post

রাসূলুল্লাহ সা. এর ব্যবহারিক জীবন

ছাত্রসংবাদ ডেস্ক

১৮ অক্টোবর ২০২২

[ ২০২২ সালে প্রকাশিত

৩ পাতা ক্যালেন্ডার ডেস্ক ]

[ ১ম পর্ব ]

রাহমাতুল-লিল আলামিন

পথহারা মানুষের পথের দিশা দিতে যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। কিন্তু তাঁদের তিরোধানের পর মানবজাতি আবারও বিভ্রান্তির স্রােতে গা ভাসিয়ে পাপের গহিন সাগরে ডুব দিয়েছে। এভাবে নবীহীন এ প্রান্তরে দীর্ঘ যাত্রা শেষে মানুষ প্রবেশ করে এক ঘোর অন্ধকার যুগে। যেখানে ছিল না কোনো সুবিচার, ছিল না কোনো সত্যের আলোকচ্ছটা। গোটা আরব সমাজ তখন জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত। ডুকরে কাঁদছে মানবতা। পাপাচার-অনাচার, অন্যায়-অত্যাচার, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, ব্যভিচার-আত্মসাৎ ইত্যাদিতে ছেয়ে গেছে গোটা সমাজ। নিষ্পেষণ-নিপীড়নই যেন সমাজের ভূষণ। মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতায় ডুবে মানুষ ভুলে গেছে তার প্রকৃত মালিককে। এমনই যখন অবস্থা, তখন ঘোর অমানিশায় মুক্তির আলোকবর্তিকা নিয়ে মরুর বুকে সুবহে সাদিক হয়ে আগমন করলেন বিশ্বনবী সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদ। তাঁর আগমনী বার্তা ধরার বুকে এক নতুন ভোরের ঘোষণা দিল। ভূলোকে ছড়িয়ে দিল নবচেতনার ইশতিহার।

জন্ম ও শৈশব

১২ রবিউল আওয়াল, সোমবার। সুবহি সাদিকের সন্ধিক্ষণে নতুন সূর্যের বারতা নিয়ে মা আমিনার কোলজুড়ে এলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, বিশ^নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। ষষ্ঠ শতাব্দীর ক্যালেন্ডারে তখন চলছে ৫৭০ কিংবা ৫৭১ সন। 

নবীজির জন্মের দু’মাস পূর্বেই বাবা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছিলেন। তাই অভিভাবকত্বের ভার এখন পিতামহের উপর। দাদা আবদুল মুত্তালিব এতিম নাতির নাম রাখলেন ‘মুহাম্মাদ’ আর মা আমিনা নাম দিলেন ‘আহমাদ’। এরপর আরব রীতি অনুযায়ী শিশু নবীকে দুধ পানের জন্য প্রেরণ করা হলো আবু লাহাবের দাসী ‘সুয়াইবা’ এবং পরে বনু সা’দ গোত্রের হালিমার ঘরে। শিশু মুহাম্মাদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মা হালিমার বেদুঈন জীবনে বারাকার ঢেউ বয়ে গেল। তাঁর সংসারে সবকিছুই যেন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আসতে থাকল। এখানেই নবীজি কাটিয়ে দিলেন শৈশবের ছয়টি বছর। আয়ত্ত করলেন কষ্টসহিষ্ণুতা, নেতৃত্বের হাতেখড়ি ও বিশুদ্ধ আরবি ভাষা।

বক্ষবিদারণ 

নবীজির বয়স চার বছরে উপনীত হলে এক দুপুরে ফেরেশতা জিবরাইল (আ) এসে রাসূলুল্লাহ সা.-এর বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। নবীজি তখন দুধভাইদের সাথে মাঠে ছাগল চরাচ্ছিলেন। ঘটনায় ভয় পেয়ে তাঁর সঙ্গীরা বাড়িতে ছুটে গিয়ে হালিমাকে সব জানাল। হালিমা যতক্ষণে ঘটনাস্থলে হাজির হলেন, ততক্ষণে ফেরেশতারা নবীজির কলব পরিষ্কার করে চলে গেছেন। মা হালিমা এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে নবীজিকে আমিনার কোলে ফেরত পাঠালেন।

মায়ের মৃত্যু

শিশু মুহাম্মাদের বয়স যখন ছয় বছর, তখন মা আমেনা ছেলেকে নিয়ে মদিনায় গেলেন পরলোকগত স্বামীর কবর জিয়ারতে। ফেরার পথে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি এবং সেখানেই পরলোকগমন করলেন। 

দাদা ও চাচার তত্ত্বাবধানে নবীজি

মা হারানোর পরবর্তী দুই বছর নবীজি দাদার স্নেহছায়ায় লালিত-পালিত হলেন। একদিন দাদা আবদুল মুত্তালিবও পাড়ি জমালেন ওপারে। এরপর রাসূলুল্লাহ বেড়ে উঠতে থাকলেন চাচা আবু তালেবের অভিভাবকত্বে। ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে ব্যবসায়িক সফরে সিরিয়া গমন করলে সেখানে ‘বুহাইরা’ পাদ্রির সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটল। পাদ্রি বালক মুহাম্মাদকে ভবিষ্যৎ রাসূল হিসেবে চিহ্নিত করলেন এবং তাঁকে সিরিয়ায় না নিয়ে মক্কায় ফেরত পাঠাতে অনুরোধ জানালেন। ফলে আবু তালেব ব্যবসা ও সফর সংক্ষেপ করে দ্রুত মক্কায় ফিরে এলেন। 

যুদ্ধের বিভীষিকা ও শান্তিসংঘ গঠন

মাত্র ১৫ বছর বয়সে নবী কুরাইশ ও বনু কাইস গোত্রের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের ভয়াবহতা নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করলেন। ‘ফিজারের’ যুদ্ধ নামে খ্যাত সেই যুদ্ধে বালক মুহাম্মাদও গোত্রের পক্ষে অংশগ্রহণ করে তীর কুড়িয়ে দিলেন। গোত্রীয় রেওয়াজে যুদ্ধে অংশ নিলেও শত্রুপক্ষকে কোনো আঘাত করলেন না তিনি। 

এই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর কিশোর মনে গভীর আঁচর কেটে দিল। তিনি ভাবতে থাকলেন এর থেকে উত্তরণের পথ কী! অতঃপর চাচা যুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সাথে যুগপৎ হয়ে কুরাইশ বংশের আরো বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব ও যুবককে একত্রিত করলেন এবং অন্যায় জুলুমের অবসান ও নির্যাতিতকে সহায়তার লক্ষ্যে গঠন করলেন ‘হিল-ফুল-ফুজুল’ নামক একটি সামাজিক সংগঠন।

মানবিক মূল্যবোধকে সম্মান, গৃহবিবাদের অবসান, মুসাফির-পথিকের জান-মালের নিরাপত্তা, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিল এই সংঘের মূল উদ্দেশ্য। এই সমস্ত কর্মতৎপরতার মাধ্যমে কিশোর বয়সেই নবীজি আর্ত-মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। 

আত্মনির্ভরশীলতা ও বিয়ে

তরুণ বয়স থেকেই রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। শৈশবে ছাগল চারণ এবং পরবর্তীতে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে স্বীয় যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দক্ষতার সাথে সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও আমানতদারিতার অতুলনীয় সংমিশ্রণ ঘটায় অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি সকলের অন্তরে জায়গা করে নিলেন। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। যুবক মুহাম্মাদ-এর সাফল্যগাথা শুনে মক্কার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী রমণী খাদিজাতুল কুবরা রা. তাঁর উপর ন্যস্ত করলেন নিজ ব্যবসা পরিচালনার ভার।

কিছুকাল অন্তে নবীজির ধারাবাহিক সফলতা, আমানতদারিতা ও চারিত্রিক মাধুর্যতায় মুগ্ধ হয়ে খাদিজা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সমীপে বিয়ের প্রস্তাব প্রেরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর বয়স তখন ২৫, আর খাদিজার রা.-এর ৪০ বছর। 

অবশেষে এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় চাচা আবু তালেবের নেতৃত্বে সুসম্পন্ন হলো খাদিজার সাথে নবীজির শুভবিবাহ। পরবর্তী সময়ে ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে মা খাদিজার রা.-এর গর্ভে রাসূলুল্লাহ এর দুই ছেলে (আবদুল্লাহ ও কাসেম) ও চার মেয়ে (যয়নব, রুকাইয়্যা, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা রা.) জন্মগ্রহণ করেন। 

আল আমিন

জাহেলিয়াতে পূর্ণ যে আরব সমাজে অন্যের অধিকার হরণকে মনে করা হতো চতুরতা এবং আত্মসাৎই ছিল যেখানকার রীতি, নবীজি সা. সেই সমাজেই হয়ে উঠেছিলেন আমানতদারিতার প্রতিচ্ছবি! সততার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততায় সকলেই ছিল মুগ্ধ! ফলে লোকজন তাঁর কাছে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র আমানত রাখত এবং তাঁকে ডাকত ‘আল আমিন’ বা বিশ্বস্ত বলে!

সামাজিক সঙ্কট নিরসন

বিশ^নবী সা.-এর বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর, তখন কাবাঘর পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু হলো। সংস্কার শেষে পবিত্র পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’ বসানো নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের মাঝে এমন বিতর্কের উদ্ভব ঘটল, যা প্রায় যুদ্ধাংদেহি অবস্থার অবতারণা করল! পরিশেষে আবু উমাইয়া মাখজুমির পরামর্শে সকলেই উদ্ভূত সঙ্কট নিরসনে ‘আল আমিন’কে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নিলো। রাসূলুল্লাহ সা. সামগ্রিক পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে এমন এক বুদ্ধিদ্বীপ্ত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিলেন, যা রক্তারক্তির পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে ধাবিত করল। ফলে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আমেজে সুন্দরভাবে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের কাজ সমাপ্ত হলো। 

অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

পৌত্তলিকতার স্বর্গভূমিতে বসবাস করেও রাসূল কখনো হস্ত নির্মিত কাল্পনিক খোদার প্রতি আগ্রহ বোধ করেননি। অনর্থক গল্প-আড্ডায় সময় নষ্ট করা কিংবা ভোগ বিলাসের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানোর লোকও তিনি ছিলেন না। ফলে জাহেলি যুগের অতি সাধারণ অনুষঙ্গ নারী-মদ-জুয়া কিংবা অন্য কোনো পঙ্কিলতা তাঁকে সামান্যতম স্পর্শও করতে পারেনি।

মার্জিত স্বভাব, উন্নত বিবেক-বুদ্ধি, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, পরিচ্ছন্ন জীবন-যাপন ও দূরদর্শিতা তাঁকে সকলের থেকে আলাদা করে রেখেছিল। তিনি ছিলেন সর্বাধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, পরিচ্ছন্ন মন ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। ছিলেন উত্তম প্রতিবেশী, এতিম-গরিব ও বিপদগ্রস্তদের সহায়ক। অসহায়দের প্রতি কোমলপ্রাণ এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর। কল্যাণমূলক কাজ ও অঙ্গীকার পালনে ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী এবং আমানতদারিতায় অতুলনীয়। দায়িত্ববান স্বামী, স্নেহবৎসল পিতা, অন্তরঙ্গ বন্ধু ও ক্যারিশম্যাটিক লিডার হিসেবে তাঁর উপমা ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই।

মুক্তির চিন্তায় মশগুল

গোটা সমাজ যখন অন্যায়-অনাচারে বিপর্যস্ত, তখন রাসূল সা. একলা বাঁচো নীতি অবলম্বন করে ঘরে বসে থাকেননি। বরং কী করে এই অনাচারের বিষপাষ্প থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়, সেই চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। জীবন-জীবিকা, আর্থসামাজিক দায়িত্ব পালনের ফাঁকে যখনই সুযোগ পেতেন লোকালয় ত্যাগ করে হেরাগুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হতেন। চিন্তার গভীরতায় খুঁজে ফিরতেন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে মানবতার মুক্তির পথ। ৩৩ বছর বয়স থেকে হেরাগুহাকেই নিজের কর্মস্থল বানিয়ে ফেললেন। এভাবেই কেটে গেল সাতটি বছর। অবশেষে এলো সেই মহাসন্ধিক্ষণ, অজ্ঞতার অমানিশা দূরে ঠেলে নাজিল হলো মানবতার মুক্তির দিশারি আল কুরআন!

হেরার আলোয় আলোকিত ধরা

পবিত্র রমজানের এক বেজোড় রাতে হেদায়েতের রশ্মি নিয়ে হেরাগুহায় আগমন করলেন জিবরাঈল (আ)। নবীজিকে বললেন- ‘ইকরা’ (পড়ো)। অতঃপর কিছু আলাপের পর একে একে নাজিল হলো সূরা আলাকের প্রথম পাাঁচটি আয়াত। এর মধ্য দিয়ে সূচিত হলো এক নতুন যুগের যাত্রা। ঘোষিত হলো এক অনিবার্য বিপ্লবের ইশতিহার। চল্লিশ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.।

রহমাতুল-লিল আলামিন

রাসূলুল্লাহ সা.-এর নবুয়ত লাভের মধ্য দিয়ে সর্বত্র এক পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে গেল। ভূলুণ্ঠিত মানবতা খুঁজে পেল মুক্তির দিশা। অধিকার ফিরে পেল নির্যাতিত-নিষ্পেষিত জনগণ। পণ্যে পরিণত হওয়া নারী ভূষিত হলো তাঁর প্রাপ্য সম্মানে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অশ্লীলতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত হয়ে অন্ধকার আরব ভূখণ্ড হয়ে উঠল আলোর ফোয়ারা। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভ্যতার সূতিকাগার! এখান থেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল হেরার রাজতোরণ। প্রমাণিত হলো রাসূলুল্লাহ সা. গোটা আর্তমানবতার জন্য বিশেষ রহমত। যার যথার্থ প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছে পবিত্র কুরআনে- ‘আর তোমাকে পৃথিবীবাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)


[ ২য় পর্ব ]

রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনাচার

জীবনাচার মানুষের ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমেই জানা যায় ব্যক্তির প্রকৃত আদর্শ কী। রাসূল সা.-এর জীবনাচার ছিল ইসলামী আদর্শের ধারক এবং কুরআনের জীবন্ত প্রতিফলন। তিনি ছিলেন কথা ও কাজে অভিন্ন। ছিলেন অনাড়ম্বর ও পরিচ্ছন্ন জীবনে অভ্যস্ত। তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও পোশাক পরিচ্ছদ ছিল মার্জিত। বক্তৃতা, উপস্থাপন পদ্ধতি, নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা, সুভাষণ ও সম্ভাষণে ছিলেন অত্যন্ত অভিজাত ও স্মার্ট। চুল-দাড়ি-নখ-দাঁতসহ শরীরের যতেœ এবং সুগন্ধি ব্যবহারে ছিলেন খুবই শৌখিন।

নিয়মানুবর্তিতায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়বে ছিলেন অতুলনীয় এবং বন্ধুবৎসল আচরণে সবার প্রিয়। এই জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা দিয়েছেন : তোমাদের জন্য রাসূলের (জীবনাচারের) মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব : ২১)

অনাড়ম্বর জীবন

রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে। দুনিয়ার জীবনকে তিনি মনে করতেন মুসাফিরখানা। এই কারণে পছন্দ করতেন মুসাফির কিংবা নিঃস্বের মতো জীবনযাপন করতে। (মুসলিম-১৪৭৯) তিনি সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন এবং খেজুর পাতার চাটাইয়ে বিশ্রাম নিতেন। একদিন তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে উমর রা. কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘রোম ও ইরানের সম্রাটরা ভোগবিলাসে মত্ত, আর আপনার এই অবস্থা!’ রাসূল জবাব দিয়েছিলেন, ‘উমর! তুমি কি এতে খুশি নও যে, তারা দুনিয়া নিয়ে থাকুক আর আমরা আখিরাত লাভ করি?’ 

নববি বৈশিষ্ট্যানুযায়ী দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের জিন্দেগিকেই তিনি প্রাধান্য দিতেন। এ কারণে দুনিয়াবি চাকচিক্যকে কখনো গ্রহণ করতেন না। এই অনাড়ম্বতা দারিদ্র্যের কারণে নয়; বরং তার তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণেই ছিল। ফলে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে দামি উপঢৌকন আসলে তিনি নিজের জন্য গ্রহণ না করে তা সাহাবাদের রা. মাঝে বিলিয়ে দিতেন।

আত্মনির্ভরশীলতা

মহানবী সা. নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন। জামা-কাপড় ধোয়া, পাদুকা সেলাই ও বকরির দুধ দোহন করার মতো সাংসারিক কাজের পাশাপাশি স্ত্রীদের রান্নার কাজেও যথাসাধ্য সহযোগিতা করতেন। তিনি কখনো অন্যের দান-সদকার মুখাপেক্ষী ছিলেন না। নিজের ঘাম ঝরানো উপার্জনে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। বকরি পালন থেকে শুরু করে ব্যবসা পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন হালাল উপার্জনের তাগিদে। এ ক্ষেত্রে কোনো অহেতুক লজ্জাবোধে তিনি ভুগতেন না।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছিল নবীজির ভূষণ। এমনকি পরিচ্ছন্নতাকে তিনি ঈমানের অঙ্গ বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। (মুসলিম-২২৩)

প্রতিটি সকাল তাঁর শুরু হতো মেসওয়াক ও অজুর মাধ্যমে এবং দিনের পরিসমাপ্তি ঘটত মেসওয়াক শেষে ইশার সালাত আদায়ের মাধ্যমে।

তিনি দিনে পাঁচবার মিসওয়াক করতেন এবং মুখে দুর্গন্ধ হয়, এমন খাবার খাওয়াকে অপছন্দ করতেন। নবীজি নিয়মিত গোসল করতেন এবং প্রতি সপ্তাহান্তে নখ-গোঁফ কাটতেন। নিয়মিত দাড়ি আঁচড়াতেন এবং চুলে তেল দিয়ে সুন্দর করে সিঁথি কেটে চুলের যত্ন নিতেন। পরিষ্কার কাপড় পরিধানের পর সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং সবসময় সুন্দর-পরিপাটি অবস্থায় থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন- ‘আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’ (মুসলিম : ১৬৭)

লেনদেন

ওয়াদা পালন, আমানতদারিতা ও লেনদেনে স্বচ্ছতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন খুবই সতর্ক ও তৎপর। এ জন্য তিনি লেনদেনের আগে সমস্ত শর্ত বর্ণনাপূর্বক চুক্তি লিপিবদ্ধ করতেন। এই স্বচ্ছতার স্বীকৃতিস্বরূপ জাহেলি যুগেই নবীজি অর্জন করেছিলেন ‘আল আমিন’ উপাধি। পরবর্তী যুগেও লেনদেন, আমানত রক্ষা ও রাষ্ট্রীয় সন্ধি-চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ। 

মদিনায় হিজরতের পূর্ব মুহূর্তে যখন তিনি রক্তপিপাসু কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ, তখনও নিজের কাছে গচ্ছিত মক্কাবাসীর আমানতের কথা ভুলে যাননি; বরং আলী রা.-এর হাতে দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন আমানতদারদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। 

লজ্জাশীলতা

রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন পর্দানশিন মেয়ের চেয়েও অধিক লজ্জাশীল। কোনো বিষয় অপছন্দ হলে তাঁর চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে যেত। নবী সা.-এর লজ্জাশীলতার বিষয়টি তাঁর কয়েকটি হাদিস থেকেও বুঝা যায়। তিনি বলেন : ‘প্রতিটি ধর্মের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। ইসলামের বিশেষ স্বভাব হলো লজ্জা।’ (ইবনে মাজাহ : ৪১৮১) ‘লজ্জা ও অল্প কথা বলা ঈমানের দুটি শাখা।’ (মিশকাত-৪৭৯৬) 

নিরহঙ্কার

রাসূল সা. ছিলেন অতি বিনয়ী ও নিরহঙ্কার। অহঙ্কারের কালিমা কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়াকে তিনি অপছন্দ করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও গরিব-মিসকিন ও অসহায়দের সাথে স্বাভাবিক নিয়মে ওঠা-বসা করতেন। ক্রীতদাসদের নিমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করতেন। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষদের সহজেই সান্নিধ্য দিতেন।

মধ্যমপন্থা অবলম্বন

রাসূলুল্লাহ সা. সকল কাজে মধ্যম ও সহজ পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করতেন। সব ধরনের প্রান্তিকতা ও সংকীর্ণতা থেকে নিজে দূরে থাকতেন ও বাকিদের দূরে থাকতে বলতেন। তিনি নিঃসঙ্কোচে ভালো জিনিসের প্রশংসা এবং খারাপ জিনিসের সমালোচনা করতেন।

সত্যনিষ্ঠতা

নবী  সা. সত্যের সাক্ষ্য প্রদানে ছিলেন আপসহীন। সত্য গ্রহণ, সত্য প্রচার ও সত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর চেয়ে অগ্রগামী আর কেউ ছিল না। তিনি অসত্যের বিরুদ্ধে ছিলেন বজ্রকঠিন। রাসূলুল্লাহ সা. কোনো কথা বললে তা নিশ্চিতভাবে সত্য এবং তার ফলাফল অবশ্যম্ভাবী বলে সবাই ধরে নিত। যেমন : প্রথমবারের মতো ঈমানের ঘোষণা দেওয়ার জন্য নবী সা. যখন সাফা পাহাড়ে উঠে জনসাধারণকে বললেন- ‘আমি যদি বলি, একটি শত্রুদল এই পাহাড়ের ওপার থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করবে। তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?’ সকলে বলল, ‘অবশ্যই! কারণ আপনাকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখিনি।’ একবার সাদ রা. মুশরিক নেতা উমাইয়াকে বললেন, ‘রাসূল সা. তোমায় যুদ্ধের ময়দানে হত্যা করবেন।’ সে আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘আমাকে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ যখন কিছু বলেন, তা মিথ্যা হয় না।’ (বুখারি-৩৬৩২)

প্রফুল্ল মনোভাব

রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল। এক ফালি মুচকি হাসি সর্বদা তার ঠোঁটে লেগেই থাকত। তাঁর চেহারার প্রফুল্লতা এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, মন খারাপ অবস্থায় কেউ তাঁর দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যেত। নবীজি নিজের হাস্যোজ্জ্বল মনোভাব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ঘোষণা দেন-‘অপর মুসলিম ভাইয়ের দিকে হাসিমুখে তাকানোও এক প্রকার সদকা।’

রাসূল সা. বিভিন্ন বয়সী মানুষদের সাথে মনন বুঝে মাঝে-মধ্যে মার্জিত রসিকতাও করতেন। যেমনটি সাহাবি আনাস ইবনে মালিক রা. বলেছেন, ‘নবী করিম সা. কখনো কখনো আমাকে ‘দুই কানওয়ালা’ বলে ডাকতেন।’ (শামায়েলে তিরমিজি-২৩৬)

একবার জনৈক ব্যক্তি নবী সা.-এর কাছে বাহনের জন্য একটা জন্তু চাইল। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দিচ্ছি।’ লোকটি বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করব?’ রাসূলুল্লাহ সা. এবার বললেন, ‘উটগুলো কি উটনীর বাচ্চা নয়?’ (আবু দাউদ-৪৯৯৮)

রাসূল সা.-এর কাছে এক বৃদ্ধা এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমায় জান্নাত দান করেন।’ জবাবে রাসূল সা. রসিকতা করে বললেন, ‘হে অমুকের মা! কোনো বৃদ্ধা তো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ এই কথা শুনে বৃদ্ধা কান্না শুরু করে বাড়ির পথ ধরলেন। এবার রাসূল সা. সাহাবাদের বললেন, ‘তাকে গিয়ে বলো- (বৃদ্ধাবস্থায় নয়) বরং যুবতী ও চিরকুমারী হয়ে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (শামায়েলে তিরমিজি-২৪১)

সম্ভাষণ

রাসূলুল্লাহ সা. বড়ো-ছোটো সবাইকে আগে সালাম দিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানাতেন। মেহমানদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানানো, কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, খবরাখবর নিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিদায়বেলায় তিনি মেহমানকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে আসতেন।

কথা বলার ধরন

রাসূল সা. ছিলেন স্পষ্টভাষী। তাঁর ভাষাশৈলী ছিল উচ্চমানের। তিনি নিজেই এর স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, ‘আমি আরবি ভাষাভাষীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ উচ্চারণের লোক।’ 

কারও সাথে কথা বলার সময় তিনি ব্যক্তির মুখের দিকে ফিরে কথা বলতেন। কথার মাধ্যমে কাউকে হেয় কিংবা ছোটো করা থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। জিহ্বার ব্যবহার সম্পর্কে তিনি এতই সচেতন ছিলেন যে, তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যে ব্যক্তি তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো।’ (বুখারি-৬৪৭৪) অযথা ও অসার বাক্যব্যয় কিংবা বাহুল্য প্রদর্শন থেকে তিনি দূরে থাকতেন।

বাগাড়ম্বতা

কম কথায় বেশি বার্তা পৌঁছানো, সুন্দর-সাবলীল, যৌক্তিক ও স্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য দেওয়ায় নবীজির সমকক্ষ কেউ ছিল না। দীর্ঘ ও বিরক্তিকর বক্তৃতা না দিয়ে তিনি সংক্ষেপে বেশি বার্তা দিতেন। কথা বলার সময় শ্রোতাদের মন-মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। মদিনার লোকেরা সারাদিন কর্মব্যস্ত থেকে রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তাই তিনি এশার পর উপদেশ দান কিংবা বক্তৃতা প্রদান থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন।

উপদেশ দান

উপদেশদানের ক্ষেত্রে রাসূল সা. ঠিক তা-ই বলতেন, যা নিজে করতেন। নিজে না করে অন্যকে কখনো তিনি উপদেশ দিতেন না। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা নিজেরা কর না’। (সূরা আসসফ : ২)

উপদেশদানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তির মানসিক ও সার্বিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। সাধ্যানুযায়ী মানার উপদেশ দিতেন। সকল প্রকার বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থাকতেন।

চলনভঙ্গি

রাসূলুল্লাহ সা.-এর চলনভঙ্গি না ছিল দ্রুত, না ছিল মন্থর; বরং এই দুয়ের মাঝামাঝি গতিতে কিন্তু দৃঢ়পদে হাঁটতেন তিনি। পথ চলার সময় সামনের দিকে এমনভাবে ঝুঁকে হাঁটতেন, মনে হতো যেন তিনি কোনো উঁচু স্থান থেকে নিচে অবতরণ করছেন। রবের নিষেধাজ্ঞা মেনে নম্রভাবে চলতেন এবং জমিনে গর্বভরে হাঁটা থেকে বিরত থাকতেন। হাঁটার সময় চোখ নিচু রাখতেন এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলতেন।

ভ্রমণপদ্ধতি

নবী সা. একাকী ভ্রমণ করা অপছন্দ করতেন। দূরবর্তী কোথাও গেলে রাতে সফর করাকে উৎসাহিত করতেন। তবে সফর শেষে রাতে বাড়ি ফেরাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কোথাও সফরে বের হলে একজনকে প্রধান করতেন এবং সবাইকে পরামর্শ দিতেন নেতার আনুগত্য করার। সফরে থাকাকালীন সময়ে দোয়া কবুল হয়, তাই এ সময় তিনি বেশি বেশি দোয়া করতেন ও অন্যদের উৎসাহ জোগাতেন।

খাদ্যাভ্যাস

রাসূলুল্লাহ সা. উদরপূর্তি করে খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করতেন। খাওয়ার পরিমাণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 

‘মানুষের পেটের চেয়ে খারাপ পাত্র আর নেই। আদম সন্তানের কোমর সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমাই তো যথেষ্ট। সে যদি তাতে তুষ্ট না হতে পারে, তাহলে (পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে নেবে) এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং অপর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঠিক করে নেবে।’ (সহিহ বুখারি)  

বর্তমান আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও একই পরামর্শ দেয়। রাসূল সা. খেতে বসে খাবারের সমালোচনা করা, খাদ্যের দোষত্রুটি সন্ধান করাকে পছন্দ করতেন না। পছন্দ হলে খেতেন, না হলে রেখে দিতেন। খাবারের আগে ও পরে দোয়া পড়তেন। তাঁর রুচিবোধ ছিল অত্যন্ত মার্জিত। তিনি গোশতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। তাঁর প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম ছিল- মধু, সিরকা, মাখন, কালোজিরা ও লাউ। দুধের সাথে খেজুর খেতেও তিনি ভালোবাসতেন। পানীয় দ্রব্যের মধ্যে প্রিয় ছিল সুপেয় পানি। 

তিনি পৃথক পৃথকভাবে খাওয়া পছন্দ করতেন না, বরং একত্রে বসে খাওয়ার উপদেশ দিতেন। খাওয়ার সময় দস্তরখানা ব্যবহার করতেন। ডান হাত দিয়ে নিজের দিক থেকে খাবার তুলে নিতেন, পাত্রের মাঝখানে হাত দিতেন না। 

বিশ্রাম 

রাসূল সা. রাতের প্রথমার্ধে ঘুমিয়ে পড়তেন। শোয়ার জন্য বিছানায় এসে দু’হাত মিলিয়ে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করতেন। তারপর ফুঁ দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীরে তিনবার হাত বুলিয়ে দিতেন। মুখমণ্ডল ও শরীরের সামনের অংশেও অনুরূপ বুলাতেন। অতঃপর ডান কাত হয়ে শুয়ে পড়তেন। ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে উঠার পরে দোয়া পড়তেন। মাঝে মধ্যে দিনের মধ্যভাগে বা মধ্যাহ্নে কিছু সময়ও বিশ্রামের জন্য রাখতেন। 

গভীর রাত পর্যন্ত অনর্থক জেগে থাকাকে রাসূল সা. নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় ও কুরআন তিলাওয়াত করতেন।


[ ৩য় পর্ব ]

অনুপম চরিত্রের আধার রাসূল সা. 

রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন অনুপম চরিত্রের আধার। তাঁর চরিত্রের দ্যুতিতে আলোকিত হতো বন্ধু-শত্রু সকলই। হত্যার উদ্দেশ্যে আগত ব্যক্তিও তাঁর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে পান করেছিল ঈমানের পেয়ালা। তাঁর চারিত্রিক নিষ্কলুষতার আকর্ষণে আমীর বরণ করেছিল ফকিরের বেশ। হিং¯্র জাতি হয়েছিল উত্তম আদর্শের ঝাণ্ডাধারী। তাঁর চরিত্রের সুধা গ্রহণের জন্য ভ্রমরের মত চারপাশে জমা হতেন অসংখ্য সাহাবি। অন্ধকার জাহেলিয়াত দূরীভূত হয়েছিল তাঁর চরিত্রের পবিত্র আলোয়। তাঁর চরিত্রের আলোকরশ্মি বুকে ধারণ করে সত্যের তরে জীবন বিলাতে শিখেছে অসংখ্য তরুণ-যুবা-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। তাঁর অনুপম চরিত্রের সাক্ষ্য দেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন- 

‘নিশ্চয়ই আপনি সচ্চরিত্রের মহান আদর্শের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।’ (সূরা কালাম : ৪)

সঙ্গীদের প্রতি ভালোবাসা

রাসূল সা. তাঁর আন্দোলনের সাথীদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন এবং পরম মমতায় আগলে রাখতেন। তাঁদের কষ্টে বুক ভেজাতেন, দুর্দিনে পাশে থেকে ব্যথার অংশীদার হতেন। কোনো উপঢৌকন এলে তিনি সঙ্গীদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন, কেউ দাওয়াত দিলে সঙ্গীদের নিয়েই আতিথ্য গ্রহণ করতেন এবং খাবার ভাগাভাগি করে খেতেন। মুমিনগণ নিজেদের যতটুকু ভালোবাসেন, নবীজি তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁদের ভালোবাসেন। (সূরা আহযাব : ৬) তিনি বলতেন, 

‘নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়ে অধিক ঘনিষ্ঠ। সুতরাং মুমিন কোনো ধন-সম্পদ রেখে মারা গেলে সেগুলোর উত্তরাধিকারী হবে তার নিকটাত্মীয়গণ। আর যদি ঋণ অথবা অসহায় সন্তানাদি রেখে যায়, তবে সে যেন আমার কাছে আসে, আমি তার অভিভাবক।’ (সহিহ বুখারি-৪৪১৯)

আমাদের মতো পরবর্তী যুগের অনুসারীদের নবীজি আরো বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সাহাবাদের বলতেন :

‘তোমরা তো আমার সঙ্গী। কিন্তু আমার ভাই হলো, যারা আমার ওপর ঈমান আনবে, অথচ আমাকে দেখবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ-১২৭১৮)

আল্লাহ তায়ালাও তাঁর ভালোবাসা বর্ণনা করে বলেন,

‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে সহ্য করা দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সূরা তওবা : ১২৮)

সাহসিকতা

রাসূল সা. ছিলেন অত্যন্ত সাহসী পুরুষ। চরম কঠিন মুহূর্তেও তিনি টলে পড়তেন না; থাকতেন দৃঢ়, অবিচল! উহুদ ও হুনায়নের বিভীষিকাময় কঠিন পরিস্থিতিতে বিক্ষিপ্ত মুসলিম বাহিনী তাঁর সাহসিকতা ও হিম্মতে আবারো সংঘবদ্ধ হয়েছিল। ফিরে পেয়েছিল প্রাণশক্তি! তাঁর অবিচলতায় ভর করেই ইসলাম চরম কোণঠাসা অবস্থা থেকে পরিণত হয়েছিল একটি বিজয়ী শক্তিতে।

একদিন গভীর রাতে মদিনার লোকজন বিকট চিৎকার শুনল। ভয় পেয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল, রাসূল একটা বেয়ারা ঘোড়াকে নিয়ে ফিরছেন এবং স্বাচ্ছন্দ্য মনে মদিনাবাসীকে অভয় দিচ্ছেন। 

লক্ষ্যে অবিচলতা

রাসূল সা. ছিলেন নিজ লক্ষ্যের প্রতি সদা অবিচল। কোনো বাধা-বিপত্তি তাকে দ্বীন কায়েমের সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মক্কাবাসীর লোভ-লালসা ও জুলুম-নির্যাতনের বিপরীতে স্বীয় লক্ষ্যের প্রতি তিনি ছিলেন অটল। মুশরিকদের লোভনীয় প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যদি তোমরা এক হাতে চন্দ্র এবং অন্য হাতে সূর্যও এনে দাও, তবুও এ আদর্শ থেকে আমি চুল পরিমাণ বিচ্যুত হবো না। হয় এ আদর্শ বিজয়ী হবে, নচেত এ পথে আমার জীবন উৎসর্গ হবে।’

পরিশ্রমপ্রিয়তা

আরামপ্রিয়তা এবং দূরে বসে কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা নবীজির স্বভাবের বিপরীত ছিল। তিনি সবসময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতেন; হয় দুনিয়াবি দায়িত্ব, নয়তো পরকালীন আমল। তিনি নিজ হাতে উপার্জনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং সকল কাজে নিজে অংশগ্রহণ করতেন। খন্দকের যুদ্ধে পেটে পাথর বেঁধে সানন্দে মাটি কাটা ও বহনের কাজ করেছেন। 

দ্বীনের স্বার্থে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সফরে তাঁর কোনোরূপ অলসতা ছিল না। শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে তিনি বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছেন। দীর্ঘ ৮০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তাবুক অভিযান পরিচালনা করা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সিদ্ধান্তগ্রহণ শক্তি ও দূরদর্শিতা

কঠিন মুহূর্তে সঠিক ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং গৃহীত সিদ্ধান্তে অটল থাকার ব্যাপারে নবীজি ছিলেন অনন্য উদাহরণ। মাক্কী জীবনে উমর রা.-এর ইসলাম গ্রহণের জন্য দোয়া, কঠিন মুহূর্তে বাদশাহ নাজ্জাশিকে পত্র প্রেরণ, হিজরতের সিদ্ধান্ত, মদিনা সনদ, বদর যুদ্ধে কুরাইশদের মোকাবেলার সিদ্ধান্ত, উহুদে গিরিখাতে সৈন্য সমাবেশ এবং তাদের প্রতি দেওয়া নির্দেশ, বাইয়াতে রিদওয়ানের ঘটনা, হুদায়বিয়ার সন্ধি এবং এই সন্ধি মোতাবেক আবু জান্দাল রা.কে ফিরিয়ে দেওয়া, প্রভৃতি ঘটনা তাঁর সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা, দূরদর্শিতা এবং তাতে অটল থাকার উজ্জ্বলতম নিদর্শন।

পরামর্শসুলভ মনোভাব

রাসূলুল্লাহ সা. সামষ্টিক কোনো সিদ্ধান্ত পরামর্শ ছাড়া হঠকারী গ্রহণ করতেন না। যে কোনো অভিযান কিংবা বড়ো পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি পরামর্শ করতেন, যদিও তাঁর উপর ওহি নাজিল অব্যাহত ছিল। বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় এর নজির পাওয়া যায়। খন্দক যুদ্ধে সালমান ফারসি রা.-এর পরামর্শ গ্রহণ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বিজ্ঞ সাহাবিদের পরামর্শ সভার সদস্য করেছিলেন। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, শাসন প্রণালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ শূরা নির্ণয় করত।

আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করে বলেন : 

‘যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামাজ কায়েম করে; পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সূরা শুরা : ৩৮) 

মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতা

রাসূলুল্লাহ সা. মহানুভবতায় ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর মহানুভবতায় মুমিন, মুশরিক, আহলে কিতাব সকলেই সিক্ত হতো। একদিন এক বেদুঈন মসজিদে নববিতে প্রস্রাব করে দিলে উপস্থিত সাহাবাগণ তাকে বাধা দিতে উদ্যত হয়। কিন্তু নবী তাদের থামিয়ে বললেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও। ওর প্রস্রাব করা শেষ হলে এক বালতি পানি ঢেলে দাও। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, তোমাদের সহজ ও বিনয়ী আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠোরতা বা উগ্রতার জন্য নয়।’

এমনিভাবে শত অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি তায়েফবাসীদের জন্য দোয়া করেছিলেন। যারা তাকে দেশ ছাড়া করেছিল, মক্কা বিজয়ের পর তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেছিলেন : ‘তোমাদের উপর আজ আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত!’

যুদ্ধবন্দীদের সাথে সুন্দর আচরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সহজশর্তে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সমস্ত উদাহরণ নবীজির মহানুভবতাকে চমৎকারভাবে প্রকাশ করে। 

কোমল হৃদয়

আল্লাহর রাসূল সা. ছিলেন অত্যধিক কোমল হৃদয়ের অধিকারী। মানুষের দুঃখ-কষ্টে তিনি ব্যথিত হতেন এবং অন্যের বেদনায় অশ্রু বিসর্জন দিতেন। নিজ শিশুপুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর পর তিনি অঝোরে কেঁদে বলেছিলেন, ‘এটা হচ্ছে রহমত (মমতা), যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাহদের অন্তরে সৃষ্টি করেছেন।’ তিনি সাহাবাদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত কোমলদিল। যার সাক্ষ্য আল্লাহ তায়ালা কুরআনে দিয়েছেন- 

‘আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোর হৃদয় হতেন, তবে তারা আপনার পাশ থেকে সরে যেত।’ 

ধৈর্যশীলতা

মহানবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এতটাই উন্নত ছিল যে, তিনি বিরোধীদের নির্যাতন-নিপীড়নের মোকাবেলা করতেন ধৈর্যের মাধ্যমে। কুরাইশদের অসংখ্য অপবাদ আর কুৎসার বিপরীতে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ধৈর্যহারা হননি কিংবা তাদের কটু কথার জবাব মন্দ ভাষায় দেননি। 

