post

বিদ্যুৎসঙ্কটে দেশ : বিপর্যস্ত জনজীবন

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

০৪ জুলাই ২০২২

সারাদেশে প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কলকারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও অফিস আদালতে কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। শিশু-বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা জটিল অসুখে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে তাপপ্রবাহের জন্য প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে শহর ও গ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। এই বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাই শুরু হয়ে গেছে লোডশেডিং। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ একবার গেলে আর আসে না। নেই কোনো শিডিউল। ইচ্ছেমতো বিদ্যুৎ নিচ্ছে আর দিচ্ছে। শহর-নগর থেকে গ্রাম-জনপদ সর্বত্রই বিদ্যুৎসঙ্কট। করোনার তাণ্ডব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ভয়াবহ জ্বালানি সঙ্কটে বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ জনজীবন। বৈশ্বিক এই পরিস্থিতির প্রভাবে বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতও আজ সঙ্কটে নিপতিত। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় মানুষের অনেকটা ভুলে যাওয়া ও লোডশেডিং ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আমদানিনির্ভর ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাসের (এলএনজির) আমদানি স্পট মার্কেট থেকে আরো আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অন্তত ২০ শতাংশ জ্বালানি তেলের আমদানি কমাতে। গত এক মাস যাবৎ দফায় দফায় বৈঠক করে বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে ভাবছে সরকার। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি না করলে এবং ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রাখলে বর্তমান গ্রীষ্মকালীন তাপদাহে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট পূরণে পিক আওয়ারে প্রায় দেড় হাজার থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কম হবে। ফলে জ্বালানি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ব্যবহারে একগুচ্ছ কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার।

লোডশেডিং কেন, জানালেন প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাসসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। তাই বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে অনেক দেশেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন। ঢাকা সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ করেন।

লোডশেডিংয়ের রুটিন ও মসজিদের এসি

৬ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দেন, আমাদের এখন একটাই উপায়, কখন, কোন এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে সেটার একটা রুটিন তৈরি করা। যাতে মানুষ প্রস্তুত থাকতে পারে। মানুষের কষ্টটা যেন আমরা লাঘব করতে পারি। সে বিষয়ে আমাদের এখন নজর দিতে হবে। 

অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে লিখেন, গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো আমাদেরকেও সমস্যায় ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। আবার ১৮ জুলাই বিকেলে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎসাশ্রয়ে মসজিদে এসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে এসি একেবারে বন্ধ করা হবে না। নামাজের সময় মসজিদে এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে উপাসনার সময় এসি চলবে। 

বিদ্যুৎসঙ্কট নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও বিবৃতি

সারাদেশে ভয়াবহ লোডশেডিং জনজীবন চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপের জন্য পুরো বিদ্যুৎ খাতে চলছে অরাজকতা। বিদ্যুৎ সঙ্কটের দরুন দেশের হিমাগারগুলোর মজুদকৃত খাদ্যপণ্যের মান নষ্ট হচ্ছে। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চক্রান্ত দেশবাসী রুখে দাঁড়াবে বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। 

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ : জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর বলেছেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের জ্বালায় অতিষ্ঠ দেশের ৮০ ভাগ মানুষ পল্লী গ্রামের, তাদের দুঃখ বুঝবে কে? ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার রুটিন প্রস্তুত করতে না পারা সারপ্লাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রিয় বাংলাদেশ! এ আওয়াজ জাতিকে অনেক শুনতে হয়েছে- দেশ এখন বিদ্যুৎ-এ সারপ্লাস। জাতীয় সংসদে জনগণের অর্থ অপচয় করে উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে। এ সময়ে প্রিয় দেশটিতে লোডশেডিংয়ের রুটিন নিয়ে আমরা ব্যস্ত! যা আবার একেবারেই তালগোল পাকানো। এ-তো কেবল শহুরে জীবনের কথা। ৮০ ভাগ জনগণ যারা পল্লী গ্রামে বসবাস করেন, সে জায়গাটিতে দেশের সর্বত্রই লোডশেডিংয়ের জ্বালায় জনজীবন অতিষ্ঠ। তাদের কথা ভাবার কি কারো কোনো সময় আছে? রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল অর্থ অপচয় করে দুর্নীতির মাধ্যমে যারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে, দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের হুঙ্কার দেওয়া সরকার এখন কি তাহলে বিনা শর্তে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে? তা না হলে বিদ্যুৎ-এর লোডশেডিং কেন- যা ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এমনকি হাত মসজিদের এসি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো। যা জনগণের ক্ষোভের মুখে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর কত ঘুমাবো আমরা? রাজনৈতিক নিপীড়নের পাশাপাশি সমানতালে চলছে অর্থনৈতিক তাণ্ডব। জাগতে হবে সবাইকে, নিজেদের অধিকার আদায়ে, জাতি ও রাষ্ট্রকে বাঁচানোর তাগিদে।

বিএনপি : ১৮ জুলাই বিকালে রাজধানীর গুলশানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাবেক বিদ্যুৎমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও কেন এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তে আসতে হলো? বিদ্যুৎসঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য এগুলো (এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং) করেনি। এগুলো করেছে রিজার্ভে টান পড়েছে, তাই তেল-গ্যাস আমদানি করতে পারছে না; কম বিদ্যুৎ খরচ হলে আমদানিও কম লাগবে সে জন্য। সরকার এত ঢোল পেটালো ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে গেছি আমরা, সেই রিজার্ভ এখন কোথায়? হঠাৎ করে নাই হয়ে গেলো কেন? আজকে দেশ অর্থনৈতিক ক্রাইসিসে দাঁড়িয়ে গেছে এবং এটার জন্য আমি পুরোপুরি সরকারকে দায়ী করি। সরকারের পরিকল্পনায় বলা ছিল ৬৪ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন থাকবে সরকারের হাতে, আর ৩৬ ভাগ থাকবে বেসরকারি হাতে। সরকার তড়িঘড়ি করে বেজ প্লান্টগুলো বেসরকারি সেক্টরে দিয়ে দিল। সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি, এই পরিকল্পনা খারাপ ছিল, দুরভিসন্ধিমূলক ছিল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। যার ফলে আমাদের বিদ্যুতের যে আইন, সেগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে সংসদে আইন পাস করে যাকে ইচ্ছে তাকে পাওয়ার স্টেশন দিয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতের দেশ বলে হাতিরঝিলে অনেক ফানুস উড়লো, কিন্তু আজকে এসে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি না।’ 

ইসলামী আন্দোলন ঢাকা মহানগর : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম বলেছেন, সারাদেশে ভয়াবহ লোডশেডিং জনজীবন চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে। সরকার বলছে ১০০ ভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। এখন দেখি সারাদেশে লোডশেডিংয়ে জনগণ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এভাবে প্রতারণার কোনো মানে হয় না। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে আজ সর্বক্ষেত্রে এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী লোডশেডিংয়ের জন্য আলোকসজ্জা বন্ধের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি দুর্নীতি বন্ধের কথা বলেননি। দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে পারলে লোডশেডিং থাকবে না।

ইসলামী ঐক্যজোট : ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব ও মহাসচিব মাওলানা আব্দুল করিম খান বিদ্যুৎসঙ্কট চরম আকার ধারণ করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দেশের জ্বালানি খাতে প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন সরকার নিয়ন্ত্রণ করে সারা দেশে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নেতৃদ্বয় দেশের জাতীয় স্বার্থে অনতিবিলম্বে বিদ্যুৎ ঘাটতি নিরসনের লক্ষ্যে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেওয়ার জোর দাবি জানান। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত বেসরকার প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে অহেতুক বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ষড়যন্ত্রে উৎপাদনের হার ইচ্ছা করে কমানো হয়েছে। তারা বলেন, বিদ্যুৎসঙ্কট অব্যাহত থাকলে দেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, হাসপাতাল, ব্যবসা বাণিজ্য প্রত্যেক বিভাগেই মহাসঙ্কট দেখা দিবে। এই জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা চরমভাবে বিঘ্নিত হবে।

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) : এনডিএম-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। বিদ্যুতের ঘাটতির দরুন দেশের সব হিমাগারে মজুদকৃত খাদ্যপণ্যের মান নষ্ট হচ্ছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফাঁকাবুলি দিয়ে জনগণের সাথে প্রতারণা করা আওয়ামী সরকার গত একযুগে গ্যাস এবং কয়লার বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে দৃষ্টি না দিয়ে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপের জন্য পুরো বিদ্যুৎ খাতে চলছে অরাজকতা। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের উপর দেশের বিদ্যুৎ খাত নির্ভর হয়ে পড়ায় বেড়েছে ভর্তুকির পরিমাণ। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে পারছে না সরকার। সবকিছুর কারণে বাড়ছে লোডশেডিং যা বলে দেয় সরকার কতটা ব্যর্থ। গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে ক্রমাগত ঘাটতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে শিল্প কলকারখানায় যা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। আমরা অবিলম্বে জ্বালানি খাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে দুদকের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। 

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন : বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর আমীর মাওলানা মুহাম্মদ হোসাইন আকন্দ এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো ছড়িয়েছে। কিন্তু ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জনজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভয়াবহ লোডশেডিং বেড়েই চলছে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে জাতিকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে দেয়া হচ্ছে। তিনি অনতিবিলম্বে লোডশেডিং সঙ্কট নিরসনে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানান।

গণসংহতি আন্দোলন : গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন। সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বিষয়কে একমাত্র কারণ হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে সরকারের নীতিই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহে দেশকে বিদেশনির্ভর করে তুলেছে। গত ১৩ বছর ধরে জনগণ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে অর্থের জোগান দিয়ে এলেও স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সকে কাজে লাগানো এবং দেশীয় মালিকানা নিশ্চিত রেখে সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে কয়লাবিদ্যুতে বিনিয়োগ বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের জন্য জনগণের দাবিকেও উপেক্ষা করেছে; বরং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে কতিপয় মুনাফার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে আমদানি করা জ্বালানিকেই একমাত্র বিকল্প হিসেবে হাজির করেছে। সেক্ষেত্রেও বিশেষত এলএনজির ক্ষেত্রে সময়মতো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে না পারায় এখন খোলাবাজার থেকে বেশি দামে এলএনজি কিনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে (প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। ফলে স্বনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথাযথ নীতি গ্রহণ না করা, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মহোৎসব এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে অতিরিক্ত মুনাফা ও সরকারের বর্ধিত আয়ের জোগান দেওয়ার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার এই নীতি আজকের এ সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি : গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দেশজুড়ে মারাত্মক লোডশেডিংয়ে বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের অতিকথন ও আত্মতুষ্টির খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। সরকারের ভুল নীতি, জ্বালানি খাতে চুরি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সিস্টেম লসের কারণে আজ বিদ্যুতের এই বেহাল দশা দেখা দিয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দম্ভ করে বলে আসছিলেন যে, শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করে লোডশেডিং তারা জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবায় বিরূপ প্রভাব 

মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, জ্বালানি স্বল্পতার কারণে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে অফিসের সময় কমিয়ে ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। ইন্টারনেট সেবা সরবরাহের অন্যতম কাঁচামাল বিদ্যুৎ। মোবাইল ইন্টারনেট সেবা দিতে সারাদেশে লক্ষাধিক বিটিএস টাওয়ার রয়েছে, যা বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত। তাছাড়া প্রত্যেকটি অপারেটরের জোনভিত্তিক অপারেশন কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এমনকি আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলির অপারেশন কেন্দ্রও বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত হয়। বিদ্যুতের লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা এখন পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বা বিটিআরসির সঙ্গে ইকো সিস্টেম গড়ে তোলার কার্যক্রম লক্ষ্য করিনি। সমন্বয় না থাকায় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবায় ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমান সময়ে জীবনের অন্যতম সেবার নাম টেলিযোগাযোগ ইন্টারনেট। অফিস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সময় কমিয়ে আনলে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবার চাহিদা বাড়বে বহুলাংশে। তাই দ্রুত টেলি যোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে দ্রুত প্রস্তুতি বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সঙ্কট উত্তরণে করণীয়

লোডশেডিং করা ছাড়া বিদ্যুতের চলমান সঙ্কট নিরসনের কোনো উপায় দেখছে না সরকার। কিন্তু এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এজন্য বিদ্যুৎসাশ্রয়ে সবার সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ স্টোর করে রাখার মতো কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। এটি একটি চলমান ব্যবস্থা। চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করতে হয়। কাজেই উৎপাদন কম হলে লোডশেডিং অপরিহার্য। দেশে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে গাড়ির ছড়াছড়ি। গাড়ি কেনা ও ব্যবহারে লাগামহীন অর্থের ও জ্বালানির অপচয় হচ্ছে। মাত্র ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ বা একটা পাউরুটি কিনতে বাজারে ছুটছে গাড়ি। বাড়িতে-অফিসে ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর (কম্পিউটার, আইপ্যাড, ল্যাপটপ, মোবাইল, মাইক্রোওয়েভ) চার্জারটি সকেটের সঙ্গে অবিরাম অবিচ্ছিন্ন রেখে আমরা বিদ্যুতের অপচয় ঘটাচ্ছি। এসির ব্যবহারেও রয়েছে অজ্ঞতা ও অবহেলা। এসির এয়ার ফিল্টার নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে অন্তত ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। অবিরাম না চালিয়ে বিরতি দিলে এসির ব্যবহারেও বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়। মাত্র ১০০-১৫০ বর্গফুটের ছোট ছোট দোকানে একসঙ্গে এক বা দুই ডজন বাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। অতিরিক্ত বাতি ব্যবহার করলে কক্ষের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তা শীতল করতে প্রয়োজন হয় এসি বা ফ্যানের ব্যবহার। রাজধানী ঢাকায় বহু অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা ও সিঁড়িঘরের বাতি জ্বলে সকাল সাত-আটটা পর্যন্ত, অথচ প্রাকৃতিক আলোয় তখন ভরে যায় চারপাশ। শীতকালে উষ্ণ পানির ব্যবহার শেষে বাথরুমের গিজারটি চালু থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সরকারি অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায়ই বাতি-ফ্যান-এসি চালু রেখে নামাজে, সভায় কিংবা মধ্যাহ্নভোজে চলে যান। ঘুমন্ত এ জাতিকে জাগাবে কে? কাজেই এ অপচয় রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। 

সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো দরকার। সূর্য এক ঘণ্টায় পৃথিবীতে যে পরিমাণ শক্তি দেয়, তা থেকে সারা বিশ্বের সব মানুষের সারা বছরের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এটি কোনো আজগুবি গল্প নয়, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানিয়েছেন এই তথ্য। বর্তমানে বিদ্যুতের বড় দুই কাঁচামাল জ্বালানি তেল আর কয়লার জোগান অফুরন্ত নয়, একদিন শেষ হয়ে যাবে সেগুলো। বিজ্ঞানীদের হিসাব, বিদ্যুতের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তাতে বিকল্প জ্বালানির না হলে তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে আর মাত্র ৩৫ বছর, ২০৪৫ সাল পর্যন্ত। আর কয়লার মজুদ শেষ হয়ে যাবে ২১৫৯ সালের মধ্যে। তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলেই মনে করেন বিজ্ঞানীরা। সূর্যের আলো থেকে যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবীতে আসে, তা পৃথিবীর সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি ও পরমাণু শক্তির মোট পরিমাণের কাছাকাছি। ডেজার্টটেক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর সব মরুভূমিতে সারা বছর যে পরিমাণ সৌরশক্তি থাকে, তার এক শতাংশও যদি সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল বসানো যায়, তাহলে পুরো পৃথিবীর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বিদ্যুতের সঙ্কট নিরসনে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানো দরকার।

বায়োগ্যাস উৎপাদন বাড়ানো দরকার। দেশে উৎপাদিত জৈব পদার্থ পচনের ফলে বিভিন্ন যে গ্যাস পাওয়া যায় তার মিশ্রিত রূপ হলো বায়োগ্যাস। জৈব সার, পৌর বর্জ্য, নর্দমার আবর্জনা, খাদ্যবর্জ্যরে কাঁচামাল থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়। দেশের সব জেলায় বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি সঙ্কট নিরসন, পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব। তাই বায়োগ্যাস উৎপাদন ও এর ব্যবহার বাড়ানো দরকার। 

বিদ্যুৎ খাতে ‘চুরি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সিস্টেম লস’ কমাতে জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ দিতে না পারলে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় করা এবং সে অর্থ বিদ্যুৎ পেতে অন্যত্র ব্যয় করা। জরুরি ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং তার জন্য এই খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। দেশের বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর দ্রুত সংস্কার করে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা।

গ্যাস ও তেল উত্তোলনে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এক্ষেত্রে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা। রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি পেতে কূটনৈতিক উদ্যোগসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। উচ্চ দামের স্পট মার্কেটকে কেবল শেষ ব্যবস্থা হিসেবেই কাজে লাগানো। 

সরকারি-বেসরকারি অফিস, সুপার মার্কেট, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসির সীমিত ব্যবহারসহ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের আলোকসজ্জা বন্ধ করা। শিল্প উৎপাদন, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দিরসহ জরুরি পরিষেবাগুলো লোডশেডিংয়ের বাইরে রাখা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট মোকাবিলায় আশু, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অবিলম্বে জাতীয় কমিশন গঠন করা। 

বিদ্যুতের সুষম বণ্টন প্রয়োজন। বিদ্যুতের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা না গেলে সাধারণ মানুষ উন্নয়নশীল দেশের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। অনেক দেশেই এ বৈষম্য রয়েছে। তবে বাংলাদেশের যেহেতু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম এবং এখনো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি এবং সুশাসনের অভাব রয়েছে, তাই সুষম বণ্টনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির