post

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে হামাস : অবৈধ দখলদার ইসরাইলবিরোধী যুদ্ধে যেভাবে টিকে আছে

মুহাম্মদ নূরে আলম

২০ মার্চ ২০২৪

এই লেখার শুরুতে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি, The Jerusalem Post ইসরাইলের পত্রিকায় হামাসের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর জেরুজালেমকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি হামাসের এই শিরোনামে “Hamas vows to ‘liberate’ Jerusalem on 35th birthday” একটি নিউজ প্রকাশ করে এবং ৮ ডিসেম্বর ২০২২ ‘‘The Jerusalem Post / JPost.com’’  অফিসিয়াল ফেইসবুকে নিউজটা বুস্ট করে পোস্ট করে। সেখানে অনেক কমেন্টেই দেখলাম হামাস ও ফিলিস্তিনের জনগণ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের বিরুদ্ধে মন্তব্যের ঝড়। তাই আমিও একটি পালটা মন্তব্য করার আগ্রহ থেকে মন্তব্য করি। আমার মন্তব্যটি ছিল এই রকম, “InshaAllah, One day Allah will give to victory Hamas and Palestine people. and also destroy Jews and Israel’’ এই মন্তব্য করার ১ ঘণ্টাও পার হয়নি ফেইসবুক থেকে নোটিফিকেশন, যথারীতি মন্তব্য মুছে দেয় ফেইসবুকের মালিক ইহুদি মার্ক জুকারবার্গ। শুধু তাই নয়; আমার ফেইসবুক একাউন্ট ১ মাসের জন্য রেস্ট্রিকটেড (restricted) করা হয়। এইভাবে ফিলিস্তিনের ওপরে উগ্র ইহুদি ও দখলদার সন্ত্রাসী ইসরাইলের বর্বরতা, হত্যা-নির্যাতনের খবর প্রকাশ করতে দেয় না। কোনো মিডিয়ায় আপনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখালে আপনার মন্তব্য মুছে দেবে বা ব্লক করে দেবে। এমনই হাজারো বাধা ও সমস্যার মুখে হামাস ও ফিলিস্তিনের জনগণকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, সেই ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। গাজার সাধারণ নাগরিকদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ, বসতবাড়ি দখল, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, মিডিয়া-সংবাদপত্র অফিসেও বিমান থেকে বোমা হামলা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন লাইন ধ্বংস, গণহত্যা, গণগ্রেফতার প্রকৃতপক্ষে ইসরাইলের হিং¯্র ও বর্বর মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। হাসপাতালে হামলার পরও আমরা পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘের নীরবতা দেখছি। গাজা যুদ্ধে সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। এজন্য জাতিসংঘ দেশটির সেনাবাহিনীকে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানিয়েছে। এ খবর দিয়েছে আল জাজিরা। হামাস ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরাইলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা দখলদার অবৈধ ইসরাইলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হলো, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরাইল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একটি পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র। হামাস সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটেনিকায় বলা হয়েছে, Hamas, also spelled Ḥamās, acronym of Ḥarakat al-Muqāwamah al-Islāmiyyah, English Islamic Resistance Movement, militant Palestinian nationalist and Islamist movement in the West Bank and Gaza Strip that is dedicated to the establishment of an independent Islamic state in historical Palestine. Founded in 1987, Hamas opposed the secular approach of the Palestine Liberation Organization (PLO) to the Israeli-Palestinian conflict and rejected attempts to cede any part of Palestine.1

হামাস জানবাজ মুজাহিদের সংগ্রামী ও শহীদি সংগঠন। হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া-এর সংক্ষিপ্ত রূপ-হামাস। ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। ফিলিস্তিনের একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল। দলটি গাজা শহর নিয়ন্ত্রণ করে। হামাসের সামরিক শাখা ইজ্ আদ-দ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেড। প্রতিষ্ঠাকাল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৭। ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের সদর দপ্তর। হামাসের মতাদর্শ হচ্ছে- আশআরি-মাতুরিদি, ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ, ইসলাম, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, জায়নবাদ আগ্রাসন প্রতিরোধ ও গণতন্ত্র। হামাস ফিলিস্তিনকে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করতে এবং বর্তমানে ইসরাইল, পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপ এলাকায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর আমেরিকার National Counterterrorism Center-এর মতে- হামাস হলো, HAMAS formed in late 1987 at the beginning of the first Palestinian intifada (uprising). Its roots are in the Palestinian branch of the Muslim Brotherhood, and it is supported by a robust sociopolitical structure inside the Palestinian territories. The group’s charter calls for establishing an Islamic Palestinian state in place of Israel and rejects all agreements made between the PLO and Israel. HAMAS’ strength is concentrated in the Gaza Strip and areas of the West Bank.2

আমেরিকার কাউন্টার টেররিজম সেন্টার বলছে, মুসলিম বাদ্রারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা থেকেই হামাসের জন্ম হয়। হামাস পরিচালিত বহু জনহিতকর সংস্থা আছে। তারা গাজায় মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে, যা ১৯৫০ সাল থেকে চলমান। অন্য যেকোনো সংগঠন থেকে হামাস জনকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে। The Council on Foreign Relations is an American think tank প্রতিষ্ঠানের মতে, Hamas had been active in the Gaza Strip since the 1950s and gained influence through a network of mosques and various charitable and social organizations.3

হামাসের নেতৃত্ব সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়। যেহেতু ইসরাইলি বাহিনীর টার্গেটে থাকেন সংগঠনটির নেতারা, সম্ভবত এ কারণেই সমান্তরাল নেতৃত্ব তৈরি করে দলটি। হামাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী হামাসের বর্তমান মুখপাত্র আবু ওবায়দা (Hamas spokesman Abu Obeida)। তার আগে ছিল আবদ আল-লতিফ আল-কানউ (Abd al-Latif al-Qanou) এবং তারও আগে এই দায়িত্ব পালন করেন ফাওজি বারহুম।

পলিটিক্যাল ব্যুরোর প্রধান ইসমাঈল হানিয়া, পলিটিকাল ব্যুরোর উপ-প্রধান মুসা আবু মারজুক ও খালেদ মিশাল। কট্টর ইসরাইলবিরোধী আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আহামদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন-আব্দেল আজিজ আল-রানতিসি, মাহমুদ জাহার, মোহাম্মদ তাহ আব্দেল ফাত্তাহ দুখান, ইবরাহিম ফারেস আল-ইয়াজুরি, ইসা আল-নাশশার ইবরাহিম কুকা, মোহাম্মদ হাসান, শামা ও হাসান ইউসুফ।  ২০০৪ সালের মার্চে গাজায় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শহীদ হন শায়খ আহামদ ইয়াসিন। পরের মাসেই শহীদ হন আব্দেল আজিজ আল-রানতিসি। এরপর প্রধান হন খালেদ মিশাল। তাঁকেও হত্যার চেষ্টা করে ইসরাইলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। তবে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সামনে আসেন ইসমাইল হানিয়া। 

মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা ছিল ফিলিস্তিনের হামাস। প্রথম ইন্তিফাদা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই এটির গাজা শাখা ইসরাইলবিরোধী অবস্থান নেয় এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহামদ ইয়াসিনের ১৯৮৭ সালে দেওয়া বক্তব্য এবং ১৯৮৮ সালের হামাস সনদ নিশ্চিত করে যে, হামাস আধুনিক ইসরাইলসহ ফিলিস্তিনকে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করতে এবং বর্তমানে ইসরাইল, পশ্চিম তীর এবং গাজা স্ট্রিপ এলাকায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইন্তিফাদা মাধ্যমে হামাসের বেড়ে ওঠার সম্পর্কে Inside Hamas: The Untold Story of Militants, Martyrs and Spies গ্রন্থের লেখক Zaki Chehab বলেন,By the start of the Intifada, the various Islamist movements that went on to become Hamas had managed to establish themselves as a potent force in Palestinian politics, and one whose outlook and strategy differed in key ways from Fatah. (page-22).4

হামাস প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। প্রথমত, এর সামরিক শাখা ইজ আদ-দ্বীন আল-কাসাসম ব্রিগেডের মাধ্যমে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা। পিএলও-র মতো হামাস ইসরাইলের অস্তিত্বের অধিকারে বিশ্বাস করে না। তাদের প্রতীকে রয়েছে জেরুজালেমের ‘ডোম অব দ্য রক বা আল আকসা মসজিদ’। ইসরাইল, গাজা ও পশ্চিম তীরকে একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে তারা বিবেচনা করে। ১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাত ‘অসলো’ চুক্তির অধীনে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন, যার মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া প্রথম ইন্তিফাদার অবসান হয়। হামাস এই শান্তি প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করে দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। হামাস তাদের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডের মাধ্যমে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতিহত করতে অনেকটাই সফল হয়েছে। এ সম্পর্কে Praeger security international থেকে প্রকাশিত Hamas: Terrorism, Governance, and Its Future in Middle East Politics গ্রন্থের লেখক JENNIFER JEFFERIS বলেন, In the establishment of the Qassam Brigades, Hamas once again rein-forced their identity as one that was founded in Islam, in pursuit of Nationalism, by means of resistance. The relationship between the three Meant that each carried the moral value of the other, which gave greater Weight to Hamas’s resistance than Fatah could claim. (Page-109).5

২০০৪ সালে ইয়াসিন আরাফাতের মৃত্যুর পর হামাস ও ফাতাহ’র মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয় এবং সেটা চরম আকার ধারণ করে ২০০৬-এর নির্বাচনের পর। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে গাজার সাধারণ নির্বাচনে হামাস পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলে নির্বাচনে জয়ী হয় হামাস। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিনে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০০৭ সালে হামাস ফাতাহ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে পরাজিত করে গাজার দখল নেয়। সেই থেকে গাজা শাসন করছে হামাস। মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ-এর অধীনে রয়েছে পশ্চিম তীর আর গাজা এলাকার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে। ২০০৮-০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলি সেনার সঙ্গে হামাসের তুমুল যুদ্ধ এখনও চলমান। সেই যুদ্ধগুলোতে হামাস ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট ছুড়ে ইসরাইলের বর্বরতার প্রতিবাদ জানায়। ক্রমাগত রকেট হামলার মুখে সন্ত্রাসী ইসরাইলি বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ইসরাইলের ধ্বংসকাণ্ডের ওপরে গাজা পুনর্গঠনে এবং সাধারণ মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ায় হামাসের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে। ২০০৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের সন্ত্রাসী তালিকায় রাখে। হামাস এই বিষয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করে। তবে আদালত তাদের আবেদন বাতিল করে। যুক্তরাজ্য কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়াও হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু ইরান, রাশিয়া, তুরস্ক, চীন ও সিরিয়া হামাসের পক্ষে অবস্থান নেয়। তারা মনে করে, হামাস স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল এবং গাজার সরকারপ্রধান।

হামাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগী দেশ কাতার। দেশটির আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি প্রথম রাষ্ট্রনেতা, যিনি ২০১২ সালে হামাস সরকারের সঙ্গে দেখা করেন। এখন পর্যন্ত দেশটি হামাসকে ২০০ কোটি ডলার দিয়েছে। হামাসের প্রতি তুরস্কেরও সমর্থন রয়েছে। সংগঠনটির নেতা ইসমাঈল হানিয়ের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে রজব তাইয়েব-এদোয়ানের। এছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ ও ফাউন্ডেশনের সহযোগিতাও পায় তারা। ২০২১-২২ এবং ২০২৩ সালের সংঘাতেও ইসরাইলের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন শতাধিক রকেট ছুড়েছে হামাস। দীর্ঘদিন হামাস রকেটের জন্য ইরানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সুদান ও মিশর হয়ে ইরান থেকে অস্ত্র আসতো। তবে বর্তমানে গাজাতেই হামাস রকেট বানাচ্ছে বলেও ধারণা করা হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে হামাস প্রায়শই বলে আসছে যে ইসরাইল যদি ১৯৬৭ সালের সীমান্তে সরে যায়, ক্ষতিপূরণ প্রদান করে, অঞ্চলগুলোতে অবাধ নির্বাচনের অনুমতি দেয় এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরে আসার অধিকার দেয়, তবে তারা একটি যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করবে।

ইজ্ আদ-দ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেড হলো ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের সশস্ত্র শাখা। ইজ্ আদ-দ্বীন আল-কাসসামের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত রূপ আল-কাসসাম। এর নেতৃবৃন্দ হচ্ছেন, মোহাম্মাদ দেইফ ও মারওয়ান ইসসা। সদরদপ্তর গাজায় অবস্থিত। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় থেকে এটি ইসরাইলের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই সংগঠনটির শক্তি-সামর্থ্য বহু রাষ্ট্রকে বিস্মিত করে দিয়েছে। ইজ্ আদ-দ্বীন আল-কাসসামকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও মিশর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রিগেড নেতা মোহাম্মদ দেইফকেও নির্বাহী আদেশ ১৩২২৪-এর অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে মনোনীত গ্লোবাল টেররিস্ট হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। আল-কাসসাম ব্রিগেডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে-আল কুরআন এবং রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ আর মুসলিম শাসক ও বিদ্বানদের নীতি অনুসরণে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা। আল-কাসসামের উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনের জনগণকে জায়নবাদী ইহুদিদের দখলদারিত্বের হাত থেকে মুক্ত করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যা জায়নবাদী সন্ত্রাসীরা হরণ করেছে। সেইসাথে আল-কাসসাম নিজেকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক মনে করে।

আল-কাসসাম ব্রিগেড হামাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও তারা হামাসের অঙ্গ সংগঠন, তবুও তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। হামাসের বক্তব্য অনুসারে : ‘ইজ্ আদ-দ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেড একটা স্বাধীন সামরিক সংগঠন (ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য সন্ত্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করে যাচ্ছে)। এর নিজস্ব নেতা রয়েছে, যারা হামাসের আদেশ গ্রহণ করে না এবং তথ্য ও অগ্রগতির কথাও হামাস নেতাদের জানানো হয় না। যোদ্ধাদের পরিচিতি এবং সংগঠনে এদের অবস্থান মৃত্যু পর্যন্ত গোপন থাকে। এমনকি যখন তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তখন তারা সবুজ বেল্ট দিয়ে বাঁধা কালো মুখোশ পরিধান করে। ইজ্ আদ-দ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেড স্বাধীন অণুশাখা মডেলে কাজ করে। এ কারণে অনেক সিনিয়র নেতাও অন্য শাখার খবর জানে না। এই শাখাগুলো নেতাদের মৃত্যুর পর নিজেরাই নেতা নির্বাচন করে। আল আকসা ইন্তিফাদার সময়ে বিমান হামলায় অনেক নেতা মারা যায়। এদের মধ্য রয়েছে সালাহ শাহাদি ও আদনান আল গুলের মতো বড়ো নেতা। সংগঠনটির বর্তমান এবং দীর্ঘমেয়াদি নেতা মোহাম্মাদ দেইফ, যিনি পাঁচবার গুপ্তহত্যা থেকে বেঁচে গেছেন বলে কথিত আছে। আল কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র হলেন আবু ওবায়দাহ। তিনি বলেন, The Al-Qassam Brigades spokesman, Abu Obeida, warned the Zionist enemy against harming Hamas leader, Yahya Sinwar, or any of the resistance leaders.6

অসলো চুক্তির পরপরই হামাসকে সহযোগিতার জন্য সংগঠনটির সশস্ত্র রূপান্তর ঘটে। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে অধিকৃত জালাবিয়া এলাকায় ব্রিগেডটি ব্যাপকভাবে ইসরাইলি হামলার স্বীকার হয়। বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাও মারা যান। তারপরও সংগঠনটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে আক্রমণ করার মতো সক্ষমতা অর্জন করে। এরপর তারা দলে যোগ দেওয়ার মতো প্রচুর স্বেচ্ছাসেবীও পেয়ে যায়। একদল গোপনে কাসসামকে বিভিন্ন হাতে বানানো অস্ত্র যেমন আল বানা, বাতর, ইয়াসিন ইত্যাদি সরবরাহ করে। কাসসাম রকেট তাদের আর্টিলারি প্রযুক্তিতে সর্বশেষ সংযোজন। ২০০৫ সালের প্রথমদিকে কাসসাম ইসরাইলি সরকার এবং ফিলিস্তিনি অথরিটির (পিএ) শান্তি আলোচনার পক্ষে মতামত দেয়। এই সুযোগে তারা নিজেকে আবার জোরালোভাবে সংগঠিত করে। ২০০৫ সালের আগস্টে ইসরাইল গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে কাসসাম গাজায় ব্যাপক র‍্যালি করে। এ সমস্ত র‍্যালিতে তারা নিজেদের প্রচুর অস্ত্রের মজুদ আর সৈন্য-সামন্তের ব্যাপকতা প্রদর্শন করে ফিলিস্তিনি সাধারণ নাগরিকদের মনে আশা জাগান সন্ত্রাসী ইসরাইল বাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এই ব্রিগেডের উল্লেখযোগ্য সদস্য হচ্ছেন- ইয়াহইয়া আয়াশ, আদনান আল হুল, সালাহ শাহাদি, ওয়ালি নাসার, আহমেদ জাবেরী, সালামা আহমাদ, ইমাদ আব্বাস, নিদাল ফাতহি রাব্বাহ ফারহাত, আবু ওবায়দাহ (মুখপাত্র), ইয়াসিন আল-আসতাল ও মারওয়ান ইসসা।

১ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে তাদের প্রথম অপারেশনের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘আল-কাসসাম ব্রিগেড’। এ ব্রিগেডের একটি অংশ দরনসশান নামে একজন ইসরায়েলি রাবাইকে (ইসরায়েলি ধর্মযাজক) হত্যা করে। এক ঘোষণার মাধ্যমে হামাস আল-কাসসাম ব্রিগেডকে তাদের মিলিটারি শাখা হিসেবে ঘোষণা করে। শুরুতে সীমিত সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শুরু করা এ ব্রিগেড এখন গাজার একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে। কেবল গাজাতেই তাদের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এটি একটি সত্যিকারের সেনাদল, যেটিতে সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন এবং ব্রিগেড। নর্দার্ন গাজা ব্রিগেড, গাজা ব্রিগেড, সেন্ট্রাল গাজা ব্রিগেড এবং সাউর্দার্ন গাজা ব্রিগেড নামে আল-কাসসামের চারটি ব্রিগেড আছে; যার মূল সৈন্য সংখ্যা অন্তত ৫০-৬০ হাজার। একটি পিস্তল নিয়ে শুরু হয় এ সামরিক শাখা, এরপর অস্ত্রাগারে যোগ হয় একটি রাইফেল। অতঃপর নিজেদের তৈরি মেশিনগান। ধীরে ধীরে ‘হোয়াজ’-এর মতো বিস্ফোরক যন্ত্র, আত্মঘাতী হামলার জন্য বেল্ট এবং দূর থেকে হামলার জন্য বিস্ফোরক যন্ত্র যোগ হয়। ২০০১ সালের ২৬ অক্টোবর আল-কাসসাম ব্রিগেড স্থানীয়ভাবে তৈরি রকেট দিয়ে ইসরাইলে হামলা চালায়। এ রকেটের নাম ছিল ‘কাসসাম-১’। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যবহার করা হয় ‘কাসসাম-২’। এর মধ্যে ২০১২ সালের এক যুদ্ধে তারা এম-৭৫ ব্যবহার করে। এ সময় যুদ্ধে তারা ইসরাইলের হাইফা শহরকে লক্ষ করে আর-১৬৯ রকেট ব্যবহার করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনীর মতো আল-কাসসাম ব্রিগেডের ইঞ্জিনিয়ারিং, এরিয়াল, আর্টিলারি এবং আত্মঘাতী স্কোয়াড রয়েছে। ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য আল কাসসাম বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন করেছে। আল-কাসসামের মিলিটারি শাখা ‘আল-বাত্তার’, ‘আল-ইয়াসিন’ নামের কামান বিধ্বংসী গোলা তৈরি করে, যেটি ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী মেরকাভা কামান ধ্বংস করতে সক্ষম।৭

মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে অবৈধ দখলদার ইসরাইলবিরোধী যুদ্ধে যেভাবে টিকে আছে হামাস

হামাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে হামাসের কাজ ও তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়, Hamas is a national Palestinian movement that works with the rest of the Palestinian people and with all national and Islamic factions and bodies and people of conscience all over the world on resisting the Israeli occupation as well as liberating the Palestinian land, Jerusalem, and Islamic and Christian holy places, securing the right of Palestinian refugees to return to their homeland and establishing a sovereign Palestinian State.8

ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন বা ‘হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া’ সংক্ষেপে ‘হামাস’। আমাদের মধ্যে যাদের জন্ম ৯০-এর দশকে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেই সংবাদপত্রের ছাপার অক্ষরে অথবা টেলিভিশনে ফিলিস্তিনের প্রধান প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে এই সংগঠনের নামই শুনে এসেছি ছোটোবেলা থেকে। একেবারে সাম্প্রতিক সংঘাতেও প্রিন্ট থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সবখানেই ফিলিস্তিনের একপ্রকার প্রতিনিধি হিসেবেই উঠে এসেছে হামাসের নাম। এই সংগঠনটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের মতাদর্শে বিশ্বাস করে। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহামদ ইয়াসিন ও হামাসের ৪টি মূলনীতির সম্পর্কে, Inside Hamas: The Untold Story of Militants, Martyrs and Spies গ্রন্থের লেখক Zaki Chehab বলেন, The founder of Hamas later described to me in an interview the development of his movement in four, clearly defined stages. The first phase was to build its institutions; charities and social committees which would open their doors to the young and old–anyone who could play a role in resisting the occupier. This was a prelude to their confrontation with the Israeli enemy in the Intifada which, according to Sheikh Yassin, was instigated single-handedly by Hamas, without the involvement of other Palestinian factions. The second phase worked on strengthening the roots of the resistance within every household in the West Bank and Gaza, and to bolster its political credibility.(page-21)9

ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালে ২০০৪ সালে গাজায় নামাজে যাওয়ার সময় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হমলায় নিহত হন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আহামদ ইয়াসিন। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আরেক প্রভাবশালী নেতা আব্দেল আজিজ আল-রানতিসি। ইসরাইলি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শায়খ আহামদ ইয়াসিনসহ হামাসের অনেক নেতা নিহত হলেও সংগঠনের কর্মকাণ্ডের গতি কখনোই স্তিমিত হয়ে পড়েনি। একজন নেতা নিহত হওয়ার পর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার স্থান বা পদটি পূরণ করা হয়েছে আরেকজনকে দিয়ে। এ কারণে হামাসের মধ্যে কখনোই নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়নি। ইসরাইলি অনুচরদের প্রবেশ রোধে এবং সংগঠনের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংগঠনের মধ্যে অত্যাধুনিক পন্থায় কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে চলা হয়। এ কারণে শায়খ আহামদ ইয়াসিন নিহত হওয়ার পর গাজায় হামাসের অতি পরিচিত কোনো নেতা নিগৃত হবার কথা শোনা যায় না।

ফিলিস্তিনিরা গাজার প্রতি ইসরাইলি দখলদারিত্বের আগ্রাসী নীতি মেনে নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন হামাসের মুখপাত্র আবু ওবাইদা। তিনি বলেন, গাজা উপত্যকায় আরোপিত অবরোধ ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং বিশ^ ইস্যুতে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণকারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে লজ্জাজনক।

‘গাজায় অবরোধের ১৬ বছর : প্রভাব এবং সম্ভাবনা’ শীর্ষক শিরোনামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রদত্ত একটি বক্তৃতায় সাবেক মুখপাত্র আল-কানউ এই কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের জনগণ গাজা উপত্যকার প্রতি অব্যাহত আগ্রাসী নীতি মেনে নেবে না। এই অব্যাহত অবরোধ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একধরনের আগ্রাসন এবং ২.৫ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিদের জন্য হুমকি। হামাসের মুখপাত্র ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ ও আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যতের পরিণতির জন্য ইসরাইলি দখলদারিত্বকে দায়ী করেছেন। ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ব্যাপক সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে আল-কানউ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্বের মুক্ত জনগণকে গাজার অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য ইসরাইলি দখলদারিত্বের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য তাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করার এবং দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।১০

হামাসের এক একজন কর্মী জানেন, শায়খ আহমাদ ইয়াসিনের সাড়া জাগানো উক্তি “We chose this road, and will end with martyrdom or victory’’- “আমরা যে রাস্তাটি বেছে নিয়েছি, শাহাদাত বা বিজয়ের মাধ্যমে তা শেষ করব।’’ তাদের এই লড়াই কোনো স্বার্থ অর্জনের জন্য নয়; এই লড়াই মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই। ফলে এই লড়াইয়ের যেমন শেষ নেই, তেমনি নেই পরাজয়। প্রশ্ন হলো- ইসরাইলি নজরদারির মধ্যে হামাস যোদ্ধারা কোথায় থাকে আর কীভাবেই-বা চলাফেরা করে? কীভাবেই-বা ইসরাইলের আগ্রাসন ও বর্বরতার প্রতিরোধ করে। কীভাবেই-বা গাজার জনগণের জন্য জনকল্যাণমূলক কাজ করে। অপরাপর মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধারা যেভাবে শার্কের মুখের সামনে পাইলট ফিসের মতো ঘুরে বেড়ায়, তেমনি ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও সাধারণ মানুষের মাঝে অবস্থান করে। ইসরাইলের অভিযোগ গাজায় টানেলের মধ্যে হামাস যোদ্ধারা অবস্থান করে। কিন্তু ইসরাইলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা হচ্ছে; তারা এই টানেলের কোনো কূল-কিনারা করতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে হামাস যোদ্ধারা গাজায় এতটাই জনপ্রিয় যে, গাজায় ইসরাইলের গোয়েন্দা কার্যক্রম কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে গাজায় বেসামরিক লোকজনের ওপর ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলা অব্যাহত রয়েছে। আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট, যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনির সংখ্যা কমিয়ে এনে ভূমি ও বসতবাড়ি দখল এবং গাজায় নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপন। বেসামরিক হোক বা প্রতিরোধ যোদ্ধা, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের যে-কোনো উপায়ে হত্যা করা ইসরাইলের অঘোষিত নীতি। ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিছুদিন পরপর এভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। ফলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নতুন কোনো ঘটনা নয়; বরং বর্বর ইসরাইলের চলমান সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অংশ। যে-কোনো ফিলিস্তিনি নাগরিককে হত্যা করতে হবে এই মানসিকতা দিয়ে ইসরাইলি নাগরিকদের গড়ে তুলছে জায়নবাদী ইহুদিরা। হামাসের হামলায় নিহত ইসরাইলি সৈন্য মোশে মালকুর লাশ দাফনের পর তার এক বন্ধু ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে বলছিলেন, Hamas killed my friend; we need to kill them–not just the Hamas militants but all the people in Gaza,” গাজার সাধারণ নাগরিকদের হত্যা প্রকৃতপক্ষে এই বর্বর ইহুদি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।১১

প্রশ্ন হলো, হামাসের এই প্রতিরোধের লড়াই কার সাথে? শুধুই কি ইসরাইলের সাথে? না, আসলে তো পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলো তো মার্কিন যুদ্ধবিমান। ইসরাইলের সামরিক ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যে জনগোষ্ঠী ইসরাইলের সাথে লড়াই করছে, তাদের জন্য পশ্চিমা বিবেক কাঁদবে এমন আশা করা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকতে হবে, সেটাই আত্মরক্ষার পথ। মধ্যপ্রাচ্য শান্তির নামে একাধিক চুক্তি হয়েছে। এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরা হারিয়েছে স্বজন আর ভূখণ্ড। ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে অসলো চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়নে ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিডে, ২০০৩ সালে তাবায়, ২০০৭ সালে আনাপোলিসে এবং ২০১০ সালে ওয়াশিংটনে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। না, শূন্য বলা ঠিক হবে না। এখন জেরুজালেমকেও রাজধানী ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০ বছরের আলোচনার নামে যা হয়েছে, তাতে সবই ইসরাইলের অর্জন। এর মধ্যে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ধীরে ধীরে কমে এসেছে। ইসরাইলের দখলদারিত্ব বেড়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণের লাশের সারি দীর্ঘ হয়েছে। জবরদখল করা জমিতে ৫৩ হাজার ইসরাইলি সেটেলারের বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরও সাড়ে চার হাজার বাড়ি ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের এই জমি দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলে ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে। সেই ধারাবাহিকতা এক দিনের জন্যও থামেনি। অসলো চুক্তির পর ফাতাহ গেরিলা যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু স্বপ্নের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করা যায়নি। কারণ, ইসরাইল রাষ্ট্রের কোনো সীমানা নেই। যেখানে ফিলিস্তিনি বসতি, সেখানে ইসরাইলের সীমানা বা অবৈধ দখলদারিত্ব। শান্তিচুক্তির পর ফাতাহর প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তিতুল্য গেরিলা যোদ্ধা ইয়াসির আরাফাত রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। পরে তদন্তে দেখা গেছে, বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের তীর এখনও ইসরাইলের দিকে। এই প্রসঙ্গে ইহুদি ইতিহাসবিদ ও গবেষক হিসেবে ইলান পেপে আমাদের জানাচ্ছেন যে, ফিলিস্তিনের প্রতিটি গ্রামের মানুষের সংখ্যা, গ্রামপ্রধান বা মুখতারের পরিচিতি, গ্রামে প্রবেশ-নির্গমনপথ ইত্যাদিসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল নিধন-বিতাড়নযজ্ঞ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে পুরোদমে এই নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। যে কটি গণহত্যা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে সবার আগে আসে দেইর ইয়াসিনের গণহত্যা।১২

এখন ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ড চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সমুদ্রে যাতে মাছ ধরতে না পারে, সেজন্য ইসরাইলি গানবোট সারাক্ষণ পাহারায় থাকছে। গাজার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ইসরাইলি কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে হামাস সরকার গঠনের পর ২০০৬ সাল থেকে চলছে গাজার ওপর অবরোধ। গাজার মানুষের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণ হয় সুড়ঙ্গ পথে। চোরাচালানের মাধ্যমে আনা-নেওয়া মালামালের মাধ্যমে। এভাবে একটি জনবসতি কত দিন টিকে থাকবে। হয় তাদের ইসরাইলের কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে অথবা প্রতিরোধ লড়াইয়ের মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। হামাসের আন্দোলন ও ২০০৬ সালের নির্বাচন সম্পর্কে Nova Science Publishers, Inc. New York থেকে প্রকাশিত ISRAEL VS. HAMAS বইয়ের সম্পাদক NEJC KARDELJ বলেন, The rise in popularity and strength of the HAMAS (Harakat al Muqawama al-Islamiyya, or Movement of the Islamic Resistance) Organization and its interaction with Israel is important to an understanding of Israel’s ÔÔArab” policies and its approach to counterterrorism and counterinsurgency. The crisis brought about by the electoral success of HAMAS in 2006 also challenged Western powers’’ commitment to democratic change in the Middle East because Palestinians had supported the organization in the polls. Thus, the viability of a two-state solution rested on an Israeli acknowledgement of the Islamist movement, HAMAS, and on Fatah’’s ceding power to it.13

মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন- “ইসরাইলের অবশ্যই আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু হামাসের আগ্রাসন মোকাবেলার অধিকার নেই!” হামাস দক্ষতার সাথে ইসরাইলের হামলা ও বর্বরতা মোকাবিলা করে টেলিফোন লাইন মেরামত ও অন্যান্য জরুরি পরিসেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, হামাসের কাজের দক্ষতার সম্পর্কে ঘড়াধ Nova Science Publishers, Inc. New York থেকে প্রকাশিত ISRAEL VS. HAMAS বইয়ের সম্পাদক NEJC KARDELJ বলেন, All in all, HAMAS, after the initial, very regrettable violence in Gaza, restored order, and though continuing to battle certain powerful clans, earned respect; instituting the first ÔÔ911” emergency telephone service, and operating more efficiently than expected. 14

হামাস এইসব বাস্তবতা উপলব্ধি করে যুদ্ধবিরতির জন্য কতগুলো শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজায় ইসরাইলি হামলা বন্ধ করা। অবরোধ তুলে নেওয়া, সমুদ্রের ১২ মাইল পর্যন্ত সীমানায় মাছ ধরার নিশ্চয়তা দেওয়া, আটক নেতাকর্মীদের ছেড়ে দেওয়া। এসব দাবি মেনে নেওয়া না হলে যুদ্ধ চলবে। সর্বশেষ ফিলিস্তিনের সাবেক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হামাস এই দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। কারণ, তারা জানে স্থলযুদ্ধে ইসরাইলের বিজয় অর্জন করা সম্ভব হবে না। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে লেবানন যুদ্ধের মতো তাদের পরাজিত হতে হবে। ফিলিস্তিনিরা বিশেষ করে গাজার অধিবাসীরা এই লড়াইয়ের পথ থেকে সরে আসেনি। অপরদিকে এই লড়াইকে শুধু ভয় পায় ইসরাইল। এ কারণেই হামাসকে নির্মূল করতে চায় ইসরাইল। নারী ও শিশুদের হত্যা কিংবা হাসপাতালে হামলা করে ইসরাইল যেমন ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে চায়, তেমনি হামাস যোদ্ধাদের মনোবল ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু এতে ইসরাইলের অর্জন খুব সামান্যই। কারণ, হামাসের সামরিক শাখা গড়ে উঠেছে প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে, যার নামের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে নিহত সিরিয়ান মুক্তি আন্দোলনের নেতা শহীদ ‘ইজ আদ-দ্বীন আল-কাসসাম’-এর নাম অনুসারে এ সামরিক শাখার নাম দেওয়া হয় ‘আল কাসসাম’ বিগ্রেড। ১৫

গাজার মানুষের কাছে হামাস কেন জনপ্রিয়

১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনির ওপর নেমে আসে দুর্যোগ। একে তারা নাম দেয় নাক্ববা। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে মিশরকে পরাজিত করার পর গাজা এবং পশ্চিম তীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ইসরায়েল। ইসরাইলের ওপর গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো অভিযান চালাল গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের ৫৮ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই কংক্রিট ও স্টিলের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মিশরের সঙ্গে গাজার আরও ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত আছে। ভূমধ্যসাগরের তীরে গাজার উপকূলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। ইসরায়েলি নৌবাহিনী কোনো জাহাজকে এই উপকূলে আসতে দেয় না। ২০০৫ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় (প্রতিরোধ আন্দোলন) গাজা থেকে সরে যায় ইসরাইল। পরের বছর ২০০৬ সালে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠায় জয়ী হয়ে হামাস সরকার গঠন করে। তবে নির্বাচনে বেশি আসন পেয়েও ক্ষমতা পায়নি হামাস। ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক দল ফাতাহ এবং পশ্চিমা সমর্থকরা হামাসকে পশ্চিম তীর থেকে সরিয়ে দেয়। ফলে ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়। অবশেষে ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতা চলে যায় হামাসের হাতে। এর পর থেকে গাজায় আর নির্বাচন হয়নি। এএফপি, আরব নিউজ, দ্য নিউ আরব। 

১৯৮৭ হামাস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাপকভাবে জনসেবা এবং সামাজিক কাজ করতে লাগল। যেমন : ফ্রি ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা, ফ্রি স্কুলিং, কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মসজিদ এবং লাইব্রেরি নির্মাণ, খেলার মাঠ নির্মাণ, পার্ক নির্মাণ, ফ্রি রুটির দোকান চালু, মা ও শিশুদের জন্য মেডিকেল সেন্টার প্রতিষ্ঠা, ইসরাইলের অবরোধ থেকে বাঁচতে ব্যাপকভিত্তিক টানেল চালু। গাজার লাইফ লাইন হলো এই টানেলগুলো। এই কাজগুলোর মাধ্যমেই হামাস গাজার মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। আর এই জনগণকে সাথে নিয়েই দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলমান গাজা অবরোধের মধ্যেই হামাস ইসরাইলবিরোধী যুদ্ধে টিকে আছে। হামাসের মেধাবী নেতারা জানে মানুষের কোন প্রয়োজনটি আগে? শরণার্থী শিবিরের শিশুরা যেন মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে, সেটাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে কাজ শুরু করে হামাস। স্কুল, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা আর সেগুলোকে সবার সমান নাগালে রাখা হয়ে ওঠে হামাসের মূল কাজ। মানুষ কাছে টেনে নেয় হামাসকে। ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় “হামাস চার্টার”, যার লক্ষ্য হলো অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো। 

অন্যদিকে শরণার্থী শিবির থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের সংগঠন ব্যক্তিগত দানের ওপর নির্ভর করে একটার পর একটা সফল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে থাকে হামাস। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনিরা এবার তাদের খুচরা দান পাঠাতে থাকে হামাসের ঠিকানায়। হামাস প্রতিটা পাই-পয়সার হিসাব রাখে সর্বাধিক স্বচ্ছতা আর দক্ষতার সঙ্গে। শক্ত সামাজিক সংগঠন হওয়ায় আর ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতি রেখে কাজ করায় নৈতিকতার একটা নতুন মান তারা রচনা করে। গাজার জনগণের মনে আস্থা, ভালোবাসা আর সম্মানের একটা জায়গা করে নেয় হামাস। এটা হামাসকে ‘ফিলিস্তিনি বেইমান’দের পাকড়াও করারও সাহস দেয়। জনগণই তাদের সহযোগিতা করে।

ইসরাইলের গোয়েন্দাদের টাকা খেয়ে অনেক ফিলিস্তিনি ‘নেশাখোর বেইমান’ ইসরাইলের কাছে গোপন সব খবর পাচার করতে থাকে। কোন নেতা কোথায় থাকে, কখন আসে, ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে সেসব খবর কিনে নিয়ে চোরাগোপ্তা হত্যা ইসরাইলের অনেক দিনের পেশা। হামাসের এসব ঘরের শত্রু নিধন কার্যক্রম তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়। গাজা আর পশ্চিম জেরুজালেমের নির্বাচনে সবাইকে তাক লাগিয়ে ফাত্তাহকে পর্যুদস্ত করে হামাস জনপ্রতিনিধিত্বের মুকুট পেয়ে যায়। এটাও হামাসের একটা বড়ো শক্তি। ইসরাইলের অবরোধ কাটিয়ে গাজার লোকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব গোপন সুড়ঙ্গপথ তৈরি করা হয়েছিল, তার সবগুলোতেই ছিল হামাসের বুদ্ধি, জ্ঞান আর অর্থ।

অবরুদ্ধ আর যুদ্ধবিধ্বস্ত এক টুকরা বসতিকে সস্তায় বিনোদনের সুযোগ তৈরির জন্য হামাসের তৈরি পার্ক, বাগান, খেলার মাঠ, ফুটবল ময়দান, চিড়িয়াখানা, রেস্তোরাঁ বিনোদনের পাশাপাশি অনেক মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। গাজার উপকূলে পাওয়া গ্যাস হামাসের ব্যবস্থাপনায় চলে গেলে ইসরাইলের তা থেকে ফায়দা নেওয়ার খায়েস কখনো পূর্ণ হবে না। ইসরাইল চায় গ্যাস তারা নেবে, দাম শোধ করবে টাকায় নয় সামগ্রী দিয়ে, মানে বাটার সিস্টেমে। হামাস এটাতে রাজি নয়। তারা যে আন্তর্জাতিক দামে নগদে কিনবে তাদের কাছে বিক্রি করতে চায়। গাজায় হামাসরা থাকলে ‘ন্যায়নীতির প্রশাসন চালু রাখলে’ মিশরের কাবু অর্থনীতি সামরিক চাবুক বেশিদিন সইবে না। তারাও হামাসের গণতন্ত্র চাইবে। অতএব, মিশরের সিসির কেউ-ই চায় না হামাসের বাড়-বাড়ন্ত অবস্থা।

১৮ বছরের গাজা শাসনে হামাসের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। সংস্থাগুলো রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে। সাধারণ নীতিনির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় একটি সংস্থা। একে পলিটব্যুরো বলা হয়। ১৫ জন সদস্য দ্বারা এ সংস্থাটি গঠিত। ইসমাইল হানিয়াহ (৬০) বর্তমানে রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে সংস্থাটিতে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২০ সাল থেকে কাতারের দোহা থেকে তিনি গাজায় তার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কারণ মিশর গাজায় এবং বাইরে তার চলাচল নিষিদ্ধ করে। শূরা কমিটি নামে একটি সংস্থা পলিটব্যুরোর সদস্যদের নির্বাচন করে। তবে এ কমিটির সদস্য সংখ্যা অজানা। স্থানীয় কমিটিগুলো গাজা এবং পশ্চিম তীরে তৃণমূলের সমস্যাগুলো দেখাশোনা করে। 

গাজার দৈনন্দিন বিষয়গুলো ইয়াহিয়া সিনওয়ার তত্ত্বাবধান করা হয়। তিনি আগে হামাসের সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন। পাশাপাশি রয়েছে সমাজকল্যাণ এবং স্বাধীনভাবে পরিচালনার সংগঠন মারওয়ান ইসা এবং মোহাম্মদ দেইফ হামাসের সামরিক শাখা ইজ আদ-দ্বীন আল-কাসেম ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ দেইফ এমন একজন নেতা, যাকে কমপক্ষে ছয়বার হত্যার চেষ্টা করেছে। এবারের ইসরাইলের অভিযানেও দেইফ প্রধান ভূমিকায় ছিলেন। তিনিই অডিও বার্তায় ইসরাইলে হামাসের অভিযানের ঘোষণা করেছিলেন। রেকর্ডিংয়ে দেইফকে বলতে শোনা যায়, ‘আক্রমণের প্রথম ২০ মিনিটে ৫,০০০ রকেট এবং শেল দ্বারা শত্রুদের অবস্থান এবং দুর্গগুলো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, ছোট্ট এ সংগঠনটি গত সপ্তাহের শক্তিশালী ইসরাইলের ওপর অভিযানে ব্যবহার করেছে নানা ধরনের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ। ফলে হামাসের আর্থিক সহায়কদের নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। 

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তায় হামাস তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করে থাকে। কীভাবে হামাসকে অর্থায়ন করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই প্রথমে আসে ইরানের নাম। তাদের অর্থায়নের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ইরান থেকে। শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তাই নয়; বাহিনীটিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও সাহায্য করে ইরান। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি প্রবাসী এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের দাতারা হামাস আন্দোলনের অর্থায়ন করে। কিছু ইসলামিক দাতব্য সংস্থার মাধ্যমেও অর্থ পেয়ে থাকে হামাস। ইরান ছাড়াও রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর তুরস্ক থেকেও আর্থিক সাহায্য পায় হামাস। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর ট্রান্সন্যাশনাল থ্রেটস প্রজেক্টের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল বাইম্যান বলেন, হামাস ইরান থেকে (গাজা) উপত্যকায় টানেলের মাধ্যমে অস্ত্র পায়। এমইআই-এর একজন সিনিয়র ফেলো বলেছেন চার্লস লিস্টার, ‘সমুদ্রপথে হামাসকে তার আরও উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাচ্ছে ইরান।১৬

তথ্যসূত্র: ফিলিস্তিন ও আল আকসা মুক্তির সংগ্রামের শতবর্ষ (অপ্রকাশিত)

1. GbmvB‡K¬vwcwWqv Ad weª‡UwbKv, nvgvm (Introduction of Hamas).

2. National Counterterrorism Center, Hamas (https://www.dni.gov/nctc/groups/hamas.html).

3. The Council on Foreign Relations is an American think tank, What Is Hamas? (https://www.cfr.org/backgrounder/what-hamas)

4. Inside Hamas: The Untold Story of Militants, Martyrs and Spies, By Zaki Chehab, (Published in 2007 by I.B.Tauris & Co Ltd, 6 Salem Road, London W2 4BU), page-22

5. Hamas: Terrorism, Governance, and Its Future in Middle East Politics, by Jennifer Jefferis, Praeger security international, page-109.

6.   হামাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে আল কাসসাম ব্রিগেড সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। (https://hamas.ps/en/hashtag/522/Al-Qassam-Brigades)

7. উইকিপিডিয়া, পার্সটুডে, বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা, এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা, হামাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট।

8. হামাসের কাজ সম্পর্কে অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। (https://hamas.ps/en/).

9. Inside Hamas: The Untold Story of Militants, Martyrs and Spies, By Zaki Chehab, (Published in 2007 by I.B.Tauris & Co Ltd, 6 Salem Road, London W2 4BU), page-21

10. Palestinians won’t accept Israeli occupation’s aggressive policy towards Gaza, says Hamas spokesperson, 28 November 2022 (https://hamas.ps/en/).

11. ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান

.12. Fateful Triangle: The United States, Israel and the Palestinians, by NoamChomsky, New Delhi-2005. page-95

13. দ্য এথিনক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন, লেখক : ইলান পেপে, ওয়ানওয়ার্ল্ড পাবলিকেশনস, লন্ডন, ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৪।

14. Israel vs. Hamas, Editor by Neje Kardelj, Nova Science Publishers, Inc. New York, page-2 

15. Ibid, page-14

16. Israel vs. Hamas, Editor by Neje Kardelj, Nova Science Publishers, Inc. New York, page-2 

16. 1.) What is Hamas? A simple guide to the armed Palestinian group; 8 October 2023; Al Jazeera. 2.) History Illustrated: The story of Hamas and its fight for Palestine; 11 October 2023; Al Jazeera. 3.) Over 70% of Palestinians approve of Hamas invasion on Oct.7, recent poll shows; by All Arab News Staff | March 21, 2024. 4.) Inside Hamas: The Untold Story of Militants, Martyrs and Spies, By Zaki Chehab, Published in 2007 by I.B.Tauris & Co Ltd, 6 Salem Road, London W2 4BU. page 40-41. 5.)  Hamas as social Movement; January 2004; Authors: Glenn E. Robinson; Naval Postgraduate School.

লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির