১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মাত্র ছয়জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল যে সংগঠন, সময়ের পরিক্রমা ও প্রয়োজনে সেই সংগঠনটি নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪৮তম বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রসমাজের কাছে আস্থা ও আদর্শের বাতিঘর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই আদর্শিক আন্দোলনের সূচনা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সারাবিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের জন্যও গুরুত্ববহ।
ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশের ছাত্রসমাজের মধ্যে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন সময় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সংগঠনটি স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের তীব্র জুলুম-নির্যাতন, গুম ও খুনের শিকার হয়েও আদর্শ প্রচারে পিছপা হয়নি। সর্বোপরি, এদেশের জনগণের কল্যাণে নিবেদিত থেকেছে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। শত শত শহীদের আত্মত্যাগ ও মজলুমের আর্তনাদকে আগামীর পথচলার শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যাবে স্বপ্নের সোনালি স্বদেশ বিনির্মাণে- এই আমাদের প্রত্যাশা ও প্রত্যয়।
এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আগামীর পথচলা কতটা চ্যালেঞ্জিং। কথিত আধুনিকতার নামে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে অবক্ষয় আমরা প্রত্যক্ষ করছি, স্বার্থ ও সামর্থ্যের দ্বন্দ্বে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আমরা মোকাবিলা করছি, সময় যেন বারবার আমাদের সতর্ক করছে যে, আমাদের আরও বেশি সক্রিয় ও প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে। এ ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি নিরাপদ করতে এবং এদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শপথ বাস্তবায়নে আমরা ছিলাম, আছি এবং থাকব- ইনশাআল্লাহ।
ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা
মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও জাতীয় শহীদ দিবসে স্মরণ করি সেই সব বীরদের, যাদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার। সেই মহান ভাষা শহীদদের বিদেহী আত্মার প্রতি মহান করুণাময়ের করুণাশ্রিত শান্তি কামনা করছি। বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্য মাতৃভাষায় শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চা ও সংহত করার বিকল্প নেই। এছাড়া অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সকল জাতিগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সমান সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পর ১৯৪৭ সালে জনপদের মানুষ খুঁজে পেয়েছিল হারানো সেই স্বপ্ন, বাঁধতে চেয়েছিল মুক্তির গান, বুকের গভীরে জেগেছিল স্বাধীনতার তীব্র আকাক্সক্ষা। কিন্তু মোহভঙ্গ হলো, নেতৃত্ব আবারও প্রতারণা করল। তাই একটি নতুন দেশ সৃষ্টি হলেও স্বাধীনতার সেই আকাক্সক্ষা অধরাই রয়ে গেল!
মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই সূচিত হলো ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে এক বৈষম্যহীন সমাজ, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আপামর জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়ল মহান মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা প্রাক্কালে আবারও ঢেকে গেল অন্ধকারে। সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে বসল ১৯৭২-এর সংবিধান। বাকশালী জুলুম-নির্যাতন ও বিভাজনের রাজনীতির কারণে জনগণ মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেল। নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনও আশানুরূপ সুফল দিতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো কথা রাখেনি- জনগণ প্রতারিত হয়েছে বারবার।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যর্থতায় প্রতিষ্ঠিত হলো শতাব্দীর ভয়াবহতম ফ্যাসিবাদ। ফিরে এলো বাকশাল ২.০। আবারও রক্তের নেশায় উন্মত্ত স্বৈরশাসকেরা মায়ের কোল খালি করতে থাকল। দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্মম নির্যাতন, খুন, গুমের পর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ; হালভাঙা নাবিকের মিলেছে দিশা- ৩৬ জুলাই!
নতুন করে রাষ্ট্র গঠনের এক অবারিত সুযোগ এসেছে। এবার যদি পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত গড়তে না পারি কিংবা এই সুযোগ হাতছাড়া করি, তাহলে শুধু স্বাধীনতার স্বাদই নির্বাসিত হবে না, বরং শকুনের নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি- হারাতে হবে এই ভূখণ্ডটিও! তাই নতুন স্বদেশ বিনির্মাণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে হাল ধরতে হবে নতুন প্রজন্মকে।
আপনার মন্তব্য লিখুন