আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ আর এ ঘোষণারই প্রতিধ্বনি ঘটেছে আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে, যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল- বিদ্যমান শাসনপ্রক্রিয়ায় রূপান্তর ঘটিয়ে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যাতে সুশাসন অর্জিত হয়। এটি অনস্বীকার্য যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হলেও আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য ফ্যাসিস্ট কায়দায় রক্তাক্ত ২৮ শে অক্টোবর সংঘটিত করে। লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করে জনগণের মাঝে সৃষ্টি করে ভীতি! গণতান্ত্রিক রোড থেকে রাষ্ট্রনীতি পতিত হয ঘোর অন্ধকারে! সেই অমানিশা জাতির ললাট থেকে এখনো কাটেনি! একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতি কবে মুক্তি পাবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। মার্টিন লুথার কিং বলেছেন- অন্যায়কে অমান্য করা, ইহা একজনের নৈতিক দায়িত্ব।
পৃথিবীর ইতিহাসে নাজিবাদ বা জাতীয় সমাজতন্ত্র (national socialism) এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার। তার রচিত ‘মেইন কাম্প” (main kamp)-ই হলো এই মতবাদের অন্যতম তাত্ত্বিক ভিত্তি। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তখন তিনি উগ্র ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদী মতবাদ কায়েমে ব্রত হন। হিটলার বিশ্ব জয়ের জন্য জার্মান জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৪৫ সালে চক্রীপক্ষ পরাজয়বরণ করলে হিটলারের জীবনাবসান ঘটে। নাজিবাদ অনুযায়ী জার্মানিরাই বিশ্বের প্রকৃত এবং নিখুঁত এবং সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি। এই শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জার্মানিরা বিশ্বের অন্যান্য সকল জাতির ওপর প্রভুত্ব করবে এটাই তারা মনে করে। একই মনোভাব পোষণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দেশকে তারা পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনায় খামখেয়ালিপনা ও যেন তেনো পদ্ধতিকেই তারা নীতি বানিয়ে নিয়েছে। হিংস্রতা, অমানবিকতা ও পৈশাচিকতাকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি বানিয়ে নিয়েছে। গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের বিবেচনায় ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম সম্পর্কিত বাংলাদেশের স্কোর ২০১৭ সালে ছিল ১০০-এর মধ্যে ৪৭। ২০২১ সালে তা ৩৯-এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের ক্রমাবনতি ঘটছে।
গভর্ন্যান্স বা সুশাসন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সূচকই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাকস্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের সক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মান, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ৪০টি উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক অবস্থানের নির্ণায়ক হিসেবে এ সূচক প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের সূচক অনুযায়ী, বাকস্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবনতি সর্বাধিক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৫০ থেকে ২৬ দশমিক ৫৭-তে নেমে এসেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অভাব বা সন্ত্রাসের দিক থেকেও বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে গত ২৪ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ২৬ দশমিক ৬০ থেকে ১৬ দশমিক শূন্য ৪-এ অবনতি ঘটেছে। এলিজা হেইউড বলেছেন- যারা একটি বিষয় নিয়ে অন্যায় করে তারা প্রতিটি নিয়েই করবে এটাই স্বাভাবিক।
সেই মনোভাব থেকেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে আওয়ামী লীগ বর্বরোচিত ও জঘন্য মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছে! মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন পৈশাচিক ও জঘন্য হত্যার ঘটনা খুবই বিরল। ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা এই আহ্বানে সাড়া দিয়েই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি- বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সেদিন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। লগি, বৈঠা, লাঠি, পিস্তল ও বোমা হামলা চালিয়ে যেভাবে মানুষ খুন করা হয়েছে তা মনে হলে আজও শিউরে ওঠে সভ্য সমাজের মানুষ। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ মেরে লাশের উপর নৃত্য উল্লাস করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়েছে। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়।
সুপরিকল্পিত হামলা
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তাণ্ডব। তার প্রথম শিকার হয় গাজীপুরে জামায়াতে ইসলামীর অফিস। এসময় লগি-বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডবে শহীদ হন রুহুল আমিন।
২৮ অক্টোবরের হামলা চালানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এ জমিন থেকে ইসলামী আন্দোলন নিশ্চিহ্ন করে ও নেতৃত্বকে হত্যা করাই ছিল উদ্দেশ্য। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমীর ও সফল মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, মাওলানা আবদুস সোবহান (সাবেক এমপি)-সহ তিনজন পূর্বেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জুলুমের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।সর্বশেষ ১৪ই আগস্ট ২০০৩ সালে বিশ্ববরেণ্য আলিমে দ্বীন ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমীর, সাবেক এমপি, মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বিনা চিকিৎসায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে শহীদ করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধের ইতিহাস দিয়ে আওয়ামী লীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে, তার মাত্রা দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে তা আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসেছে।
২৮ অক্টোবর সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবে
চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ছিল। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের লগি, বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। তাদের পৈশাচিক হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয় জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের এই আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। তারা একযোগে বিজয়নগর, তোপখানা রোড ও মুক্তাঙ্গন থেকে পল্টন মোড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। পল্টন মোড়ের পৈশাচিকতার সেদিনটিতে পুরো পল্টনজুড়েই ছিল লগি-বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডবতা। লগি-বৈঠা আর অস্ত্রধারীদের হাতে একের পর এক আহত হতে থাকে নিরস্ত্র জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লগি-বৈঠা দিয়ে একের পর এক আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের উপর ওঠে নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে।
২৮ অক্টোবর সকাল ১০টায় আমরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্থ কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিউরে ওঠছে!
পল্টন রাঁধুনির গলিতে আমরা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। শাহাদাতের মৃত্যুর জন্য মুজাহিদ প্রায়ই তার মায়ের কাছে দু’আ চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাক্সক্ষা পূর্ণ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
হায়েনারা আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর গলির মধ্যে ফেলে রেখেছে। আমাদের ভাইয়েরা কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ, তখনও কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। মূলত আমি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়েই শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।
এক পর্যায়ে দীর্ঘ ৫-৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পিস্তলের গুলি আমার বাম পায়ে আঘাত হানলো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো জমিনে লুটিয়ে পড়লাম। দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? তারা আওয়ামী লীগ ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই, গার্মেন্টস কর্মী ও হিন্দার মতো লোকদের নিয়ে এসেছে। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। কোনো ভালো ঘরের সন্তান কি এখানে ছিল? ২৮ অক্টোবর বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। কিন্তু আজও ভাবি- আওয়ামী লীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে? এই স্বৈরাচারী জঙ্গি শাসন আর কত দিন চলবে?
যা হোক, এ সবের মাঝে পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। শ্রদ্ধেয় শহীদ আমীরে জামায়াত সাবেক সফল মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের সহসী নেতৃত্ব। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। সেদিন তাঁর বক্তব্য ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর অবিকল প্রতচ্ছবি। সেদিন শহীদ নিজামীসহ স্টেজে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে রক্ষা করতে শহীদেরা জীবন দিয়েছে কিন্তু মাথা নত করেননি। কিন্তু সেই নেতৃবৃন্দ অনেকেই আজ নিজেই শাদাদাতের অমিয় সুধা পান করে চলে গেছেন মহান মাবুদের দরবারে।
২৮ অক্টেরব নিয়ে রাজনীতিতে এখনো লাভ-ক্ষতির নিরন্তর হিসেব চলছে। কিন্তু শহীদ পরিবারের অনুভূতিতো ভিন্ন! শহীদ ফয়সালের মায়ের অনুভূতি এমন- “সেই ভয়াবহ ২৮ অক্টোবর সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা ভোলার মতো নয়, ফয়সালকে হারিয়ে আর স্ব^াভাবিক জীবনে ফিরে আসা ‘মা’ হয়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ছিল খুবই নরম স্বভাবের। এমন ছেলেকে লগি-বৈঠা দিয়ে জীবনের তরে শেষ করে ফেলা এটা মানুষের কাজ নয়, এরা নরপশু, ওদেও ভেতর মায়ামমতার লেশমাত্র নেই। আল্লাহর পছন্দনীয় সবদিক থেকে সুন্দর বান্দাটিকেই তিনি তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। শহীদদের স্বভাবটা এরকমই হয়ে থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওদেরকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।”
শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মা বলেন- “সে দাখিলে ১১তম স্থান অধিকার করে। মানুষের যেকোনো বিপদ কিংবা সমস্যা সমাধানে সে দ্রুত সাড়া দিত। এক ছেলের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠলে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির পর দেখা গেল তার ওষুধের টাকা নেই। সে তার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ঐ ছেলের ওষুধ কিনে দেয় এবং সারারাত তার বিছানার পাশে থেকে শুশ্রƒষা প্রদান করে ভোরে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে। এলাকার এক বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিলে ঐ লোকটিকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। সরকারি বিজ্ঞান কলেজে অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু ছেলেরা পর্যন্ত বায়তুলমালে অর্থ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করতো। শিপন এলাকার অনেক ছেলেকে কুরআন পড়তে শিখিয়েছে।এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে ভালো করতে হবে এই চিন্তায় সে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। সে সবাইকে মসজিদে নামাজ এবং কুরআনের আলোকে জীবন গড়ার তাগিদ দিতে ব্যতিক্রম আয়োজনের মাধ্যমে তাদেরকে দাওয়াত পৌঁছাতো। যেমন: ব্যায়াম, ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন। ফজরের নামাজের সময় ছেলেদেরকে নামাজের জন্য ডাকতো।
আমার শিপনকে যেরকম নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে, আমার কুরআনে হাফেজ ছেলেকে তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দাঁত পর্যন্ত শহীদ করেছে- তাই আমি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয় এবং কোনো সন্তানকে যেন এভাবে না মারা হয়।”
শহীদ রফিকুল ইসলামের মা বলেন- ‘আমার ছেলেকে হারানোর দু-একদিন পর এক রাতে ঘুমের মাঝে আমার ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমি তার সাথে কথা বললাম। আমি বললাম ‘তুই না মরে গেছিস?’ সে বলল- ‘আম্মা, এ কথা আর কখনো তুমি বলবে না। আমি মরে যাইনি, আমি শহীদ হয়েছি।’
হ্যাঁ সে ইসলামের জন্যই শহীদ হয়েছে, আর আমি তার গর্বিত মা। আমার ছেলের কোন অপরাধ ছিল না। সে এলাকার ছেলেদের কুরআন শেখাতো, নামাজ পড়াতো। এতসুন্দর সোনার টুুুকরো ছেলেকে যে আওয়ামী হায়েনারা আঘাতের পর আঘাতে আমার বুক খালি করিয়েছে আমি তাদের বিচারের অপেক্ষায় আছি। যদি দুনিয়ায় দেখে যেতে নাও পারি তবে অবশ্যই সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর দরবারে বিচার দেখবো ইনশাআল্লাহ।
শহীদ মাসুমের মায়ের অনুভূতি এমন- “মাসুম লেখাপড়ার পাশাপাশি কুরআন-হাদিসের চর্চা করে এবং আমল করে। ছাত্রশিবিরের একজন ছাত্রকে পিতা-মাতার চক্ষুশীতলকারী সন্তান হিসেবে সমাজে উপহার দেয়। অভাবীদের ও গরিব ছাত্রের ভর্তির টাকার ব্যবস্থা করে নিজের প্রিয় পছন্দের জামাটি পরিয়ে দিয়ে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শহীদ মাসুম।লেখাপড়ায়ও মেধাবী ছিল। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ৩টি লেটারসহ ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইংলিশে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। আওয়ামী-সন্ত্রাসীরা তাকে মেরে ফেললো- এ কথাটি এখনো এলাকাবাসী সহ্য করতে পারছে না। আল্লাহর কাছে চলে যাওয়ার পর এখন বুঝি কী সম্পদ হারিয়েছি। ওকে আমি একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। সেই মাসুমকে ছাড়া আমি চোখের পানিকে সাথি করে বেঁচে আছি। সব আছে মাসুম নেই। তবুও এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই যে আমরা শহীদের মা হতে পেরেছি। আল্লাহর পথে বাধা দিতে গিয়ে তারাই ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে ফেরাউন ও নমরূদের মতো।”
হ্যাঁ, শত শত শহীদের রক্ত¯œাত এমন জনপদেই চলছে আজকের ইসলামী আন্দোলন। রক্তাক্ত জনপদের এ আন্দোলনের নেতা-কর্মীরাও রক্ত দেখে, বুলেট-বোমা ও লগি-বৈঠার এমন ভয়াবহ তাণ্ডব দেখে ভড়কে যায়নি। যাবেও না। কারণ, তারা জানে- জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর এই কাজে বাতিল শক্তির সাথে লড়াইয়ের পর বেঁচে থাকলে শহীদ, মারা গেলে শহীদ। আরশহীদেরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর! আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন- “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না।” (সূরা বাকারা: ১৫৪)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, “তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম: ১২১)। প্রিয় রাসূল সা. বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হওয়ার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (সুনানে নাসাঈ: ৩১৬১)।
বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহূর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তানহারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাইহারা বোনের আর্তনাদ, পিতাহারা সন্তানের করুণ চাহনি, মা-হারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণি-পেশার মানুষ। হক-বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোনো সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী। শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস।
২৮ অক্টোবরের রক্ত ও স্মৃতি বিজড়িত এ জমিনে একদিন আল্লাহর দ্বীন বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হবেই, শহীদদের পবিত্র রক্তগুলো কথা বলবেই; ইনশাআল্লাহ। সবশেষে আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলার নিকট নিবেদন-২৮ অক্টোবরের রক্তাক্ত এই জনপদের সকল শহীদ এবং কোটি কোটি মানুষের হদয়ের স্পন্দন শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ সকল শহীদদের শাহাদাতকে তিনি যেন কবুল করেন। তাঁদেরকে শাহাদাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমাদের সেই পথে কবুল করে জান্নাতে মিলিত হবার তাওফিক দিন, আমিন।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
আপনার মন্তব্য লিখুন