১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি এবং ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ছলা-কলার আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতা দখল করে উভয় দলই। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর শাহাদাতের পর তাঁর সহধর্মিনী বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। জনপ্রিয়তায় বেগম জিয়া স্বামী জিয়াউর রহমানকেও ছাড়িয়ে যান। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। যদিও ১৯৯৬ সালের সংসদ কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী ছিল।
২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের জরুরি সরকার এবং ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বেগম জিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অবর্ণনীয় রাজনৈতিক ঝড়। এই ১৭/১৮ বছরে তাঁকে দল এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ৫ আগস্ট ১৯৪৫ সালে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশী রাজনীতিবিদের বর্তমান বয়স ৮০ বছর। প্রকৃত বয়স আরও বেশি হতে পারে। অসুস্থতা এবং বয়সের ভারে তিনি ন্যুব্জ। অলৌকিক কিছু না ঘটলে তাঁর পক্ষে রাজনীতিতে ফিরে এসে দেশ ও দলের হাল ধরা যারপরনাই অসম্ভব। তাই বাস্তব-কঠিন সত্য হলো- বেগম খালেদা জিয়া আর রাজনীতির হাল ধরতে পারবেন না।
সরাসরি মন্তব্যটি করায় যারা কষ্ট অনুভব করছেন, তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন অবিসংবাদিত এবং পরিশীলিত নেত্রী মনে করেন। বিশেষ করে যে অনন্য যোগ্যতাটি তাঁকে একজন দক্ষ এবং উদার রাজনীতিকে পরিণত করেছে, তা হলো- জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামকে যুক্ত করা। বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এখানে নব্বই শতাংশের ওপরে মুসলমান। পাশাপাশি এ দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসন এবং মোড়লীপনা বরদাশত করে না। ইসলাম এবং প্রতিবেশী আগ্রাসন প্রশ্নে বেগম জিয়া দেশের মানুষের অনুভূতি এবং বিশ্বাস অনুধাবন করতে পেরেছেন। জাতীয় স্বার্থে ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদকে অঙ্গাঙ্গি করেছেন তিনি।
রাজনীতিতে উদারনীতি, গণতন্ত্রের বহুদলীয় চর্চা এবং রাজনৈতিক স্থিরতা তাঁর জীবন থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ কারাবাস এবং ততদিনে দলে চাটুকার ও সুবিধাবাদী শ্রেণির প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় বেগম জিয়া নিজের দলেই আজ বোঝা সদৃশ! তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অর্জন বিএনপির নতুন নেতৃত্ব অনুধাবন ও লালন করতে পারেনি। বলতে গেলে জিয়াউর রহমান এবং বেগম জিয়ার সকল নীতি থেকেই সরে এসেছে তারা। বর্তমান নেতৃত্বের মাঝে সর্বদা ইসলাম-ভীতি কাজ করে। ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের একেবারে কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। ভারত প্রশ্নেও ঠিক তাই। এখন জাতীয় স্বার্থে দলটিতে ‘আপোষহীন’ মনোভাব নেই বললেই চলে। বরং হেন উপায়ে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা- বিএনপির রাজনৈতিক উত্থান এবং একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণে তাদের ভারত নীতি, ইসলামের অনুকূলে জাতীয় এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ; এই তিনটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
অনেকে মনে করেন- ইসলাম এবং ভারত প্রশ্নে বিএনপি যদি তাদের নীতি পরিবর্তন করে, তবে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর থেকেও তারা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকবে। এটা জনবিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাবে তাদেরকে। সামনের গ্রহণযোগ্য দুই থেকে তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি মুসলিম লীগ এবং জাতীয় পার্টির ভাগ্যাবরণের দিকে যেতে পারে। সেই সাথে বিএনপির জনসেবা ও সমাজসেবার রাজনীতি পরিহার করে শুধু সভা-সমাবেশ এবং বক্তৃতা-মিডিয়া নির্ভরতাও তাদের পতনের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
নির্মোহভাবে ইতিহাস পড়লে দেখা যায়- ১ জানুয়ারি ১৯৮৬ সালে দল প্রতিষ্ঠা করে ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি ৪২.৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে মোট ১৫৩টি আসন লাভ করে। ৯১’র সংসদে তারা ১১.৯২ শতাংশ ভোট পেয়ে লাভ করে ৩৫টি আসন। ৯৬-তে ৩২টি এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট করেও জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১৪টি আসন। ২০০৮-এ ২৭, ২০১৪-তে ৩৪, ১৮-তে ২৩ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র ১১টি আসন লাভ করে জাতীয় পাটি। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কম আসন লাভ করে জাতীয় পার্টি।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা- জাতীয় পার্টি নানাবিধ কারণেই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সামনের এক-দুইটি জাতীয় নির্বাচনে তারা প্রার্থী দেওয়ার মতো নেতা-কর্মী পেলেও তারপরের সময়কালে সবগুলো আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো কোনো লোক পাবে না। তাছাড়া জাতীয় পার্টি শুরু থেকেই একটি আঞ্চলিক দল হিসেবেই তাদের যাত্রা শুরু করে। নিজেদের রাজনীতির শেষবেলায় এসে তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে খ্যাত উত্তরবঙ্গে আসন হারাচ্ছে তারা, তাদের দুর্গে আঘাত হানছে জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে বিএনপিও কি জাতীয় পার্টির পরিণতির দিকেই হাঁটছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কিছুটা একাডেমিক এবং তাত্ত্বিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। দলটি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি এমন একটি আদর্শ; যা জাতি, লিঙ্গ বা বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের বাংলাদেশীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার আমল অর্থাৎ ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি তাদের দলীয় নীতিতে মোটামুটি অটল ছিল। কিন্তু ১/১১-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান অবধি বিএনপি লক্ষ্যহীন ক্লান্ত পথিকের ন্যায় খুঁড়িয়ে হাঁটছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ে ঘটেছে ডান-বামের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ফলশ্রুতিতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে রয়েছে একাত্মতার সংকট। কোনো যাচাই-বাছাই না থাকায় যে কোনো মত ও পথের মানুষ দলটিতে অনুপ্রবেশ করে বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। অভ্যন্তরীণ দলীয় মতানৈক্য ও কোন্দল তার অন্যতম কারণ।
কর্মীদের একাংশ চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস ইত্যাদিতে জড়িয়ে দলীয় ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। তাদের বিদেশ-নীতিও ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সাথে সঠিক মাত্রার সম্পর্ক নির্ণয় এবং চালিয়ে নিতে তারা আনাড়ী। শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ ভারতের তাবেদারী পছন্দ করে, যা দেশের বেশিরভাগ মানুষের বিরাগভাজনের কারণ হতে পারে। এছাড়া দলটির ভঙ্গুর রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এর ছাত্র ও যুব সংগঠনের দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বিএনপিকে নতুন করে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়েও তাদের কোনো সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা নেই। পরিবারতন্ত্রের অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না তারা। দল সংগঠনের ক্ষেত্রে সচরাচর ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায় তাদের। দেশের বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষের সমস্যা সমাধানে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা দেখা যায় না বললেই চলে।
এসব কারণে তারা ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবমান। মুসলমানদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও তাদের কোনো শক্ত অবস্থান দেখা যায় না। বিএনপির সাম্প্রতিক অনেক কর্মকাণ্ড জুলাই বিপ্লবের চেতনার স্পষ্টত বিরুদ্ধে অবস্থানের শামিল। অনেকে এই অবস্থানকে তাদের দলীয় রাজনীতিতে শেষ পেরেক হিসেবে দেখছেন। কারণ অতীতে ছাত্রসমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোনো শক্তিই বেশিক্ষণ ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। শীর্ষ নেতৃত্বের ইসলাম-বিদ্বেষী মনোভাব এতে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করবে। তাছাড়া সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন (নবী-রাসূলগণের আদর্শ) আদর্শ ব্যতীত কোনো একজন মানুষের আদর্শ দিয়ে দীর্ঘসময় রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা দুষ্করই বটে!
লেখক : বিশিষ্ট গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
আপনার মন্তব্য লিখুন