যাগিং রাজনীতির মাধ্যমে।
এখানে উল্লেখ্য, আধিপত্যবাদী শক্তি তখন ভাবতেও পারেনি- বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মানুষ বিএনপির ওপর আস্থা রাখবে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী তখন মোট ভোটের ১২ শতাংশের ওপরে পেয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়- জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধের ভোট এক জায়গায় হলে কোনো শক্তি বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ভোটের এই হিসেবকে সামনে রেখেই রাজাকার ট্যাগিং ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ট্যাগিং ন্যারেটিভ বয়ান জোরেশোরে শুরু হয়।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি থেকে শাহবাগের জাগরণ
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ নামে চরমপন্থী একটি সংগঠন। ১০১ সদস্যের এই কমিটির বেশিরভাগই ছিলেন বামপন্থী ও ভারতের চিহ্নিত দালাল হিসেবে পরিচিত। তাদের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। মোটকথা, চেতনার বয়ান ফেরি করার মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেন তারা। সবাইকে নির্মূল করে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত তাদের নামের মধ্যেই দেওয়া রয়েছে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ও চেতনা বাস্তবায়নের বয়ানের ধারাবাহিকতা ছিল ২০১৩ সালের শাহবাগের কথিত গণজাগরণ। সবাইকে নির্মূল করে শেখ হাসিনার ভাষায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল শাহবাগীদের টার্গেট।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চেতনার বয়ান ধারণ করে শাহবাগের জাগরণ থেকে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। ব্যক্তি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন সিংহাসন ছেড়ে। কিন্তু তাদের তৈরি করা ন্যারেটিভ ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার নিয়ামক শক্তি চেতনার বয়ান এখনও শোনা যায় বিভিন্ন কন্ঠে। ভারতের আধিপত্যবাদের তৈরি করা এই চেতনার বয়ান ও ন্যারেটিভ ফেরি করে আর কোনো ফ্যাসিবাদ যাতে জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে না পারে, সেজন্য সজাগ থাকতে হবে ছাত্র-জনতাকে। ফ্যাসিবাদকে নির্মূল করে জনগণের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই হোক ছাত্র-জনতার প্রত্যয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক আমার দেশ।
আপনার মন্তব্য লিখুন