post

শাবান মাসের মর্যাদা

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

রমাদানের আগমনী বার্তা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর দুয়ারে কড়া নাড়ল মাহে শাবান। রাসূলুল্লাহ সা. শাবান মাস থেকেই রমাদানের প্রস্তুতি নিতেন। রজব ও শাবানে তিনি রমাদানের অধীর অপেক্ষায় থাকতেন। হজরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, ‘‘রাসূল সা. শাবান মাসের (দিন-তারিখ হিসাব) প্রতি এত অধিক লক্ষ্য রাখতেন যা অন্য মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না।’’ (আবু দাউদ)

শাবান মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। আরবিতে এই মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ মহান শাবান মাস। ‘শাবান’ শব্দের অর্থ দূরে ও কাছে, মিলন ও বিচ্ছেদ এবং সংশোধন বা সুশৃঙ্খলা ও ফ্যাসাদ বা বিশৃঙ্খলা। শাবান মানে দু’টি শাখা বা সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈশাদৃশ্যপূর্ণ। বিপরীতধর্মী দু’টি  বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এ যেন একই অঙ্গে দু’টি রূপ। যেমন দু’টি শাখা ভিন্ন হলেও একই কাণ্ড মূলে মিলিত; হাতের পঞ্চ আঙুল ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একই সঙ্গে কাজ করে। অর্থাৎ ভিন্নতায়ও ঐক্য। শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুস্পষ্ট। যেহেতু এই মাসটি রজব ও রমাদানের মধ্যবর্তী, তাই এই মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর রহ.)

হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’। এই মাসটি বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; অর্থাৎ পূর্ব কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে  ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই মাসে। ‘‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমণ্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। সুতরাং কিবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে  দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মাসজিদুল হারামের (কাবা শরিফ) দিকে চেহারা ঘোরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ওই (কাবা) দিকেই মুখ ফেরাও।’’ (সূরা বাকারা : ১৪৪) 

তাই শাবান মাস একদিকে ইসলামী ঐক্যের মাস, অন্যদিকে কাবাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।

রাসূলুল্লাহ সা. রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান।” অর্থ : ‘‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমাদান আমাদের নসিব করুন।’’ (মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ., প্রথম খণ্ড : ২৫৯, বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, ৩ : ৩৭৫)

রাসূলুল্লাহ সা. শাবান মাসের দিন-তারিখের হিসাব রাখার গুরুত্বারোপ করেছেন। এ মাসে অধিক হারে নফল রোজা রাখা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। হজরত উম্মে সালমা রা. বলেন, “আমি রাসূল সা.কে শাবান ও রমাদান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি।” 

হজরত আয়েশা রা. বলেন, ‘‘আমি নবী কারিম সা.কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা আর অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প কয়েক দিন ছাড়া বরং বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন।’’ (তিরমিজি)

এই শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। শবেবরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত বা রজনী আর বরাত মানে মুক্তি; সুতরাং শবেবরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। ‘শবেবরাত’ আরবিতে হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রজনী। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে।

ইমাম আবু জাফর আত-তাবারি (রহ.) বলেন, ‘তাবেয়ি হজরত ইকরামা রা.  থেকে বর্ণিত, “তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাতে বছরের সব ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজীদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে পরবর্তীতে একজনও কমবেশি হয় না।’’ (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ২২)

ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন, ‘‘এ রাতের চারটি নাম আছে- লাইলাতুম মুবারাকা, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুছ্ ছাক, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।’’ (তাফসিরে কুরতুবি, খণ্ড ১৬, পৃষ্ঠা ১২৬) 

ইমাম বাগাভি (রহ.) লিখেন, ‘‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শবেবরাতের রাতে সব বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবেকদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন।’’ (তাফসিরে বাগাভি, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২২৮)। শবেবরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে সহিহ হাদিস শরিফেও অনেক বর্ণনা এসেছে। আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, “একবার রাসূলুল্লাহ সা. নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি ওফাত পেয়েছেন। আমি তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! আপনার দীর্ঘ সেজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, না জানি আপনি ওফাত পেয়েছেন? নবীজি সা.  বললেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই ভালো জানেন। তখন নবীজি সা. বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।” (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২) 

হজরত আয়েশা রা. থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সা. এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকিতে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করতেন। প্রিয়নবী সা. তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের সংখ্যার পরিমাণের চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।” (তিরমিজি-৭৩৯)

একদিন প্রিয়নবী সা. আম্মাজান আয়েশা রা.কে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে তুমি কী জান? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা. শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা কী? আল্লাহর হাবিব সা. উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে এবং কতজন আদম সন্তান মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে তাদের আমল মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিজিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়।” (ফাজায়েলুল আওকাত-২৬)

হজরত আবু মূসা আশয়ারি রা. রাসূলে কারিম সা. থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলে পাক সা. ইরশাদ করেন, “মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহপাক রহমত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং তার সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না।” (ইবনে মাজাহ-১৩৮৯)

হজরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সা. বলেছেন, “১৪ই শাবান দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদাত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ; কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে রহমত নিয়ে অবতরণ করেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ-১৩৮৪)

শাবান মাস ইবাদাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দরূদ শরিফ, জিকির, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সাদাকাহ-খয়রাত, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির