জনস্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য হলো- সমাজ, সংগঠন, সরকারি এবং বেসরকারি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মিলিত চেষ্টা এবং তথ্যাভিজ্ঞ পছন্দের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, জীবনকাল বৃদ্ধি ও মানব স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিজ্ঞান ও কলা। জনগণের স্বাস্থ্য ও তা ঝুঁকির দিকগুলো বিশ্লেষণ করা জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয়। এখানে জন শব্দটির ব্যাপ্তি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। জন শব্দের অর্থ হাতে গোণা অল্প কিছু মানুষ, সমাজের অধিকাংশ মানুষ, সমাজের প্রায় সকল মানুষ, এমনকি কয়েকটি মহাদেশের মানুষ, একইভাবে বিশ্বের সকল জনগোষ্ঠীও-এর আওতাভুক্ত হতে পারে। আলাদা আলাদাভাবে যে-কোনো পর্যায়ের সীমিত সংখ্যক মানুষও এর আওতাভুক্ত হতে পারে।
প্রত্যেক জাতির জন্য থাকে একজন প্রদর্শক। কোনো সতর্ককারী প্রেরণ ব্যতীত আল্লাহ কোনো জাতিকে শাস্তি প্রদান করেন না। আর জাতিকে পরিশুদ্ধ পরিক্রমায় পরিচালনার জন্যই আল্লাহ নবী ও রাসূলদের কল্যাণ বার্তাসহ প্রেরণ করেন। নবীরা তাদের সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেন জাতির কল্যাণার্থে।
পৃথিবীতে আগত সকল নবীর আগমন হয়েছিল বিশেষ কোনো অঞ্চল, কোনো জাতি, কোনো ভাষা, কোনো বর্ণের জন্য। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা.। তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সকল দেশের, সকল ভাষার, সকল অঞ্চলের, সকল বর্ণের মানুষের জন্য। এমনকি মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণিকূলের জন্যও তিনি নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। এজন্যই তিনি শেষ নবী। আর শেষ নবী বলেই তিনি বিশ্বনবী।
শেষ নবী- নবীদের মাঝে এক বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত অভিধা। এরপর আর কোনো নবী আসবে না হেতু শেষ নবীর দায়িত্বও বেশি। একজন মানবের জীবনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন নবী মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে পাওয়া যায়। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতা, যুদ্ধ-শান্তি, গৃহ-ময়দান, ভেতর-বাহির, জীবনের সর্বক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতার সার নির্যাস তার জীবন থেকেই পাওয়া যায়।
রাসূল মুহাম্মদ সা. একজন সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তার আচার-আচরণ, কর্ম প্রক্রিয়া, বাচনিক ভঙ্গিমা ও প্রজ্ঞা সবকিছুতেই ছিল দার্শনিকতার ছাপ। তার সমগ্র জীবনের উক্তিসমূহ বিবেচনা করলে তাতে যে নির্দেশনা রয়েছে তা নানাবিধ দার্শনিকতা ও কল্যাণ ভাবনায় পরিপূর্ণ। ব্যক্তি মুহাম্মদ সা.কে নিয়ে গবেষণা করলে, তার সামাজিক আচরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- তিনি একজন সমাজ বিজ্ঞানী তথা সমাজ দার্শনিক। আবার তার রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি বিচার করলে দেখা যায়- তিনি একজন অত্যন্ত উঁচু মাপের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথা রাষ্ট্র চিন্তাবিদ। রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে তার কার্যকলাপ দেখলে মনে হবে তিনি একজন চিকিৎসাবিদ। অনুচর ও সহচরবৃন্দের সাথে কথাবার্তায় তিনি একজন মনোচিকিৎসাবিদ। যুদ্ধক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্ব অবশ্যই তাকে একজন পেশাদার সৈনিক ও দক্ষ সমর কুশলীর মর্যাদায় উপনীত করে। এমনকি তাকে দিগি¦জয়ী সেনাপতির অভিধায় অভিষিক্ত করে। যদি তার ব্যবসা অভিজ্ঞতার দিকে নজর দেওয়া যায়- তবে তাকে একজন সৎ ও নৈতিক ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়। তার রোমান্টিকতাও ছিল স্বচ্ছ ও পবিত্র। নিত্য দৈনিকতা ও প্রাত্যহিক লেনদেনেও তিনি উদার নৈতিক ও সততার মূর্ত প্রতীক।
বিশেষত তিনি তার নবুওতি জীবনের মধ্যাহ্নে মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি একটি উদার ও আধুনিক শিশু রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। যুদ্ধপ্রিয় আরব জাতিকে ঐক্যের বন্ধনে আটকে ফেলেন। সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে অভ্যস্ত করতে প্রয়াসী হন। পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সুদৃঢ় বন্ধন তাদের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করেন। হৃদ্যতার এক আন্তরিক পরিবেশে মদিনাবাসীদের দৈনন্দিন জীবনকে সুরক্ষিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিশেষত নগরবাসীর আবহাওয়া সবুজ, সতেজ, সজীব ও সুকোমল হওয়ায় নাগরিক জীবন তথা মদিনার জনস্বাস্থ্যের প্রতি তিনি যথাযথ গুরুত্বারোপ করেন। মদিনার জনস্বাস্থ্য রক্ষনাবেক্ষণের গুরুত্বারোপ ও বিশ^ জনস্বাস্থ্যের সার্বিক কল্যাণের নানাবিধ ব্যষ্টিক, সামষ্টিক ও সামাজিক কর্মসূচি প্রদান করেন।
প্রথমত আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রাসূল সা.-এর সামষ্টিক কতিপয় কর্মসূচির প্রতি দৃকপাত করতে চাই। সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে প্রথমেই আসে মহামারীর কথা। বিশ^ যখন কোনো মহামারীর প্রকোপে আক্রান্ত হয় তখন জনগণ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এক ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়। সবাই একে অন্যের থেকে দূরে থাকতে চায়। মনে হয় যেন কেউ কারো নয়।
এহেন দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে ইসলামের নির্দেশনা কী? মাত্র কিছুদিন আগেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমরা এ ভাইরাসের মরণ ছোবল দেখেছি। বিশে^ কী পরিমাণ প্রাণহানি হয়েছিল তাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আমরা সবাই ঘরবন্দি হই। কেউ কেউ অন্যের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। এমনকি মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিশ্ব মানবতা মুখ থুবড়ে পড়ে। মৃত্যুর মিছিল দিনকে দিন লম্বা হতে থাকে। সব থেকে বড় বিপর্যয় ছিল- মানবতা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। সন্তান পিতা হতে, পিতা সন্তান হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এক অনৈতিক বিশ্ব আমাদের সামনে হাজির হয়। অথচ এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা ছিল অতীব চমৎকার।
ক. ইসলাম মহামারীকে কখনও অস্বীকার করে না। আবার কোনো অসুস্থতাকে সংক্রামকও বিবেচনা করে না। সুতরাং অসুস্থতা যার হবার তা হয়েই ছাড়বে। পালিয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। আবার গায়ে পড়ে উপদ্রুত এলাকায় যাবারও কোনো প্রয়োজন নেই। যার যার নগর রক্ষায় তারা উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
খ. মহামারী কাউকে অমানবিক করে না। এটিই ইসলামের মূল দর্শন। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য এ সত্যকে কখনও ভোলেনি ইসলাম।
গ. করোনা মহামারীর উৎস ছিল চীনের গ্রোসারি শপ। আর এর মূল প্রতিকার ছিল পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা। যা ইসলামের মৌল চিন্তার অন্তর্ভুক্ত। অতএব সবাই যদি ইসলামের পবিত্রতার নিয়ম কানুন মেনে চলত তবে কোভিড-১৯ এর ইতিহাস হতে পারত অন্যরকম। করোনাকালে আমরা হাত ধোয়ার যে প্রবণতা, ঘনঘন স্যানিটাইজার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করার যে মানসিকতা তৈরির চেষ্টা করেছিলাম বিশ্বব্যাপী। আর তাতে আমরা অনেকখানি সফলও হয়েছিলাম। অথচ অনেক পূর্ব হতেই এর সহজ সমাধান সালাত, অজু, গোসল ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছে ইসলাম।
বিশ্বের অধিকাংশ মহামারী হয়ে থাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব থেকে। কিংবা খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণে। যার পূর্ব প্রস্তুতি ইসলাম অনেক আগেই দিয়েছে। তবে কোনো জনপদে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ঐ জনপদ হতে ইসলাম কাউকে পালাতে বারণ করেছে। সুরা বাকারার ২৪৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে- তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারা সংখ্যায় ছিল হাজার-হাজার। অতপর আল্লাহ তাদেরকে বললেন, তোমরা মরে যাও। এরপর তারা সবাই মারা গিয়েছিল। এর দ্বারা এ ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পালিয়ে মৃত্যু থেকে বাঁচা যায় না। সেদিন যারা তাদের আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে পালিয়েছিল তারা সবাই মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছে। এ আয়াত আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, বিপদ বা মহামারী হতে পলায়ন নয়। বরং ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করা ও মানবিক হওয়াই মনুষ্যত্বের দাবি।
ঘ. স্যানিটেশন ও ইসলাম- স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা জনস্বাস্থ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মল, মূত্র ও বর্জ্য অপসারন প্রতিটি মানুষের জন্যই অপরিহার্য। প্রতিটি মানুষই দিনে অন্তত আট থেকে দশবার মূত্র এবং এক থেকে তিনবার মল ত্যাগ করে থাকে। মল-মূত্র নানান রোগের জীবানু বাহক বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদেরকে জানায়। মল-মূত্র ত্যাগে যদি আমরা সতর্কতা অবলম্বন না করি তাহলে আমাদের মাঝে নানান জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব হবে আবশ্যিকরূপে। এসবের মধ্যে ডায়রিয়া, কলেরা, উদর পীড়া, বদ হজম, চর্মরোগসহ আরো অসংখ্য রোগের ছড়াছড়ি হতে পারে।
তাই সমাজস্থিত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলাম অত্যন্ত কালজয়ী ও সমাজবান্ধব সমাধান প্রয়োগ করেছে। মল-মূত্র অপসারন শেষে তা হতে শরীরকে পরিষ্কার ও পবিত্র না করা অবশ্যই বদ-রুচির পরিচায়ক এবং তা রীতিমতো অসুস্থতার কারণ। এর বাইরেও তা শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি এবং শরীরে রি রি অবস্থা সৃষ্টিকারক। তাই এ বিষয়ে রাসূল সা.-এর দর্শন ছিল প্রত্যেকেই মল-মূত্র অপসারন শেষে নিজে থেকে পবিত্র হবে। ইসলামে এ পবিত্রতা বাধ্যতামূলক। হাদিসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তোমরা পেশাব বা মূত্র হতে দূরে থাক। আরেক হাদিস থেকে বুঝা যায়, পেশাব থেকে পবিত্র না হওয়াটা কবর আজাবের কারণ। মূত্র ত্যাগ শেষে ভালোভাবে পবিত্র না হওয়াকে কবিরা গোনাহ চিহ্নিত করা হয়েছে।
একইভাবে বাড়ির আশেপাশে, রাস্তার ধারে, জনসমাগম হয় এমন স্থানে মলত্যাগ করতে বারণ করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও দূরবর্তী স্থান যেখান হতে রোগ জীবানু কম ছড়াবে এমন স্থানে মল-মূত্র ত্যাগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুযোগ থাকলে মল-মূত্র ত্যাগের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা তথা দেওয়াল দিয়ে ঘিরে বর্জ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। নবী সা. নিজেও এ নীতিমালা মেনে চলতেন। আবু দাউদ শরিফের বর্ণনায় এসেছে, নবী সা. যখন প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের মনস্থ করতেন তখন তিনি খানিকটা দূরে যেতেন। এছাড়াও বিষয়টি লজ্জাশীলতারও অংশ।
রাসূল সা.-এর উক্তি, কর্মপন্থা এসব থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর তাকিদ দিয়েছেন। সমাজকে এর আওতায় নিয়ে আসতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। আজকের দুনিয়ায় আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা মূলত ইসলামের স্যানিটেশন ব্যবস্থারই উত্তরসূরি।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইসলাম মল-মূত্র ত্যাগের প্রাক্কালে রবের কাছে বিশেষ সাহায্য প্রার্থনার জন্যও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কারণ ঐ অবস্থায় শয়তান ও দুষ্ট জিনেরা অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। মানুষকে নানাভাবে কুমন্ত্রনা দিতে তৎপর থাকে। তাই আমরা যখনই বাথরুমে যাই তখনই বলে থাকি, হে আল্লাহ আমি তোমার নিকটে সমুদয় পুরুষ ও নারী দুষ্ট জিন হতে পানাহ চাই।
ইসলাম এভাবেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে বাহ্যিক, প্রায়োগিক ও আধ্যাত্মিক অপবিত্রতা থেকে হেফাজত করতে প্রয়াসী থেকেছে।
ঙ. বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার- পানির অপর নাম জীবন। পানি ব্যতিত জীবের চিন্তা অকল্পনীয়। পানি ছাড়া কোনো জীব বাঁচে না। চতুষ্পদ জন্তু পানি খায়। জীবন বাঁচায়। এতে পানির বিশুদ্ধতার বিষয়টি জড়িত থাকে না। হাঁস-মুরগি, পশু-পাখির ক্ষেত্রেও পানির বিশুদ্ধতার বিষয়টি অপরিহার্য নয়। এক্ষেত্রে মানুষ একেবারেই ব্যতিক্রম। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বরং এটিও সত্য যে, অশুদ্ধ পানি মানুষের মধ্যে রোগ বালাই ছড়ায়। তাই কেউ কেউ বলেন, মানব জীবনের অপর নাম বিশুদ্ধ পানি। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশুদ্ধ পানির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, আর আমরা জলাধার মেঘমালা হতে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি। যাতে তদ্বারা উৎপন্ন করি শস্য ও উম্ভিদ। (সূরা নাবা : ১৪-১৬)
আল্লাহ তায়ালা আসমান হতে যে পানি বর্ষণ করেন তা অবশ্যই বিশুদ্ধ। শস্য ও উদ্ভিদ উদ্গত হয় সেই পানি দিয়ে। আর সেজন্যই মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত পানি হবে তেমনই। অর্থাৎ বিশুদ্ধ।
পৃথিবীতে পানির অন্যতম উৎস ঝর্ণা। যা পাহাড় হতে উৎসারিত হয়। সেই পানিও বিশুদ্ধ। নবী মুহাম্মদ -এর পূর্ব পুরুষ ইবরাহিম (আ) যখন তার পুত্র ইসমাইল ও স্ত্রী হাজেরাকে মক্কায় রেখে চলে আসেন। তখন মা-বেটা পানির সংকটে পড়ে যায়। এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে। শেষত শিশু ইসমাইলের পদাঘাতে একটি কূপের সৃষ্টি হয়। যা আজও বিশুদ্ধ পানির অন্যতম আধার হিসেবে সারা দুনিয়ায় বিবেচিত। আর তা হলো জমজম কূপের পানি। এ সকল পানিই বিশুদ্ধ পানির অন্যতম উৎস ও আধার।
ইসলাম সর্বদা মানুষকে বিশুদ্ধ পানি পানে উৎসাহিত করে। ইসলামে পানির ব্যবহার অনেক বেশি। অজু, গোসল, পবিত্রতা অর্জন, পান করা প্রভৃতি কাজে পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ পরিমাণেই করতে হয়। সকল ক্ষেত্রে ইসলাম বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ এবং দূষিত পানি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে থাকে।
অজুর প্রাক্কালে পানির পরীক্ষণ পদ্ধতি আমাদেরকে সত্যিই বিস্মিত করে। প্রথমেই আমরা হাতে পানি নিয়ে পানি পরখ করি সেটি স্বচ্ছ ও ঝকঝকে কি না? আবার তা মুখে দিয়ে দেখি তা পানযোগ্য কিনা? অনন্তর নাকে পানি দেই। দেখি এতে কোনো দুর্গন্ধ আছে কি না?
আবশ্যিক গোসলের প্রাক্কালেও পানির এমন পরীক্ষণ আমরা প্রত্যক্ষ করি। অজু এবং গোসলের ক্ষেত্রেই যদি পানির এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবশ্যক হয় তাহলে পানি পান করার ক্ষেত্রে এর বিশুদ্ধতার পরীক্ষণ আরো কত বেশি আবশ্যক হবার কথা। ইসলাম সর্বদাই মানুষ ও মানুষকে অনেক বেশি মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় আর কোনো ধর্ম এত সিরিয়াস হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
তবে দুনিয়াতে বিশুদ্ধ পানির পরিমাণ খুব বেশি হবে না বলেই নবী সা. পানির অপচয় হতে উম্মতকে সতর্ক করেছেন।
চ. পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামের অনন্য নির্দেশনা- প্রতিটি প্রাণিকেই শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ ও বর্জন করতে হয়। মানুষও এ নিয়মের অধীন। মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে। আর কার্বন ডাই অক্সাইড বর্জন করে। একইভাবে বৃক্ষ অক্সিজেন বর্জন করে। আর কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ ও বর্জনে মানুষ ও বৃক্ষ একে অপরের বিপরীতমুখী। তাই মানুষের সজীব, সতেজ নিঃশ্বাস নেবার জন্য বৃক্ষের প্রতুলতা কাম্য। অন্যথায় সমাজে সজীব নিঃশ্বাসের আকাল হবে। বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে মানুষ নানাভাবে রোগগ্রস্ত হবে। যা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মারাত্মক হুমকির কারণ হবে। তাই পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ও শিল্পায়নের এই যুগে যদি বেশি বেশি গাছ লাগানো না হয় তবে পৃথিবী মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে নিশ্চিতভাবেই।
অতি আশ্চর্যের বিষয় হলো ইসলাম অনেক পূর্ব হতেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছে। নবী সা. এরশাদ করেন, তুমি যদি দেখো কেয়ামত সমাসন্ন, সকল আলামত ও নির্দেশনায় কেয়ামতের আর কোনো দেরি নেই। এমতাবস্থায়ও যদি তোমার হাতে কোনো গাছের চারা থাকে তবুও তা লাগিয়ে দাও।
অত্র হাদিসে বৃক্ষরোপন ও পরিচর্যার যে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সত্যিই তা অনন্য।
ছ. খাদ্য সুরক্ষা- জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, খাদ্য সুরক্ষা। কারণ মানুষের অধিকাংশ রোগ হয়ে থাকে খাদ্যবাহিত ও পানিবাহিত।
আমরা আলোচনাকে লম্বা করব না। এতটুকু বলতে চাই, খাদ্য গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপারে রাসূল সা. ছিলেন অতীব সূক্ষ্মদর্শী। এ বিষয়ে তার কর্মপন্থা ও নির্দেশনা ছিল মানবকল্যাণের বার্তাবাহী। তিনি অতি ভোজনের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বলেছেন, মুমিন খায় এক পেটে। আর কাফির খায় সাত পেটে।
তিনি কখনই পেট ভর্তি বা তারও বেশি করে খেতেন না। কারণ অতি ভোজন রোগের নিয়ামক। তিনি সর্বদাই পেটের কিছু অংশ ফাঁকা রেখে খাবার সম্পন্ন করতেন।
খাবার গ্রহণে তিনি কখনই হাউ-মাউ ও কাড়াকাড়ি করে খেতেন না। কারণ এটি শিষ্টাচার বিরোধী ও উন্নত রুচির পরিপন্থি। সকল খাদ্য উপাদানের পরিমিত খাবার খেতে চেষ্টা করতেন। বেশির ভাগ সময় সবজি খেতেন। এটি কেবলই অর্থাভাবে নয়। বরং স্বাস্থ্যেরও প্রয়োজনে।
জ. চিকিৎসায় প্রাকৃতিক পথ্য ব্যবহার- তিনি মেশিনে প্রস্তুতকৃত, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৈরিকৃত পথ্য ব্যবহার না করে রোগ সারাতে প্রাকৃতিক পথ্য ব্যবহার করতেন। কারণ তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। তিনি সবজি, ফলাদি, ভেষজ চিকিৎসায় সুস্থ থাকার পক্ষপাতি ছিলেন।
একটি গল্পের অবতারনা করেই আমরা প্রবন্ধের যবনিকা টানব। একবার পারস্য সম্রাট নবী মুহাম্মদ সা.কে একজন ডাক্তার উপহার হিসেবে পাঠান। ডাক্তার মহানবীর সাথে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি অবগত করেন। বসার জন্য একটি স্থান আবদার করেন। নবীজি তার জন্য সকল ব্যবস্থা করেন। ডাক্তার চেম্বার করেন একমাস।
একমাস পর তিনি নবীর কাছে আসেন। বিদায়ের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। আর বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করেন, গত এক মাসে একজন রোগীও আমার ভাগ্যে জোটেনি।
নবীজি তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। ডাক্তার নবী সমীপে আরজ করেন, দয়া করে আপনি আমাকে বলুন, দীর্ঘ ৩০ দিনে আমি একটি রোগীও পাইনি। এর কারণ কী? নবী সা.-এর বিনীত ও আস্থাপূর্ণ জবাব ছিল, আমার সাহাবীরা ক্ষুধার্ত না হলে খায় না। আর খেতে বসে কখনই পেট পুরে খায় না।
রাসূল সা.-এর এ উক্তি হতেই আমরা তার জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় উচ্চ দর্শনের অনুমান করতে পারি।
জনস্বাস্থ্যের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অল্প কয়েকটি দিক আমরা অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। আমরা রাসূলের জীবনী ও হাদিস পাঠে নিশ্চিত হয়েছি, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তার দর্শন ছিল উচ্চমাত্রার। আমরা যা উল্লেখ করেছি আর যা উল্লেখ করিনি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার সকল স্তরেই তার দর্শন ও অবদান ছিল সক্রিয় ও সমাজ বান্ধব।
আমরা যদি রাসূল সা.-এর জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক সকল নীতিমালা অনুসরন করি তবে নিশ্চিত আমাদের পৃথিবীতে জনস্বাস্থ্যের কোনো সংকট থাকবে না। আল্লাহ আমাদের রাসূল সা.-এর জনস্বাস্থ্য দর্শনকে যথাযথ উপলব্ধি করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন