post

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত

ড. আহসান হাবীব ইমরোজ

বৃটিশ-ভারতে যে সকল জনদরদী মনীষী সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার এবং জাতীয় জাগরণে আজীবন সংগ্রাম ও ত্যাগ-স্বীকার করেছেন, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তিনি আমাদের পাঠ্যসূচি, পত্রিকা, পলিটিক্স ও প্রজ্ঞায় কতটুকু আছেন? আমাদের তরুণ-যুবারা তাঁর সম্পর্কে কী-বা জানে? আমরা নিশ্চয়ই যাদুকর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর লেখনী সম্পর্কে জানি! কিন্তু এটা কি জানি- প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ছিলেন তাঁরই দাদা-শ্বশুর? হুমায়ূনের লেখায় যাঁর স্টাইল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, তিনিই প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। এমনকি যে ‘দখিন হাওয়া’তে হুমায়ূনের বসতি, সেটিও ছিল প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ-এর প্লট। এর নামকরণও করেছিলেন তিনিই।  

ঐতিহ্য জানার আমাদের এ দৈন্যদশা দেখেই বোধহয় জাগৃতির কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী আক্ষেপ-কাব্য ছুঁড়েছেন। অনলবর্ষী ছন্দে তিনি বলেছেন-

‘দেখ একবার ইতিহাস খুলি 

কত উচ্চে তোরা অধিষ্ঠিত ছিলি,

তথা হতে হায়! কেন রে পড়িলি?

নয়ন মেলিয়া দেখ একবার।’

তাহলে আর দেরি নয়, এবার এই প্রিন্সিপাল সম্পর্কে আমরা এক ঝলক জেনে নিই-

জন্ম ও নাম

ইবরাহীম খাঁ-এর ডাক নাম ছিল খাজা মিয়া। দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ডাকতেন- প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। এ মহান কর্মবীর ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার অন্তর্গত বিরামদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

পরিবার ও পড়ালেখা 

তাঁর পিতা শাবাজ খাঁ ছিলেন প্রভাবশালী গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি  ফশলান্দী হতে বিরামদি গ্রামে এসে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে সে গ্রামের নাম হয় ইবরাহীম খাঁ-এর বাবার নামে- শাবাজনগর। তাঁর মাতা রত্না খানম। ইবরাহীম খাঁ সাত ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন ৬ষ্ঠ। ফশলান্দী ও লোকেরপাড়াতে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করেন তিনি। সরিষাবাড়ির পিংনা হাইস্কুল হতে ১৯১২ সালে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ হতে আইএ পাশ করেন। অতঃপর ১৯১৬ সালে কলকাতার সেন্টপলস কলেজ হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স), ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯২৩ সালে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রী লাভ করেন খাঁ সাহেব। 

বিয়ে

১৯১৭ সালে টাঙ্গাইলের বড়বাশালিয়া গ্রামের রইছ মমতাজ উদ্দীন খাঁর ছোটো মেয়ে আনজুমননেছার সঙ্গে ইবরাহীম খাঁর বিয়ে হয়।

কাজের ময়দান ও মেন্টরের গুরুত্ব

মুসা আলাইহিস সালাম নবুয়তের আগে মেন্টর হিসেবে পেয়েছিলেন শোয়াইব আলাইহিস সালামকে আর নবুয়তের পর খিজির আলাইহিস সালামকে। ময়দান হিসেবে পেয়েছিলেন মাদায়েন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সরাসরি আল্লাহ তাআলা গাইড করতেন, তবুও আল কুরআনের পাতায় পাতায় বিগত নবী-রাসূলদের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তিনি ময়দান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মদিনাকে। আমরা এ ক্রমটি দেখি সক্রেটিস থেকে প্লেটো, এরিস্টটল এবং আলেকজান্ডারের ক্ষেত্রেও।

মাওলানা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহকে নির্দেশনা দিতেন আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ। মাওলানা ময়দান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন লাহোর শহরকে। মেন্টরের সাথে তাঁদের বয়সের পার্থক্য ২০ থেকে ৪০ বৎসর। এভাবে সঠিক মেন্টর ও ময়দানকে বাছাই করাই হচ্ছে সাফল্যের অন্যতম সোনালী সূত্র।  প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নিজে সাফল্যের এ সোনালী সূত্রকে অনুসরণ করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কোন ময়দানকে তিনি বাছাই করেছিলেন এবং কে ছিল তাঁর মেন্টর?  

ইবরাহীম খাঁ-এর কাজের ময়দান

বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যার শাসনকর্তা দাউদ খান, সোলয়ামান খান কররানীদের সুযোগ্য বংশধর হচ্ছে করটিয়ার পন্নী পরিবার। গত পাঁচশত বছরের এতদঅঞ্চলে ইসলামী জাগরণের প্রতীক আতিয়া মসজিদ (১৬০৯ সাল)। এর প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ খান পন্নীর বংশধররা প্রথমে গোড়াই অতঃপর প্রায় ১৭০ বছর আগে করটিয়াতে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা এ এলাকার নাম দেন কুররাতুন আতিয়া (করটিয়া) অর্থাৎ আতিয়া (পরগনার) শহর। এখানে এলেন সাঈদ খান পন্নীর সুযোগ্য উত্তরসূরী সা’দত আলী খান পন্নী। তাঁর সন্তান হাফিয মাহমুদ আলী খান পন্নী। আর তদীয় পুত্র ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া।

বাংলাদেশের বর্তমান ইউনিয়ন সংখ্যা ৪৫৭৮টি। করটিয়া প্রশাসনিকভাবে একটি ইউনিয়ন হলেও অনেক জেলার চাইতেও ছিল অগ্রণী। গত দেড়শত বছরের বাংলার ইতিহাসে এ মফস্বল করটিয়াকে কেন্দ্র করে দেশ-উপমহাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি তথা মুসলিম জাগরণের যে কাজ হয়েছে, কয়েকটি জেলাতেও সে কাজ হয়নি। পন্নী পরিবারের সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৪০ বছর আগে ১৮৮৪ সালে ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার সাথে পাল্লা দিয়ে করটিয়ায় নিজস্ব প্রেস হতে বৃহত্তর মোমেনশাহীর প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘আখবারে ইসলামিয়া’ প্রকাশ হতো। 

কুরআন মাজিদের বাংলা অনুবাদকদের প্রথম সারির একজন ছিলেন মৌলভী নঈমুদ্দীন, যাঁকে সে যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম বলা হতো। তাঁর কুরআনের অনুবাদসহ প্রায় ৩৭টি বইয়ের শুভ সূচনা হয় করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস হতে সা’দত আলী খান এবং হাফেজ মাহমুদের তদারকিতে। ১৯১৩ সালে চাঁদ মিয়ার আয়োজনে এবং স্যার সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে এ করটিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয় সমগ্র ভারতের মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স। করটিয়ার নামদার কুমুল্লি খানপাড়া গ্রামের ফজিলাতুন্নেসা ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং ১৯২৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্রাজুয়েট।

ইবরাহীম খাঁ-এর মেন্টর

চাঁদমিয়া ও তাঁর পূর্বপুরুষগণ করটিয়াকে শুধু টাঙ্গাইল নয়, সমগ্র বাংলায় এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আল কুরআনের অনুবাদ, মোমেনশাহীর প্রথম প্রেস, পত্রিকা আখবারে ইসলামিয়া, সমগ্র বাংলার অন্যতম বৃহৎ হাট। তবে আমাদের অনুসন্ধান- চাঁদ মিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে এ জাগরণের জন্য বাছাই করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- কে এই চাঁদ মিয়া?

১৮৭১ সালে ১লা রমজান চাঁদের কান্তি নিয়ে জন্মেছিলেন বলেই দাদি তাঁর নাম দিয়েছিলেন চাঁদ মিয়া। পূর্ণাঙ্গ নাম ওয়াজেদ আলী খান পন্নী। পিতা ছিলেন সুপণ্ডিত (অন্ধ অথচ কুরআনের হাফেজ) মাহমুদ আলী খান পন্নী। তিনি গৃহশিক্ষকদের কাছে আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি; এ পাঁচটি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গের জন্য গঠিত মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি, লর্ড কার্জনের বিদায় সম্ভাষণ সভার সভাপতি এবং প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। করটিয়া হাইস্কুল, সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠা তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি। তিনি যে ওয়াক্ফ দলিল করেন, তাতে শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য তাঁর বার্ষিক দানের পরিমাণ বর্তমানের প্রায় এক কোটি টাকা! 

কবি গোলাম মোস্তফা তাঁকে বলেছেন, ‘বাংলার দ্বিতীয় মুহসীন।’ প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ চাঁদ মিয়াকে জেলখানায় দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এ লোহার কপাটটি সামনে না থাকলে আজ আপনার পায়ের ধুলা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।’ সাবেক মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান বলেছেন, ‘তাঁর মতো লোক বিরল। তিনি সর্বভারতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন।’ সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিন বলেছেন, ‘তিনি নিজেকে রিক্ত করিয়া তাহার সর্বস্ব জনহিতকর কাজে ব্যয় করিয়াছেন।’ লন্ডন মিউজিয়ামে চাঁদ মিয়ার তৈলচিত্রের নিচে লেখা আছে- ‘One who defied the British’. মওলানা ভাসানী বলেছেন, ‘জমিদাররা যদি সবাই চাঁদ মিয়ার মতো হতো, তবে কখনোই জমিদার-বিরোধী আন্দোলন করতাম না।’ 

ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া এতটা জনপ্রিয় ছিলেন যে, বৃটিশ সরকার ১৯২১ সালে তাঁকে গ্রেফতারের সময় টাঙ্গাইলে প্রায় ১০ হাজার এবং মোমেনশাহী স্টেশনে প্রায় ৩০ হাজার বিক্ষুব্ধ লোক একত্রিত হয়েছিল। তাঁকে গ্রেফতারকারী দু’জন পুলিশ ইস্তফা দিয়েছিল চাকরি থেকে। প্রায় ৯০ বছর আগে  ১৯৩৬ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। করটিয়ার মতো এক নিভৃত গ্রামে প্রায় ১০-১২ হাজার লোক শামিল হয়েছিল তাঁর জানাজায়। তিনিই ছিলেন ইবরাহীম খাঁ-এর মেন্টর। 

ইবরাহীম খাঁ-এর শিক্ষা আন্দোলন

১৯১৯ সালের ১৮ নভেম্বর খাঁ সাহেব চাঁদ মিয়ার অনুরোধে করটিয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। মাত্র পাঁচসিকি (১.২৫ টাকা) দামের চেয়ারে বসে কাজ শুরু করেন তিনি। মাঝে কিছুদিন ময়মনসিংহ শহরে গিয়ে ওকালতি করেন। অতঃপর চাঁদ মিয়ার ডাকে ও তাঁর দানে ১৯২৬ সালে ‘সাদত কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটির প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন খাঁ সাহেব। একটানা ২২ বছর (১৯২৬-১৯৪৭) এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। অবিভক্ত বাংলা ও আসামে সা’দত কলেজ মুসলিম প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ ছিলেন প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল। 

আটিয়ার চাঁদ ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর সার্বিক সহযোগিতা ও প্রেরণায় প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ তাঁর যৌবনের ২৮টি বছর এবং সমগ্র জীবনের (৮৪) এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছেন করটিয়ার এ কাঁদামাটির ভেতর। করটিয়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে সত্যিকার মানুষ গড়তে তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ সময়ে তাঁরা অজপাড়াগাঁ করটিয়ার সার্বিক ভ্যালু বৃদ্ধি করে শুধু টাঙ্গাইল ও বাংলাদেশ নয়, বরং বিশ্বের বুকে এ জনপদকে এক গৌরবোজ্জ্বল জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।

সা’দত কলেজের ছাত্রসংসদের প্রথম ভিপি ছিলেন শামসুল হক। সে সময় সংসদে একটি পোস্ট ছিল- জায়গীর সম্পাদক। এটি বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। এটি দরিদ্র ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার জন্য করা হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়- কলেজ অগ্রসর করার জন্য তিনি এলাকার সব মানুষকেও বিপুলভাবে যুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁরই প্রেরণা ও নির্দেশনাতেই আশেপাশের প্রায় ১০টি জেলা যেমন- সিরাজগঞ্জ, নাটোর, গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ এবং গাজীপুরে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে এ জায়গাগুলোতে কোনো কলেজ ছিল না। 

তাঁরই প্রেরণা ও পরশে এই করটিয়া সা’দত কলেজ হতে বাংলাদেশের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ড. এম এন হুদা, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল শামসুল হক, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীসহ ১০ জনের মতো মন্ত্রী এবং ৪০ এর অধিক এমপি বের হয়েছেন।

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ সা’দত কলেজকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের সেরা মেধাবী শিক্ষকদের একত্রিত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নোয়াখালীর দেশখ্যাত ফকলোর বিশেষজ্ঞ প্রিন্সিপাল তোফায়েল আহমদ, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালেক (যিনি নিজ হাতে পুরানো কলেজ মসজিদের মিহরাবে অঙ্কিত আয়াতটি লিখেছিলেন) প্রমুখ। আবদুল মালেক সাহেবের এক সন্তান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গাইনোকলোজিস্ট প্রফেসর ডা. সায়েবা আক্তার একুশে পদক পেয়েছেন এবার। ইংরেজি শিক্ষক আজিমুদ্দিন এর ছেলে আজকের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক, নোবেলের পরই বিখ্যাত পুরস্কার রেমন-ম্যাগসাইসাই প্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও করটিয়ার স্কুলে লেখাপড়া করেছেন।

ইবরাহীম খাঁ-এর সাহিত্যচর্চা

করটিয়ার এই স্বর্ণালী সময়ে প্রচুর সাহিত্যচর্চা করেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। বাতায়নসহ তাঁর স্মৃতিচারণমূলক বইগুলোতে করটিয়ার প্রচুর ঘটনা পাওয়া যায়। একজন শক্তিশালী মানবতাবাদী  লেখক হিসেবে ইব্রাহীম খাঁ তাঁর লেখায় মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের কথা বলেছেন। তিনি শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, নাটক, ভ্রমণকাহিনী, রসরচনা, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস ও জীবনচরিত, শিশুসাহিত্য, পাঠ্যবই ও অনুবাদসহ শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশেষ করে কামাল পাশা (১৯২৭), আনোয়ার পাশা (১৯৩৯), ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র (১৯৫৪), বেদুঈনের দেশ (১৯৫৬), ব্যাঘ্র মামা (১৯৫১) ইত্যাদি। পাশাপাশি সাহিত্য ক্ষেত্রে বাতিঘর হিসেবে ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. আবদুল্লাহ, ড. আব্দুস সাত্তার, কবি তালিম হোসেন প্রমুখ এমনকি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলকেও প্রেরণা দিয়েছেন। 

কি পেলেন তিনি?

প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ একশত বছর আগে সমগ্র এশিয়ার সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য স্টাইলের এবং মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে এমএ পরীক্ষা দিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর (১৯১৯-১৯৪৭) করটিয়ার মতো অজপাড়াগাঁয়ে কেন কাটিয়েছেন? ভাবা যায়- এটি একজন ব্যক্তির জন্য কী পরিমাণ ত্যাগ-কুরবানী? তবে তাঁর এ মানবদরদী ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজের পুরস্কার তিনি দুনিয়াতেই পেয়েছেন। প্রশ্ন হতে পারে- কি পেয়েছেন?

তিনি নিজে পূর্ব-পাক শিক্ষাবোর্ডের সর্বপ্রথম চেয়ারম্যান, দুইবার এমপিএ, একবার কেন্দ্রীয় গণপরিষদ ও এমএনএ নির্বাচিত হন। উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেবে তিনি ব্রিটিশ আমলে ‘খান সাহেব’ ও ‘খান বাহাদুর’ এবং পাকিস্তান আমলে ‘সিতাঁরা-ই-ইমতিয়াজ’ ও ‘তমঘায়ে কায়েদ-ই আম’ উপাধি এবং নাটকে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৩) ও সাহিত্যের জন্য একুশে পদক (১৯৭৬) লাভ করেন। এক জীবনে আর কী চাই? 

মৃত্যুবরণ

খ্যাতনামা কলম-সৈনিক, সুসাহিত্যিক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ১৯৭৯ সালের ২৯ মার্চ ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে সমাহিত করা হয় তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে ভূঞাপুর কলেজটি ‘ইবরাহীম খাঁ কলেজ’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। 

শেষকথা

আমরা এসব মহীয়ান পুরুষ ও গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে যেন ভুলে না যাই। এ স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস এবং মহান পুরুষদের শিক্ষা ও সংগ্রামই আমাদের দেশ ও জাতীর নবজাগরণে প্রাণসঞ্চার করতে পারে ইনশাআল্লাহ।

লেখক :  বিশিষ্ট গবেষক ও প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির