post

বিজয় দিবসের অঙ্গীকার

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশেরই আছে স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু বিজয় দিবস নামে বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত এবং বিপুল গৌরবমণ্ডিত দিন সব জাতির ইতিহাসে নেই; সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সফলভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনও সব জাতিকে করতে হয়নি। বাঙালি জাতি সেই অনন্য সাধারণ কাজটি করেছে বলেই তাদের কাছে বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা অপরিসীম।

মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন।

আমাদের বিজয়ের ইতিহাসটা অনেক বড়। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে গেলেও বাঙালিরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। পাকিস্তান ও ভারত- দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশকে। পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল অনেক। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা সবসময়ই শাসিত ও শোষিত হতো। তাই তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার আন্দোলন করেছে।

লাল-সবুজ পতাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার পথটি মোটেও সহজ ছিল না। শুরুটা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম আগুন জ্বলে বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি। ফাগুনের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত একাকার হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঝরায় বাঙালি। পুরো বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়।

এরপর ১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে শুরু হয়েছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। 

শত বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের গণমানুষ সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তো নয়, বাঙালি প্রাণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। অঞ্চলভিত্তিক খণ্ড যুদ্ধজয়ের দু-একটি দৃষ্টান্ত অতীতে থাকলেও ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্বের পরিচয়ে এবং বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে এমন শৌর্য-বীর্যময় বিজয় লাভ বাঙালির জাতীয় জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। অথচ ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ, ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধ।

২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নির্বিচারে হত্যা চালায়। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পৈশাচিক হত্যালীলায় মেতে ওঠে, অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন আর নারী নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে চরম ত্রাস সৃষ্টি করে। গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দুঃসহ এই জীবন-মরণ সঙ্কটের মুখে বাঙালিকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিতে হয় এবং মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রাণ বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।

অসহায় বাঙালিরা দলে দলে আশ্রয় গ্রহণ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে।  শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এদেশের ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও সামরিক ও বেসামরিক লোকদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। পাক বাহিনীর মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। যতই দিন যেতে থাকে ততই সুসংগঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তুলে। বিশাল শত্রুবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়েও মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। 

দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের যোগাযোগ অনেকটা ভেঙে পড়ে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নিকট নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় ঢাকা রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। যৌথ বাহিনীর পক্ষে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জগজিৎ সিং অরোরা।

বিজয় দিবস বাঙালি জাতিসত্তার আত্মমর্যাদা, বীরত্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রতি বছর এই দিনটি বাঙালিরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ১৬ই ডিসেম্বর এলেই দেশব্যাপী বিজয়ের ধ্বনি নতুন করে উচ্চারিত হয়। বিজয়ের এই উদযাপন তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করে তোলে।

বিজয় দিবস আমাদের একটি জাতীয় দিবস। এ দিন রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে দেশের সব জায়গায় বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। এ দিন বিজয় মেলা, কুচকাওয়াজসহ বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালি স্মরণ করে এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়টি।

বিজয়ের মাস শুরু হতেই শুরু হয় বাংলাদেশিদের বিজয় উদযাপনের প্রস্তুতি। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের পতাকা ফেরি করতে দেখা যায়। বাসাবাড়ির ছাদে, যানবাহনে পতপত করে ওড়ে লাল সবুজের নিশান।

ব্যাপক আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে বাঙালি উদযাপন করে বিজয় দিবস। জাতীয় পর্যায়ে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

সকালে সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রপতির কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন, প্রধানমন্ত্রীও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী প্রদান করেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। এ উপলক্ষে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয় ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল’। মহামুক্তির আনন্দঘন এই দিনে এক নতুন উল্লাস জাতিকে প্রাণ সঞ্চার করে এনে দেয় সজীবতা। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি চোখে আনন্দ অশ্রু আর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন অবশেষে মিলিত হয় জীবনের মোহনায়। বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের তাহার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। বাঙালি যেন খুঁজে পায় তার আপন সত্তাকে।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষায় হতে হবে যত্নবান। তবেই বিজয় হয়ে উঠবে অর্থবহ। যেকোনো জাতির শক্তির প্রধান উৎস ঐক্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন এটি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল মত-পথ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ। এজন্যই সম্ভব হয়েছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মাত্র নয় মাসে পরাজিত করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর আমরা সেই ঐক্য আর ধরে রাখতে পারিনি। গুরুত্বহীন বিষয়েও রাজনৈতিক বিভক্তি দেশে গণতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করার পথে বড় অন্তরায় হয়ে আছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের নেতৃত্বকে। সেই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় অভিন্ন নীতি অনুসরণ অপরিহার্য। আমাদের সামনে অসীম সম্ভাবনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হলে আমাদের অগ্রগতি ঘটবে দ্রুত। বিভেদ ভুলে আমরা সে পথেই অগ্রসর হবো ইনশাআল্লাহ- এই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

Mohammad Asadul Islam

- 4 months ago

আমার প্রিয় পত্রিকা!

Mahbubur Rahman

- 4 months ago

স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আমরা পাইনি, আমাদের সকল ভেদাভেদ ভুলে জাতি গঠনে অগ্রসর হওয়া উচিত...

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির