post

ভূ

সোলায়মান আহসান

২৯ মে ২০২৪

In the aftermath of the Second World War, there began a massive reorganization of the world. We are living through an era of the most extensive and intensive political change in human history. Our generation is living through a genuine global political awakening. 

- Zbigniew Brzezinski, 1979

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে ব্যাপক পুনর্গঠন শুরু হয়। আমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যাপক এবং নিবিড় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের একটি যুগের মধ্যে বসবাস করছি। আমাদের প্রজন্ম একটি প্রকৃত বৈশ্বিক জাগরনের মধ্য দিয়ে বাস করছে।

- আইবনিউ রেজেজিনস্কি, ১৯৭৯

আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে ‘ঠান্ডা লড়াই’ বা ‘ঈড়ষফ ধিৎ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতির চালিকা শক্তি ছিল এই ঠাণ্ডা লড়াই। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সবকিছুই এই ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব-রাজনীতি ও ঠান্ডা লড়াই অনেকটা সমার্থক হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যুগপৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘পরাশক্তি’ বা ‘Super Power’ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। উভয়ের মধ্যকার উত্তেজনার সময়কে ঠান্ডা লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই দুই পরাশক্তি সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে স্বীয় কূটনৈতিক তথা অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রচারণা শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং পৃথিবীকে দুটি পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত করে ফেলে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রগুলো এভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গঠিত হয় দুটি সামরিক জোট। 

মার্কিন বলয়ভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল গঠিত হয় ন্যাটো (NATO : North Atlantic Treaty Organization) এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয়ভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে ১৯৫৫ সালের ১ মে গঠিত হয় ওয়ারশ (Warsaw pact)।

ন্যাটো শুরু হয় ১২ দেশের সমন্বয়ে যা এখন ৩২ দেশের জোটে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০২৩-এ ফিনল্যান্ড ও ২০২৪-এ সুইডেন সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এবার ইউক্রেন অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। 

অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে আলবেনিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাংগেরি, পূর্ব জার্মান, চেকোশ্লাভাকিয়া এবং বুলগেরিয়াকে নিয়ে ওয়ারশ জোটের করুণ পরিণতি ঘটে নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে।

১৯৯১ সালে গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ (গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট, ১৯৯০) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তীব্র অসন্তোষ, অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পট পট করে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে ১৫ খণ্ড হয়ে পড়ল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে হলো রাশিয়ান ফেডারেশন। 

অর্থাৎ আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার Cold war এর যুগের অবসান ঘটে। আমেরিকা এবং তার মিত্রদেশ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশসমূহ এখন গোটা বিশ্বকে ভাগাভাগি করে খাওয়ার উৎসবে মেতে ওঠে। মার্কিনীদের নজর পড়ে তেলসমৃদ্ধ দেশ (মধ্যপ্রাচ্য) এবং পূর্বের রাশিয়াপুষ্ট দেশসমূহের দিকে। 

রাশিয়া তখন বিশ্ব নাট্যমঞ্চে অনুপস্থিত। ওয়ারশ জোটের অন্যতম শক্তিধর দেশ পূর্ব জার্মান সমাজতন্ত্রের মন্ত্র বাদ দিয়ে বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে পশ্চিম জার্মানের সঙ্গে একীভূত হয়েছে (১৯৮৯)। এর আগে মুক্তবিশ্বের হাওয়া লাগে পোল্যান্ডে। গণতন্ত্রের পতাকা উড্ডীন হয়। একে একে রাশিয়ার বলয় থেকে বের হয়ে যায় আলবেনিয়া, রোমানিয়া, হাংগেরি, চেকোশ্লাভাকিয়া, বুলগেরিয়া। আর পূর্ব জার্মান আগই পুঁজিবাদী বিশে^ শামিল হয়েছে। 

এরপর বিশ্ব কি দেখল? ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ, টুইন টাওয়ার নাটক, আফগানিস্তানে মার্কিনী বাহিনীর ক্র্যাক ডাউন- দীর্ঘ সিকি শতাব্দী জুড়ে মার্কিনী ও তাদের দোসরদের হলি খেলা। মুসলিমদের বলা হলো- আল কায়েদা, জঙ্গি, বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য হুমকি। নানা জায়গায় নানাভাবে মুসলিমদের নিধন করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশকে তছনছ করে দেওয়া হলো। লাখ লাখ নিরীহ মুসলিমকে হত্যা করা হলো। 

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব মানচিত্রের ঘটনা প্রবাহ পাল্টাতে থাকে। ইরানের মার্কিনী ও পশ্চিমাদের যুগপৎ ধ্বংসের কার্যক্রমকে ব্যর্থ করে দিয়ে টিকে থাকা। সিরিয়ার বাশারকে টিকিয়ে রাখার রাশিয়ার পুতিনীয় হস্তক্ষেপ, আল কায়েদার নামে মুসলিমদের জঙ্গি চিহ্নিতকরণের নীলনকশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়া। আফগানিস্তান থেকে রাতের অন্ধকারে মার্কিন বাহিনীর পলায়ন। তালেবানদের আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ। তুরস্কের উত্থান (রিসেপ তায়েফ এরদোয়ান) এবং পাকিস্তানে ইমরান শাসনের প্রেক্ষিতে মার্কিনীদের পাততাড়ি গোটানো, মধ্যপ্রাচ্য ‘কাতার সংকট’ সৃষ্টি করে মার্কিনীদের ব্যর্থ নীতি প্রমাণিত। আর দৃশ্যপটে নতুন দেশ চীনের প্রবেশ।

একদিকে রাশিয়া এবং চীন যুগপৎ বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ভূ-রাজনীতির সমীকরণ নিয়ে হাজির হয়েছে। যা রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ করা এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার প্রকাশ্য বিরোধ চীনের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট করে দিয়েছে। একইভাবে ২০১৬ সালে দক্ষিণ-চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে মার্কিনী ও মিত্রদের সঙ্গে টান টান উত্তেজনা। উল্লেখ্য, দক্ষিন-চীন সাগরের সন্নিহিত দেশ ফিলিপাইনের একটি দ্বীপ (স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ) নিয়ে চীনের সঙ্গে মারাত্মক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পরে আন্তর্জাতিক আদালতে ফিলিপাইনের দাবি স্বীকৃত হলেও তা প্রত্যাখ্যাান করে। দৃশ্যপটে আমেরিকা (ফিলিপাইনের মিত্র) উপস্থিত হয়। বিমানবাহী রণতরী নিয়ে হাজির হয় আমেরিকা। স্পেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, ব্রিটেন ও ভারতকে সাউথ-চীন সাগর অভিমুখে অগ্রসর হতে মার্কিনীরা আমন্ত্রণ জানিয়ে বিফল হয়। ভারত তার একটি ফ্লিট নিয়ে খানিক পথ অগ্রসর হয়ে ফিরে যায়। একইভাবে এই অঞ্চলে তাইওয়ান নিয়ে মার্কিনীদের অবস্থান চীনের প্রত্যাখ্যানের ঘটনাসমূহ প্রমাণ করে তাদের অবস্থান।

চীনের অবস্থান সরাসরি মার্কিনী স্বার্থবিরোধী। এর প্রেক্ষাপটও আছে। আমেরিকা সুদূর অতীত থেকেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। চীনের সঙ্গেও করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা হাত বাড়ায় চীনের দিকে- বন্ধুত্বের। চীনেরও তখন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য আমেরিকান সহায়তা দরকার ছিল। চুক্তি হয় দুদেশের সঙ্গে। চীনের প্রযুক্তি উন্নয়নে আমেরিকা সহায়তা দেবে। কিন্তু কিছুদিন পর চীনারা জানতে পারল আমেরিকা চুক্তি অনুসারে উন্নত প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে না। চীন বেরিয়ে আসে চুক্তি থেকে। দৃশ্যপটে রাশিয়ার প্রবেশ ঘটে। পরবর্তীতে চীন-রাশিয়া যৌথ সক্ষমতায় মার্কিনীদের বিরুদ্ধে এমন সব অত্যাধুনিক কৌশলগত সামরিক অস্ত্র তৈরি করে যা দেশ দুটিকে শক্তিশালী করে তোলে।

বিশে^র ভূ-রাজনীতি দ্রুত পরবর্তিত হয়েছে। দ্রুত নয়, তবে পরিবর্তনটা স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। আগে অস্ত্র তৈরি করে গোপন করা ছিল নিয়ম। এখন প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে অনিবার্য। মহড়ার মাধ্যমে অস্ত্রের সক্ষমতা ভিডিও করে প্রচার করাও সাম্প্রতিক কালের নিত্যদিনের ঘটনা।

আসুন, আমরা ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে খানিকটা জানার চেষ্টা করি। ‘ভূ-রাজনীতি’ শব্দটি মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সুইডিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুডলফ কেজেলেন দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের (১৯১৮-৩৯) মধ্যবর্তী সময়ে এর ব্যবহার সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হয়। সমসাময়িক আলোচনায়, ভূ-রাজনীতিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি আলগা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভূ-রাজনীতি সমগ্র বিশ্বকে ঘিরে যেমন আছে তেমনি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি রয়েছে। মূলত আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তারের জন্য শক্তি প্রতিযোগিতায় যে মেরুকরণ করা হয় তা-ই ভূ-রাজনীতি হিসেবে স্বীকৃত। ষাটের দশকে এশিয়ায় এক ধরনের ভূ-রাজনীতি ছিল। অসম ও অন্যায্য পার্টিশনের মাধ্যমে ১৯৭৪-এ উপমহাদেশে দুটি দেশ ভারত ও পকিস্তানের জন্ম। ব্রিটিশ নিয়োগকৃত ধুরন্ধর সিরি রেডক্লিফ এমনভাবে দুটি দেশের মানচিত্র এঁকে দিলেন যা ১৯৭১-এ তিনটি মানচিত্রে রূপ নিয়েও এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতি আসেনি। ষাটের দশকে ছিল খেলোয়াড় আমেরিকা। আমেরিকা চাইল এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি প্রো-আমেরিকান দেশ। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চাইলেন এশিয়ার মোড়লগিরি। কিন্তু আমেরিকা দেখল ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। প্রচুর ডলার ঢালতে হবে। আমেরিকা বেছে নিল ইরানকে। ইরানে প্রচুর তেল সম্পদ আছে। আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে ইরানের পাহলভি রাজবংশের সম্রাট রেজা শাহের চুক্তি হলো তেল উত্তোলনের। শাহকে প্রলোভন দেখানো হলো- তুমি হবে এশিয়ার মোড়ল, অস্ত্র মজুদ করো। ট্রেনিং আমরাই দেবো। সেভাবে ইরান ভারতকে পেছনে ফেলে অত্যাধুনিক অস্ত্র ভান্ডারে শক্তিশালী হয়ে উঠল। আমেরিকা ভারত এবং পাকিস্তানের কাছেও অস্ত্র বিক্রি করত। কিন্তু অর্থের দৌড়ে না ভারত না পাকিস্তান ইরানের সমান হতে পেরেছে। আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির কৌশল হলো যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে দুই দশকে দেখেছি কীভাবে ইরান-ইরাক, ইরাক-কুয়েত, কাতার অবরোধ যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। 

১৯৬৫ সালে ভারত খেলো আমেরিকার কাছ থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা। পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াইয়ে ভারত বহু ফ্রন্টে শোচনীয় পরাজয়বরণ করে। ভারত মনে করে এ পরাজয় হয়েছে আমেরিকা যেসব অস্ত্র পাকিস্তানকে দিয়েছে, তা অস্বীকার করেছিল বলে। ইন্দিরা গান্ধী নতুন মিত্রের খোঁজে মস্কো ছুটলেন। চুক্তি হলো ইন্দিরা-কোসিগিন ২৫ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে বিজয় অর্জন করে রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতা মূলত ভূমিকা পালন করে। অপরদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকা চিরাচরিত প্রতারণামূলক আচরণ করে। বর্তমান কালে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও আমেরিকার ভূমিকা লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যাবে। যদি ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে ইউক্রেনের পাশে না দাঁড়াত এতদিনে কিয়েভের পতন ঘটে যেত। 

এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, আফগানিস্তানে পরাজয়, তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাওয়া রাশিয়ার সঙ্গে ভারত সম্পর্ক ছেড়ে আমেরিকার সঙ্গে ঝুঁকে পড়ে। এখন তো ইরান নেই আছে নতুন ‘পরাশক্তি’ চীন। তাই, ভারত কৌশলগত অস্ত্রের ভান্ডার বাড়াতে চায়। লক্ষ্য পাকিস্তান নয়- চীন। চীন রাশিয়ার কৌশলগত প্রতিরক্ষা মিত্র নয় শুধু, নব্বইয়ের পর এ পর্যন্ত অর্থ দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন সহায়তাদানকারী বন্ধু দেশ। তাই চীন প্রশ্নে রাশিয়া কি ভারতের পাশে দাঁড়াবে? কক্ষনো না। ভারতকে তাই চীনাদের দেখিয়ে আমেরিকার দুয়ারে ধর্ণা দিতে হলো মোদীকে। রাশিয়ার সঙ্গে এর আগের ২৫ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দশক অতিবাহিত হওয়ার পর আমেরিকা হতে পারে ভারতের মিত্র। কিন্তু বিগত দুই দশকে ভারতের গতিবিধি প্রমাণ করে কিছু অস্ত্র আমেরিকা এবং ফ্রান্স থেকে ক্রয় করলেও চীনা জুজুর ভয়ে আবার রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে ভারত। পুতিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষাসহ ২০টি চুক্তি করেছে মোদী। ওই চুক্তির আলোকে ভারত এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৫টি এবং পূর্বের ক্রয়কৃত সুকহুই ভার্সানের ২৭ এবং ৩০ মডেলের যুদ্ধ বিমানের খুচরো যন্ত্র ও মানোন্নয়নে সহায়তা পাবে। এতে আবার আমেরিকা নাখোশ ভারতের ওপর। কিন্তু আমেরিকার এশিয়া নীতির জন্য ভারতকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। 

ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান

এই তিন দশক আগেও বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে এক অজানা ভূ-খণ্ড হিসেবেই ছিল। ভারত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন অভিধান, বই-পুস্তক, এটলাসে বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্গত একটা ছোট্ট জনপদ দেখানো হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের তৈরি মোবাইল সেট সামস্যাং-এ যে ম্যাপ দেওয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশ নামে দেশ স্বীকারই করা হয়নি। বিগত ৯৬-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি পত্রিকায় ‘মূখ্যমন্ত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করে। এখন বাংলাদেশের অবস্থান ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের গুরুত্ব ভারতের কাছে বরাবর ছিল। কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য (মনিপুর, আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয় অরুণাচল) মূল ভারতের বিশাল অংশ থেকে আক্ষরিক অর্থে বিচ্ছিন্ন। কার্যত ভারত দুই খণ্ডে বিভক্ত। দ্বিতীয় খণ্ড বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বে অবস্থিত। এই দুই খণ্ডের মধ্যে যাতায়াতের জন্য বা এই দুই খণ্ডকে সংযুক্ত করে যে জমি সেটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত পঞ্চগড় জেলার উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে বিস্তৃত। সেই সংযোগকারী ভূ-খণ্ডে ভারতের যে বিখ্যাত শহরটি অবস্থিত তার নাম শিলিগুড়ি। সে জন্যই ওই ভূ-খণ্ডের নাম শিলিগুড়ি করিডোর। শিলিগুড়ি পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত। ইংরেজি শব্দ করিডোর মানে বারান্দা। এই করিডোর উত্তর-দক্ষিণে চওড়া বা প্রশস্ত কম বেশি ২০ মাইল। ভারত নামের বিশাল দেশের এই দিকের দুটি খণ্ডকে সংযোগকারী এই করিডোর সব ধরণের কৌশলগত বা রণকৌশলগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য অপর্যাপ্ত ও অপ্রতুল। অপরদিকে এসব রাজ্যে রাজনৈতিক অসন্তোষ রয়েছে। সশস্ত্র গ্রুপও রয়েছে। এদের দাবি স্বাধীনতা। ফলে এসব রাজ্যে দ্রুত প্রবেশের জন্য ভারতের প্রয়োজন বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে Easy Entrance বা দ্রুত চলাচলের সুবিধা। সে কারণেই ভারত বাংলাদেশের কাছে ওই সুবিধা পেতে ‘ট্রানজিট চুক্তি’ করতে আগ্রহী।

অপরদিকে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বে ভারতের যে অংশ, তার সবচেয়ে উত্তর-পূর্বে অবস্থিত প্রদেশের নাম অরুণাচল। অরুণাচলের সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা হচ্ছে বিশাল শক্তিধর রাষ্ট্র গণচীনের। মানচিত্রের এই অংশে ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ বিধ্যমান। ১৯৬২ সালে এই অঞ্চলে ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। ভারত ওই যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়েছিল। অরুণাচল ও চীনের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত, সেখানে একটি অংশ উভয় দেশের মধ্যে বিতর্কিত। এই অঞ্চলে চীন এবং ভারতের মধ্যে আরো একটি মারাত্মক সংঘর্ষ বেঁধে যাওয়া অসম্ভব নয়। এখানে প্রায়শ ভারত ও চীনের মোতায়েনকৃত সৈন্যদের মধ্যে খণ্ড খণ্ড লড়াই হয়ে থাকে। 

১৯৬২ সালে ভারতের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল অপর্যাপ্ত সৈন্য সংখ্যা, যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সে লাইন অব কমিউনিকেশন বা সরবরাহ সড়ক ছিল সেটার দুর্বলতা ইত্যাদি। ৬২ সালের পরে ক্রমান্বয়ে ভারত এই অঞ্চলে সামরিক ভৌত কাঠামো এবং লাইন অব কমিউনিকেশনের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু ১৯৬২ সালে যেমন ২০২৪ সালেও তেমনি শিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) চিকেন বা অপ্রশস্তই রয়ে গেছে। তফাৎ হলো ১৯৬২ সালে শিলিগুড়ি করিডোর ছিল, উত্তর পাশে নেপাল, স্বাধীন সিকিম (এখন ভারতভুক্ত), ভুটান এবং দক্ষিণে হলো বাংলাদেশের পঞ্চগড়। ১৯৬২ সালে ঘটনাচক্রে পাকিস্তানিরা শিলিগুড়ি করিডোরকে ডিস্টার্ব করেনি। এখন ভারত নিশ্চিত হতে চায় ওই সাত রাজ্যের নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সহযোগিতা। তাই ট্রানজিট দরকার বাংলাদেশের কাছে। চীন এটাকে সুনজরে দেখছে না। কারণ ভারত ও চীনের মধ্যকার বিতর্কিত এলাকা চীন তার প্রদেশ আকসাই চীনের অন্তর্গত মনে করে। ভারত মনে করে তাদের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখের অংশ। এই অঞ্চলটির আয়তন ৩৭০০০ বর্গ কিলোমিটার।

চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব নানান কারণেই। চীন চায় আঞ্চলিক মোড়ল হতে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতা রয়েছে। এমনকি এ দুটি দেশ আক্রান্ত হলে একে অপরের সহযোদ্ধা হয়ে মোকাবিলা করার প্রতিরক্ষা চুক্তিও করা। চীনের আঞ্চলিক মোড়ল হতে প্রধান বাধা ভারত। তাই ভারতকে একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা চীনের। ভারতের সন্নিহিত দেশগুলোর সঙ্গে অসন্তোষ ও রেষারেষিকে চীন কাজে লাগাতে চায়। এছাড়া ভারতকে ঘীরে চীনের শক্তিশালী কৌশলগত প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করার উদ্যোগও বেশ স্পষ্ট। পাকিস্তানের গোযাদরে নৌবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি, শ্রীলঙ্কায় হামবানটোটায় সমুদ্র নৌবন্দর নির্মাণ এবং মিয়ানমারে সামুদ্রিক বন্দর নির্মাণ কার্যক্রম চীনের উদ্দেশ্য বোঝা যায়।

ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক একদিকে শীতল হওয়া, অপরদিকে চীনের সঙ্গে উত্তপ্ত হওয়া প্রমাণ করে ভূ-রাজনীতির মেরুকরণ। শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ভুটান দেশসমূহের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বেড়েছে, ভারতের সাথে কমেছে। চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। করোনা সংকটের আগেও চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছিল। চীন অতি সহজেই একটি দেশের উন্নয়নে ঋণ বা বিনিয়োগ করতে পারে। ইতোমধ্যে চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দান করেছে। ভারতও চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ চীনের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং একশ জন সফর সঙ্গী নিয়ে এসে পরিষ্কার ভাষায় জানান- ‘বাংলাদেশ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’। ‘স্ট্র্যাটেজিক’ শব্দটি সামরিকগত অর্থ হলো- যুদ্ধে অংশীদারিত্ব। যে কারণে চীন বাংলাদেশে আগে পিছে মিলে ৩২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইতোমধ্যে চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় পদ্মা ব্রীজ, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা মেট্রোরেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদি বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। 

চীন চায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি তার প্রতি সমর্থন দিক। আর ভারতকে মোকাবিলা করতে হলে সন্নিহিত এইসব ছোট ছোট দেশ তার দরকার। চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত ৪ হাজার ৫৭ কিলোমিটার। এই বিশাল সীমান্ত অঞ্চলের অনেকটাই বিবাদমান। 

পরাশক্তি রাশিয়া এবং আমেরিকার কেন বাংলাদেশের প্রয়োজন? বিগত দেড় দশকের ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে রাশিয়া বাংলাদেশকে বেশ গুরুত্ব দেয়। তা কি পরমাণু বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং যুদ্ধ বিমান মিগ-২৯ কেনানোর জন্য? না, এখানে ভূ-রাজনীতির বিষয় আছে। আমেরিকার বিগত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশ আসতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য আমেরিকার উদ্বেগ এবং উচ্চ পর্যায়ের সরকারের লোকদের উপর্যুপরি সফর প্রমাণ করে না আমেরিকার নজরও বাংলাদেশে? আমেরিকা বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকুক না থাকুক, তার মাথা ব্যাথার কারণ এখানে নয়। তার মাথাব্যাথা চীনকে কেন্দ্র করে। তাই আমেরিকা বাংলাদেশ তার নীতির পক্ষে থাকুক, এমন একটা প্রো-মার্কিনী সরকার চায়। সেদিকেই এগোচ্ছিল আমেরিকা। কিন্তু ২০২৪-এ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমেরিকা কাজে লাগাতে পারেনি। আমেরিকা চায়নি ভারতকে অসন্তোষ্ট করতে। কারণ আমেরিকা জানে চীন প্রশ্নে ভারতের সমর্থন তার দরকার। তাছাড়া মিয়ানমারে সূচি সরকার পড়ে যাওয়ায় আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নীতি অনেকটা ভেস্তে গেছে। তাই, আমেরিকা ধারে চলার নীতি গ্রহণ করেছে। 


প্রধানমন্ত্রী ভারত-চীন সফর ও ট্রানজিট চুক্তি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে গত ২১ জুন দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লী যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ২০ দিনের মাথায় চীন সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চার দিনের সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসেন। ভূ-রাজনীতির দৃষ্টিতে এ দুটি দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। 

ভারতের নির্বাচনোত্তর কালে প্রধানমন্ত্রীর ১৫ দিনের ব্যবধানে দিল্লী সফর নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক কথা বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। উল্লেখ্য, ৯ জুন মোদির শপথ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সেই সফরটি ছিল নিতান্ত মোদির তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার আনন্দঘন মুহূর্তে উপস্থিত থাকা মাত্র। রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। এবার শেখ হাসিনার এ সফরে ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউঘ) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ঢাকা ও দিল্লী। সাধারণত মনে করা হয় সমঝোতা স্মারক কোনো বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি নয়, যা অবশ্যই পালন করতে হবে। ১০ টির মধ্যে ৭টি নতুন এবং ৩টি নবায়ন করা হয়েছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, একাডেমিক সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক বিনিময় করেন। 

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, ভারতকে সড়ক পথে ট্রানজিন প্রদান, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকার করেছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন এসব চুক্তির অধিকাংশ  ভারতের অনুকূলে গেছে অথবা চুক্তি অনুযায়ী পরিপালনের ভারতের অনীহা বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসেনি। এবার রেল ট্রানজিটের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক চুক্তির ব্যাপারে পর্যবেক্ষক মহল নান বিশ্লেষণ করছেন। 


রেল ট্রানজিট কেন?

ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণ সম্পর্কে এর আগে সামান্য ধারণা দেওয়া হয়েছে। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ভারত সফরের সময় রেল ট্রানজিট সংক্রান্ত যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, তা শুধু ভারতের একতরফা স্বার্থ রক্ষার জন্যই না, বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে। এ সম্পর্কে ভারতের  পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোযাত্রা বলেছেন, রেলওয়ের জন্য সমঝোতা স্মারকটি ছিল দুই দেশের রেলওয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ছয়টি আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগ রয়েছে, কিন্তু এ রেল সংযোগ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এর মাধ্যেমে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে ট্রানজিট পাওয়া যাবে। রেল ট্রানজিটের অংশ হিসেবে আগামী মাসের (আগস্ট) কোনো এক সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেছে দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলহাটি ক্রসবর্ড়ার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলক চালানো হবে। (ট্রান্সক্রিপ্ট অব স্পেশাল ব্রিফিং বাই ফারন সেক্রেটারি অন স্টেট ভিজিট অব প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া, ২২ জুন ২০২৪, মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল অ্যাপায়ার্স, ইন্ডিয়া)। 

এ ট্রানজিট থেকে একমাত্র ভারত কৌশলগতভাবে লাভবান হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যেতে পারবে, মালামাল আনা-নেওয়া করতে পারবে। জরুরী প্রয়োজনের কথা বলে সেনাবাহিনী, সামরিক সরঞ্জাম, মালবাহী ওয়াগন নিয়ে যেতে পারবে। তাতেও আপত্তি ছিল না, ভারতের উত্তর-পূর্ব সাত রাজ্যে যে ধিকি ধিকি আগুন জ¦লছে, আর ওই আগুনে ঘি ঢেলে দেবার আয়োজনে প্রতিবেশি বৈরী দেশটি প্রস্তুত কিনা তা আমরা যেভাবে জানি না, তেমনি এ আগুন আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়বে কি না এর কোনো নিশ্চিত বার্তা নেই। 

অন্যান্য টেকনিক্যাল সমস্যা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারত এবং চীনের মাথা তুলে দাঁড়ানোর ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ প্রায় দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বাংলাদেশ যদি এক্ষেত্রে কোনো পক্ষে বেশি সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে যায়, তবে নির্ঘাৎ বিপদ অপেক্ষা করছে। 

এবার প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সম্পর্কে সামান্য দৃষ্টিপাত করা যাক। কারণ সম্প্রতি (১১ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের বেইজিং সফর অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল। একদিন সফর সংক্ষিপ্ত করা ও সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে আলোচনা হয়েছে বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়া এবং সরকারের মুখপাত্র চীন সফর নিয়ে মন্তব্য করেছে। ওসব বিষয়ে যাচ্ছি না।

প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং যাওয়ার আগে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ রাজনীতিবিদ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভারত হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক মিত্র আর চীন হলো উন্নয়নের অংশীদার’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার আশ^াস পাওয়া গেছে। আমরা ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার জন্য বলব।’ কিন্তু বাস্তবে চীনের ১ বিলিয়ন চীনা মুদ্রা ইউয়ান (বাংলাদেশি মুদ্রায় কম বেশি) ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তার ঘোষণা আসে। এ ছাড়া ২০টি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা দৃশ্যত তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। 

কেন এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চীনের- তা সামান্য আলোকপাত করব। আগেই বলেছি ভূ-রাজনীতির খেলায় চীনের বাংলাদেশকে দরকার। তা ২০১৬ তে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জন পিং এসে স্পষ্টভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে যান। ওই সময় শি অত্যন্ত উদারচিত্তে ২৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা (বিনিয়োগ) দিতে সমঝোতা স্মারক সই করেন। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীতে টানেল ও আনোয়ারায় চীনা ইপিজেড এর উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট শি। এমনকি এরপর গঙ্গাব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রে নৌ বন্দর নির্মাণ করার আগ্রহ চীনের পক্ষ থেকে আশ^াস দিলেও একসময় ইউটার্ন নিতে দেখা যায়। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রে নৌ বন্দরের প্রস্তাব উপক্ষিত হয়। এমনকি ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প চীনকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলেও ভারত থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট হয় চীন নয় তিস্তা প্রকল্প ভারতকে দেওয়া হবে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে ভারত ওই প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করার মতো অবস্থায় নেই। ইতিপূর্বে ভারত চারবারে স্বাক্ষরিত ভারতের ৮ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত এখনও ১ বিলিয়ন ডলারও বিনিয়োগ করেনি। চীনের অসন্তুষ্টির মূল কারণ ট্রানজিট প্রদান। ভারত যেভাবে নিরাপত্তা প্রশ্নে চীনকে অধিক গুরুত্ব দেয় (পাকিস্তান অপেক্ষাও)। তেমনি চীনও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তার দিকটি সম্পর্কিত মনে করে। অন্যদিকে আমেরিকার দিকেও চীনকে নজর রাখতে হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত অন্যত্র আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি। কারণ বর্তমানকালে ভূ-রাজনীতি বুঝতে হলে সামরিক শক্তি, অস্ত্র প্রতিযোগিতা কীভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে তা-ও বুঝতে হবে। সেটা আরও জটিল বিষয়।


উপসংহার

বাংলাদেশ কি বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে? সেটা কি হওয়া ঠিক হচ্ছে- এটা নিয়ে ভাবার বিষয়। আমার ভাষ্যমান নিবন্ধে খানিকটা পরিষ্কার করতে প্রয়াস পেয়েছে বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলার মধ্যে পড়ে গেছে। শুধু ভারত-চীন নয় অন্যান্য বৃহৎ শক্তি রাশিয়া এবং আমেরিকার নজরও আছে। জাপান ও তুরস্কেরও দূরবর্তী নজর রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সতর্কভাবে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করতে হবে। বিশে^র এমন অনেক দেশ আছে শক্তিতে হীন হয়ে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। খুব দূরে তাকানোর দরকার নেই সিকিম ও ভুটানের মধ্যবর্তী উপত্যকা ডোকলাম নিয়ে চীন-ভারত যে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ভুটান তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঞধপষব দেয়। ভারতীয় সৈন্য ভুটানে জোরপূর্বক প্রবেশ করে। তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত ঘোষণা দেন চীন যদি তার অবস্থান থেকে সরে না যায়, আক্রমণ করা হবে। চীনও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত বলে জানায়। কিন্তু ভুটানের রাজমাতা কৌশলে ভারতের সেনাবাহিনীকে সরে যেতে বাধ্য করেন এবং চীনের অনড় ভূমিকায় ভারতও যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। রুশদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চেচনিয়া, জর্জিয়া টিকে আছে না। পুতিনকে খুশি করতে রাশিয়ার পাশাপাশি চেচেন বাহিনী লড়াই করেছে। আবার তারাই ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে। বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে টিকে আছে। যদি ইরানের কথা বলি, হয়তো অন্যরকম মনে হবে উদাহরণ; কিন্তু মার্কিনী ও পশ্চিমা শক্তির নানা অবরোধ, ইসরাইল কর্তৃক গুপ্ত হত্যা, হামলা পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে ইরান। 

আবার চীন-রাশিয়া প্রসঙ্গে আসি। নব্বইয়ের দশকের পর একক সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকা বিশ^ব্যাপী যে মোড়লীপনা করেছে, এখন তা সীমিত হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, আসিয়ানভুক্ত দু’একটা দেশ, জাপান, আফ্রিকার দরিদ্রপীড়িত কিছু দেশ ব্যতীত আমেরিকার খরবদারি এখন খুব বেশি কার্যকর নেই। অপরদিকে রাশিয়া এবং চীন যৌথভাবে বিশে^র ওপর প্রভাব আগের তুলনায় অনেকটা বাড়িয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া প্রথম দিকে বেকায়দায় পড়লেও এখন কিয়েভ চাপের মধ্যেই আছে। এক্ষেত্রে ইরানের ‘ড্রোন’ সহায়তা বিশ্বে নয়া মেরুকরণ ইঙ্গিত দেয়। অপরদিকে চীন ইরানের সঙ্গে ২৫ বছরের নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ দেখা হচ্ছে। 

একটা বিষয় হলো, বর্তমান কালে সম্পর্কের উপলক্ষ্য দুটি মৌলিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক. সামরিক শক্তি, দুই. অর্থনীতি। এ কারণে মার্কিনীরা চায় না ইরান পরমাণু বোমার অধিকারী হোক। কিন্তু কোনো দেশ কি করো অনুমতির অপেক্ষা করে সামরিক অস্ত্র নির্মাণে?

বাংলাদেশ নিজেকে হীন ও অসহায় ভাবার কারণ নেই। কারণ বিশাল সেনাবাহিনী, বিপুল অস্ত্রের ভান্ডার এখন শক্তির নিয়ামক নয়। যুদ্ধটা এখন মুখোমুখি নেই। তাই চীন বহু আগেই তার সেনাবাহিনীকে ছোট করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিশাল ট্যাংক গলিয়ে নৌ-বাহিনীর জন্য ফ্লিট বানাচ্ছে। ভারতও নিয়মিত সেনাবাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করছে। পুরনো মান্ধাতা আমলের অস্ত্র ভাঙ্গারি হিসেবে অন্য কাজে লাগাচ্ছে।

বাংলাদেশ যদি কৌশলগত অস্ত্র এবং সেনাবাহিনীকে চৌকস প্রশিক্ষণ দিয়ে সাজাতে পারে- নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার কারণ নেই। আমরা জানি বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে থাকে। এক্ষেত্রে চীন বড় ধরণের সরবরাহকারী দেশ। এমন কোনো দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা উচিত নয় যারা নিজেরাই বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত অস্ত্র ক্রয় করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও টেকসই ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পথে যেতে পারেনি। এ অবস্থায় আমেরিকাসহ পশ্চিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে। মন্ত্রীদের আমেরিকায় ‘গণতন্ত্র নেই’ ‘নিরাপত্তা নেই’ এসব গলা ফাটিয়ে না বলাই উচিত। এদের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। একইভাবে ভারতমুখী নয়; নানামুখী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। 

লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির