post

‘ইসলামী আন্দোলন’ কী

ড. ইউসুফ আল কারযাভী অনুবাদ : সাজ্জাদ হোসাইন খাঁন

২৩ জানুয়ারি ২০২৪

ইসলামী আন্দোলন কী

“ইসলামী আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি এমন জামাতবদ্ধ (সম্মিলিত) সুশৃঙ্খল জাতীয় কার্যক্রম, যার মাধ্যমে ইসলামকে সমাজের নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনা যায় এবং মানবজীবনের সকল  দিক ও বিভাগকে ইসলামের আলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা যায়।

সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের মূলকথা হলো-সর্বাগ্রে কাজ করা। সক্রিয়তাই হলো ইসলামী আন্দোলনের প্রাণ। ধারাবাহিক, বিরতিহীন ও অক্লান্তভাবে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাওয়া। ইসলামী আন্দোলন শুধু কথার কথা নয়; নয় নিছক কথার ফুলঝুরি। ইসলামী আন্দোলন কোনো মাঠ গরম করা বক্তৃতা নয়। অথবা কোনো সুবিশাল হলরুমের সুশীতল এসির বাতাসমাখা ঠাণ্ডা লেকচারও নয়। ইসলামী আন্দোলন আবার শুধু গ্রন্থ রচনা করাও নয়। নয় পত্রিকার পাতায় প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লেখা। যদিও এ সবকিছু ইসলামী আন্দোলনের জন্য দরকার- এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবই মূল বিষয় নয়। এসব কাজও ইসলামী আন্দোলনের অংশ; তবে এগুলোই ইসলামী আন্দোলন নয়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বাণী- “আপনি বলে দিন- তোমরা কাজ করে যাও, আল্লাহ তায়ালা অচিরেই তোমাদের কাজ দেখবেন; আরও দেখবেন রাসূল ও মুমিনরাও।” সূরা তাওবা : ১০৫

ইসলামী আন্দোলন : একনিষ্ঠ জাতীয় কাজ

ইসলামী আন্দোলন একটি জাতীয় কাজ। এই কাজের ভিত্তি হলো-ঈমানের সাথে, সওয়াবের প্রত্যাশায় ব্যক্তিসত্তার জাগরণ এবং ব্যক্তিগত প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা। এই কাজের প্রতিদানের সব আশা-প্রত্যাশা থাকবে আল্লাহ তায়ালার কাছে; মানুষের কাছে নয়।

ব্যক্তিসত্তার এই জাগরণের মূলকথা হলো- একজন মুসলিমের হৃদয়ে যখন ইসলামের পথে চলার প্রেরণা সৃষ্টি হয়, ইসলামের আলোয় জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে আলোকিত করার চেতনা ফিরে আসে এবং ঈমানের নূরে মনন আন্দোলিত হয়, তখন তার সামনে একদিকে এসে দাঁড়ায় ঈমান ও বিশ্বাস এবং অন্যদিকে সামাজিক নানা বাধা-প্রতিবন্ধকতা। সে তখন দ্বীনের ভালোবাসাকেই প্রাধান্য দেয়। তার হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি, রাসূল সা.-এর প্রতি, কুরআনে কারিমের প্রতি ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি কল্যাণ কামনার ঝরনাধারা বইতে থাকে। তার মনে একধরনের ঘাটতি ও অসম্পূর্ণতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, নিজের অসম্পূর্ণতা ও তার চারপাশের সমষ্টির অসম্পূর্ণতা। তার মধ্যে সৃষ্টি হয় স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করার প্রতি প্রবল আগ্রহ। আল্লাহ তায়ালার বিধিবিধান ও ফারায়েজের মধ্যে যেসব বিধান মানুষ আদায় করে না, বরং পরিত্যাগ করেছে, সেসব বিধানকে আবার পুনর্জীবিত করার, অসম্পূর্ণ বিধানকে পূর্ণতা দেয়ার, আল্লাহর কালিমার ছায়াতলে মুসলিমদের একত্রিত করার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় আল্লাহর পথের পথিকদের প্রতি ভালোবাসা; আদর্শের সহযাত্রীদের প্রতি সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি। আর আল্লাহর দ্বীনের শত্রুদের প্রতি তার অন্তরে জাগে প্রবল ঘৃণা। আল্লাহর শত্রুদের হাত থেকে ইসলামী ভূখণ্ডকে আজাদ করার, অমুসলিমদের প্রভাব থেকে মুসলিম ভূখণ্ডকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখে সে। পৃথিবীর দেশে দেশে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার, নতুন করে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন তাকে প্রাণিত করে। তখন সে নব উদ্যমে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করে, সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজে বাধা দেয় এবং সার্বিকভাবে আল্লাহর পথে জিহাদ করার (হাতে, মুখে ও অন্তরে) আকাক্সক্ষা লালন করে; যদিও অন্তরের জিহাদ সবচেয়ে দুর্বল। আর সে স্বপ্ন দেখে, তার ও তার সহযাত্রীদের সম্মিলিত এই প্রচেষ্টায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হবে; উড্ডীন হবে দ্বীনের পতাকা।

সরকারি কাজের সীমাবদ্ধতা

ইসলামী আন্দোলন ওপরে বর্ণিত নির্ভেজাল জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে বিকশিত হয়। প্রকৃত ইসলামী আন্দোলন গড়ে উঠে মূলত জাতীয়ভাবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি বা আধা সরকারি কর্মসূচি- যেমন, ইসলামের প্রচার-প্রসারে কাজ করার জন্য উচ্চ পরিষদ গঠন করা অথবা জোট গঠন করা কিংবা কোনো লিগ বা সংঘ করা ইত্যাদি-যার দেখাশোনা বা তত্ত্বাবধান করবে মন্ত্রণালয় অথবা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান; তাও অল্পবিস্তর ইসলাম ও মুসলিমদের খেদমতে কাজে আসে। আর তার ফলাফল নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটি যারা প্রতিষ্ঠা করবে বা পরিচালনা করবে তাদের নিয়তের ওপর, তাদের সদিচ্ছা ও আকাক্সক্ষার ওপর। আর নির্ভর করবে সরকার ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সম্পৃক্ততা ও ঘনিষ্ঠতার চেয়ে দ্বীনের সাথে তার আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতার ওপর।

কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়- এসব সরকারি কাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত ফল দিতে ব্যর্থ হয়; বরং এসব সরকারি উদ্যোগ প্রায়সই অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হয়। আর ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। নিচে সেই কারণসমূহ তুলে ধরা হলো-

এক.

এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আকাশে ঘুরপাক খেতে থাকবে। কারণ, রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তার ব্যয়ভার বহন করে। তাই রাষ্ট্র নড়াচড়া করলে প্রতিষ্ঠানটি নড়াচড়া করবে। রাষ্ট্র দাঁড়াতে বললে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে যাবে। রাষ্ট্র কথা বললে প্রতিষ্ঠানটিও কথা বলবে। রাষ্ট্র চুপ থাকলে প্রতিষ্ঠানটিও চুপ থাকবে। রাষ্ট্র যদি পূর্বমুখী হয়, প্রতিষ্ঠানটিও পূর্বমুখী হবে। আর রাষ্ট্র যদি পশ্চিমমুখী হয়, প্রতিষ্ঠানটিও পশ্চিমমুখী হবে। মোটকথা, প্রতিষ্ঠানটিকে সর্বক্ষণ রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে থাকতে হবে। তাই প্রতিষ্ঠানটি যথাযথভাবে ইসলামের কথা বলতে পারবে না। বলতে পারবে না বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর কথা। রাষ্ট্র যতটুকু বলতে দেবে, প্রতিষ্ঠানটি ততটুকুই বলতে পারবে। রাষ্ট্র যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দেবে, প্রতিষ্ঠানটি এর বাইরে যেতে পারবে না। প্রতিষ্ঠানটি কথা বলার আগে রাষ্ট্র সব সময় সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে।

দুই.

উপর্যুক্ত কথাটি অধিকাংশ সময় সেসব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না-যাদের কাজকর্ম ও চেষ্টা-সাধনা তাদেরকে অন্যদের থেকে পৃথক করে দিয়েছে, স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে এবং যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করে বেড়ায়। বরং নির্দিষ্টভাবে সেসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যাদের ওপর অর্থলগ্নিকারী রাষ্ট্র সম্রাট এবং যারা সরকারি লোকদের প্রতি প্রীত হয়ে কিংবা তাদের ভয়ে ভীত হয়ে, তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য লোভাতুর হয়ে উঠবে। তাই তারা অন্যায় কাজে তাদের বিরোধিতা করার চেষ্টা করবে না। আমি এখানে অধিকাংশের কথা বলছি। নতুবা সরকারি লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা ইখলাসে, দ্বীনের গায়রত ও দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

প্রায়শ দেখা যায়, তাদের অধিকাংশের নিয়তে ঘাটতি থাকে। ইসলামের নুসরত ও সাহায্য করার বদলে তাদের নিয়ত থাকে নিরেট রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের। তাদের কাজ অনেকটা ‘মসজিদে দিরার’-এর মতো-বাইরে দেখতে মনে হবে তাদের ইবাদত ইখলাসপূর্ণ এবং তাদের আচার-আচরণ ও চালচলন তাকওয়ায় ভরপুর, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মুমিনদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করার সাধনায় তারা জীবনপাত করে এবং যারা ইখলাসের সাথে একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের কাজ করে, পদে পদে তাদের বাধা দেওয়ার সুযোগ খোঁজে।

তিন.

উপর্যুক্ত কারণে যারা সরকারের ছত্রছায়ায় কাজ করে, জনসাধারণ তাদের বিশ্বাস করে না। জনগণ তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। তাই জনগণের আবেগ-অনুভূতিতে তাদের স্থান নেই। মানুষ তাদের সহযোগিতা করে না। এমনকি যেসব আলিম রাষ্ট্রীয় চাকরি করে, রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক কাজের জন্য যারা নিজেদের সঁপে দিয়েছে, তারাও রাষ্ট্রের মর্জিমাফিক চলতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্র যখন চায় তারা কথা বলুক, তখন তারা কথা বলতে পারে। আর রাষ্ট্র যখন চায় তারা চুপ থাকুক, তখন তাদের চুপ থাকতে হয়। ফলে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে না। জনগণ তাদের বিশ্বাস করতে পারে না। জনগণ তাদের নাম দিয়েছে ‘উলামাউস সুলতাহ’ তথা ‘দরবারি আলিম’ বা “উমালাউশ শুরতা’ তথা ‘জি-হুজুর বাহিনী’।

এসব কারণে রাষ্ট্রে যদি ইসলামী হুকুমত ও শাসনব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সরকারি বা আধা সরকারিভাবে ইসলামের কাজ করা, ইসলামী আন্দোলন করা সম্ভব নয়। যদি কিছুটা সম্ভবও হয় (সম্ভাব্যতা ধরে নিয়ে), তা হয় কেবল জ্ঞান- গবেষণা, বস্তুগত সাহায্য-সহযোগিতা, জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং বিভিন্ন সংঘ ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে। আর এসব কাজকর্ম বিশেষভাবে তখনই সম্ভব হয়, যখন ওই সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান সাহসী, মুখলিস ও নিষ্ঠাবান মানুষ হয়। তবে সামগ্রিক ও ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রের পোষকতায় কিছুতেই ইসলামী আন্দোলন করা সম্ভব নয়।

ইসলামী আন্দোলন : সুশৃঙ্খল ও জামাতবদ্ধ (সম্মিলিত) কাজ

ইসলামী আন্দোলন হলো সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত সামষ্টিক ও জামাতবদ্ধ কার্যক্রম। একা একা কেউ আন্দোলন করতে পারবে না। আবার বিশৃঙ্খলভাবেও কোনো আন্দোলন চলতে পারে না। সফলতার জন্য উভয়টাই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। সারাদেশের নানা প্রান্ত থেকে নানাজন নানাভাবে সমন্বয়হীন ও বিচ্ছিন্নভাবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ইসলামী আন্দোলনের কাজ করলেও তাতে তেমন কোনো সফলতা আসবে না; যদিও তাদের সবার কাজ কিছু না কিছু উপকারী হবে এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তারা সবাই কাজের পরিমাণের ভিত্তিতে সওয়াব ও প্রতিদান পাবেন। কারণ, আল্লাহ তায়ালার কাছে বান্দার কোনো ভালো কাজ বৃথা যায় না; নারীর হোক বা পুরুষের, কারও আমল নষ্ট হয় না। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেককে তার নিয়ত ও বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিদান দেবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “কেউ অণুসদৃশ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে।” সূরা যিলযাল : ৭

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ কাউকে তার প্রাপ্য থেকে সামান্য পরিমাণও বঞ্চিত করেন না।” সূরা নিসা : ৪০

কিন্তু মুসলিম উম্মাহর মাঝে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, বর্তমান বাস্তবতায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও কর্মসূচি সেই ফাটল মেরামত ও বন্ধ করতে যথেষ্ট নয়।

বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার। আর এটাই দ্বীনের দাবি, বাস্তবতার দাবি, সময়ের চাহিদা।

এ কারণেই ইসলাম আমাদের আহ্বান জানায় জামাতের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে। বিচ্ছিন্নতা ও বিক্ষিপ্ততা ইসলামে অপছন্দনীয় বিষয়। ইসলাম আমাদের বলে- সম্মিলিতভাবে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রতি রয়েছে আল্লাহ তায়ালার হাত (সাহায্য ও সহযোগিতা)। আর যে ব্যক্তি (মুসলিম জনসমষ্টি হতে) বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে জাহান্নামে যাবে। ইসলাম আরও বলছে- যে ছাগল দলবেঁধে থেকে দূরে চলে যায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে নেকড়ের গ্রাসে পরিণত হয়। কাতারের পেছনে একাকী নামাজ পড়া জায়েয নেই। কাতারের আগেও একাকী নামাজ পড়া জায়েয নেই। মুমিন মুমিনের জন্য প্রাচীরস্বরূপ; এর একটি অংশ অপর অংশকে সুদৃঢ় রাখে।  

এছাড়াও, এক মুমিন আরেক মুমিনকে ন্যায়ের পথে থাকার ক্ষেত্রে, তাকওয়া লালনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। পরস্পরকে সদুপদেশ দেয়া এবং বিপদে-আপদে সবর করা দুনিয়া-আখিরাতের ক্ষতি ও ধ্বংস থেকে মুক্তির অন্যতম শর্ত।

আর বাস্তবতার দাবি হলো- কার্যকর কর্মপন্থা যেন সম্মিলিত হয়, যৌগ হয়। দেখুন, এক হাতে কখনও তালি বাজে না। তালি বাজানোর মতো তুচ্ছ একটি কাজও এক হাতে হয় না; বরং আরেক হাতের সম্মিলনের দরকার হয়।

একা থাকলে মানুষ দুর্বল থাকে, দলবদ্ধ থাকলে শক্তিশালী হয়। আর সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া বড়ো কোনো কাজ করা যায় না। তেমনি সম্মিলিত সহযোগিতা ও পারস্পরিক শক্তি ছাড়া ভয়ংকর ও গুরুতর কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বলেন- “আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে, যেন তারা সিসাঢালা প্রাচীর।” সূরা সফ : ৪

আর জামাতবদ্ধ বা সম্মিলিত কাজ অবশ্যই সুশৃঙ্খল হওয়া আবশ্যক। এর ভিত্তি হতে হবে দায়িত্বশীল নেতৃত্বের ওপর। এর জন্য থাকতে হবে সতর্ক ও সুপরিকল্পিত নীতিমালা। থাকতে হবে সুস্পষ্ট বিধিবিধান। নেতৃত্ব ও নীতিমালার মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করবে দায়িত্বশীল শূরা পরিষদ। আর তা সবাই মেনে চলবে।

ইসলাম নিয়ম-শৃঙ্খলাহীন জমায়েতকে সমর্থন করে না। এমনকি নামাজের ছোট্ট একটি জামায়াতেও নিয়ম-শৃঙ্খলা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ তায়ালা নামাজের এলোমেলো কাতার পছন্দ করেন না। কাতারে অবশ্যই পাশাপাশি লেগে লেগে দাঁড়াতে হবে। কাতারের মাঝখানে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। সামনের কাতারে জায়গা রেখে পেছনের কাতারে দাঁড়ালে নামাজ মাকরুহ হবে। যে কাতারে ফাঁকা জায়গা রাখা হয়, শয়তান এসে সেটা পূরণ করে দেয়। কাতারে দাঁড়ানোর সময় অবশ্যই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হবে। ওঠাবসায় ও বাহ্যিক দৃশ্যে সামঞ্জস্য হতে হবে, আগপিছ হওয়া যাবে না। তেমনি অন্তরে ও প্রকাশ্যে, আকিদা ও কিবলায় এক হতে হবে। আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেন-

“তোমরা আগপিছ হয়ে এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ো না; অন্যথায় তোমাদের অন্তর মতভেদে লিপ্ত হয়ে পড়বে।”

ইমাম তাঁর পেছনের কাতার ঠিক করে দেবেন, যেন সবাই সোজা হয়ে দাঁড়ায়, মাঝখানে ফাঁক না রাখে। মুসল্লিদের উপদেশ দিয়ে তিনি বলবেন- “তোমরা তোমাদের ভাইদের প্রতি কোমল হয়ে যাও।” 

সুতরাং, জামায়াতে নম্রতা ও কোমলতা প্রয়োজন, পুরো জামায়াতের শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যবিধানের জন্য। কঠোরতা ও জিদ করলে কাতারে সৌন্দর্যবিধান করা সম্ভব নয়। এরপর আসে ইমামের আনুগত্যের কথা। রাসূল সা. বলেন- “ইমাম এজন্য নিযুক্ত হন যে, মুক্তাদিরা তার অনুসরণ করবে। ইমাম তাকবির বললে তোমরাও তাকবির বলবে, তিনি রুকু করলে তোমরাও রুকু করবে এবং তিনি যখন সিজদা করবেন, তোমরাও সিজদা করবে।” 

নামাজের কাতার থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না; (জামায়াত চলাকালীন) একাকী নামাজ পড়লে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ইমামের আগে কেউ রুকু বা সিজদা করতে পারবে না। ব্যতিক্রম হলে এই সুশৃঙ্খলতা ভেঙে পড়বে। আর যে ব্যক্তি এমনটা করবে- ইমামের আগে আগে রুকু-সিজদা করবে- আল্লাহ তায়ালা তার মস্তক গাধার মস্তকে পরিবর্তন করে দেবেন। হাদীসে এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

কিন্তু ইমাম যখন ভুল করবেন, তখন মুক্তাদিদের কাজ হলো শুধরে দেওয়া। নামাজে ভুল হলে লুকমা দেওয়া ওয়াজিব। অর্থাৎ, ইমামের ভুল শুধরে দেওয়া ওয়াজিব; হোক সেই ভুলটি কথায় বা কাজে; কিরাতে অথবা নামাজের অন্য কোনো রুকন আদায়ের ক্ষেত্রে।

এটা হলো ইসলামের ছোট্ট একটি জামায়াতের চিত্র। তাহলে তো নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এই শৃঙ্খলা আরও বেশি দরকার, এই আনুগত্য আরও বেশি জরুরি। তবে নিষ্পাপ কোনো নেতৃত্ব নেই। আবার প্রশ্নহীন কোনো আনুগত্যও নেই।

ইসলামী আন্দোলনের কাজ : ইসলামের তাজদিদ

ইসলামী আন্দোলনের কাজ কী?

ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- ইসলামের তাজদিদ সম্পাদন করতে এবং পথের সকল বাধা-বিপত্তি দূর করে নতুন করে আবার ইসলামকে জীবনের সকল দিক ও বিভাগের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে ফিরিয়ে আনতে।

‘ইসলামের তাজদিদ’- এটা আমাদের নিজস্ব কথা নয়; এটা হাদীসেরই কথা। ইমাম আবু দাউদ ও ইমাম হাকিম সহীহ সনদে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন; রাসূল সা. বলেন- “নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শিরোভাগে এমন কারও আবির্ভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মতের দ্বীনকে তাজদিদ (সংস্কার/ নবায়ন) করবেন।” 

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যাখ্যাকার ‘মান’ শব্দটি থেকে নির্দিষ্ট একজনকেই বুঝিয়েছেন- যিনি দ্বীনের সংস্কার করবেন। আর তারা প্রতিটি শতাব্দীর মুজাদ্দিদ কে-তা নির্ধারণ করে দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেক শতাব্দীর শুরুর দুয়েক বছরের মধ্যে যেসব মনীষী আলিম ও ইমাম ইন্তেকাল করেছেন, তাদের মধ্যে কে মুজাদ্দিদ-তা নির্ধারণ করতে প্রয়াস পেয়েছেন তারা। যেমন- উমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. প্রথম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ। তিনি ইন্তেকাল করেন ১০১ হিজরিতে। দ্বিতীয় শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হলেন ইমাম শাফেয়ি রহ.। তিনি ইন্তেকাল করেন ২০৪ হিজরিতে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে।

তবে হাদীসের ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, ‘মান’  শব্দটি একবচনের জন্য যেমন ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনি বহুবচনের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং, মুজাদ্দিদ একজনও হতে পারেন; অনেকজনও হতে পারেন কিংবা বড়ো একটি দলও হতে পারে। আর এই মতকেই ইবনে আসির রহ. তাঁর আল জামিউ লিল উসুল গ্রন্থে প্রাধান্য দিয়েছেন। হাফেজ যাহাবি রহ.-সহ আরও অনেকে এই মতের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উক্ত কথার ওপর আমি আরেকটি কথা যোগ করতে চাই। আমার মনে হয়- সংখ্যা হিসেবে বহুবচন হওয়া আবশ্যক নয়। আর ‘এই এই শতাব্দীতে অমুক অমুক মুজাদ্দিদ’-এটাও চিহ্নিত করা জরুরি নয়; বরং এখানে জামায়াত বা দল বলতে একটি প্রতিষ্ঠান বা একটি আন্দোলনও হতে পারে। যে প্রতিষ্ঠান, যে আন্দোলন চিন্তা, দাওয়াত ও কর্মতৎপরতার মাধ্যমে সুসংহতভাবে দ্বীনের তাজদিদের ক্ষেত্রে কাজ করবে, দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ঘটাবে। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় এটাকেই আমি প্রাধান্য দিই।

আর আগামী দিনে এই তাজদিদ বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দুআ করছি। আমরা দুআ করছি, তিনি যেন আমাদের আজকে গতকালের চেয়ে ভালো করেন এবং আগামীকালকে আজকের চেয়ে ভালো করেন।  

কিসের মাধ্যমে এই তাজদিদ হবে?

ইসলামী আন্দোলনের ওপর যেই তাজদিদ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব, তা তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে। সেগুলো হচ্ছে-

১. ইসলামী নেতৃত্ব তৈরি

উম্মাহর অন্যতম প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে- আধুনিক সমাজকে ইসলামের আলোকে পরিপূর্ণভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে, এমন নেতৃত্ব। আর উম্মাহর প্রয়োজন পূরণ করাই তো ইসলামী আন্দোলনের কাজ। অতএব, ইসলামী আন্দোলনের প্রধানতম কাজ হচ্ছে ইসলামী নেতৃত্ব তৈরি করা, যে নেতৃত্ব নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকবে না কিংবা বিপদ-বিপর্যয় ও দায়িত্বের ভারে ভেঙে পড়বে না; যে নেতৃত্ব ইসলামের সঞ্জীবনী থেকে মুসলিমদের রোগ নিরাময় করতে সক্ষম হবে; যে নেতৃত্ব ইসলামের আলোকে মুসলিমদের সব ধরনের সমস্যা সমাধান দেবে; যাদের প্রত্যেকের মাঝে সমন্বয় ঘটবে পরিপূর্ণ ঈমান ও গভীর বোঝাপড়ার এবং পরস্পরের মধ্যে থাকবে সুদৃঢ় বন্ধন।

২. ইসলামী চিন্তা ও মনন গঠন

ইসলামী আন্দোলন এমন এক ব্যাপক ইসলামী মত ও চিন্তা গঠন করা যা বিশাল জনসমষ্টির রীতি-পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করবে। ইসলামের সাথে জীবনের সকল দিকের সামঞ্জস্য বিধান ও সমর্থন করবে। সবাই হৃদয় থেকে গ্রহণ করবে যে, তাতে দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ ও সৌভাগ্য রয়েছে। আর সবাই দাঈদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে মোটামুটি অবহিত হওয়ার পর, তাদের শক্তি ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর, বিশৃঙ্খলার আগাছা উপড়ে ফেলে, ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের ওপর পতিত ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে তাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে। তাদের ভালোবাসবে, সহযোগিতা করবে এবং পৃষ্ঠপোষকতা করবে।

৩. উম্মাহর পুনর্গঠন

একটি সর্বজনীন আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও পরিমণ্ডল গঠন করা ইসলামী আন্দোলনের বৃহৎ কাজ- যা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কথা ভাববে, তাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবে এবং আপন করে নেবে। তখন উম্মাহর সদস্যরা ইসলামের পয়গাম ও ইসলামী সভ্যতার হাকিকত উপলব্ধি করতে পারবে। তারা মুক্ত হবে নেতিবাচক গোঁড়ামি থেকে। যেসব অপকর্মের মূলে রয়েছে মিথ্যা ও কদাচার, সেসব থেকে মানুষকে মুক্ত করা ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য। তা এমন একটি ব্যাপক উদ্যোগ- যা অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির কাছে ইসলামী শক্তির প্রকাশিত হওয়ার পথ খুলে দেবে। আর এর মাধ্যমে এটা জানান দেওয়া যাবে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধিবাসীদের দেশে নিজেদের আকিদা-বিশ্বাস অনুযায়ী নিজেদের শাসনকার্য পরিচালনা করা মুসলিমদের অধিকার- যা পশ্চিমারাও তাদের গণতান্ত্রিক নীতিতে আছে বলে স্বীকার ও প্রচার করে।

অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতে যত ধর্ম, মতবাদ, আদর্শ পৃথিবীতে প্রচারিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, তন্মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ও সম্ভাবনার ধারক হলো ইসলাম। পৃথিবীতে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ ইসলামের অনুসারী। সুতরাং, মুসলিমরা তাদের ঐশী, মানবিক ও বৈশ্বিক পয়গামের প্রচার-প্রসার করবেই- এটা তাদের নৈতিক অধিকার; দায়িত্ব-কর্তব্যও বটে।

অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির