সিরাজউদ্দৌলার নবাবি অর্জন করার পর থেকেই তিনি বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এই বিরোধিতা এসেছে তার আত্মীয়-স্বজন যারা মসনদের দাবিদার ছিলো। সেই বিরোধিতা ক্রমেই ষড়যন্ত্রে রূপ নেয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ও আধিপত্যবাদী ইংরেজরা। বাংলাসহ এই উপমহাদেশে রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসন চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ শুরু হয় পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। যে গোষ্ঠী এসেছিল এদেশে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে, তারা হত্যা করল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে।
পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ ছিল, কিছু ছিল প্রত্যক্ষ কারণ আবার কিছু ছিল পরোক্ষ। পরোক্ষ কারণের প্রধান ছিল আলীবর্দী খানের প্রতি তাঁর নিকটাত্মীয়দের ঈর্ষাপরায়ণতা। পুত্রহীন আলীবর্দী খানের দুই জামাতার মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকার শাসনকর্তা, তারা আশা করেছিলেন আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তারা মসনদের উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু সিরাজকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নেওয়ার তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তা অবশেষে শত্রুতায় পরিণত হয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান শত্রু ছিল তাঁর খালাত ভাই পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গ। সিরাজউদ্দৌলার অপর শত্রু ছিল তার খালা মেহেরুন নেসা। মেহেরুন নেসা ওরফে ঘসেটি বেগম ছিল অপুত্রক। সে সিরাজউদ্দৌলার ছোট ভাই ইকরামুদ্দৌলাকে লালন পালন করে। ঘসেটি বেগমের ইচ্ছা ছিল নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে ইকরামুদ্দৌলাকে মসনদে বসাবে। কিন্তু ইকরামুদ্দৌলা অকালে মৃত্যু বরণ করেন। ঘসেটি বেগম শওকত জঙ্গের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। এক সময় ঘসেটি বেগম শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।১
সিরাজউদ্দৌলার আরেক শত্রু ছিল মীর জাফর আলী খান। সে আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমকে বিয়ে করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। মীর জাফর আলী খান ছিল অত্যন্ত লোভী ও অকৃতজ্ঞ। মীর জাফর নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি হয়ে নবাব সিরাজের প্রধান শত্রু হয়ে ওঠে। ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের সাথে যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্যতিব্যস্ত তখন মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানির সাথে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা খালা ঘসেটি বেগমকে তার প্রাসাদ থেকে নিজ প্রাসাদ মনসুরগঞ্জে নিয়ে আসেন। এসময় সিরাজ মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি থেকে সরিয়ে মীর মদনকে ঐ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। পরে তিনি অবশ্য মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু মীর জাফর আগে থেকেই নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, এই ঘটনা অসন্তুষ্টি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সময় মুর্শিদাবাদে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হয়ে ওঠে। সিরাজের প্রতি নাখোশ জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ঊমিচাঁদ প্রমুখ হিন্দু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে তদস্থলে ইয়ার লতীফকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র করে। আলীবর্দী খানের হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বীজ বপনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দু কর্মকর্তাদের নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এ সময় যারা প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে জানকী রাম, দুর্লভ রাম, রাম নারায়ণ, কিরাত চাঁদ, বিরু দত্ত, গোকুল চাঁদ, উমিচাঁদ রায় এবং রাম রাম সিংহের নাম উল্লেখযোগ্য।২
সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে হিন্দু কর্মকর্তা অধিক সংখ্যায় নিয়োগ পান। এভাবে আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দুরা সকল ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এর পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত অশুভ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে তারা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বাংলার মুসলিম রাজত্বের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সিরাজউদ্দৌলাও তাঁর নানার মতই হিন্দুদেরকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। তিনি মোহনলাল নামক এক কাশ্মিরী হিন্দুকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। মোহনলাল সিরাজের উপরে প্রভাব বিস্তার করে নবাবের প্রধান উজিরে পরিণত হন। আর এসব হিন্দুরাই নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করে। নবাব সিরাজের হাতে কলকাতা পতনের পর যদি উমিচাঁদ নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ মানিক চাঁদ প্রমুখ হিন্দুগণ গভর্নর ড্রেক ও তার লোকজনকে সাহায্য না করতো তা হলে ইংরেজদের জন্য আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
ঊনত্রিশে ডিসেম্বর ক্লাইভের রণতরী হুগলী নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে বজবজ দখল করে। তার চার দিন আগে ক্লাইভ মানিক চাঁদের মাধ্যমে নবাবকে যে পত্র লিখে তাতে বলা হয়, নবাব আমাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমরা এসেছি তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী হতে আসিনি তার কাছে। আমাদের দাবি আদায়ের জন্য আমাদের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট। মানিক চাঁদ পত্রখানি নবাবকে দিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। হয়তো দেয়নি। দিলে নবাব নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। মানিক চাঁদ সর্বদা নবাবকে বিভ্রান্ত রেখেছে। তার ফলে বিনা বাধায় ক্লাইভ ৩১ ডিসেম্বর থানা ফোর্ট এবং ১লা জানুয়ারি, ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরুদ্ধার করে। মানিকচাঁদ ইচ্ছা করলে নবাবের বিরাট সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ইংরেজদের আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারতো। সে তার কোনো চেষ্টাই করেনি। কারণ ইংরেজদের দ্বারা তার এবং তার জাতির অভিলাষ পূর্ণ হতে দেখে সে আনন্দলাভই করছিল। এমনকি এ সকল স্থান ইংরেজ-কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার সংবাদটুকু পর্যন্ত সে নবাবকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।৩
ইংরেজদের হাতে বলতে গেলে, ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ তুলে দিয়ে সে হুগলী গমন করে এবং হুগলী ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। ক্লাইভ হুগলীতে তার নামে লিখিত পত্রে অনুরোধ জানায় যে, পূর্বের মতো সে যেন এখানেও বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়। দু’দিন পর হুগলী আক্রমণ করে ক্লাইভ সহজেই তা হস্তগত করে। ইংরেজ কর্তৃক এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অধিকৃত হওয়ার পর মানিক চাঁদ নবাবকে জানায় যে, ইংরেজদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। হুগলী অধিকারের পর ইংরেজ সৈন্যগণ সমগ্র শহরে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিরাট সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।
হুগলীর পতন ও ধ্বংসলীলার সংবাদ পাওয়া মাত্র সিরাজউদ্দৌলা বিরাট বাহিনীসহ ২০ জানুয়ারি হুগলীর উপকণ্ঠে হাজির হন। ইংরেজগণ তখন হুগলী থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে যায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য তাদের সাথে সন্ধি করেন। ৯ ফেব্রুয়ারি নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে তা আলী নগরের সন্ধি বলে পরিচিত। এ সন্ধি অনুযায়ী ১৭১৭ সালের ফরমান মুতাবেক সকল গ্রাম ইংরেজদেরকে ফেরত দিতে হবে। তাদের পণ্যদ্রব্যাদি করমুক্ত হবে এবং তারা কলকাতা অধিকতর সুরক্ষিত করতে পারবে। উপরন্তু সেখানে তারা একটা নিজস্ব টাঁকশাল নির্মাণ করতে পারবে।
সিরাজউদ্দৌলাকে এ ধরনের অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তার কারণ হলো মানিক চাঁদের মতো তার অতি নির্ভরযোগ্য লোকদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা।৪ অপরদিকে ক্লাইভের নিকটে এ সন্ধি ছিল একটা সাময়িক প্রয়োজন মাত্র। ইংরেজরা একইসাথে প্রয়োজনবোধ করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং ফরাসিদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার। এতদুদ্দেশ্যে ক্লাইভ ওয়াটস এবং উমিচাঁদকে সিরাজউদ্দৌলার কাছে পাঠিয়ে দেয় এ কথা বলার জন্য যে, তারা ফরাসি অধিকৃত শহর চন্দরনগর অধিকার করতে চায় এবং তার জন্য নবাবকে সাহায্য করতে হবে। এ ছিল তাদের এক বিরাট রণকৌশল। নবাব ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি বিদেশী বণিকদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছিলেন। এ নীতি কি করে ভঙ্গ করতে পারেন?
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, ইংরেজদের সাহায্য না করলে তারা এটাকে তাদের প্রতি শত্রুতা এবং ফরাসিদের প্রতি মিত্রতা পোষণের অভিযোগ করবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ নীতিতেই অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত করেন। তদনুযায়ী তিনি সেনাপতি নন্দনকুমারকে নির্দেশ দেন যে, ইংরেজরা যদি চন্দরনগর আক্রমণ করে তাহলে ফরাসিদের সাহায্য করতে হবে। অনুরূপভাবে ফরাসিরা যদি ইংরেজদেরকে আক্রমণ করে তাহলে ইংরেজদেরকে সাহায্য করতে হবে। ক্লাইভ দশ-বারো হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নন্দকুমারকে হাত করে। সে একই পন্থায় নবাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে। এভাবে ক্লাইভ চারদিকে উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতার এমন এক জাল বিস্তার করে যে, সিরাজউদ্দৌলা কোনো বিষয়েই দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারেন না। উপরন্তু হিন্দু শেঠ ও বেনিয়াগণ এবং তাঁর নিমকহারাম কর্মচারীগণ, যারা মনেপ্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল, সিরাজউদ্দৌলাকে হরহামেশা কুপরামর্শই দিতে থাকে। তারা বলে যে, ইংরেজদেরকে কিছুতেই রুষ্ট করা চলবে না। ওদিকে বাংলা-বিহার রক্ষার উদ্দেশ্যে বিরাট সেনাবাহিনী মুর্শিদাবাদ থেকে সেদিকে প্রেরণ করার কুপরামর্শ দেয়। এভাবে ইংরেজদের অগ্রগতির পথ সুগম করে দেয়া হয়।
ইতোমধ্যে ৫ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে সৈন্যসামন্তসহ একটি নতুন জাহাজ ‘কাম্বারল্যান্ড’ কলকাতা এসে পৌঁছায়। ৮ মার্চ ক্লাইভ চন্দরনগর অবরোধ করে। নবাব রায়দুর্লভ রাম এবং মীর জাফরের অধীনে একটি সেনাবাহিনী চন্দরনগর অভিমুখে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের পৌঁছাবার পূর্বেই ফরাসিগণ আত্মসমর্পণ করে বসে। তারা চন্দরনগর ছেড়ে যেতে এবং বাংলায় অবস্থিত তাদের সকল কারখানা অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এবং নবাবের হাতে তুলে দিয়ে যেতে রাজি হয়। অতঃপর বাংলার ভূখণ্ড থেকে ফরাসিদের মূলোচ্ছেদ করার জন্য ক্লাইভ নবাবের কাছে দাবি জানায়। উপরন্তু পাটনা পর্যন্ত ফরাসিদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে কোম্পানির দু’হাজার সৈন্য স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করে। নবাব এ অন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। এতে ফরাসিদের সাহায্য করা হয়েছে বলে নবাবের প্রতি অভিযোগ আরোপ করা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল কমিটি ২৩শে এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা আরও অভিযোগ করে যে, নবাব আলীনগরের চুক্তি ভঙ্গ করেছেন।৫
নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে পাকাপোক্ত ষড়যন্ত্র করে, সিরাজেরই তথাকথিত আপন লোক রায়দুর্লভ রাম, উমিচাদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে। তাদেরই পরামর্শে মীর জাফরকে নবাবের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা হয়। ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যেও সকল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। শুধু উমিচাঁদ একটু অসুবিধার সৃষ্টি করে। সে নবাবের যাবতীয় ধন-সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবি করে বসে। অন্যথায় সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশি করার জন্য ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ এক দলিল তৈরি করে। মীর জাফরের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে সে আলীনগরের চুক্তির সকল শর্ত পুরাপুরি পালন করতে বাধ্য থাকবে বলে স্বীকৃত হয়। উপরন্তু সে স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানিকে দিতে হবে এক কোটি টাকা, ইউরোপিয়ানদেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদেরকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনিয়ানদেরকে সাত লক্ষ টাকা। কলকাতা এবং তার দক্ষিণে সমুদয় এলাকা চিরদিনের জন্য কোম্পানিকে ছেড়ে দিতে হবে।
এতসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে ব্যর্থ হয় সিরাজউদ্দৌলা। সে মীর জাফরকে একটি সেনাবাহিনীসহ পলাশী প্রান্তরে ইংরেজদের প্রতিহত করার আদেশ করেন যদি তারা ফরাসিদের অনুসরণে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তার সৈন্য প্রেরণ করে। সিরাজ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্যদের সম্মুখীন হন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ রাম প্রভৃতির উপর। তারা চরম মুহূর্তে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। এরপরেও মীর মদন বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু ইংরেজদের গুলিতে নিহত হয়ে গেলেন। এই সময় নবাব সিরাজউদ্দৌলা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তখনও যুদ্ধের গতি নবাবের পক্ষে ছিল। মীর মদনের সাথে মোহনলাল ও সিনফ্রে ইংরেজদের কাবু করে ফেলেছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে মীর জাফর যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দেন। রায়দুর্লভের কুপরামর্শে ও চাপে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাতে বাধ্য হলেন।
পরক্ষণে ইংরেজদের দিক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে অবশেষে নবাবের সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য হয় এবং নবাব পালিয়ে যান। কিন্তু পথিমধ্যে মীর জাফরপুত্র মীরন তাকে হত্যা করে।৬ এভাবে পলাশীর বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের যবনিকাপাত হয়। আর এভাবেই বাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, যা উদিত হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ১৯০টি বছর।
পলাশী যুদ্ধের ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হয়-
এক. বাংলার জমিদার প্রধান, ধনিক বণিক ও বেনিয়া গোষ্ঠী দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে হলেও মুসলিম শাসনের অবসানকল্পে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে তাদের ধারণা ছিল ইংরেজ শক্তির সহায়তায় তারাই হবে মূলত বাংলার শাসক।
দুই. ইংরেজগণ হিন্দু প্রধানদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য হিন্দুদের পুরোপুরি ব্যবহার করে।
তিন. নবাবের সকল দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা অধিষ্ঠিত ছিল তারা প্রায় সকলেই ছিলো তার প্রতি নাখোশ এবং তাদের উপরই সিরাজকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো। যাদের উপরে তিনি নির্ভর করতেন তারাই তার পতনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো।
চার. পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। এ ছিল যুদ্ধের প্রহসন। ইংরেজদের চেয়ে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেকগুণ বেশি। নবাবের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ করলে ইংরেজ সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো এবং ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। অথবা সিরাজউদ্দৌলা যদি স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলেও তাকে হয়তো পরাজয়বরণ করতে হতো না।
১৫৯৯ সালে কয়েকজন ইংরেজ ব্যবসায়ী মাত্র ৩০ হাজার পাউন্ডের ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে গঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তৎকালীন মুদ্রামান অনুযায়ী, তা ২৫ হাজার ভারতীয় রুপির চেয়েও কম ছিল। এর পরের বছর রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভারতের সাথে তারা বাণিজ্য শুরু করে। ১৬১২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে তৎকালীন ভারতের প্রধান সমুদ্রবন্দর সুরাটে (ভারতীয় রাজ্য গুজরাটের একটি শহর) বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তারা। সুরাটে তখন আরও অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের একেকজনের মূলধন পুরো ইংরেজ কোম্পানির চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি ছিল।
ইংরেজদের দৈন্যদশা দেখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং তাদের মোটেও গুরুত্ববহ মনে করতেন না। এই গুরুত্বহীন, করুণার পাত্র, নামমাত্র মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে আসা ইংরেজরা একসময় পুরো উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিলো। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পুরো ভারতবর্ষে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে ইংরেজরা। তারা প্রলুব্ধ হয়েছিল শুধুমাত্র এদেশের সম্পদ দ্বারা। আর তাই সুদীর্ঘকালের শাসনামলে ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে যায় তারা।৭
তথ্যসূত্র
১. বাংলার ইতিহাস / ড. আবদুল করিম / বড়াল প্রকাশনী / পৃ. ২২৪-২২৫
২. সিরাজউদ্দৌলা / বাংলাপিডিয়া / https://bit.ly/3pNKlol/ অ্যাকসেস ইন ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
৩. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৮৬
৪. সিরাজউদ্দৌলা / বাংলাপিডিয়া https://bit.ly/3cH0jNi / অ্যাকসেস ইন ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
৫. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৮৮
৬. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৮৯
৭. উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত / সিরাজুল হোসেন খান /পৃ. ১৫-১৮)
লেখক : ইতিহাস গবেষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন