শিষ্টাচার (Etiquette, Manner) বলতে নিয়ম বা রীতির সেট যা নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠী বা সামাজিক পরিস্থিতিতে গৃহীত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। অথবা সামাজিক রীতিনীতি, আদব-কায়দা, প্রথা, অভ্যাসকে শিষ্টাচার বলে যা একটা সমাজকে একটি লক্ষ্যের পথে পরিচালনা করে। এককথায় শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। পারিবারিক ঐতিহ্য, দেশীয় আচার-আচরণ মানুষের জীবনাচারকে প্রভাবিত করে। কারো চলাফেরা, কথাবার্তা, খানাপিনা, পোশাক-পরিচ্ছদে অপছন্দনীয় কিছু দেখলে আমরা বলে থাকি লোকটি Etiquette বা Manner বুঝে না। কীভাবে কথা বলতে হয় বা কীভাবে মানুষকে সম্মান দিতে হয় তা সে জানে না; শিষ্টাচার বলে তার মাঝে কিছু নেই। মানুষের আচার-আচরণ, লেনদেন ও কথাবার্তায় ভালো কিছু প্রকাশই শিষ্টাচার।
ইউরোপ-আমেরিকা বা জাপানের লোকদের শৃঙ্খলাবোধ বা আদব-কায়দা বা মানুষের প্রতি সম্মানবোধ দীর্ঘদিন লালিত সামাজিক রীতিনীতি ও পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে গড়ে উঠেছে। তাদের শিষ্টাচারকে আমরা প্রশংসা করি। মানুষের আচরণ বা শিষ্টাচার প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে উঠতে পারে আবার বিশ্বাসের ভিত্তিতেও হতে পারে। প্রাকৃতিক নিয়মে (বংশ পরম্পরায় চলে আসা) গড়ে উঠা শিষ্টাচারের পেছনে উদ্দেশ্য থাকে দুনিয়ার জীবনে সুখী ও সুন্দর জীবন-যাপন করা যাতে অন্যরা চলার পথে বাধা না দেয় এবং সবাই মিলে ভালো থাকার একটা প্রয়াস। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে সততা, অন্যের জান-মাল, মান-সম্মানকে সম্মান প্রদানসহ এমন কিছু ভালো গুণ আমরা পাশ্চাত্যে লক্ষ করি যার জন্য তারা আমাদের কাছে প্রশংসার দাবিদার। এগুলো তাদের পলিসি। তারা মনে করে Honesty is the best Policy. (সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা)।
সততা, বিশ্বস্ততা, আমানত সংরক্ষণ, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন, ধোঁকা-প্রতারণা থেকে দূরে থাকা, এগুলো মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণ। আমার উপলব্ধি, এমন সব মৌলিক মানবীয় গুণের যারা অধিকারী আল্লাহপাক দুনিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদেরকেই কর্তৃত্ব দান করেন এবং সেটিই আমরা লক্ষ্য করি। নিজের দেশের একটি শিশুকে রক্ষা করার জন্য তাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা রয়েছে, আবার অন্য দেশের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে কষ্ট লাঘব করার জন্য উদারহস্তে সাহায্য করছে। আবার কাউকে শত্রু বিবেচনা করে তাদের ওপর হাজার হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করে নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে বিবেকের দংশন একটুও অনুভব করে না। পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য তাদের সব পলিসি। কিন্তু আমাদের নৈতিকতা, শিষ্টাচারের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। দুনিয়ার জীবনে সুখী ও সুন্দর জীবন-যাপনের পাশাপাশি আমরা চাই আখেরাতের স্থায়ী জীবনের পরম সুখ ও আনন্দ। ফলে আমাদের সততা ও সদাচরণ স্রেফ পলিসি নয় আখেরাতের জীবনেও নাজাতের কারণ। তাই আমাদের সততা ও সদাচরণ শত্রু-মিত্র সবার সাথে।
আল্লাহপাক কুরআন মাজিদে নানাভাবে শিষ্টাচার শেখালেও একই স্থানে সামগ্রিকভাবে ঈমানদারাসূলভ আচরণ শেখার জন্য সূরা হুজুরাত অনন্য। ইসলামী শিষ্টাচারের মূল বিষয় হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-এর কখনোই অগ্রগামী না হওয়া। সর্বদা অনুগামী হয়ে থাকা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-এর যে কোনো কথা শুনলে বা জানলে তাৎক্ষণিক বলে উঠা ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলেন’। আল্লাহ আমার সবকিছু শোনেন ও জানেন এ বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে যে কেহ তাঁকে ভয় করে চললে তার নৈতিক পরিশুদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। মন-মানসিকতা এভাবে গড়ে তুলতে পারলে ব্যক্তির আচার-আচরণ ভদ্র ও মার্জিত না হয়ে পারে না।
মহান আল্লাহ সূরা হুজুরাতে তাঁর প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে আমাদেরকে যেসব শিষ্টাচার শিখিয়েছেন সেগুলো প্রথমেই উল্লেখ করব। কথা বলার সময় নিজের কণ্ঠস্বর অবশ্যই রাসূল (সা)-এর কণ্ঠস্বরের নিচে হতে হবে। এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে নিয়ে আলোচনা বা হাদিস শোনার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁর মর্যাদা অনুভব করে নীরবতা অবলম্বন করতে হবে। সাথে সাথে নবীর ওয়ারিস আলেম সমাজ, মুরুব্বি ও সাংগঠনিক বা অফিসের দায়িত্বশীলের সাথে কথাবার্তার সময় নিজেদের আওয়াজ অনুচ্চ রাখাও ভদ্রতা। নবী (সা)-এর সাথে সামান্য বেয়াদবি ঈমান চলে যাওয়ার শামিল। পক্ষান্তরে অন্যান্যদের সাথে ত্রুটি আদবের খেলাপ ও গুনাহ।
হুজুরাত মূলত কিছু লোকের রাসূল (সা)-এর ঘরের বাইরে থেকে উপর্যুপরি ডাকার ক্ষেত্রে আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে বাসায় কারো সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন হলে একবার কলিং বেল দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঘর থেকে কারো বের হয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। মোবাইলের যুগে পূর্বাহ্নেই তার কাছ থেকে সময় চেয়ে নেওয়া এবং মোবাইলে যোগাযোগের সময় বারবার রিং না করে অপেক্ষা করা বা নিজের পরিচয় দিয়ে মেসেজ করা। কারো ঘরে প্রবেশের সময় অনুমতি গ্রহণের সাথে তাকে সালাম দেওয়া শিষ্টাচারের অংশ। নিজেদের ঘরে প্রবেশের সময়ও সালাম দেওয়ার কথা রাসূলুল্লাহ (সা) শিখিয়েছেন এবং ঘর থেকে বের হওয়া ও ঘরে প্রবেশের সময় দোয়া ও সালাম বিনিময় আমাদের শিষ্টাচারের অংশ।
নারী ও পুরুষ একে অপরকে বিদ্রুপ করা, খারাপ নামে ডাকা, ধারণা অনুমান করা, কারো অসাক্ষাতে নিন্দা (গিবত) করা সবই শিষ্টাচারের খেলাপ ও গুনাহের কাজ। সকল মানুষ বাবা আদম ও মা হাওয়ার বংশধর এবং বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ ও পেশার ভিত্তিতে কেহ কারো অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে। ফলে গর্ব-অহঙ্কার মুসলিম সমাজে থাকতে নেই। আল্লাহর ভয় মানুষকে বিনয়ী করে।
আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা) ছিলেন সকল সৎ গুণাবলিতে ভূষিত। নবী হওয়ার পূর্ব থেকেই সততা, বিশ^স্ততা, আমানতদারিসহ নানাবিধ সৎ গুণাবলির জন্য আরববাসীদের কাছে তিনি ছিলেন আল আমিন ও আস সাদিক। আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সুরা কলম ০৪)
নবী মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনাদর্শে রয়েছে উম্মাহর পথপ্রদর্শন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (সুরা আহজাব ২১)। শিষ্টাচার মূলত উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের সমষ্টি। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’ (হাকেম ৪২২১)। রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুওতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ’ (আবু দাউদ ৪৭৭৬)।
মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম দিক। সদাচরণের সবচেয়ে বড় হকদার হলেন নিজের পিতা-মাতা এবং পর্যায়ক্রমে স্বামী/স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, চলার পথের সাথি, চাকর-চাকরানি, নিজেদের অধীনস্থ যারা, অমুসলিম অর্থাৎ আল্লাহপাকের সকল বান্দা ও তাঁর সকল সৃষ্টি। এমনকি ইতর প্রাণী ও বৃক্ষলতাও সদাচরণ পাওয়ার দাবিদার। জীব-জানোয়ারকে কষ্ট দিয়ে আটকে রাখা এবং অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতা ছেঁড়াও অপরাধ। কুরআন ও হাদিসে সবার সাথে ভালো আচরণের জোর তাগিদ রয়েছে। পিতা-মাতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বার্ধক্যাবস্থায় তাদের সাথে সামান্য বিরক্তিসূচক ‘উহ’ শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। পিতা অপেক্ষা মাতার মর্যাদা তিনগুণ বেশি। আবার পিতামাতা মারা যাওয়ার পর তাদের জন্য দোয়া করার কথা বলার পাশাপাশি দোয়া করার ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহপাকের সকল বান্দার সাথে সদাচরণের তাগিদ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আবার বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার অধীনস্থদের নিকট উত্তম। যে ব্যক্তি রুজির প্রশস্ততা ও হায়াত বাড়াতে চায় সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করে। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে পেটপুরে খায় সে মুমিন নয়। এভাবে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে, আমরা যদি যথার্থ মুসলিম হতে পারি তাহলে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নিরাপদ হয়ে যাবে।
জীবনের পরতে পরতে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের জন্য আদর্শ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ২৪টি ঘন্টা উত্তমভাবে ব্যয় করার জন্য নবী মুহাম্মদ (সা)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। একটি রাষ্ট্রের তিনিই সব একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, প্রধান বিচারপতি এতকিছুর পরও তিনি এশার নামাজের পর কোনো কথাবার্তা বলতেন না। রাতকে তিনি নিয়েছিলেন বিশ্রাম ও ইবাদত-বন্দেগির জন্য এবং দিনে তিনি থাকতেন কর্মচঞ্চল। রাত জাগা ও সকালে ঘুমানো রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে যে শিষ্টাচার শিখিয়েছেন তার পরিপন্থী। তিনি অজু করে ডান কাতে ঘুমাতেন এবং ঘুমানোর পূর্বে সুরা ফালাক ও নাস পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন।
খানাপিনার ক্ষেত্রে তিনি সকল হালাল খাবার গ্রহণ করেছেন। তবে কোনো খাবার অপছন্দ হলে তার দোষত্রুটি বা রান্নার ত্রুটি না বলে এড়িয়ে চলতেন। তিনি মধু, খেজুর এবং সব্জি হিসেবে লাউ পছন্দ করতেন। তিনি দস্তরখানা বিছিয়ে খাদ্য গ্রহণ করতেন এবং অপচয়কে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। খাওয়া শেষে তিনি প্লেট ও আঙুলগুলো চেটে চেটে খেতেন। অপচয়কারীকে আল্লাহপাক শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। খাওয়ার পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে খেতেন এবং ধীরে ধীরে খেতেন ও খাওয়ার শেষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। সাহাবীদের সাথে একত্রে খানা খাওয়ার সময় নিজের নিকট থেকে খানা গ্রহণ করতেন। তিনি সবসময় পরিমিত ও ক্ষুধা লাগলে খেতেন। খাওয়ার গ্রহণের সময় তিনি একভাগ খাদ্য, একভাগ পানি ও একভাগ খালি রাখার কথা বলতেন। খাদ্য অপচয় করা ও ভূরিভোজ রাসূল (সা) প্রদত্ত শিষ্টাচারের পরিপন্থী।
মসজিদে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দিয়ে এবং বের হওয়ার সময় বাম পা আগে দিয়ে বের হওয়া রাসূল (সা) প্রদত্ত শিষ্টাচার। প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ পড়ে প্রথম কাতারে মেহরাবের কাছাকাছি বসা এবং জায়গা না থাকলে দ্বিতীয় কাতারে বা পর্যায়ক্রমে বসা। আগের কাতারে জায়গা খালি রেখে পেছনে বসা এবং মানুষকে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে আগে যাওয়াও আদবের খেলাপ। এতেকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করে দেওয়া ও জিকির-আযকার করা এবং হৈ চৈ না করে চুপচাপ থাকা মুহাম্মদ (সা)-এর শেখানো শিষ্টাচার।
রাসূলুল্লাহ (সা) আগে মানুষকে সালাম দিতেন এবং সালামের ব্যাপক প্রচলনের জন্য সাহাবীদের তাগিদ দিতেন। ছোট বড়, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে মানুষের সাথে সালাম বিনিময় করতেন এবং সালাম বিনিময় ও ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান সর্বোত্তম আমল বলেছেন। রাসূল (সা) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং গর্ব-অহঙ্কারকে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। অগ্রিম সালাম দেওয়ার মাধ্যমে বিনয় প্রকাশ পায়। তিনি হাতে ধরে তাঁর উম্মতকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।
রাস্তায় চলার ক্ষেত্রেও প্রিয়তম নবী (সা) আমাদের শিষ্টাচার শিখিয়েছেন। রাস্তার ডানদিকে ও দৃষ্টি সংযত রেখে চলতে বলেছেন। কোনো কষ্টদায়ক জিনিস রাস্তায় পড়ে থাকলে সেটা সরিয়ে ফেলায় রয়েছে সওয়াব। রাস্তার ধারে ও পানির কিনারায় মলমূত্র ত্যাগকারীকে লানত করেছেন। অথচ দূর্গন্ধের কারণে আমাদের রাস্তায় চলাফেরা করা দায়।
ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান প্রদান, তাদের কল্যাণ সাধন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-এরই তাগিদ। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তোমরা সর্বোত্তম দল। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে’ (সুরা আলে ইমরান ১১০)। মদিনায় একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের সাথে অবস্থান করছিলেন। এমন সময়ে একটি লাশ আসতে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে যান। সাহাবিরা বলেন, একজন ইহুদির লাশ। রাসূল (সা) বলেন, একজন মানুষের লাশ। আলী (রা) মসজিদের দিকে এগিয়ে যেতে সামনে একজন বয়োবৃদ্ধ ইহুদিকে পান। তাকে ক্রস করে যেতে তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করেন। তাঁর এমন আচরণ আল্লাহর কাছে খুব পছন্দনীয় হয়। আল্লাহপাক তাঁর নবী (সা)-কে জানিয়ে দেন। আলী (রা) জামাতে শরীক না হওয়া পর্যন্ত রাসূল (সা) রুকু দীর্ঘ করেন। বাসে বা রাস্তায় চলতে কোনো বয়োবৃদ্ধ কাউকে দেখলে সালাম দেওয়া এবং উঠে সিটে বসতে দেওয়াটা আমাদের শিষ্টাচার। আবার শিশু দেখলে তাকে আদর করাও আমাদের সংস্কৃতি। এমনসব শিষ্টাচার আমরা রপ্ত করেছি আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-এর কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়’। অর্থাৎ তারা ইহুদি না খ্রিষ্টান তা আল্লাহর রাসূল (সা)-এর দেখার বিষয় নয়, সে যে মুসলিম সমাজের বাইরে এটাই সত্য।
ওজনে কমবেশি বা ধোঁকা-প্রতারণা করে মানুষকে ঠকানো ইসলামী শিষ্টাচার বহির্ভূত। কারণ আমাদের মহান মনিব আল্লাহপাক সতর্ক করেছেন, ‘যারা নেওয়ার সময় পুরোপুরি নেবে আর দেওয়ার সময় কম দেবে, এমন লোকদের জন্য রয়েছে ধ্বংস’ (সূরা আল-মুতাফফিহিন ১-২)। একজন বিশ^া সী ব্যক্তির নিকট থেকে লেনদেন করলে কোনো সন্দেহ-সংশয় ছাড়া পূর্ণ প্রশান্তির সাথে যে কেউ করতে পারে। আবার মানুষের জীবন, ধনমাল ও সম্মান অত্যন্ত পবিত্র। একজন বিশ^াসী ব্যক্তির কাছে সবাই নিরাপদ।
রাসূল (সা) বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়।’ আল্লাহপাক বলেছেন, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে’ (সুরা আল হুমাজা : ১-২)। অর্থাৎ যারা মানুষকে হেয় করে, অপদস্থ করে, সম্মান ক্ষুণœ করে তাদের প্রতি আল্লাহর চরম ক্রোধ প্রকাশিত হয়েছে এ সূরায় এবং সে জালেমের স্থান হবে দাউ দাউ করা জ্বলা হুতামায়। আর হুতামার পরিচিতি দিয়েছেন আল্লাহ নিজেই বলেছেন তা আল্লাহর আগুন, প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত ও উৎক্ষিপ্ত। মনে রাখতে হবে অসংখ্য নেয়ামতে ভরা যে জান্নাত আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন তাতে কোনো জালেমের ঠাঁই নেই।
প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা) আমাদের সামগ্রিক জীবনে চলার পথে যে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন তা যদি বাস্তবিক অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে আল্লাহপাকের ঘোষণা মোতাবেক আমরা হতাম শ্রেষ্ঠতম জাতি এবং সমগ্র বিশ^কে শাসন করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা আল্লাহ আমাদের দান করতেন। সুরা নূরের ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহপাক জমিনে খেলাফত (রাজত্ব) দানের সুস্পষ্ট ওয়াদা করেছেন এবং তাতে শর্ত আরোপ করেছেন এক) ঈমান দুই) নেক আমল। আমরা কাজ না করার নাম রেখেছি নেক আমল। আমরা কুরআন পড়ি ¯্রফে সওয়াবের আশায়, কুরআন থেকে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে নয়। কুরআন-হাদিস যে কাজ করতে আদেশ করে সেটি সম্পন্ন করা এবং যে কাজ করতে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকার নামই নেক আমল। যা পড়ি ও বিশ^াস করি বলে দাবি করি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। এতো ঘুষ-দুর্নীতি, অনাচার, গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন মুসলিম প্রধান দেশে হওয়া স্বাভাবিক নয়। আমাদের লেবাস ও আনুষ্ঠানিকতায় ছিটেফোঁটা থাকলেও স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ ও লেনদেনে ইসলাম একেবারেই অনুপস্থিত। আল্লাহপাক আমাদের মাঝে সঠিক উপলব্ধি দান করুন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।
আপনার মন্তব্য লিখুন