রাসূল সা. ছোটবেলায় মা-দাদাকে হারিয়েছিলেন। নবুয়ত লাভের পর আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে তাঁর দুই মেয়ে রুকাইয়া ও উম্মে কুলছুমের বিবাহ ভেঙে গিয়েছিল। (যিলালিল কুরআন : ৩/৮২) লোকদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে গেলে আবু লাহাব তাঁকে গালি দিয়ে লোকদের বলত, ‘এ লোকটি বিধর্মী মিথ্যাবাদী! তোমরা এর কথা বিশ্বাস করো না’। (মুসনাদে আহমাদ-১৬০৬৬) আবু লাহাবের স্ত্রী নবীজির বিরুদ্ধে নানা ব্যঙ্গকবিতা পাঠ করে লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলত। সে নবীজির যাতায়াতের পথে এবং তাঁর বাড়ির দরজার সামনে কাঁটা ছড়িয়ে বা পুঁতে রাখত, যাতে রাসূল সা. কষ্ট পান। (মিশকাত-৫৭৭৮) রাসূল সা. সালাতে দাঁড়ালে মুশরিকরা উট ও বকরির নাড়িভুঁড়ি তাঁর মাথার উপর রেখে আসত। রান্নার জন্য উনুনের ওপর হাঁড়ি চাপানো হলে হাঁড়ির উপরও নিক্ষেপ করত। (ইবনে হিশাম-১/৪১৬) এত কিছুর পরও রাসূলুল্লাহ সা. ধৈর্যহারা হননি।

হিজরতের দিনে আবু বকর রা.-সহ গুহায় আত্মগোপনকালে কাফেররা তাদের নাকের ডগায় এসে পড়েছিল, এমন কঠিন মুহূর্তেও রাসূলুল্লাহ সা. ভেঙে পড়েননি। বরং ধৈর্যের সাথে আল্লাহর ওপর ভরসা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা কুরআনে বলেছেন,

‘যখন তারা গুহায় ছিল, তখন সে (মুহাম্মাদ সা.) তার সঙ্গীকে বলেছিল, বিষ হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা তাওবাহ : ৪০)

এই সকল ঘটনা ছাড়াও কুরাইশ কর্তৃক আরোপিত রাসূলুল্লাহর উপর শিয়াবে আবু তালেবের দুঃসহ অবরোধ, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র, দেশ ত্যাগ, মদিনায় উপর্যুপরি হামলা, মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র, তাঁর পবিত্র স্ত্রীর বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা রটনা, ছেলে সন্তানের মৃত্যু, কন্যাদের মৃত্যু ইত্যাদির মতো কঠিন মুহূর্তেও তিনি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।

দানশীলতা

রাসূলুল্লাহ সা.-এর দুয়ারে এসে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরতেন না। স্বল্প পরিমাণ হলেও তিনি দেওয়ার চেষ্টা করতেন অথবা অন্যের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে দিতেন। রমজান মাস ও বিশেষ উপলক্ষ এলে তিনি দানের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিতেন এবং অন্যদেরও উৎসাহ দিতেন।

একবার জনৈক লোক এসে নবী সা.-এর কাছে কিছু ছাগল চাইল। নবীজি তাকে এত বেশি ছাগল দিলেন, যা দিয়ে দুই উপত্যকার মাঝামাঝি স্থান পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর ওই ব্যক্তি নিজ গোত্রের কাছে গিয়ে বলল, ‘হে আমার জাতি ভাইয়েরা! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো, কারণ মুহাম্মাদ অভাবের আশঙ্কা করেন না।’


[ ৪র্থ পর্ব ]

রাসূলুল্লাহ সা.-এর মুয়ামালাত/ ব্যবহারিক জীবন

জনসাধারণের সাথে রাসূলুল্লাহ সা.-এর আচরণ ছিল অত্যন্ত বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতাপূর্ণ। নানান প্রকৃতির মানুষের সাথে তিনি মিশতেন; কিন্তু কখনো জাতি-বর্ণ-গোত্র ভেদে কারো সাথে আচরণে তারতম্য করেননি। হেয়প্রতিপন্ন করেননি কাউকে। স¤্রাট থেকে শুরু করে দাস-দাসী, আমীর-ফকির, বন্ধু-শত্রু, মুসলিম-অমুসলিম, আরব-অনারব, ধনী-গরিব, সাদা-কালো সবার সাথে তিনি সম্মানজনক আচরণ করতেন। জনসাধারণের সাথে তাঁর ব্যবহার এতটাই মুগ্ধকর ছিল যে, প্রথম সাক্ষাতেই অনেকে অভিভূত হয়ে তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করতেন। যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি, তারাও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। 

ওহি অবতরণের সূচনাকালে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর নিকট প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তখন আম্মাজান খাদিজা রা. অভয় দিয়ে বলেছিলেন,

‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ কক্ষনো আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, অসহায়দের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বদের জীবিকার ব্যবস্থা করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করেন।’ 

নবীজির সুন্দর সামাজিক আচরণের সাক্ষ্য স্বয়ং শত্রুপক্ষও দিত। রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াস যখন আবু সুফিয়ানকে মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, ‘তিনি সত্য কথা বলেন এবং ওয়াদা রক্ষা করেন।’ 

পৃথিবীর ইতিহাসে কেবল একজন ব্যক্তিই রয়েছেন, যার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে ব্যবহারিক জীবন পর্যন্ত সকল পর্যায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.। তাঁর ব্যবহারিক জীবনের সবকিছুই আমাদের সামনে উপস্থিত। 

পিতা-মাতার সাথে ব্যবহার

রাসূলুল্লাহ সা. শৈশবেই পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। দুধমা হালিমা রা. যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাঁর অধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আরেক দুধমা সুয়াইবা-যিনি আবু লাহাবের দাসী ও অমুসলিম ছিলেন-তিনিও যতদিন জীবিত ছিলেন, নবী তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং বিভিন্ন সময় উপহার-উপঢৌকন প্রেরণ করেছেন। 

ইসলাম গ্রহণের কারণে অনেক সাহাবায়ে কেরামকে মা-বাবা থেকে সরে আসতে হয়েছিল এবং অনেকের পিতা-মাতা সন্তানের সাথে থেকেও মুশরিক অবস্থায় ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতেও রাসূল সা. প্রত্যেককেই নির্দেশ দিয়েছিলেন পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার অব্যাহত রাখতে। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার দিক থেকে কে বেশি হকদার?’ নবীজি বললেন, ‘তোমার মা।’ লোকটি বলল, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ সে বলল, ‘তারপর কে?’ নবীজি আবার বললেন, ‘তোমার মা।’ সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা।’ (বুখারি-৫৫৪৬)

আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে যায়, এমন আদেশ ব্যতীত পিতা-মাতার সমস্ত আদেশ মান্য করতে নবীজি নির্দেশ দিয়েছেন। একইসাথে যথাসাধ্য কোমল ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতে উৎসাহিত করেছেন। উপদেশ দিয়েছেন তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করতে। অনেক সাহাবাকে নবীজি জিহাদের ময়দান থেকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন অসুস্থ বাবা-মায়ের সেবা করতে।

স্ত্রী-সন্তানদের সাথে ব্যবহার

নিজ সন্তান-সন্ততির প্রতি নবীজি সা.-এর স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল অফুরান। স্ত্রীদের সাথে তাঁর মধুর সম্পর্কের উপমা খুঁজে পাওয়া বিরল। স্ত্রীদের অধিকার ও চাহিদার প্রতি তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। স্ত্রী-সন্তানদের সাথে নিয়মিত গল্পগুজব করতেন। তাদের মতামতের মূল্য দিতেন এবং আন্তরিকতার সাথে পরামর্শগুলো শুনতেন। বাড়িতে অবস্থানকালে স্ত্রীদের সাংসারিক কাজে সাহায্য করতেন। হজরত আয়িশা রা. বলেন, 

‘রাসূলুল্লাহ সা. বাড়িতে অবস্থানকালে পরিবারের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থাকতেন এবং আজান হলে নামাজের জন্য উঠে যেতেন।’

নবীজি সা. পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয়কৃত অর্থকে সর্বোত্তম অর্থ (সাদাকা) বলে ঘোষণা দিয়েছেন। 

আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর সাথে ব্যবহার

সুখে-দুঃখে আত্মীয়-স্বজনের পাশে দাঁড়ানো, ভালো কিছু রান্না হলে প্রতিবেশীর ঘরে পাঠানো, উপহার প্রদান ইত্যাদি ছিল রাসূল সা.-এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। প্রতিবেশীর অধিকার ক্ষুণ্ন করাকে তিনি বড়ো ধরনের পাপ বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। নবী প্রতিবেশীর অধিকার বিষয়ে এত বেশি উপদেশ দিতেন যে, সাহাবায়ে কেরাম আশঙ্কা করতেন-এই বুঝি প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন। (বুখারি-৫৪৭৬) তিনি বলেছেন,

‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায়; অথচ তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে।’ (আদাবুল মুফরাদ-১১২)

প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার ক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিম বিভাজন না করতেও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। 

অধস্তন ও শ্রমিকদের সাথে ব্যবহার 

অধস্তনদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল ছিলেন সবার ব্যতিক্রম। যায়েদ বিন হারেসা রা. শিশু বয়সে আল্লাহর রাসূল সা.-এর খেদমতে এসেছিলেন। এরপর নবীজির আচরণে তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আল্লাহর রাসূলের সেবায় জীবন অতিবাহিত করাকেই শ্রেয় মনে করেছেন। মাদানি জীবনে আনাস বিন মালেক রা. দশ বছর ধরে আল্লাহর রাসূলের খেদমত করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, 

‘কোনো বিষয়ে নবীজির পক্ষ থেকে ধমক তো দূরের কথা ‘কেন করেছো, কেন করনি’ এমন প্রশ্নেরও সম্মুখীন কোনো দিন হইনি।’

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে নবীজি সা. বলেছেন :

‘তোমরা শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দিবে।’ (মিশকাত-২৯৮৭)


সাহাবাদের সাথে ব্যবহার

রাসূল সা. সাহাবাদের সাথে কোমল ব্যবহার করতেন এবং আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। যে কেউ বিনাদ্বিধায় তাঁর কাছে আসতে এবং মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত। কারও ভুলত্রুটি গোচর হলে তিনি পরম আদর আন্তরিকতার সাথে তা শুধরে দিতেন; কোনো প্রকার ধমক দিতেন না। 

তিনি সানন্দে সাহাবাদের বাড়িতে মেহমান হয়েছেন ও মেহমানদারি করেছেন। বাড়িতে কিংবা মসজিদে নববীতে সাহাবাদের সাথে খোশগল্প করা, তাদের জীবনের গল্প শুনা, সমস্যায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ভালো সংবাদে উৎফুল্ল হওয়া এবং খোশ-আমদেদ জানানো, সুখে-দুঃখে সঙ্গ দেওয়া, এসব ছিল রাসূল সা.-এর নিত্যদিনের দৃশ্য। তিনি সবসময় সাহাবাদের প্রতি কোমলদিল ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন। কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)


অবিশ্বাসীদের সাথে ব্যবহার

রাসূল সা. নবুয়তের সুমহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অবিশ^াসীদের দ্বারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাচ্ছিল্য, অপবাদ ও কটূক্তিতে বিদ্ধ হয়েছেন; কিন্তু তাদের মন্দের জবাবে কখনো মন্দ ব্যবহার করেননি। তায়েফের মাটিতে অবিশ^াসীদের প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত হয়েও তিনি বদদোয়া করেননি; বরং নির্যাতনকারীদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের হেদায়েত কামনা করেছেন। বদর থেকে তাবুক পর্যন্ত সকল যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের সাথে তিনি যে উদার ও মহানুভবপূর্ণ আচরণ করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তৎকালীন যুদ্ধরীতিতে এমন ব্যবহার অকল্পনীয়ও বটে। মক্কা বিজয়ের পর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার এবং পূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রহমাতুল-লিল আলামিন মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা করেছিলেন। এক অবিশ^াসী বেদুঈন নবীজিকে হত্যা করতে এসে পরপর তিনবার ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়েছিল। নবীজি তিনবারই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহর ক্ষমার এই অনুপম দৃষ্টান্ত মানবতার ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে আছে। 

অসুস্থের সেবা

অসুস্থ কাউকে দেখতে যাওয়া, রোগীর সেবা করা, দুর্দশাগ্রস্ত লোকের পাশে দাঁড়ানো এবং তাঁদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাসূল ছিলেন সবার আগে। এক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিম, বন্ধু-শত্রু কোনো পার্থক্য তিনি করতেন না। রোগীর সেবা করা, জানাজায় উপস্থিত হওয়া প্রভৃতি কাজকে প্রত্যেক মুসলিমের অধিকার ও কর্তব্য বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। 

ছোটো-বড়ো সম্পর্ক

নবীজি সা. ছোটোদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠতেন। হাসান-হোসাইন তাদের আদরের নানাকে ঘোড়া বানিয়ে পিঠে চড়ে খেলা করত। রাসূল সা.-এর কাছে কোনো খাবার এলে প্রথমে ছোটোদের দিয়েই তিনি বিতরণ শুরু করতেন। ছোটোদের চুমু দেওয়া, আলিঙ্গন করা, আদর করা প্রভৃতি আচরণ ছিল তাঁর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আনাস ইবনে মালিকের ছোটো ভাই উমাইরের পোষা পাখি ‘নুগাইর’ মারা গিয়েছিল বলে সে মন খারাপ করে বসে ছিল। নবীজি জানতে পেরে তাঁর মন ভালো করার জন্য রসিকতা করে ছন্দে ছন্দে বলেছিলেন- ‘ইয়া আবা উমাইর, মা ফায়ালান নুগাইর?’ অর্থাৎ ‘হে আবু উমাইর, তোমার নুগাইরের কী হয়েছে?’

নবীজি সা. সবসময় বড়োদের সম্মান করতেন। মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে বড়োদেরকেই অগ্রাধিকার দিতেন। এভাবেই তিনি বড়োদের সম্মান ও ছোটোদের স্নেহ করার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত মানবজাতির সামনে পেশ করেছেন। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য তিনি ঘোষণা করেছেন, 

‘যে ব্যক্তি ছোটোদের স্নেহ ও বড়োদের শ্রদ্ধা করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি-১৯২০)

অতিথিপরায়ণতা

মেজবান হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত মেহমানদারি, আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে আদর-আপ্যায়ন আমাদের শেখায়, কিভাবে মেহমানকে সমাদর করতে হয়। তিনি বলেছেন, 

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনে, সে যেন মেহমানের সমাদর করে।’ (বুখারি-৬১৩৬)

সাধ্যমত মেহমানকে খাবার পরিবেশন করা, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আপ্যায়ন করা, তাঁদের থাকার সুব্যবস্থা করা ইত্যাদি ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর ভূষণ। মেহমানকে বিদায় দেওয়ার কালে নবীজি তাঁর হাত ধরতেন এবং মেহমান নিজে থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া পর্যন্ত তিনি হাত ছাড়তেন না।

রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জনসাধারণের সাথে ব্যবহার

রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের পর একটি অংশগ্রহণমূলক স্বাধীন ও সার্বভৌম কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। কারণ এই রাষ্ট্রে ইসলামের সকল বিধিবিধান সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাসূল সা. জনগণের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিতেন এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতেন। রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিয়মিত সাক্ষাৎ দিতেন, তাঁদের অভিযোগ-অনুযোগ শুনতেন, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতেন।

বিচারের ক্ষেত্রে তিনি ইনসাফ ও সুবিচারের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্বকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিতেন না। মুসলিমের বিরুদ্ধে এক ইহুদির দায়ের করা মামলায় তিনি সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইহুদির পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এমনকি উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় আলী রা.-এর বিরুদ্ধেও রায় দিয়েছিলেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। একবার মাখযুমী বংশের একজন মহিলা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হলে রাসূল সা.-এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন উসামা ইবন যায়েদ মহিলার দণ্ডাদেশ মওকুফের ব্যাপারে রাসূল সা.-কে সুপারিশ করেন। এতে রাসূল সা. উসামাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ ঘোষিত দণ্ডবিধি কার্যকরের বিরুদ্ধে তুমি সুপারিশ করছ? জেনে রাখ! আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সুনানে নাসায়ী-৪৮৯৫)

এভাবে সাম্য ন্যায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি মানবজাতির জন্য শান্তির মডেল হয়ে আছেন।


[ ৫ম পর্ব ]

রাসূলুল্লাহ সা.-এর দিনলিপি

পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ্য জীবনযাপন এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে সকল কর্মপ্রচেষ্টা নিয়োজিত করা সফলতার মূলমন্ত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষ রাসূলে আকরাম মুহাম্মাদ মুস্তফা এই মূল মন্ত্রের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন নানান ঘটনার সমষ্টি। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। দ্বীনের প্রয়োজনে গুহায় থাকতে হয়েছে, সফরে কিংবা রণাঙ্গনেও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তা ছাড়া মাক্কী জীবন থেকে মাদানি জীবনের বৈশিষ্ট্য ও ধরনেও রয়েছে ভিন্নতা। ফলে তাঁর জীবনের নির্দিষ্ট কোনো দিনলিপি দাঁড় করানো মুশকিল। তবে যুদ্ধ ও সফরের মত ব্যস্ততা ব্যতীত সাধারণ দিনগুলোয় তিনি একটা সুষ্ঠু নিয়মের মধ্য দিয়ে চলতেন। এই নিয়মের আওতায় তিনি ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজের আঞ্জাম দিতেন। পাশাপাশি ইবাদাত-বন্দেগিতেও মশগুল হতেন। 

বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর মাঝে নবীজি সা. কিভাবে সমন্বয় সাধন করতেন, কিভাবে এত ব্যস্ততার মাঝেও আল্লাহর দরবারে ধরনা দিতেন, তা তাঁর দিনলিপির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝা যায়। বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী মানুষের দিনিলিপি আমাদের শেখায় কিভাবে দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে সমন্বয় সাধন করে দুই জগতেই সফলতা অর্জন করা যায়।

ভোর 

- ঘুম থেকে জাগরণ। (বুখারি-৫/২৩৬)

- মিসওয়াক ব্যবহার। (মুসলিম-১/১২৮)

- আল্লাহ তায়ালার হামদ এবং শোকর আদায়। 

- আজান শ্রবণ। (বুখারি-৬১৪)

- ফজর সালাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ। (বুখারি-৬০১)


ফজরের সালাত

- মসজিদে প্রবেশ। (মুসলিম, নাসায়ী)

- সালাতে ইমামতি। (মিশকাত-১১১৮)

- মাসনুন দোয়া পাঠ।

- উপস্থিত মুসল্লিদের সাথে আলাপ-আলোচনা।


সূর্যোদয়ের পর 

- দুই রাকাত নামাজ আদায়। (মিশকাত-৩০৬ পৃ.)

- বাড়িতে প্রত্যাবর্তন। (আবু দাউদ-৫০৯৬)

- মিসওয়াক ব্যবহার। (মুসলিম-১/১২৮) 

- পরিবার-পরিজনদের অভিবাদন জ্ঞাপন। (সূরা নূর : ৬১)


সকালের খাবার

- বাড়িতে খাবার থাকলে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ। (তিরমিজি-২৩৮০) 

- খাবার না থাকলে রোজার নিয়তকরণ। (মুসলিম-১১৫২)

দিনের কর্মতৎপরতা শুরু

- মসজিদে ফিরে দুই রাকাত নামাজ আদায়। (বুখারি-১১৬৩, মুসলিম-৭১৪)

- সাহাবায়ে কেরামদের দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষাদান। (শামায়েলে তিরমিজি-৮৮)

- সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়াবলি দেখাশোনা করা।


দুপুরের আগে

- আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া। 

- মদিনার বাজারে হাঁটাহাঁটি করা।

- বাড়িতে আগত অতিথিদের সাথে সাক্ষাৎ। 


দুপুরের খাবার

- রান্নাকৃত বা হাদিয়া হিসেবে আগত খাবার গ্রহণ। (বুখারি-৩৩২২)

- পরিবারের সদস্য, অভাবগ্রস্ত অথবা সাহাবাগণকে সঙ্গে নিয়ে খাবার গ্রহণ। (বুখারি-২৮১২)

বিশ্রাম

- খাওয়া শেষে জোহরের সালাতের সময় সন্নিকটে আসার আগ পর্যন্ত হালকা বিশ্রাম। 

জোহরের সালাত

- নামাজের ইমামতির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে যাত্রা। (আবু দাউদ-৮০৬)

- মসজিদে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে নসিহা প্রদান। 

- সুনির্দিষ্ট কাজে মনোনিবেশ।


আসর

- আসরের নামাজের ইমামতি। (মিশকাত-৮৩০)

- মাসনুন দোয়া পাঠ।

বাদ আসর

- বাড়িতে প্রত্যাবর্তন। (শা. তিরমিজি-২৩১)

- পরিবার-পরিজনের সাথে অর্থবহ সময় উপভোগ। (প্রাগুক্ত)

- মধু বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্যগ্রহণ।

মাগরিব

- আজান শুনে মসজিদে গমন।

- মাগরিবের সালাতের ইমামতি। (বুখারি-৭৬৫)

- দোয়া-মাসনুন পাঠ।

- সাহাবাদের কর্মব্যস্ততার খোঁজখবর গ্রহণ।

- বাড়িতে প্রত্যাবর্তন।


রাতের খাবার

- শুধু খেজুর এবং পানি দিয়ে রাতের খাবার গ্রহণ।

- সঙ্গীদের সাথে উপভোগ করে খাবার গ্রহণ।

- খাবার শেষে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায়।

এশার নামাজ

- সালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন। (শামায়েলে তিরমিজি-২০৮)

- সালাত শেষে অতি সংক্ষেপে নসিহাহ প্রদান। (শামায়েলে তিরমিজি-২০১)

- মাঝে-মধ্যে সাহাবা রা.-এর বাড়ি পরিদর্শন।

- বাড়ি ফিরে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো।

শয়নকাল

- ঘুমানোর প্রস্তুতি কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া পাঠ। (শামায়েলে তিরমিজি-২০১)

- রাতের মধ্যভাগ পর্যন্ত ঘুম। (শামায়েলে তিরমিজি-২৬৪)

মধ্য রজনী 

- রাতের মাঝামাঝি সময়ে বিছানা ত্যাগ। (মুসলিম-১১৬৩)

- নিজ ঘরে অথবা মসজিদে তাহাজ্জুদের সালাত আদায়। (সূরা আলে ইমরান : ১৭, মুসলিম-৭৭৮) 

- কখনো কখনো এই সময়ে কবরস্থানে গমন এবং মরহুমদের জন্য দোয়া প্রার্থনা।

রাতের শেষ প্রহর 

- তাহাজ্জুদ শেষে রাতের এক-ষষ্ঠাংশ বাকি থাকতে স্বল্প সময়ের জন্য হালকা বিশ্রাম গ্রহণ। (বুখারি-৬১৪, শামায়েলে তিরমিজি-২৬১)

- ফজরের আজান শুনে শয়ন ত্যাগ এবং মসজিদে গমন।

জাগরণ

সাধারণত রাতের শেষ অংশেই রাসূলুল্লাহ এর দিন শুরু হতো। ঘুম থেকে জেগে মেসওয়াক ও পবিত্রতা অর্জন শেষে তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন। অতঃপর নিমগ্নচিত্তে সালাত ও জিকিরে ডুবে যেতেন। তাহাজ্জুদে সাধারণত তিনি সূরা আলে ইমরানের শেষ ১০ আয়াত পড়তেন। তাহাজ্জুদ শেষে স্ত্রীর ঘুম ভাঙাতেন এবং একসাথে বিতরের সালাত আদায়ান্তে প্রাণ খুলে প্রভুর কাছে দোয়া করতেন। দোয়া শেষে ফজরের আজান পর্যন্ত হালকা ঘুমাতেন বা বিশ্রাম নিতেন। নচেত স্ত্রীর সাথে খোশগল্প করেই সময় অতিবাহিত করতেন।

ফজরের সময়

বেলালের আজান শুনার পর দোয়া পাঠ শেষে বাসায় দু’রাকাত সালাত (ফজরের সুন্নাত) আদায় করতেন। অতঃপর মসজিদে এসে ইমামতিতে দাঁড়াতেন। নামাজ শেষে জায়নামাজে বসেই সূর্যোদয় পর্যন্ত বিভিন্ন জিকির ও দোয়া পাঠ করতেন। সূর্যোদয়ের পর সাহাবাদের সাথে বিভিন্ন দ্বীনি বিষয়ে আলাপ করতেন, তাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন, স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতেন এবং নতুন ওহির ব্যাপারে অবহিত করতেন। অতঃপর ইশরাকের নামাজ শেষে বাড়ির পথ ধরতেন।

সকাল

বাড়িতে ফিরে সবাইকে সালাম জানাতেন। বাড়ির কাজে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন। খাবার থাকলে খেয়ে নিতেন, অন্যথায় বলতেন- ‘আমি রোজার নিয়ত করলাম’। বাড়ির কাজ শেষে আবার মসজিদে নববীতে ফিরতেন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে মনোনিবেশ করতেন। এ সময় তাঁর কাছে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকেরা আসত এবং বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাত। এ সময়কে অফিস টাইমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এ সময় নবীজি মানুষজনের জিজ্ঞাসার জবাব দিতেন এবং সমস্যার সমাধান করতেন। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কাউকে কোথাও পাঠানোর থাকলে প্রেরণ করতেন।

এসব কাজ থেকে অবসর হয়ে দ্বিপ্রহরের আগে তিনি মদিনার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের খবরাখবর নিতে বের হতেন। অসুস্থদের খোঁজ নিতেন, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় গমন করতেন, হাট-বাজারের তদারকি করতেন। কারো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে সহযোগিতার ব্যবস্থা করতেন। মাঝে মধ্যে মেয়ে ফাতেমার বাড়িতে যেতেন এবং আদরের নাতিদের সাথে আনন্দঘন সময় কাটাতেন।

জোহর

জোহরের পূর্বে রাসূল সা. বাড়ি ফিরতেন এবং গোসল সেরে খাবার গ্রহণ করতেন। অতঃপর আজান পর্যন্ত কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতেন। নামাজের সময় হলে মসজিদে গমন করতেন। নামাজ শেষে রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যস্ততা না থাকলে বাড়িতে ফিরতেন অথবা মসজিদে নববীতে কিছু সময় কায়লুলা করে (বিশ্রাম করে) ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। ব্যস্ততা থাকলে বাড়িতে সামান্য বিশ্রাম শেষে মদিনার বাইরে বেরিয়ে পড়তেন এবং বিভিন্ন জনপদের খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন। বিচারকার্য থাকলে তার সমাধান করতেন।

আসর

আসরের নামাজ শেষে তিনি বাড়ি ফিরতেন এবং পরিবারের লোকজনের সাথে সময় কাটাতেন। এই সময়ে তিনি পরিবারের লোকদেরকে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন, ছোটোদের সাথে খুনসুটি করতেন এবং পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতেন। কখনো কখনো মধু পান করতেন।

মাগরিব

মাগরিবের ওয়াক্ত হলে তিনি আবার মসজিদে গমন করতেন এবং সালাত আদায় শেষে মসজিদে নববীতেই অবস্থান করতেন। সাহাবাদের সারাদিনের কর্মব্যস্ততার খোঁজ-খবর নিতেন। আলোচনা শেষে বাড়ি ফিরে রাতের খাবার গ্রহণ করতেন।

ইশা

আজান হলে মসজিদে গমন করতেন। মদিনার লোকজন সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকত বিধায় ইশার নামাজ শেষে তিনি কোনো বক্তৃতা বা নসিহার কর্মসূচি রাখতেন না। লোকেরা নামাজ শেষে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ত। নামাজ শেষে নবী কখনো কখনো তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবাদের (যেমন-আবু বকর, উমর, উসমান রা. প্রমুখ) বাড়িতে গমন করতেন এবং তাঁদের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠতেন। কারও দাওয়াত থাকলে তাতে শামিল হতেন। অনেক সময় ঘনিষ্ঠ সাহাবাদের নিজ বাড়িতেও আমন্ত্রণ জানাতেন এবং আপ্যায়ন করাতেন। বাড়ি ফেরার পথে কারও কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেলে সেখানে বসে তিলাওয়াত শুনতেন। বাড়ি ফিরে স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনের সাথে সময় কাটাতেন। ঘুমানোর সময় তিনি ডান কাত হয়ে দোয়া পড়ে ঘুমিয়ে পড়তেন এবং রাতের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাতেন। (ইফাফা থেকে সংগৃহীত)

[ ৬ষ্ঠ পর্ব ]

‘উসওয়াতুন হাসানাহ’

রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনের প্রতিটি দিক আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ ও পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে মানবতার মুক্তির মহামন্ত্র। একমাত্র তাঁকে অনুসরণের মাধ্যমেই মানুষের কাক্সিক্ষত মুক্তিলাভ সম্ভব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র আল কুরআনুল কারিমে আমাদের জন্য যে আদর্শ পেশ করেছেন, তার বাস্তব প্রতিফলন ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.। এজন্য তাঁকে অনুসরণ করার অর্থ হলো-আল্লাহর বিধানকে অনুসরণ করা। আল্লাহ তায়ালা তাই মানবজাতির জন্য তাঁকে সর্বোত্তম আদর্শ বলে ঘোষণা দিয়েছেন :

‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব : ২১)

বিশ্ববাসীর জন্য উত্তম আদর্শ

“As a father, as a teacher, as a law giver, as a law maker, as a reformer of the society, as a commander, as a messenger, Mohammad (sm.) is the superman of the world.”

উপরের উক্তিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের দেয়ালে লিপিবদ্ধ একটি মূল্যায়ন। এখান থেকেই বুঝা যায় মুহাম্মাদ সা. কেন বিশ^বাসীর জন্য উত্তম আদর্শ। জীবনের যে বিভাগেই দৃষ্টি নিবন্ধ করা হোক না কেন, সে বিভাগেই নবীজি সফল ও সেরা মানুষ। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি দিক থেকেই তিনি মানুষের জন্য আদর্শ।

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আদর্শ

মদিনায় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের প্রথম পদক্ষেপেই রাসূল সা. রাষ্ট্রের সকল জাতি-ধর্ম-গোত্রের নাগরিককে একটি সম-অধিকারভিত্তিক সাংবিধানিক চুক্তির আওতায় ঐক্যবদ্ধ করেন। মদিনাসনদ নামে পরিচিতি এই চুক্তিনামাই পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান। রাষ্ট্রকাঠামোয় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে তিনি একটি নতুন পদ্ধতির কল্যাণরাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। পরবর্তী মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে তিনি এই মদিনা নামক নগর রাষ্ট্রটিকে রূপান্তর করেন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিতে। একইসাথে নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা, সৌহার্দ, সুশাসন। প্রতিষ্ঠা করেন আইনের শাসন, ন্যায্য অধিকার, নাগরিক মর্যাদা, সুশিক্ষা, সুস্থ ও সহযোগিতামূলক সংস্কৃতি। তৈরি করেন উন্নত চরিত্রের নাগরিক, দক্ষ সেনাদল ও যোগ্য নেতৃত্ব। জর্জ বার্নার্ড শ’ তাই বলেছেন,

“I believe that if a man like prophet Muhammad was to assume the dictatorship of modern world would success in solving its problem in a way that world being in men needed peace and happiness.”

আইনপ্রণেতা হিসেবে আদর্শ

সংবিধান একটি দেশের আইনের প্রথম উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি একটি আদল ও ইনসাফপূর্ণ সংবিধান, ন্যায্য অধিকারভিত্তিক উত্তরাধিকার আইন, সম্মান-নিরাপত্তা নির্ভর বিবাহ ও তালাক আইন, দৃষ্টান্তমূলক ফৌজদারি আইন, পারস্পরিক স্বার্থ ও সৌহার্দরক্ষামূলক ভোক্তা আইন ইত্যাদি প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেকে আদর্শ বিশ^জনীন আইনপ্রণেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রণীত আইনের প্রধান উৎস ছিল ওহি- তথা কুরআন। 

সংস্কারক হিসেবে আদর্শ

মুহাম্মদ সা.-এর পয়গাম ছিল দুনিয়াতে এক বিরাট সংস্কারমূলক আন্দোলন। তিনি জাহেলিয়াতের সমস্ত কুপ্রথাকে ভেঙে মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তায় পরিবর্তন আনেন।

সমাজকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে তাতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিলোপ করেন গোত্রভিত্তিক সংঘাত, জীবনের বদলা, নারীকে জীবন্ত কবর দেওয়ার রীতি, সম্পত্তি আত্মসাৎ, মদ-জুয়া, সুদ ও দাস-দাসীর প্রতি অত্যাচারের মতো হাজারও কদাচার।

সেনানায়ক হিসেবে আদর্শ

রাসূল সা. ছোটো-বড়ো সব মিলিয়ে ২৭টি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে নবীজির নীতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি যতটা সম্ভব ক্ষয় ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করতেন। এমনকি যুদ্ধের চেয়ে শান্তি আলোচনায় বেশি আগ্রহ বোধ করতেন। যুদ্ধ বেধে গেলে প্রতিপক্ষকে আগে হামলা করার সুযোগ দেওয়া, নারী-শিশু-বৃদ্ধ-ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের উপর হামলা না করা এবং শস্যক্ষেত ধ্বংস না করা ছিল তাঁর অন্যতম নীতি। তাঁর যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল শান্তি ও মানবিক মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা। সৈন্যবিন্যাস, যুদ্ধক্ষেত্র নির্বাচন, হামলার ধরন ও যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ এবং নিজ সৈন্যদের রক্ষায় তাঁর মতো বিচক্ষণ সেনানায়ক বিরল।

ব্যবসায়ী হিসেবে আদর্শ

নবীজি সা. পারিবারিক সূত্রেই ব্যবসার নাড়ি-নক্ষত্র শিখেছিলেন। তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতা, সততা ও সুনাম খাদিজার মতো নামকরা বণিককেও মুগ্ধ করেছিল। যে সমাজে প্রতারণা ছিল ব্যবসায়ের মূল কৌশল, সেই সমাজকেই তিনি শিখিয়েছিলেন প্রতারণার পথ অবলম্বন করা হারাম। ওজনে সঠিক দেওয়া, দ্রব্যের গুণাগুণ সম্পর্কে মিথ্যা না বলা, ভালোর মধ্যে-খারাপ না মেশানো, মজুদদারির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করা, লেনদেন লিখে রাখা ইত্যাদি ছিল তাঁর ব্যবসার প্রধান মূলনীতি।

শিক্ষক হিসেবে আদর্শ

একটি সভ্য ও সুন্দর পৃথিবী গড়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক জ্ঞানের উৎকর্ষসাধন। সেই উদ্দেশ্যসাধনে মানবজাতির শিক্ষকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিশ্বনবী সা.। তিনি নিজেই বলেন- ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৯)। শিক্ষাদান পদ্ধতিতে নবীজি সা. অনুপম আদর্শ। তিনি কেবল উপদেশ বা দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা দেননি; বরং নিজের ব্যবহার ও কর্মের দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষা দিতেন। শিক্ষাদানকালে স্থান-কাল ও শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা বিবেচনায় রাখতেন। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির পরই কথা শুরু করতেন। কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যেনো শিক্ষার্থী তা ভালোভাবে বোঝে। (শামায়েলে তিরমিজি-২২২)

সেরা প্রজন্ম তৈরিতে আদর্শ

নবীজির হাতে গড়া মানুষগণ ছিলেন সর্বকালের সেরা মানুষদের অন্যতম। তাদের সততা, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতা ও জবাবদিহিতা ছিল অতুলনীয়। তাঁদের হাতেই গড়ে উঠেছিল জ্ঞান-গরিমা-শিল্প-সৌহার্দ ও শান্তিতে মোড়ানো ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। কবি ফররুখ আহমদ তাই যথার্থই বলেছেন,

‘তব বিদ্যুৎকণা-স্ফুলিঙ্গে লুকানো রয়েছে লক্ষ দিন,

তোমার আলোয় জাগে সিদ্দিক, জিন্নুরাইন, আলী নবীন,

ঘুম ভেঙে যায় আল ফারুকের-হেরি ও প্রভাত জ্যোতিষ্মান

মুক্ত উদার আলোক তোমার অগণন শিখা পায় যে প্রাণ।’

জ্ঞানের প্রচার-প্রসারে সফলতা

নবীজি সা. বলতেন, ‘জ্ঞান মুসলমানের হারানো সম্পদ। তাই যেখানেই তা কুড়িয়ে পাবে, সেখান থেকেই আহরণ করবে’। ইক্বরা দিয়ে যে নবীর নবুয়তের সূচনা, তিনি জ্ঞানার্জনের নেশাকে বুকে ধারণের জন্য জ্ঞানচর্চাকে ইবাদত বলে ঘোষণা দেন। বাধ্যতামূলক করেন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রাথমিক জ্ঞানর্জন। জ্ঞানের সঞ্চালনের জন্য যায়েদ বিন সাবেতকে নির্দেশ দেন বিদেশী (হিব্রু) ভাষা শিখতে। নবীজির এই সকল পদক্ষেপের ফলে পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডগুলো পরিণত হয়েছিল জ্ঞানের স্বর্গভূমিতে। সেখান থেকে আলো নিয়েই মধ্যযুগে সূচনা হয়েছিল অন্ধকার ইউরোপের রেনেসাঁ। 

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আদর্শ

নারী যখন পণ্য সামগ্রীর ন্যায় ব্যবহৃত হতো, ছিল না তাঁর মানবিক মর্যাদা কিংবা পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার, কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করাকে যখন কুলক্ষণ বিবেচনা করা হতো, তখন মহানবী সা. ঘোষণা করেন,

‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’, ‘যে ব্যক্তি কন্যাসন্তানের যথাযথ লালন-পালন করবে, জান্নাতে সে আমার সঙ্গী হবে’; ‘দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ উত্তম স্ত্রী’; ‘স্বামী-পিতাদের সম্পত্তিতে স্ত্রী-কন্যাদের অংশ রয়েছে’।

পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর সম্মান ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর মতো সফল আর কেউ নেই।

দাস-দাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আদর্শ 

বিদায় হজ্জের ভাষণে নবীজি সা. দাস-দাসীদের সম্পর্কে বিশেষ নসিহত পেশ করেন :

‘স্মরণ রেখো! তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসীরা অসহায়, নিরাশ্রয়। খবরদার! তাদের ওপর কখনো জুলুম করবে না, তাদের অন্তরে আঘাত দেবে না। তোমাদের মতো তাদেরও একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দিলে কষ্ট পায়, আর আনন্দে আপ্লুত হয়। তোমরা যা খাবে, তাদেরও তা-ই খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরও তা-ই পরাবে।’

রাসূল সা. হাবশি দাস বেলাল রা.-কে প্রধান মুয়াজ্জিনের সম্মানে ভূষিত করেন, স্বীয় দাস যায়েদ বিন হারেসাকে মুক্ত করে সন্তানের ভালোবাসা দেন এবং তাঁর সন্তান উসামাকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। তিনি দাসমুক্তিকে জান্নাত লাভের উপায় হিসেবে ঘোষণা দেন। একইসাথে যারা মানবপাচারের মাধ্যমে মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, কিয়ামতের দিন তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করবেন বলেও ঘোষণা দেন।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আদর্শ

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা. নজিরহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি ঘোষণা দেন- অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের, সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার, গরিবের ওপর ধনীর এবং ধনীর ওপর গরিবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। বাহ্যিক মাপকাঠিতে সকলের মর্যাদা সমান। তিনি গোত্রীয় আভিজাত্য, বংশীয় গৌরব ও বর্ণবাদের মতো বিভেদপ্রাচীরের ওপর কুঠারাঘাত করে সাম্য ও সমতার বাণী প্রচার করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন এক অভূতপূর্ব অধিকারভিত্তিক সমাজ।

সভ্যতার কারিগর হিসেবে আদর্শ 

তমসাচ্ছন্ন আরবের সকল অজ্ঞতা, মূর্খতা, কুসংস্কার ও পঙ্কিলতা দূর করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সৌহার্দে সমৃদ্ধ এ নয়া সভ্যতার সূচনা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.। যেখানে মানবিক মূল্যবোধ, মানুষের মর্যাদা ও সম্মান ছিল অতুলনীয়। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা ছিল সর্বোচ্চ। এই সভ্যতার হাত ধরে সুগম হয়েছিল পূত-পবিত্র এক নতুন শিল্প-সংস্কৃতির পথ।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির