post

রূহ ও কলব : স্বরূপ ও প্রকৃতি

রেদওয়ান রাওয়াহা

০৭ মে ২০২২

রূহ শব্দটি আরবি। এটি একবচন। বহুবচনে আরওয়াহ। যার বাংলা হলো আত্মা বা প্রাণ। এই যে সুন্দর এক পৃথিবী, আমরা যে এই পৃথিবীতে খুব সুন্দর করে চলাচল করি, এই জীবনকে এত দারুণভাবে উপভোগ করি, এসব পারি কেন? পারি এই রূহ বা আত্মার জন্যই। রূহ-ই আমাদের জীবন্তসত্তা। এটা এমন এক অশরীরী বস্তু, যা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি। হবেও না। পবিত্র কুরআনুল কারিমে রূহ শব্দটি অনেকবার এসেছে। আল্লাহ রূহ সম্পর্কে বলেন, ‘অতএব যখন আমি তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবো এবং তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা তার জন্য সিজদাবনত হও।’ (সূরা সোয়াদ : ৭১-৭২)

আল্লাহর রাসূলের কাছেও এই রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো। জবাবে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সা. কী বলেছেন, সেটার বিষয় আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে কী জানিয়েছেন, তা পবিত্র কালামুল্লাহতে এভাবেই এসেছে- “তারা আপনার নিকট রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলে দিন, রূহ আল্লাহর একটি আদেশ মাত্র।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৮৫) রূহ সম্পর্কে এরচেয়ে বেশি কিছু কুরআন বা ইসলাম আমাদের জানায় না। কোনো তাত্ত্বিক আলোচনাও হাজির করে না।

তবুও রূহের হাকিকত নিয়ে মানবসমাজে এবং ইসলামী মহলেও মতবিরোধ আছে। এই রূহের পাশাপাশি আল্লাহ আমাদেরকে একটা দেহও দিয়েছেন। সেই দেহের একটা সুন্দর অবয়বও দিয়েছেন। মহান আল্লাহর আদেশে যতক্ষণ একটি প্রাণীর দেহে রূহ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ ওই প্রাণী জীবিত থাকে। এর এক মাইক্রোসেকেন্ড আগেও কেউ মরে না। তাকে কেউ মারতে পারবেও না। এবং এক মাইক্রোসেকেন্ডের পরেও কেউ তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪৫)

সোজা কথায়, আমাদের দেহের অভ্যন্তরে যতদিন রূহ থাকে আমরা ততদিন-ই বেঁচে থাকি এ-ধরায়। যেদিন রূহ আল্লাহর আদেশে আমাদের দেহ থেকে বেরিয়ে যায়, সেদিনই আমরা নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে পড়ি। রূহের বিচ্ছেদে আমরা হয়ে পড়ি স্রেফ একটা লাশ। এই লাশটাও আর সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে দুনিয়ায় থাকতে পারে না। কেউ-ই এ লাশটাকে আর কাছে রাখে না। আমাদের প্রিয়জন-স্বজন, যাদেরকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতাম, সে তারাই আমাদের রূহবিহীন নিথর দেহটা আর কাছে রাখে না। রাখতে পারেও না। যে দেহটায় সামান্য একটু দুর্গন্ধ হয়ে পড়লে আমরা নানান পারফিউম ও বডি স্প্রে কিংবা আতর মাখিয়ে সুরভিত ও সুভাসিত করে রাখি, সে দেহটা-ই পরবর্তীতে পচে-গলে একাকার হয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। একটু বেশি সময় জমিনের ওপরে রাখলেই দুর্গন্ধ ছড়ানো শুরু করে। যে দেহটার জন্যই আমাদের প্রতি মানুষ আকর্ষিত হয়, সে দেহটাকেই আবার মানুষ খুব তাড়াহুড়ো আর যত্ন করে মাটির নিচে চাপা দিয়ে আসে। কিন্তু আত্মা বা রূহ থেকে যায়। তাকে মাটির নিচে চাপা দেওয়া যায় না। কবরে সমাহিত করা যায় না। তা মরেও না। ¯্রফে মৃত্যুর স্বাদটা শুধু গ্রহণ করে। তো যে আত্মার জন্য আমরা জীবিত, যে আত্মার জন্য আমাদের এতো দাম। সে আত্মাটিও তো কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে রোগাক্রান্ত। দেহ রোগক্রান্ত হলে আমরা তার চিকিৎসা করাই। কিন্তু আত্মারও অসুখ আছে, সেটার বিষয়ে আমরা সচেতন থাকি না। থাকি উদাসীন। অথচ এই আত্মারও যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তার রোগসমূহেরও প্রতিকার-প্রতিরোধ প্রয়োজন। আত্মা যখন অসুস্থ হয়, তখন তা চিকিৎসা খোঁজে। দেহের মতো আত্মারও প্রশান্তি প্রয়োজন। সুস্থতার প্রয়োজন। যত্ন প্রয়োজন।

রূহ বা আত্মা ধরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে না। সে ধীরে ধীরে রোগাক্রান্ত হয়। অসুস্থ হয়। আমাদের দেহের মধ্যে একটা মাংসপিণ্ড আছে। সেটা যদি ঠিক থাকে তাহলে আমাদের সব ঠিক। সেটা অসুস্থ হয়ে গেলে আমাদের রূহের পাশাপাশি দেহও অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমরা এ কথাটিই জানতে পারি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর  রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে। তিনি বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব।’ (বুখারি-৫২)

কলবের একটা অর্থ হৃদয় বা অন্তর। এই কলব সম্পর্কেও মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে। আর সেসব আয়াতে কারিমায় কলবের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আলোচনার উল্লেখ রয়েছে। যেমন, ‘তাদের কলবগুলোতে রোগ আছে।’ (সূরা বাকারা : ১০)

রোগাক্রান্ত কলবের ক্ষতি কেমন, তা-ও পবিত্র কালামুল্লাহ মাজিদে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা উল্লেখ করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের কলব রয়েছে, কিন্তু তারা তা দ্বারা বোঝে না।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯) তার মানে অসুস্থ-রোগাক্রান্ত অন্তরের অধিকারী ব্যক্তির দ্বারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, দ্বীনের বিধি-বিধান বুঝা সম্ভব নয়। অনুধাবন করা সম্ভব নয় সত্যকে। সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ একই আয়াতে পশুর সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন।

এভাবে যদি কলব বা অন্তর অসুস্থ হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে পড়ে; তখন ধীরে ধীরে আমাদের সামগ্রিক সত্তাটা-ই পাপিত হয়ে যায়। এবং আমরা পশুর চেয়েও অধম হয়ে পড়ি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা-ই তা বলেছেন। পাপের পরিণতিতে আমাদের রূহ এবং দেহও অসুস্থ হয়ে পড়ে। অশান্ত হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে আমরা আল্লাহর অবাধ্যতার কাজ করে যাই হররোজ। এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন, “শরীরের রোগ থেকে অন্তরের রোগসমূহ আরো কঠিন। কারণ শারীরিক রোগ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। কিন্তু অন্তরের রোগ মানুষকে অনন্তকালের দুর্ভাগ্যের (জাহান্নামের) দিকে নিয়ে যায়।” (মিফতাহু দারিস সায়াদাহ, ১/৩০৬)

অন্তরের এই রোগগুলো কী কী?  বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম মুজতাহিদ আলিমে দ্বীন, শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদের রচিত কিতাবে অন্তরের রোগ হিসেবে যেগুলোই উঠে এসেছে। সেগুলো হলো, প্রবৃত্তির অনুসরণ, দুনিয়ার মহব্বত, নিফাকি, মাখলুকের প্রেমাসক্তি, গাফিলতি, ঝগড়া-বিবাদ, অহঙ্কার, নেতৃত্বের লোভ। এ ছাড়াও যেগুলো হৃদয়কে কলুষিত করে, অন্তরকে নষ্ট করে, তা হচ্ছে; হিংসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, প্রদর্শনেচ্ছা, অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যসহ ইত্যাদি। এগুলোই পাপিত-রোগগ্রস্ত কলবের নমুনা। এসব কারণেই অন্তরের শান্তি হারিয়ে যায়। হৃদয়টা প্রশান্তিহীন অস্থির হয়ে পড়ে। হৃদয়-মনে সব সময় সর্বাবস্থায়-ই অস্থিরতা বিরাজ করে।

এই যে পাপিত-রোগগ্রস্ত অশান্ত কলব, প্রশান্তিহীন হৃদয়, অস্থির আত্মা, যখন তাতে শান্তি থাকে না, তখন কিভাবে সেটায় প্রশান্তি পাওয়া যায়, পবিত্র কুরআন মাজিদ তা আমাদেরকে জানিয়ে দেয় এভাবে, “নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।” (সূরা রা’দ : ২৮)

এ সম্পর্কে তথা আল্লাহর স্মরণের উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার প্রভুর স্মরণ করে আর যে করে না, তাদের উদাহরণ হলো জীবিত এবং মৃত ব্যক্তির ন্যায়। তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশোবার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ পাঠ করবে, তার পাপ যদি সমুদ্রের ফেনার সমতুল্যও হয়, তবুও আল্লাহ দয়া করে তা ক্ষমা করে দিবেন।” (বুখারি-৬৪০৫/০৭)

রাসূলুল্লাহ সা. আরো বলেন, যে ব্যক্তি দিনে একশোবার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ও-লাহুল হামদু ও-হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির’ পড়ে সে ব্যক্তি দশটি দাস স্বাধীন করার সওয়াব পাবে, তার জন্য একশোটি নেকি লেখা হবে এবং তার একশোটি গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে। ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে তার রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তার চেয়ে উত্তম আর কেউ হবে না। (বুখারি-৬৪০৩)

এভাবে আমরা যদি আমাদের কলবকে আল্লাহর জিকিরে-ফিকিরে ব্যস্ত রাখতে পারি, তাহলে ইনশাআল্লাহ রোগ এসে বাঁধবে না। কোনো রোগ (পাপ) যদি আমাদের আঘাত করে, আক্রমণ করতে আসে, তখন সে রোগ স্থায়ী হতে পারবে না। আমাদের আত্মাকে চিরস্থায়ী আখেরাতে আজাবের মুখোমুখি হওয়া লাগবে না। আমরা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমেই আত্মার যত্ন নেয়াটা সম্ভবপর হবে। অন্তরের এই যে রোগ, এ-রোগের সুস্থতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়াও একটা চমৎকার সাজেশন দিয়েছেন। তিনি বলেন, কলবকে অসুস্থতা থেকে সুস্থতায় পরিণত করা কেবল ইলমের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই তো আল্লাহ তার কিতাবের নাম দিয়েছেন অন্তরের রোগসমূহের সুস্থতা। আর এ কারণেই শরীরের চিকিৎসক ডাক্তারেরা আর অন্তরের চিকিৎসক আলিমেরা।” (মিফতাহু দারিস সায়াদাহ- ১/৩০৫) এখান থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? তা হচ্ছে এই যে, আমরা কুরআনের ইলম অর্জন করবো। আর আলিমদের সংস্পর্শে থাকবো। আর আল্লাহকে ভালোবাসবো। কারণ, এই দুনিয়ায়ও তো আমরা যাকে ভালোবাসি, তার কথা-ই হরহামেশা স্মরণ করি। চিন্তা-ভাবনার বিশাল একটা অংশজুড়ে থাকে সে ভালোবাসার ব্যক্তিটি কিংবা সে বস্তুটি। আর যদি আমরা সত্যিকারের-ই আল্লাহর ভালোবাসার দাবিদার হই, কিংবা ভালোবাসি, তাহলে অবশ্যই আমাদের ধ্যান-ধ্যারণায়, আমাদের চিন্তা-ভাবনায় বিরাজিত থাকবে আল্লাহর জিকির-ফিকির। আসলে এটাই কলব বা অন্তরের স্বরূপ-প্রকৃতি। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে একটা মজলিশে ওনার কিছু ছাত্রবৃন্দ অন্তরের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “অন্তরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য। আল্লাহর ভালোবাসা-ই হলো অন্তরের আসল স্বভাব বা প্রকৃতি।”  (রূহের চিকিৎসা : ৭৬ পৃষ্ঠা)

এবার আমরা পুনরায় রূহ বা আত্মার আলোচনায় ফিরে যাই। আমরা রূহ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছি, সেখানে বলেছি এই রূহ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। মতবিরোধ আছে। তো মতবিরোধগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রূহের মৃত্যু আছে কিনা? তার মৃত্যু হয় কি না? এক্ষেত্রে কোনো কোনো আলিম বলেন রূহেরও মৃত্যু হয়। তাঁরা দলিল হিসেবে সূরা কাসাসের ৮৮, মুমিনের ১১ এবং বাকারার ২৮ নাম্বার আয়াতসমূহ উপস্থাপনা করেন। আর যারা বলেন রূহ মৃত্যুবরণ করে না, তারা দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন সূরা আলে-ইমরানের ১৬৯-৭১ নাম্বার আয়াতকে। তারা বলেন, রূহকে সৃষ্টিই করা হয়েছে জীবিত থাকার জন্য। (রূহের রহস্য, ইমাম ইবনুল কায়্যিম : ৭৪ পৃষ্ঠা)

আলিমদের এই মতবিরোধ থেকে আমরা স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় মতটিকেই সত্যের অধিক কাছাকাছি বলে গ্রহণ করতে পারি। সে জন্য আমরা শুরুতেই বলেছি যে, রূহের মৃত্যু হয় না। শুধু মৃত্যুর স্বাদটাই সে গ্রহণ করে। সে হিসেবে আমরা রূহ সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তে আসতে পারি, বা রূহ সম্পর্কে যে বিষয়টি বলতে পারি তা হচ্ছে রূহ হলো এক প্রকার শক্তি। আর বিজ্ঞানের ভাষায় শক্তির একটা পরিচয় হচ্ছে যার বা ধ্বংস নেই, এটি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপ নিতে পারে এবং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে যেতে পারে। সে হিসেবে রূহ-এরও বিনাশ নেই। কিন্তু সৃষ্টি আছে। আল্লাহ তা সৃষ্টি করেন। মানুষের মৃত্যুর পর রূহ দুনিয়া থেকে আলমে বরযখে স্থানান্তরিত হয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি রূহ কেবল দেহ ত্যাগ করে মাত্র, তার মৃত্যু হয় না। রূহ সম্পর্কে প্রায় এমন কথাই বলেছেন মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী (রহ)। তিনি বলেন, “রূহ এক প্রকার আলোকবিন্দু। যা পরিবর্তনশীলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মুক্ত বিভিন্ন পদার্থের সংমিশ্রণ থেকেও। তিনি আরো বলেন, এটা ছোট-বড়, কালো-সাদা, এ ধরনের সকল বিপরীত অবস্থার মধ্যে একই থাকে। এর কোনো প্রকার বিবর্তন বা বিভক্তি হয় না।” (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ : ১/৫২)

একথাগুলো কেনো বললাম? বলেছি এই জন্য যে, মুমিন-কাফির, নেককার-ফাসেক নির্বিশেষে আমরা সবাই তো মৃত্যুবরণ করি; যখন আমরা মৃত্যু বরণ করি, যখন আমাদের রূহ কবয করা হয়, তখন আমাদের রূহের সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়? কী ব্যবহার করা হয়? সেটা বলার জন্য। যাইহোক, এবার তাহলে সেটা বলি।

রূহকে যখন দেহ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, কবয করা হয়, তখন দেহ তা দেখতে থাকে। মালাকুল মাউত যখন রূহ কবয করেন, তখন অন্যান্য মালাইকারা তার থেকে সে রূহ নিয়ে যান। রূহটা যদি সলিহিন বা মুত্তাকি বান্দাদের রূহ হয়, তাহলে সে রূহ সুগন্ধি ছড়ায়। চারিদিক সুঘ্রাণে মাতোয়ারা করে রাখে। আর যদি তা বদকারদের রূহ হয় তাহলে তা পচা-গলা লাশের চেয়েও উৎকট আর বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়ায়। মুমিন বান্দার রূহের জন্য আসমানের ফেরেশতারা অবিরত দু’আ করতে থাকে। সে রূহের জন্য আসমানের দরোজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। পাখির ন্যায় সে রূহ জান্নাতের গাছগাছালি থেকে ফলফলাদি চরম তৃপ্তির সাথে খেতে থাকে।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে আমরা জানতে পারি যে, মৃত্যুর সময় মানুষের কাছে মালাইকা আগমন করে। মৃত্যুমুখে পতিত ব্যক্তি যদি সলিহিন হয়, তখন তারা বলেন, “হে পবিত্র আত্মা, পবিত্র দেহ থেকে প্রশংসিত অবস্থায় বের হয়ে এসো। আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের শুভসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। এভাবে তারা রূহ বাহির হওয়ার আগ পর্যন্ত আহ্বান জানাতে থাকে। যখন রূহ বের হয়ে আসে, তখন তারা তা নিয়ে আসমানে আরোহণ করেন। এ রূহের জন্য আসমানের দরোজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। অন্যান্য মালাইকাগণ জিজ্ঞেস করে এই ব্যক্তি কে? বলা হয় অমুক ব্যক্তি। তখন বলা হয়, পবিত্র আত্মাকে স্বাগতম, যা ছিল পবিত্র দেহে। প্রশংসিত অবস্থায় তুমি প্রবেশ করো। আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তাকে অবিরত এ সংবাদ প্রদান করা হয়, ততক্ষণ অবধি, যখন তা মহামহিম আল্লাহ যে আসমানে অবস্থান করেন সেখানে পৌঁছে যায়।’

‘মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি পাপাচারী হয়, তখন মালাইকাগণ এসে বলেন, হে নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মা, নিন্দিত অবস্থায় বের হয়ে আসো এবং উত্তপ্ত গরম পানি ও রক্ত-পুঁজের দুঃসংবাদ গ্রহণ করো এবং অনুরূপ বহু বিষাক্ত বস্তুরও। রূহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবেই আহ্বান জানাতে থাকেন। অতঃপর তাঁরা রূহসহ ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেন। কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না। জিজ্ঞেস করা হয় এ ব্যক্তি কে? বলা হয় অমুক। তখন বলা হয়, নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মার জন্য নেই কোনো সাদর সম্ভাষণ। তুই নিন্দিত অবস্থায় ফিরে যা। কারণ তোর জন্য আকাশের দ্বার খোলা হবে না। (ইবনে মাজাহ-৪২৬২)

যে সমস্ত মুমিন আল্লাহর রাহে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, সেসব সৌভাগ্যবানদের রূহ জান্নাতের দরোজায় দীপ্তমান নহরে সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট স্থানে থাকবে, সকাল-সন্ধ্যা তাদের জন্য জান্নাত থেকে খাবার আসবে। (মুসনাদ আহমাদ-২৩৯০)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কোনো (মুমিন) ভাই মৃত্যুবরণ করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তার রূহকে সবুজ পাখির পেটে রেখে দেন। আর সে রূহ সবুজ পাখির পাকস্থলীতে করে জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে উড়ে বেড়ায়। (আবু দাউদ-২৫২০)

সাঈয়িদুনা আলী ইবনে আবু তালিব রা. বলেন, “মুমিনদের রূহ জমজম কূপে রাখা হয়। আল্লাহর রাসূলের আরেকজন বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী করিম সা. বলেছেন, নিঃসন্দেহে মুমিনদের রূহসমূহ সপ্তম আসমান থেকে তাঁরা জান্নাতের দৃশ্যাবলি অবলোকন করেন।” (শরহুস সুদুর বিশারহি হালিল মাওতা ওয়াল কুবুর, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি : ২৩৫-৩৭ পৃষ্ঠা)

সোজা কথায় মুমিনদের রূহ তাদের মর্যাদার মাপকাঠি অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে। তবে যারা নিকৃষ্ট পাপাচারী, কাফির-মুশরিক, তাদের রূহ থাকে সিজ্জিনে। তাদের রূহ বা আত্মাকে সেখানে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। সেখানে তারা আল্লাহর আজাবের যে ভয়ানক কষ্ট, তা অনুভব করতে থাকে।

আমরা শেষ পর্যায়ে যা বলতে চাই, তা হলো, আল্লাহ আমাদেরকে আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের দেহ মরে গেলেও আত্মা মরে না। আমাদের কর্মের ওপর নির্ভর করে তার স্থান কোথায় হবে। যদি ভালো কাজ করি, কেয়ামতের আগ অবধি রূহ ইল্লিনে থাকবে। আর খারাপ কাজ আল্লাহর অবাধ্যতার কাজ করলে থাকবে সিজ্জিনে। তো আমাদের দেহের ও আত্মার পরিচালনা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে কলবের ওপর। যদি আমাদের কলবটা আল্লাহর জিকির-ফিকিরে নিমজ্জিত থাকে, মশগুল থাকে, তবে আমরা আমাদেরকে তথা আমাদের দেহকে আর রূহকে আল্লাহর অবাধ্যতায় পরিচালিত করবো না। তাঁর পথেই কাজ করবো। তাঁর সন্তুষ্টির পথেই চলবো। যদি সেভাবে আমরা আল্লাহর স্মরণে থাকি তাহলে আমাদের রূহ বা আত্মা শান্তিতে থাকবে। আরাম আর আনন্দে থাকবে। সে কারণেই রূহের মধ্যে কলবের আলোচনা এনেছি। চেষ্টা করেছি রূহ আর কলব নিয়ে একটু ধারণা দেয়ার। আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাত উপযোগী বান্দা হিসেবে কবুল করুন। তাঁর দেখানো পথে আমাদের শরীর ও আমাদের অন্তরকে পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন! 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির