post

WE WANT JUSTICE। শাহাদাত হোসাইন

১১ জানুয়ারি ২০১৯

WE WANT JUSTICEসুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের মাটিতে সোনা ফলে। এদেশের মতো সুস্বাদু পানির আধার পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এই মাটি, পানি ও নদ-নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি। বাউল, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালিতে মাতোয়ারা এদেশের মানুষ। আবহমান কালব্যাপী সম্পদের প্রাচুর্য ও সবুজ প্রকৃতি এদেশের মানুষের হৃদয়ে এঁকে দিয়েছে কোমলতার ছবি। এই কোমল হৃদয়ের মানুষগুলোর ইতিহাসে রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিগ্রহ। তারা বারবার প্রতারণার শিকার হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত ও বাধাগ্রস্ত হয়েছে; বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও প্রকৃতির নির্মম কশাঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে জনপদ, তারপরও মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন থেমে থাকেনি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়ে যাওয়া স্বাধীনতার সূর্য ১৮৫৭, ১৯৪৭ পেরিয়ে আবার উদিত হয় ১৯৭১ সালে। পরাধীন আমলের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে হয়ে পড়েছে অকার্যকর। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি, অসততা, অদক্ষতা, অজ্ঞানতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধিতা আজ সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে গ্রাস করেছে গভীরভাবে। রাষ্ট্রজুড়ে চলছে অবাধ লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও কায়েমি স্বার্থ হাসিলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ফলশ্রুতিতে সবুজ শ্যামল প্রিয় এই বাংলাদেশের নির্মলতা আজ পঙ্কিলতায় নিপতিত। এমতাবস্থায় বিদ্যমান রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশ ও শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করে এসবের প্রতিকারে কার্যকর গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। তা ছাড়া প্রগতিশীল চিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে স্বাজাত্যবোধ ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলে সুনাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তাই একটি সামাজিক আন্দোলনের ভিত্তিমূল হিসাবে কাজ করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যার কর্মক্ষেত্রসমূহ নিয়ে কিছু কথা নিম্নে তুলে ধরা হলো।

প্রাণ ও প্রকৃতি সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য আজ সার্বিকভাবে হুমকির মুখে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, কৃষিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার, শিল্পের ক্ষতিকর বর্জ্য, বনজসম্পদ ধ্বংস, পাহাড় কেটে আবাসন ও চাষবাসসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের মাটি, পানি, বাতাস, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও সমুদ্রসহ সামগ্রিক পরিবেশ আজ দূষণের মুখে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণী তথা জীববৈচিত্র্যের ওপর। এমতাবস্থায় প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষা তথা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য বাংলাদেশ নিশ্চিতকরণে একটি সমন্বিত উদ্যোগ আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি কার্যকর জাতিগঠন ও তার ক্রমোন্নতির জন্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। যে কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম প্রাণরস হচ্ছে তার আবহমান সংস্কৃতি। চলমান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই একটি জাতির আত্মপরিচয় বিকশিত হয়। সাংস্কৃতিকভাবে হীনমন্য কোনো জাতি কখনো উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারে না। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। সপ্তম শতাব্দীর চর্যাপদ থেকে শুরু করে সমগ্র মধ্যযুগের সাহিত্য, লোকগীতি, বাউল গান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদিসহ আধুনিক কালের রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা, গান আমাদের অমূল্য সম্পদ। তথ্য যোগাযোগ ও আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে নিজস্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদানগুলি বিদেশী সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন হুমকির সম্মুখীন। আবহমানকাল ধরে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে বিরাজমান বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি হওয়া উচিত আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ। জাতীয় সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন চিহ্নিত করে তা পরিহারকল্পে গণসচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একটি কার্যকর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।

WE WANT JUSTICEকৃষি পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ অসংখ্য নদ-নদী প্লাবিত এই ভূখণ্ড সুপ্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকাজের জন্য বিখ্যাত। হিউয়েন সাংয়ের ভাষায় “এখানে স্বর্গের ঋতুগুলো সারা দেশে ধনদৌলত ছড়িয়ে রেখেছে”। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের ফলে দিনদিন সীমিত হচ্ছে আমাদের কৃষিজমি। যার অনিবার্য পরিণতি হলো খাদ্য খাটতি, পুষ্টিহীনতা ও দরিদ্রতা। এমতাবস্থায় অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্য ও প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে আমাদের কৃষিভূমি ও জলাশয়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি। জীবপ্রযুক্তি সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে অধিক উৎপাদনশীল শস্য, ফলমূল, মৎস্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ, গবাদিপশুর খামার সম্প্রসারণসহ সামগ্রিক কৃষিব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনয়নের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কৃষিনীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কৃষিজমি সংকোচন রোধে গ্রামপর্যায়ে বহুতল বিশিষ্ট সামাজিক আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান অত্যাবশ্যক।

অর্থনীতি ’৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর পরও আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। রাষ্ট্রের প্রায় বিশাল জনগোষ্ঠী আজও দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এখনও বিপুল সংখ্যক জনগণের নাগালের বাইরে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণে একটি শ্রেণীর সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার জালিয়াতি, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার অর্থ পাচারের কারণে জাতীয় অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আজ আকাশ-পাতাল। সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের মাধ্যমে দ্রুত কোটিপতি হবার প্রতিযোগিতায় ইতোমধ্যে বিশ্বের সকল দেশকে পিছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যর্থতা, রাষ্ট্রশক্তির অনীহা ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে, যার প্রকৃত উদাহরণ প্রতি বছর কেবল ভারত, শ্রীলংকা ও অন্যান্য দেশ আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কমবেশি ১০-১৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের জন্য একটি অশনিসঙ্কেত। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করে এ প্রবণতা রোধ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

শিল্প যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে শিল্পোন্নয়ন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বাংলাদেশ শিল্প ক্ষেত্রে অনেকাংশেই পিছিয়ে। আমাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস জনশক্তি রপ্তানী ও বস্ত্রখাত। এ দুই খাতের অব্যাহত বিকাশের জন্য প্রয়োজন দক্ষতার উন্নয়ন ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অনুসরণ। তৈরি পোশাক খাতের জন্য সহায়ক শিল্প স্থাপনে এখন পর্যন্ত আমরা কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারিনি। সবার জন্য বিদ্যুৎ এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে। দেশীয় সকল প্রকার শিল্পকলকারখানা থেকে শুরু করে যানবাহন ও অন্যান্য খুচরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য বিদেশনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ সাধনে নেই কোন বৃহত্তর পরিকল্পনা ও প্রণোদনা। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অগ্রগতি ও সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে সরকারের উচিত নিবিড়ভাবে কাজ করা এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশে দলমতের উর্ধ্বে উঠে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান একান্ত বাঞ্ছনীয়। শিল্প উন্নয়নে আমাদের ভূমির স্বল্পতা ও পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে একটি বিনিয়োগবান্ধব টেকসই শিল্পনীতি একান্ত অপরিহার্য। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে তাল মিলিয়ে জীব ও তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো পেছনের সারিতে। অথচ এ সকল সম্ভাবনাময় খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার যে সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

শিক্ষা শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবহেলা, অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে ব্যর্থতার কারণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে সংকটাপন্ন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় প্রশ্নফাঁস, গণহারে পাস করানোর প্রবণতা, জিপিএ ৫ প্রদানের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত। বিশ^বিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যেখানে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, প্রচলিত জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন, যুগোপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম নেতৃত্ব তৈরি, সেখানে জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে চালু করা হয়েছে লেজুড়বৃত্তির চর্চা। একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী নেতৃত্ব সৃষ্টির পরিবর্তে পরিকল্পিতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মানসে সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে পাঠানো হয়েছে নির্বাসনে। আমরা মনে করি এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পিছিয়ে রাখার জন্যে অযোগ্য ও দাসত্ব মনোবৃত্তির নেতৃত্বে সৃষ্টির এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এমতাবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। সেই সাথে বিশ^বিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নানা বর্ণের দলীয় রাজনীতি আইন করে বন্ধ করা, বিশে^র প্রথম সারির বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন এবং আগামী শতাব্দীকে সামনে রেখে একটি সুদূরপ্রসারী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তার আশু বাস্তবায়ন আবশ্যক।

মানবসম্পদ উন্নয়ন বাংলাদেশের মতো সীমিত আয়তনের একটি জনবহুল দেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। আর এ জন্য প্রয়োজন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও চিন্তা-চেতনার সামগ্রিক পরিবর্তন। বিশে^র প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারকে সামনে রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন কাম্য। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির এ যুগে সাধারণ শিক্ষার প্রতি আমাদের বদ্ধমূল ধারণাকে পরিবর্তন করে প্রায়োগিক বা কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বায়নের সাথে তাল রেখে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োগিক, নৈতিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভারসাম্যমূলক একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

চিকিৎসা বাংলাদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিরাজ করছে এক চরম নৈরাজ্য। সাধারণ মানুষ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসেও এদেশে উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়নি। অধিকাংশ ঔষধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মাফিয়াতন্ত্র, ক্ষেত্রবিশেষে ডাক্তারদের কমিশনবাজি, রোগ নির্ণয়ে অদক্ষতা এবং ভুল চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাবে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি তৈরি হয়েছে জনগণের আস্থাহীনতা। ফলশ্রুতিতে সরকারি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে সচ্ছল মানুষেরা বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজনে হচ্ছে বিদেশমুখী। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা চিকিৎসার নামে বিদেশে পাচার হচ্ছে যা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এমতাবস্থায় সঠিক নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি, বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে তাদেরকে সারা দেশে চিকিৎসাসেবা দিতে উৎসাহ প্রদান, রোগ নির্ণয় সেক্টরে দক্ষ জনবল তৈরি ও উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

নগরায়ণ প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো ধ্বংস করে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাতে নিয়মবহির্ভূত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্যা, আবাসিক এলাকা পৃথক না থাকা, প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাটের সংকট, শহরের ভিতর যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপন, পর্যাপ্ত সংখ্যক লেক-পার্ক-খেলারমাঠ-বিনোদন কেন্দ্রের সংকট, জলাবদ্ধতা, সীমাহীন যানজট ও পরিবেশ দূষণের কারণে ঢাকা আজ মৃতপ্রায় নগরী। দেশে দ্রুতবর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং সীমিত ভূমির পরিমাণকে সামনে রেখে একটি পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। প্রশাসন শিক্ষা ও শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত কমানো এবং ঢাকার জনসংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা অত্যাবশ্যক। ঢাকা শহরের ৭০টি খাল জনস্বার্থে পুনরুদ্ধার আবশ্যক। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের অনীহা ও দস্যু গোষ্ঠীর জবরদখলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।

নিরাপদ খাদ্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। সুস্থ জীবনযাপনে নিরাপদ ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। নানা সমস্যায় জর্জরিত এই দেশ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত আবির্ভূত হয়েছে খাদ্যে ভেজাল। এমতাবস্থায় সুস্থ জীবন যাপনে যুগোপযোগী খাদ্য আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন আবশ্যক। খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি অপরিহার্য।

যোগাযোগব্যবস্থা নদীমাতৃক বাংলাদেশের নিজস্ব ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। হারিয়ে যাওয়া নৌ পথগুলো পুনরুদ্ধার ও নৌ-বন্দরগুলোর আধুনিকায়নসহ নদীকেন্দ্রিক অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি। সড়ক যোগাযোগে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রধান শহরগুলোর মধ্যে এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণ ও রেলব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ট্রাফিক আইনের আধুনিকায়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন, সমস্ত পরিবহন শ্রমিকদের জন্য শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, শহরের ভিতরে অবস্থিত টার্মিনালগুলোকে শহরের বাইরে স্থানান্তর, ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলকে যুক্ত করে বহুমুখী মেট্রো রেল চালু, বিদ্যমান ট্রেন লাইন ও ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি।

রাষ্ট্র ও রাজনীতি নেতৃত্বের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও পরনির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশ আজও একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ আজ সর্বাংশে অকার্যকর। দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমনই আজ রাষ্ট্রের ধর্ম হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী থাবা ও অযোগ্যতা আজ রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করে দুর্নীতিপরায়ণ ও অযোগ্যদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এতে করে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশাসন আজ পরিপূর্ণভাবে নির্বাসিত। অবাধ লুণ্ঠন ও অর্থপাচার, অবকাঠামো নির্মাণে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়, দফায় দফায় প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধাকে বাদ দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের কমিশন বাণিজ্য, স্পিড মানির দৌরাত্ম্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও বিদেশে পাচার আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। আইন ও বিচারালয় থেকে ন্যায়বিচার আজ অনেকাংশেই তিরোহিত। এমতাবস্থায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণই আমাদের কাম্য। যার মূল লক্ষ্য হবে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের জনগণের উন্নত আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রতিষ্ঠার অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও সে সম্ভাবনার বাস্তবায়নে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি। দেশে বিদ্যমান ধারার গণবিরোধী রাজনীতির অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে জনগণ আজ হতাশ ও দিশেহারা। এই রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মসূচি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দেশের স্বাধীনতার সফলতা নির্ভর করে জনগণের জীবনমানের উন্নতির কার্যকর কর্মসূচি ও তার বাস্তবায়নের ওপর। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমান ধারার রাজনীতি দেশের মানুষকে চরমভাবে হতাশ করেছে। হীন স্বার্থান্বেষী কিছু লোক রাজনীতিকে পর্যবসিত করেছে নিছক ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের লড়াইয়ে; সর্বজনীন কল্যাণের চিন্তা নেই এই রাজনীতিতে। জাতীয়ভাবে আমরা আজ সম্পূর্ণ লক্ষ্যহীন। নৈতিকতাবিবর্জিত স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতা ও সম্পদলিপ্সুরা নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা ও অর্জিত সম্পদ রক্ষার্থে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অন্যায়ভাবে তুলে দিয়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গের হাতে। দেশের রাজনীতি আজ সম্পূর্ণ বিদেশী দূতাবাস নির্ভর হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, জনগণের মধ্যে কার্যকর ঐক্যের সৃষ্টি হোক। জনগণের ঐক্য আজ সময়ের দাবি। জনগণের ভিতর থেকে জাগরণ সৃষ্টি হলে তারাই পারবে নিজেদের কল্যাণে নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে ও গণবিরোধী নেতৃত্ব উৎখাত করতে। আমরা চাই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। একটি ইতিবাচক গণতান্ত্রিক ও সুস্থধারার রাজনীতির চর্চা। চাই প্রতিনিধিত্বশীল একটি কার্যকর সংসদ, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা ও সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা। তাহলেই আগামী প্রজন্মের কাক্সিক্ষত উন্নত ও মানবিক একটি বাংলাদেশ আমরা তৈরি করতে পারব। আমরা মনে করি, রাজনীতিবিদদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির দূরদর্শিতার ওপরই একটি দেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়। বিশ্বমানের নিজস্ব ধাঁচের একটি সহনশীল উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চাই আমাদের কাম্য। রাজনীতি যদি ইতিবাচক হয়, জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক হয়, আত্মকেন্দ্রিকতা ও গোষ্ঠীস্বার্থের পরিমণ্ডলে অবরুদ্ধ না হয়, তাহলে সব প্রতিবন্ধকতার অন্ধকার বিদীর্ণ করে দেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব। এ ধরনের একটি রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিনির্মাণের প্রধান কারিগর হল সকল শ্রেণি ও পেশার দেশপ্রেমিক শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ও দেশের অগ্রসর জনসাধারণ, তবে এর পথ তৈরি করে দিতে হবে দেশের রাজনীতিবিদদেরকেই।

লেখক : শিক্ষার্থী, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির