ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে বিরোধিতা
প্রাথমিক প্রস্তুতির শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। এছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উক্ত হতাশা কাটিয়ে উঠার পরও আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এগোতে হয়েছিল। তার মধ্যে প্রধানত তিন ধরনের বিরোধিতা হয়েছিল। তা হলো-
১. কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করা হয়। ১৯১২ সালের ১৮ মার্চ ঢাবি প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার এক জনসভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্বও করেছেন।
২. দ্বিতীয় বিরোধিতা ছিলো পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে।
৩. ঢাবি প্রতিষ্ঠায় তৃতীয় বিরোধী ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে।
প্রধানতম এই তিন প্রকারের বাধাসহ নানা রকম বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে ঢাবি প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (সংক্ষেপে ঢাবি) ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত একটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মানসম্মত মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরিতে অবদান রাখার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে স্বীকৃতি পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
১৯১২ সালে ৩০ শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ ভারত সরকারের নিকট আবেদন জানান নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতের ক্ষমতাশীনদের পক্ষে ‘ঢাবি প্রতিষ্ঠার’ ওয়াদা করেন সমকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় পাস করা হয় ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং ১৩) ১৯২০। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ৬০০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত স্বায়ত্তশাসিত সরকারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সেই মোতাবেক ২০২১ সালের ১লা জুলাই ঢাবি শতবর্ষ পূর্ণ করেছে। প্রতিষ্ঠার সময় মাত্র ৬০ জন সম্মানিত শিক্ষক এবং ৮৭৭ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাবিতে প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় আটত্রিশ হাজারের উপরে এবং শিক্ষকসংখ্যাও প্রায় ২০০০ জন। প্রতিষ্ঠার সময় এ বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি অনুষদ তথা কলা, বিজ্ঞান ও আইন এবং ১২ বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বিভাগগুলো হলো- ১) বাংলা ও সংস্কৃতি, ২) ইংরেজি, ৩) আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ৪) ফারসি ও উর্দু, ৫) ইতিহাস, ৬) অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ৭) দর্শন, ৮) গণিত, ৯) পদার্থবিদ্যা, ১০) রসায়ন, ১১) আইন ও ১২) শিক্ষা। উল্লেখ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আরো ৮টি বিভাগসহ মোট ২০টি বিভাগের সুপারিশ করেছিল। ঢাকার আশপাশের জেলার নবাবদের ও মুসলিম নেতাদের আর্থিক অনুদান ও ৬০০ একর জমি দানের মাধ্যমে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাঁটিহাঁটি পা-পা করে যাত্রা শুরু করে। ঢাবি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানবিক গুণাবলি বিকাশ ও উন্নত নৈতিক বলিষ্ঠ চরিত্রের আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে তোলা। অল্প সময়ের মধ্যে ঢাবি শিক্ষার মান রক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালায়। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাতি’ অর্জন করতে সক্ষম হয়।
ঢাবির ভাইস চ্যান্সেলর
VC- ১৯২১ সাল থেকে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাবিতে ২৮ জন ভিসি দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম VC- স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ (Hartog)। ২৮তম অর্থাৎ শেষ VC- প্রফেসর মোহাম্মাদ আখতারুজ্জামান (বর্তমানে চলমান)।
ঢাবির ডাকসু
ঢাবি ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এবং বর্তমান পর্যন্ত ডাকসুর ২৬ জন ভিপি ও ২৬ জন জিএস দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ডাকসুর প্রথম ভিপি মো: মমতাজ উদ্দিন ও জিএস জগচন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ডাকসুর ২৬তম অর্থাৎ শেষ ভিপি মো: নুরুল হক নুরু ও জিএস গোলাম রব্বানি। উক্ত ডাকসুর মেয়াদও বর্তমানে শেষ হয়েছে। ডাকসুর নির্বাচন অনিশ্চিত অথচ কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঢাবির ভূমিকা
১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেকে শহীদ হয়েছেন। বিজ্ঞজনেরা আরো মনে করেন, ঢাবি প্রতিষ্ঠিত না হলে হয়তোবা এত সহজে পাকিস্তানের স্বাধীনতা পেতাম না। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ভূমিকার কারণে সহজেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী ও আদর্শের ধারাবাহিক কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচালনা করতে পারবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশিক্ষিত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলির অধিকারী শিক্ষার্থীরা।
ঢাবিতে ভর্তি হয়ে আমার লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপলাভ করে
আমি মুন্সীগঞ্জ জেলা নিবাসী ঢাকার মালিবাগ এলাকায় বসবাসকারী এবিএম ফজলুল করীমের ছোটবেলার লালিত ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হওয়ার। আলহামদুলিল্লাহ! আমি আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে সেই সুযোগ পেয়েছিলাম। বর্তমানেও কিন্তু আমাদের সন্তানরা অনেকেই ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন লালন করে। কারও স্বপ্ন পূরণ হয়, আবার অনেকেরই স্বপ্ন বাস্তবে পূরণ হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। আমার সৌভাগ্য হয় এমন শিক্ষকের ক্লাস করার, যাদের সুনাম ও খ্যাতি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন শিক্ষক হলেন-
১. প্রফেসর ড. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ
২. প্রফেসর ড. আহম্মদ শরীফ
৩. প্রফেসর ড. নীলিমা ইব্রাহিম
৪. প্রফেসর ড. ওয়াকিল আহমেদ
৫. প্রফেসর ড. সানজিদা খাতুন (কণ্ঠশিল্পী)
৬. প্রফেসর ড. নরেশ বিশ্বাস
৭. প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলামসহ আরও অনেক গুণী ও মেধাবী ও স্কলার শিক্ষকবৃন্দ।
ঢাবিতে আমার সাথে যারা আমার সহপাঠী ছিলো তারাও পরবতীতে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ পেশায় শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছে। আমি দীর্ঘ সময় অত্যন্ত আনন্দচিত্তে ও খোশ মেজাজে ঢাবিতে অধ্যয়ন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। মাঝে মাঝে আজও সেসব স্মৃতি আমাকে উদ্বেলিত করে। আমি ১৯৮১ সালে অনার্স এবং ১৯৮২ সেশনে এমএ বাংলা বিষয়ে পাস করি। ঢাবি থেকে এমএ পাস করার বছরই ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ঢাকার মালিবাগের আবু জর গিফারী কলেজে বাংলা বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর শিক্ষকতার পর গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে অবসর গ্রহণ করি। অবসর গ্রহণ করার পর সামাজিক কাজসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বর্তমানে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছি।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ঢাবির গৌরবময় ইতিহাস কখনো ম্লান হতে থাকে আবার কখনো গৌরব অর্জন করতে থাকে। এমনিভাবে উত্থান ও নিম্নগামী হওয়ার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রসর হতে থাকে। মাঝে মধ্যে ছাত্রদের অস্ত্রের ঝনঝনানি ও সন্ত্রাস, মারামারি, হানাহানি চলতে থাকে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাবি এখনও পরিপূর্ণভাবে অতীতের গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারে নাই। এইভাবে চলতে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ‘নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আলোকিত মানুষ’ ভবিষ্যতে তৈরি হবে কিনা জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত ঐ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া।
ঢাবির নির্বাচিত সিনেট সদস্য হিসেবে আমার ক্ষুদ্র ভূমিকা
আমি ২০০৩ সালে ঢাবি এর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনে বিপুল ভোটে ঢাবির রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট সিনেট সদস্য নির্বাচিত হই। ২৫ জন রেজিস্টার্ড সিনেট নির্বাচনে আমি তৃতীয় স্থান অর্জন করে ঢাবির সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। আল্লাহ পাকের মেহেরবানিতে ২০০৩ সালে আমি ঢাবির সিনেট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও সার্বিক উন্নয়নে কাজ করার দীর্ঘ সময় ধরে সুযোগ পাই। সিনেট সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন ও ঢাবির হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। ২০০৩ সালের সিনেট অধিবেশনে প্রস্তাব ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সিনেটের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য আমি বহু প্রশ্ন, পরামর্শ এবং আবেদন জানাই। যেমন-
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৩ সালের সিনেট অধিবেশনে সম্পূর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব করি। কিন্তু সে প্রস্তাব, যা আমি আইন হিসেবে চালু করতে চেয়েছিলাম প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিনেট সদস্যদের সমর্থন না পাওয়ায় উক্ত প্রস্তাব সিনেট অধিবেশনে পাস করানো সম্ভব হয়নি।
২. ঢাবি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আবাসিক ছাত্রী হলের ছাত্রীদের জন্য বিধি ছিল হল থেকে মেয়েরা বাইরে গেলে অবশ্যই সূর্যাস্ত যাওয়ার পূর্বে হলে ঢুকতে হবে। কোনো ছাত্রী যদি হলে যাওয়ার পূর্বে সূর্যাস্ত যায় তবে সেই ছাত্রী হলে প্রবেশ করতে পারবে না। যাতে করে ছাত্রীরা রাতে বাইরে থাকাকালীন সময় কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনায় আক্রান্ত না হয়। কিন্তু কালপরিক্রমায় ঢাবিতে ঐ আইন বাতিল করা হয়। আবাসিক ছাত্রীদের জন্য পূর্বের ন্যায় সন্ধ্যা আইন চালু করার জন্য আমি সিনেট অধিবেশনে প্রস্তাব করি। কিন্তু তাও প্রয়োজনীয় সমর্থনের অভাবে আইন হিসেবে চালু করা যায়নি।
৩. শিক্ষক প্রতিনিধি, সিনেট সদস্য এবং প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসংগঠনের নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করে একাডেমিক উন্নয়ন ও নৈতিকমান বৃদ্ধি এবং সন্ত্রাস নির্মূল করার জন্য লিখিত প্রস্তাব পেশ করি। তাও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও আমি বহু প্রশ্ন, পরামর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করি।
বর্তমানে ঢাবিতে মানবিক গুণাবলি ও বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শ মানুষ তৈরি হচ্ছে না। আদর্শ মানুষ তৈরি করতে হলে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে পারলে তবেই আমরা উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শ মানুষ তৈরি করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
ঢাবির সমাবর্তন
১৯২১ থেকে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাবির সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ৫২ বার। ১৯২১ সালে ১লা জুলাই ঢাবির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ব্রিটিশ আমলে ঢাবির প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২৪ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলে সর্বশেষ ২৪তম সমাবর্তন হয় ১৯৪৬ সালের ২১ নভেম্বর। পাকিস্তান আমলে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ। পাকিস্তান আমলে মোট ১৫ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ আমলে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৩তম সর্বশেষ ৫২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর। ব্রিটিশ আমলে সমাবর্তন হয় ২৪ বার, পাকিস্তান আমলে ১৫ বার, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৩ বার = ৫২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত এসব সমাবর্তনে দেশী-বিদেশী সম্মানিত বিভিন্ন বিষয়ে গুণী ব্যক্তিদেরকে সম্মানসূচক ডক্টরের ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন : i) ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ii) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী iii) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর iv) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ v) কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবস
১লা জুলাই ‘ঢাবি’ প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট এবং ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। ছাত্র হল ১৫টি, ছাত্রী হল ৫টি মোট ২০টি আবাসিক হল রয়েছে।
ঢাবিতে নৈতিক চরিত্রের আদর্শ মানুষ কম তৈরি হওয়ার কারণ
ঢাবিতে মানবিক গুণাবলিসহ বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শ মানুষ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় কম তৈরি হওয়ার মূল কারণ কী? তার ব্যাখ্যা প্রদান করা দরকার বলে বলে মনে করছি। প্রথমত : ব্রিটিশ আমলেই ম্যাকলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার কাজ শুরু হয়। বিশেষভাবে ইসলামী আদর্শ ও নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরির ব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে। তারা অহি শিক্ষা তথা কুরআনিক শিক্ষাসহ মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে। দ্বিতীয়ত : ম্যাকলে শিক্ষা কমিশনের উদ্দেশ্যই ছিলো ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমান ভারতীয় হলেও মনমানসিকতায় হবে একজন ব্রিটিশ ইংরেজের মতো। মূলত ঐ শিক্ষার মাধ্যমে তাদের অনুসারী যোগ্য গোলাম তৈরি করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিলো। ফলে হয়েছিলও তাই, যেমন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং বর্তমানে অধিকাংশ পাশ্চাত্যের অনুসারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেও দায়িত্বরত ব্যক্তিবর্গ যারা ঘুষ দুর্নীতিসহ নানা অন্যায় কাজে লিপ্ত আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তৃতীয়ত : বিশেষভাবে ইসলামী মূল্যবোধ ও মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বনাশ করেছিল ব্রিটিশ আমলের ম্যাকলে শিক্ষা কমিশন। বর্তমানে ব্রিটিশ আমলের ম্যাকলে শিক্ষা কমিশনের শিক্ষাব্যবস্থার আদলে শিক্ষাক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চতুর্থত : ব্রিটিশদের নিকট থেকে হিন্দুরা সুবিধা বেশি পেত। তাই হিন্দুরা তাদের মুসলিম শাসকদের পরিবর্তন করে সহজে ইংরেজদের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল। পঞ্চমত : ব্রিটিশ ও বর্ণবাদী হিন্দুরা মুসলমানদের দমন করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতো। যেমন- (ক) ১৮০০ সালের ৯ জুলাই কলকাতায় ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান সন্তানদের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করে ইংরেজ বানানোর চেষ্টা করে। (খ) তারা ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করে; সেখানে মুসলমানরা লেখাপড়ার কোনো সুযোগ পেত না।
পাকিস্তান আমলে শিক্ষাব্যবস্থা
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারতবর্ষে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এক. ভারত, দুই. পাকিস্তান। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরও ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতা সামান্য পরিবর্তন করে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। তারা নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পাকিস্তান আমলে ৬টি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কিন্তু কমিশনগুলোর সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা
১. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শিক্ষানীতির সিংহভাগ ব্রিটিশ শিক্ষানীতি অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বারবার শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি প্রণয়নে কমিটি গঠন করা হয়। অবশেষে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ২০১০ সাল থেকে ধীরে ধীরে চালু করা হচ্ছে। ২০১২ সালে শিক্ষা আইন চালু করা হয়।
২. ২০১০ সালে নতুন শিক্ষানীতি ও ২০১২ সালে শিক্ষা আইন চালু হওয়ার পর দেশের শিশুরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া ইসলামী শিক্ষাসহ মাদ্রাসা শিক্ষার কুরআনিক আদর্শ ধ্বংস করা হচ্ছে।
৩. এ পরিস্থিতিতে মাত্র ১২ বছরে মধ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভয়াবহ রূপ সৃষ্টি হয়েছে।
৪. ঢাবিতে মানবিক গুণের অধিকারী নৈতিক ও আদর্শিক মানসম্মত আদর্শ মানুষ তৈরির কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
৫. বর্তমানে ঢাবিতে আদর্শিক মূল্যবোধের বিশেষ করে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
ঢাবির শতবর্ষ পালন পরবর্তীতে আমরা আশা করবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য ফেরাতে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ আমরা সকলেই যথাযথ চেষ্টা করবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত মানসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করে ছাত্র-শিক্ষকদের সার্বজনীন মৌলিক নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসহ মানবিক গুণাবলি অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার
ঢাবি পূর্বের ন্যায় ভবিষ্যতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে আশা করা যায় আবারও ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে স্বীকৃতি লাভ করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক গুণের অধিকারী উন্নত নৈতিক চরিত্রের আদর্শ মানুষ পুনরায় তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ-
১. ঢাবির সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি ও নৈতিক উন্নত মানের চরিত্র গঠন করা যায় এমন একাডেমিক সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করা।
২. VC সহ শিক্ষকমন্ডলী থেকে ১০ জন, সিনেট সদস্যদের মধ্যে থেকে ১০ জন এবং প্রত্যেক ছাত্রসংগঠন থেকে ২জন করে প্রতিনিধি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে হবে। যাতে সন্ত্রাসসহ কোনো খারাপ কাজ ঢাবিতে সংঘটিত না হয় এবং একাডেমিক কার্যক্রম উন্নত মানে ভালোভাবে চলে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেকোনো নেশাসহ ‘ধূমপান মুক্ত’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য চেষ্টা করা।
৪. সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে আবাসিক ছাত্রীরা যাতে হলে ফিরে যায় তার জন্য সূর্যাস্ত আইন প্রণয়ন করা এবং সূর্যাস্ত যাওয়ার পর কোনো ছাত্রীকে ছাত্রী হলে প্রবেশ করতে না দেওয়ার আইন ১০০% বাস্তবায়ন করা।
৫. নিয়মিত ক্লাস সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা বাস্তবসম্মতভাবে তদারকি করা। যারা মেনে চলবে না তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা।
৬. নিয়মিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষভাবে ডাকসুর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা এবং ডাকসুকে ন্যায়সঙ্গতভাবে কার্যকর রাখা।
৭. সার্বজনীন আদর্শিক নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষানীতি প্রণয়নের ব্যবস্থা করা এবং তা কার্যকর করা।
সরকার যদি ইসলাম শিক্ষা বিষয়টিকে সকল স্তরে বাধ্যতামূলক করে তাহলে দেশের সকল অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা তাদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাবে। বাংলাদেশে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষার ফল সকল ধর্মের মানুষ ভোগ করতে পারবে। শিক্ষার্থীরা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ আলোকিত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে বলে আমরা মনে করি। তাই সরকারকে স্নাতক, অনার্স এবং স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষাসহ সকল ধর্মের মানুষের জন্য নৈতিকতার শিক্ষা আরো ভালোভাবে চালু করার জন্য আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। পরিশেষে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করবো ঢাবি যেন তার আগের গৌরব ও ঐতিহ্য অর্জন করতে পারে।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন