post

মব সহিংসতা ও গণপিটুনি সংবিধান, আইন ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ওবায়দুর রহমান

মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনা বাংলাদেশের সমাজ ও আইনের শাসনের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। এটি আইনহীনতার পরিচয় এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। অনেক মানুষ জানেই না যে, গণপিটুনি আইনত অপরাধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ইসলামী শরীয়াহ আইন, বাংলাদেশের সংবিধান, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী গণপিটুনি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দেশের মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে অনেকক্ষেত্রে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।

মব সহিংসতা (Mob Violence) বলতে বোঝায় যখন কোনো দল বা জনতা সংঘবদ্ধভাবে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালায়, যা সাধারণত নিয়ন্ত্রণহীন ও আকস্মিকভাবে ঘটে। এটি সাধারণত ব্যক্তিগত বা দলীয় ক্ষোভ, গুজব, রাজনৈতিক বা সামাজিক উত্তেজনা, ধর্মীয় বিদ্বেষ বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ঘটতে পারে। আর গণপিটুনি (Mob Lynching) হলো যখন উত্তেজিত জনতা বা জনসমষ্টি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহের বশে বা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে মারধর করে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি সাধারণত গুজব, রাজনৈতিক বা সামাজিক উত্তেজনা, ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষ বা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে ঘটে। 

স্বাধীনতার পর প্রতি বছরই গণপিটুনির মতো ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) হিসেব অনুযায়ী, গত বছরের (২০২৪) আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত গণপিটুনিতে ১২১ জন নিহত হয়েছে। আরেক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে গণপিটুনিতে সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গত বছর। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয় ১৪৬ জন, যা আগের বছরের প্রায় তিনগুণ। 

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসেব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ২ মাসে গণপিটুনির অন্তত ৩০টি ঘটনায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৯ জন এবং আহত হয়েছে ২০ জন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৭ মাসে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৭৪ জন। এইচআরএসএস বলছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান ছিল সবচেয়ে ভীতিকর। গত বছরে গণপিটুনির অন্তত ২০১টি ঘটনায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৭৯ জন এবং আহত হয়েছে ৮৮ জন। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে গণপিটুনির অন্তত ১০০৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৭৯২ জন এবং আহত হয়েছে অন্তত ৭৬৫ জন। সকল মানবাধিকার সংগঠন দাবি করে, প্রকৃত সংখ্যা এর চাইতে আরও বেশি হবে।

বাংলাদেশে গণপিটুনির কিছু উদাহরণ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ৪ মার্চ দুপুরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ইরানি নাগরিককে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা, গত ৩ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের এওচিয়া ইউনিয়নে মাইকে ‘ডাকাত’ ঘোষণা দিয়ে ২ জন জামাত কর্মীকে পরিকল্পিতভাবে পিটিয়ে হত্যা, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মাদারীপুরে ডাকাতির ঘটনায় শরীয়তপুরে ৭ জন ডাকাতকে গণপিটুনির ঘটনায় ৫ জন নিহত ও ২ জন আহত, ২৭ ফেব্রুয়ারি উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা, ২০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম মোল্লা নামে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা, ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা, ৭ সেপ্টেম্বর গণপিটুনিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে হত্যাসহ অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা বা এফআইআর হলেও সুষ্ঠু তদন্ত বা অপরাধীদেরকে শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় দোষীরা আইনের আওতায় না আসায় দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, ফলে দোষীরা রয়ে যাচ্ছে অধরাই। 

সাধারণত যারা গণপিটুনির শিকার হন, তারা অধিকাংশই কোনো না কোনো অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন বা অপরাধ সংগঠনের সময় গণপিটুনির শিকার হন। কিন্তু কোনো অপরাধীর অপরাধ বিচার করা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দায়িত্ব নয়, এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধীকে আইনের কাছে সোপর্দ করা। কিন্তু গণপিটুনির শিকার এমন অনেকেই আছেন, যারা কোনো ধরনের অপরাধের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। যেমন ২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাসলিমা বেগম রেণু নামের এক নারীকে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা, ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে ঢাকার পাশেই আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যাসহ এরকম অসংখ্য ঘটনা মিডিয়াতে বেশ আলোচিত হয়েছিল।   

মব সহিংসতা ও গণপিটুনির কারণ

আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষোভ, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ পরায়ণতা থেকে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে বেশি। এছাড়াও সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব (যেমন : শিশু চোর, গরু চোর, ধর্মীয় অপবাদ ইত্যাদি), আইনের শাসনের অভাব বা বিচার ব্যবস্থার বিলম্ব, বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, জনতার আবেগ ও উত্তেজনার বিস্ফোরণ, রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক উসকানি, সামাজিক অস্থিরতা ও হতাশা, জনসচেতনতার অভাব ইত্যাদি কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন কী বলে?

মব সহিংসতা ও গণপিটুনি বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিষয়ক একাধিক ধারা লঙ্ঘন করে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের আইনের আওতায় বিচার লাভ এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ৩৩, ৩৫ ও ৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য, তার চেয়ে বেশি বা ভিন্ন কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করে আইন নিজের হাতে তুলে নিলে দণ্ডবিধির ১৪৯, ১৮৭, ৩০৪, ৩১৯, ৩২৩, ৩২৬, ও ৩৩৫ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। 

গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া সকল ব্যক্তি সমানভাবে দায়ী হবে। কেননা আইনে ‘যৌথ দায়িত্বশীলতা’ বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন, যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন।’ এর মানে গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবেন, সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড়ো ধরনের জখম করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন। 

এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যায় আর সেটা যদি খুন হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা যায়, তাহলে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ দ্বারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করা যায়। সে হিসেবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দণ্ড হবে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’। এদিকে ২০১৯ সালে বাড্ডায় গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেণু হত্যার পর আইনজীবী ইশরাত হাসানের দায়ের করা একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত গণপিটুনি রোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন, যার প্রথম ৪টি হচ্ছে :

১. পুলিশের প্রত্যেক সার্কেল অফিসার তার অধীনের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ছয়মাসে অন্তত একবার গণপিটুনি প্রবণতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে বৈঠক করবেন। 

২. গণপিটুনির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রচার কার্যক্রম গণমাধ্যমে প্রচারণা অব্যাহত রাখবে।

৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো ধরনের অডিও, ভিডিও, মেসেজ; যা গুজব সৃষ্টি বা গণপিটুনিতে মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যে দুষ্কৃতকারীরা এ কাজে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

৪. যখনই গণপিটুনির কোনো ঘটনা ঘটবে, কোনো রকম দেরি না করে তখনই থানার ওসি এফআইআর নিতে বাধ্য থাকবেন এবং তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারকে অবহিত করবেন।

আন্তর্জাতিক আইন কী বলে?

গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র টউঐজ-এর ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ও ১১ নং ধারা লঙ্ঘন করে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র-১৯৪৮ এর তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার আছে।’ অনুচ্ছেদ পাঁচ অনুযায়ী কারও প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না। আর নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬ এর অনুচ্ছেদ ছয় ও সাতে নির্যাতনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের অনুচ্ছেদ দুই মানুষের জীবনের অধিকার নিয়ে আলোকপাত করেছে। অনুচ্ছেদ তিনে কারও প্রতি নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ পাঁচে নিরাপত্তার কথাটি তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া ২৬ অনুচ্ছেদে সবার আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। 

মব সহিংসতা ও গণপিটুনির বিষয়ে ইসলাম কী বলে?

ইসলাম শান্তি, ন্যায়বিচার ও আইন মেনে চলার শিক্ষা দেয়। মব সহিংসতা ও গণপিটুনি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, কারণ এটি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

১. আইন নিজের হাতে নেওয়া হারাম : ইসলামে বিচার ও শাস্তি দেওয়ার অধিকার শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও যোগ্য বিচারকদের রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি নিজে থেকে বিচার করতে গিয়ে কাউকে আক্রমণ বা হত্যা করে, তবে তা স্পষ্টভাবে হারাম (নিষিদ্ধ) বলে বিবেচিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর কেউ যদি কোনো মানুষকে হত্যা করে কোনো প্রাণের বিনিময়ে বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজের শাস্তি ছাড়া, তবে সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল।’ [সূরা আল মায়িদা : ৩২]

২. গুজব ও মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো নিষিদ্ধ : মব সহিংসতার অনেক ঘটনা গুজব ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ঘটে। ইসলাম কঠোরভাবে গুজব ছড়ানো ও মিথ্যা বলাকে নিষেধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যা জানো না, তার পেছনে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তর; এসবের প্রতিটির ব্যাপারেই জিজ্ঞাসা করা হবে।’ [সূরা আল ইসরা : ৩৬]

৩. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে কঠোর শাস্তি : মব সহিংসতায় অনেক নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়। ইসলাম অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে হত্যাকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।’ [সূরা আন নিসা : ৯৩]

৪. ন্যায়বিচার ও ধৈর্যের শিক্ষা : ইসলাম মানুষকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার এবং ধৈর্য ধরার আদেশ দিয়েছে। উত্তেজিত হয়ে অন্যায় কাজ করা ইসলাম সমর্থন করে না। হাদীসে এসেছে, ‘তোমরা রাগ করো না।’ [বুখারী : ৬১১৬] 

আরও বলা হয়েছে, ‘সাবধান! যদি তোমরা কোনোকিছুতে সন্দেহ করো, তাহলে যাচাই করো।’ [মুসলিম : ২৮৭৩] 

সহীহ বুখারী ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে, একবার এক বেদুইন (গ্রাম্য ব্যক্তি) মসজিদে নববীর ভেতরে প্রস্রাব করতে শুরু করে। এটি দেখে সাহাবীরা ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নবীজি তাদের থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রস্রাব শেষ করতে দাও।’ এরপর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধীরস্থিরতার সাথে তাকে ডেকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য; নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরের জন্য বানানো হয়েছে। এখানে এই ধরনের কাজ করা উচিত নয়।’ পরবর্তীতে তিনি সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন, সেখানে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করে দিতে।’

মব সহিংসতা ও গণপিটুনি প্রতিরোধ করার উপায়

গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা আজ একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে দেশের সকল নাগরিক, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মব সহিংসতা ও গণপিটুনি প্রতিরোধে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণপিটুনির সাথে সম্পৃক্ত সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে, গুজব প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি (সোস্যাল মিডিয়া ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারণা) করতে এবং এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে এবং দেশের সকল নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। সেইসাথে দেশের সচেতন সমাজ ও গণমাধ্যমকে গণপিটুনির বিষয়ে দেশের সকল নাগরিককে সচেতন করে গড়ে তুলতে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।

উপসংহার 

মব সহিংসতা ও গণপিটুনি ইসলামের মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটি অরাজকতা সৃষ্টি করে এবং সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ইসলামের আদর্শ হলো শান্তি, ন্যায়বিচার ও ধৈর্য ধরে সঠিক পথ অনুসরণ করা। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই মব সহিংসতাকে সমর্থন করা যাবে না, বরং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ অনুসন্ধান করতে হবে।

তথ্যসূত্র : 

১. বাংলাদেশের সংবিধান।

২. অপরাধ দমন আইন, দণ্ডবিধি ১৮৬০ ও দ্যা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড (CrPC)।

৩. মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র UDHR, ICCPR ও ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস।

৪. মানবাধিকার সংগঠন আসক, এমএসএফ ও এইচআরএসএস-এর পরিসংখ্যান।

৫. আল কুরআন ও আল হাদীস।

৬.  বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম।

লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় মানবাধিকার সম্পাদক, 

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির