post

বিতর্কিত ইভিএম কি সরকারি দলের আগামী নির্বাচনের ‘তুরুপের তাস’!

সরদার আবদুর রহমান

০৬ আগস্ট ২০২২

বিতর্কিত ‘ইভিএম’ কি সরকারি দলের আগামী নির্বাচনের ‘তুরুপের তাস’! কেননা এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে সরকারি দল যে সুফল পেয়েছে আর বিরোধীরা পেয়েছে তার কুফল- সেই অবস্থা দৃষ্টে পর্যবেক্ষকরা সেটিই ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। তাছাড়া এই যন্ত্রের সাহায্যে ভোটগ্রহণে একমাত্র সরকারি দলকেই জোর গলায় এর পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা যায়। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীন এই দলটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের উপর নির্ভর করতে চাচ্ছে বলেই জোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই ‘ইভিএম’ কোথাও হালে পানি পাচ্ছে না বলেও মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ২৫-২৬টির বেশি দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হয় না। তবে কিছু কিছু দেশে এর চরম অপব্যবহার ও অপকৌশল করে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেওয়ার অভিযোগ আছে।

সর্বসাম্প্রতিক খবরে জানা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০০টি আসনেই ইভিএম-এ ভোট নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন। তবে এযাবৎ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় বৈঠকে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগসহ মাত্র চারটি দল ইভিএমে আগামী নির্বাচন করার বিষয়টি সমর্থন করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এবং বিতর্ক থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিষয়টি স্পষ্ট করেই বলেছে দলটি। ইভিএম-এ আগামী নির্বাচন করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের এমন মনোভাবের সঙ্গে প্রায় প্রশ্নহীনভাবে একমত পোষণ করেছে মাত্র তিনটি দল। দল তিনটি হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। অন্যরা ইভিএম নিয়ে কমবেশি সংশয়-সন্দেহ, আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের কথা বলেছে। ইসি আয়োজিত সভায় আওয়ামী লীগের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভা শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনেই ইভিএম চাই। মন থেকে চাই। চেতনা থেকে চাই।’

সভার ভেতরে দেওয়া বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করে, ইভিএমসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে সব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বেড়েছে। ইভিএমের কারণে জালিয়াতি ও ভোট চুরি বন্ধ হয়েছে। ইভিএম পদ্ধতি জনগণের কাছে জনপ্রিয় ও সবার ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে ইসিকে এখন থেকেই প্রচার-প্রচারণার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতেও আহ্বান জানান তিনি। তবে এখন নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের নির্বাহী বিভাগের নাকি নির্বাচন কমিশনের- সে বিতর্কও থেকে যাচ্ছে। অতীতের নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার বাইরে যেতে সমর্থ হয়নি নির্বাচন কমিশন।

ইভিএম নিয়ে বড় প্রশ্ন সুশীলসমাজের

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে গত মার্চে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি। ওই সংলাপে ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানালেও ১৩ জন অংশ নেন। সংলাপে অংশ নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হলো, নির্বাচন কমিশন আইন ও সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে কি না, তা অনেকখানি নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে তার ওপর। নির্বাচনের সময় এমন একটি সরকার থাকতে হবে, নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে যারা নিস্পৃহ (নিরপেক্ষ) হবে।’ এসময় তিনি বলেন, “নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার এই মুহূর্তে বিতর্কিত। এ বিষয়ে ঐকমত্য না হলে ইভিএম ব্যবহার না করাই ভালো হবে। এখনকার বাস্তবতায় ইভিএম ব্যবহার করা হলে আরো বেশি সংশয় তৈরি হবে।” নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার জোর সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, ইভিএম সব সময় সব দেশে বিতর্কিত। নির্বাচনকালীন প্রশাসন নিরপেক্ষ রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ভোটের সময় মূল ভরসা হলো মাঠ প্রশাসন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনকার পরিবেশে যত সৎভাবেই কাজ করা হোক ইভিএমে ভোট হলে তার ফলাফল নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। অন্যদিকে ইভিএম প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ইভিএমের প্রতি আস্থা নিয়ে কথা উঠেছে। ইভিএমে ভালো দিক রয়েছে, দ্রুত গণনা হয়ে যায়। কিন্তু পুনর্গণনার সমস্যা রয়েছে। কারচুপি হয়ে থাকলে সেটা পুনরায় গণনা করা যাবে কিনা, সেটা দেখতে হবে। কাগজের ব্যালটে ভোট পুনর্গণনা করা যায়। কারিগরি কমিটির মিটিং করে আমাদের ইভিএম সম্পর্কে এটা ধারণা নিতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, ইভিএম সঠিক হলে তা চালিয়ে যেতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ইভিএম কাজে না লাগলে যতো টাকা দিয়ে কেনা হোক বর্জন করাই ভালো। এসব মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

নারায়ণগঞ্জ সিটির অভিজ্ঞতা

এবছর ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সংবাদপত্রের কলামে অভিযোগ করেন বিরোধী প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। এতে তিনি জানান, ভোটের দিন তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়াতে চারটি অভিযোগ করা হয়েছে। যথা- ১. আঙুলের ছাপ দিলেও অনেক ক্ষেত্রেই ইভিএম ওপেন হয়নি ২. অনেক বুথে দেখা গেছে মেশিন ত্রুটিপূর্ণ, যা সচল হচ্ছিল না, ৩. অনেক বুথে দেখা গেছে যে, মেশিনটি ধীরগতি হওয়ায় ভোটার টানতে পারে না। ফলে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার শেষ পর্যায়ে ভোটার কেন্দ্র থেকে চলে গেছে এবং ৪. ইভিএম মেশিনে হাতির বোতামে চাপলে নৌকায় ভোট চলে যাওয়ার অভিযোগও তখনই ভোটাররা জানিয়েছিল। ইভিএম মেশিনে কিভাবে রেজাল্ট পরিবর্তন করা যায় তা পরীক্ষাপূর্বক বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিডিয়াতে প্রকাশ করছে। তিনি বিশেষজ্ঞদের বরাতে উল্লেখ করেন, “ইভিএম দ্বারা ভোটের সংখ্যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা যায়। ‘সিল’ সিস্টেমে ভোট হলে ‘গণনার’ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করলে আবার গণনার একটি সুযোগ থাকে যাতে ভুলত্রুটি নিরীক্ষা করা যায়, যা ইভিএম মেশিনে ধরা পড়ে না। ফলে বাকপটু অসত্য কথা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সরকারের কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে জয়লাভ করানোর অভিলাষ পূর্ণ করা সহজতর হয়।”

“নৌকার বাইরে ভোট ধরে ফেলা যায়”

খোদ একজন আওয়ামী লীগ নেতাই দাবি করেন যে, “ইভিএম এমন এক সিস্টেম, নৌকার বাইরে কেউ ভোট দিলে ধরে ফেলা যায়।” গত বছর (ফেব্রুয়ারি ২০২১) লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে এক সভায় লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী ওরফে নয়ন বলেন, “ইভিএম এমন এক সিস্টেম, নৌকার বাইরে কেউ ভোট দিলে ধরি হালান যায়। চিটাগাং (চট্টগ্রাম) এক কেন্দ্রে ইভিএমে নৌকা পেয়েছে ২ হাজার ৩০০ ভোট। এক ভোট পান ধানের শীষ। পরের দিন এ ভোট কে দিছে, ওই ওয়ার্ডের নেতারা তারে ধরি হালান। কতো নম্বর ভোট নৌকার বাহিরে গেছে, তা ধরি হালা যায়।” নুর উদ্দিন আরো বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত, মেয়র পদে ভোট হবে উন্নয়নের জন্য। আর কাউন্সিলর পদে ভোট হবে নিরপেক্ষ। তারের মতো সোজা।’ এ সময় নুর উদ্দিন চৌধুরী আরো বলেন, “ইভিএম একটি মেশিন। একুলে কে কোথায় টিপ দেয়, বুঝা যায়। সুতরাং উল্টাপাল্টা টিপ দিয়ে রাজাকার ও খন্দকার মোশতাক হবেন না। যাঁরা এদিন উল্টাপাল্টা টিপ দিবেন, পরের দিন মেশিন চেক করলে সিসি ক্যামেরার মতো বের করা যাবে।”

সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস

তথ্যে জানা যায়, দেশে গত পাঁচ বছরে মোট ৭৯১টি নির্বাচন হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের পাশাপাশি জাতীয় সংসদের বিভিন্ন আসনেও ভোট হয়েছে ইভিএমে। এরপরও ভোটে এই যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়নি। পাঁচ বছর আগে ইভিএম নিয়ে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের যে অবস্থান ছিল, এখনো তা একই আছে। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও অবিশ্বাস আরো বেড়েছে।

বর্তমান কমিশনের অধীনে মোট ১৩০টি নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এসব নির্বাচনে বেশি আলোচনা হয়েছে ভোটকক্ষে (বুথ) ‘ডাকাতের’ উপস্থিতি, ইভিএমে ভোট নিতে দেরি হওয়া, আঙুলের ছাপ না মেলার মতো বিষয়। এর ফলে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা আবারো প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দিন দিন সে বিতর্ক আরো বাড়ছে। এতোদিন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর অবস্থান ছিল ইভিএমের বিপক্ষে। এখন জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গত জুন মাসে ইসির সঙ্গে মতবিনিময়ে ইভিএমের বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়েছে জাপা। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক কয়েকটি দলও ইভিএম নিয়ে তাদের সংশয়ের কথা বলছে এখন। 

শুরু থেকেই ইভিএমের ঘোরতর বিরোধিতা করে আসছে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। তারা বলে আসছে, এ যন্ত্র নীরবে ভোট চুরির যন্ত্র। এখন দলটি বলছে, তারা ইসি নিয়েই কথা বলতে আগ্রহী নয়। ইসি নিয়ে তাদের আস্থা নেই। তাদের মূল দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ইসির মতবিনিময়ে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপাসহ ১৮টি দল ইভিএম নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের পাশাপাশি নানা প্রশ্ন তুলেছে। মানুষের আস্থা না থাকা, ভোট দিতে দেরি হওয়া, অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলা- এসব কারণে জাপা ইভিএমের বিরোধী বলে জানান দলটির মহাসচিব।

জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব মূলত শহর এলাকা। সেখানেও ভোট দিতে গিয়ে নানা ঝামেলায় পড়তে হয় ভোটারদের। বিশেষ করে নারী ও বয়স্ক ভোটাররা ইভিএম ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম ঠিকমতো কাজ করেনি। ভোটের পর পরাজিত মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করেছিলেন, ইভিএম ‘জালিয়াতির বাক্স’।

ভারতে নির্বাচনে জোরদার বিতর্ক

ভারতে গত ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া লোকসভা নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক জোরদার হয়। তবে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার কাছে এই বিতর্ক তেমন মাত্রা ছাড়াতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় শান্তিপূর্ণ ভোট হলেও প্রচুর অভিযোগ আসে ইভিএম নিয়ে। কোচবিহারে তৃণমূলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, অন্তত ৮০টি ইভিএমে গোলমাল দেখা দেয়। রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের (সিইও) দফতর সূত্রে জানানো হয়, এদিন মকপোল চলার সময় ৫১টি ভিভিপ্যাটে এবং ভোট চলাকালীন ৬৫টি ভিভিপ্যাটে ত্রুটি ধরা পড়ে। ব্যালটে ত্রুটি ধরা পড়ে ০.০২ শতাংশ ইউনিটে। ১৭ এপ্রিল নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটের শুরুতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ইভিএম বিভ্রাটের খবর পাওয়া যায়। ফলে অনেক জায়গাতেই ভোট দেরিতে শুরু হয়। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিজেপি ছাড়া আর কোনো দলই ইভিএমের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। অনেক দল আবার কিছু ঘটনায় বিভ্রান্তও।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ইভিএম-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদরা এর প্রধান দু’টি গুরুতর সমস্যার কথা বলে আসছেন। এর প্রথমটি হলো, পছন্দের প্রতীকে ভোট দিলেও একটি নির্দিষ্ট প্রতীকে তা জমা হতে পারে। মেশিনটি চাইলে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব যে, নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ভোটের পর বাকি সব ভোট একটা প্রতীকেই জমা হবে। হয়তো ভোটার দেখবে যে সে তার পছন্দের প্রতীকে ভোট দিয়েছে, কিন্তু আসলে তা হবে না। দ্বিতীয় গুরুতর সমস্যা হলো, এতে ভোট পুনর্গণনার কোনো সুযোগ নেই। ইভিএম মেশিনে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। একজন ভোটার ভোট দেবার পর তার কাছে একটা প্রিন্টেড স্লিপ আসতো, যাতে কোনো কারণে ভোট পুনর্গণনার প্রয়োজন হলে এটি কাজে আসতো। সেটি করা হয়নি। কারণ এই ব্যবস্থাটি রাখতে গেলে অন্য কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা সৃষ্টি হয়। 

সেসময় ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যালট বাক্সে ফিরে আসার দাবি তুলতে শুরু করে। উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, ইউরোপের জার্মানিসহ বড় সব দেশ ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ফিরে এসেছে। আমেরিকার প্রযুক্তিবিদরা ইভিএমের ত্রুটিগুলো সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করেছে। আমেরিকার গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যালটে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। উন্নত দেশগুলো যদি ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ফেরে তবে ভারতকে কেন ইভিএম-এ থাকতেই হবে? তবুও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখা হয়। এরপরও ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ইভিএম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে। এই দলগুলো মনে করে, ইভিএম প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভোট নয়ছয় করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন, ইতঃপূর্বে উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের উপনির্বাচনে ইভিএম’র ফলাফল থেকে তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। যারাই ভোট দিয়েছেন সেখানে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঘরেই সব ভোট পড়ে। এতে জড়িত থাকায় ৬ জন নির্বাচন কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে কমিশন। এই যখন ঘটনা- তখন আগুনে ঘি ঢালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন প্রযুক্তিবিদ। তারা দাবি করেন, ‘ইভিএম মেশিন হ্যাক করা সম্ভব।’ ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নেই বললেই চলে। তাদের কার্যকারিতা, সক্ষমতা ও সৎসাহস নিয়েও প্রশ্ন নেই। এমন একটি নির্বাচন কমিশনকেও ইভিএম নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন একজন পর্যবেক্ষক।

ইভিএম নিকৃষ্ট যন্ত্র

‘ইভিএম’কে নিকৃষ্ট যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের পর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ভোট দেওয়ার পরে ইসি যে তথ্য দেবে সেটাই মেনে নিতে হবে। চ্যালেঞ্জ করে কোনো লাভ হবে না। কারণ এখানে পুনর্গণনার সুযোগ নেই। প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ইসির কারিগরি কমিটির প্রধান ছিলেন, কিন্তু তিনি এই সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। অনেক দেশেই ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে এসেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখেছি অনেকে ভোট না দিতে পেরে চলে গেছেন। যেই যন্ত্র মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে সেই যন্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা কী? ইসি ইভিএমের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করেছে। এটা কাক্সিক্ষত নয়। ইভিএমে নির্বাচন কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আছে। এতে তো ফলাফল পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তারা ডাকাতি করতে পারেন।’

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির