post

ইসলামী অর্থনীতির খুঁটিনাটি

তানভীর হোসাইন

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের যা দিয়েছেন, রাসূল সা. যা আমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন সে সকল বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার নাম হলো ঈমান। আর যারা এসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁদেরকে বলা হয় মুমিন। এদিকে ঈমান আর ইসলামের মধ্যে সম্পর্ক হলো একে অপরের প্রতিফলিত রূপ। বলা হয়ে থাকে “Islam is the complete code of life.” ইসলাম তার অনুসারীদের দিয়েছে ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয়জীবন, অর্থনৈতিক জীবনসহ সমগ্র জীবনের সম্পূর্ণ নির্দেশনা। যার অনুসরণ দ্বারা একজন মুসলিম তার জীবনকে পরিপূর্ণ অর্থবহ করে তুলতে পারবে। মানুষের অথর্নৈতিক জীবন নিয়েও ইসলাম সমাধান দিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম।”( সূরা বাকারা : ২৭৫)। মহান রাব্বুল আলামিনের এই বাণীকে সামনে রেখে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৪ শত বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের জন্য কল্যাণ-মূলক এক অর্থনৈতিক মডেল, যা ইসলামী অর্থনীতি নামে পরিচিত। ইসলামী অর্থনীতি বর্তমান সময়ে সব থেকে আলোচিত একটি বিষয়। ইসলামী কৃষ্ট ও সাংস্কৃতি নিয়ে গঠিত এ অর্থব্যবস্থা। যা মহান আল্লাহর দেওয়া নীতি-পদ্ধতি অনুসরণে পরিচালিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুনের ভাষায়, “ইসলামী অর্থনীতি হলো জনসাধারণের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান।”

ইসলামী অর্থনীতিবিদ ডা: মান্নান স্যারের ভাষায়, ‘Islamic economics is a social science which studies the economic problem of a people imbued with the value of Islam’ ইসলামী অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে থাকে।


ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি

“আল্লাহ তাআলা সুদকে হারাম এবং ব্যবসাকে করেছেন তোমাদের জন্য হালাল।” (সূরা বাকারা : ১৭২)। ইসলামী অর্থনীতির রয়েছে কতগুলো মূলনীতি এবং এই মূলনীতিগুলোর মাধ্যমে ইসলামী অর্থনীতি তার পরিকল্পনা, কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি এবং কর্মোদ্যোগ নির্ধারণ করে। নিম্নোক্ত তার মধ্যে কয়েকটা উল্লেখ করা হলো-

১. আদল তথা ন্যায়বিচার ও ইহসান এর প্রয়োগ।

২. জাকাতভিত্তিক অর্থ বণ্টন।

৩. সকল কাজে শরিয়তকে প্রাধান্য দেওয়া।

৪. সমাজে সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজ করতে বাধা দেওয়া।

৫. দুনিয়া এবং আখেরাতের কল্যাণ অর্জন।

৬. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা (তবে এক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক পন্থা বর্জনীয়)।

৭. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পরিচালনায় অভ্যস্তকরণ।

৮. জনগণের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ করা।

মানুষের বস্তুগত চাহিদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে মানুষের অস্তিত্ব, স্বাচ্ছন্দ্য ও মানবীয় উন্নয়নে কী কী বিষয় সত্যিকার অর্থে অবদান রাখে। এ কাজ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, তবে ইসলামী অর্থনীতি যদি সত্যিকারভাবেই মানবজাতির জন্য উপকার বয়ে আনে, তাহলে আমরা অদূর ভবিষ্যতে তার বাস্তবায়ন দেখব।


ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা 

সেক্যুলার বুদ্ধিভিত্তিক ও বিশ্ব দর্শনভিত্তিক কর্মকৌশল অবলম্বন করে উন্নয়নশীল এবং পুঁজিবাদী ও অন্যান্য মতবাদে বিশ্বাসী দেশগুলো তাদের অদূরদর্শিতা এবং কিছু ত্রুটিপূর্ণ অর্থব্যবস্থাকে পুঁজি করে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল, যদিও তারা এদিক দিয়ে সফল। রোম সাম্রাজ্য ১১০০ বছর ক্ষমতায় ছিল এবং তার সাথে অটোমান সা¤্রাজ্য ছিল ৭০০ বছর, উভয়ের দিকে তাকালে ইসলাম এবং অইসলামী অর্থব্যবস্থার সফলতার একটাই দিক পরিস্কার হয়- তাহলো মানবতা এবং ন্যায়বিচার। যেটা ইসলামের মূল হাতিয়ার। আদল তথা ন্যায়বিচারকে পুঁজি করে আজও ইসলামী রাষ্ট্রগুলো তাদের দেশকে শাসন করছে। ইসলামী অর্থনীতির ঐতিহাসিক ভিত্তি হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত; যেটা ইসলামেরও মূল উদ্দেশ্য। দুনিয়াতে সফল হওয়ার পাশাপাশি আখিরাতে সফল হওয়ার জন্য যে চাবিটি দরকার সেটা আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে রাসূল সা. দিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। নিম্নোক্ত ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা বর্ণনা করা হলো:

১. হালাল-হারাম মেনে চলা।

২. ধন-সম্পদ ইনসাফভিত্তিক বণ্টন করা।

৩. জাকাত ও ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন।

৪. অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা।

৫. ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

৬. সুদকে হটিয়ে কর্জে হাসানা ও মুদারাবার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৭. শ্রম ব্যবস্থায় শ্রমনীতির বাস্তবায়ন করা।

৮. ভূমি ব্যবস্থায় মিরাসি আইন বাস্তবায়ন করা।

৯. বাজার ব্যবস্থায় অসাদুপায় নিয়ন্ত্রণ করা।

১০. সমাজের কল্যাণার্থে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

১১. সর্বোপরি রাষ্ট্রব্যবস্থায় অর্থনৈতিক নীতিতে শরিয়তের প্রতিফলন ঘটানো।


ইসলামী অর্থনীতির কর্মকৌশল

ইসলাম এমন এক অর্থব্যবস্থার ধারণা পোষণ করে যা বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, বাস্তবিকভাবে পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক পন্থার মতোই কাজ করে কিন্তু মৌলিকভাবে পৃথক উভয়ের থেকে। ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল উৎস শরিয়াহ এবং একে কেন্দ্র করেই অর্থব্যবস্থায় তার কার্যসিদ্ধ করে। ইসলামসহ সকল অর্থব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করা। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পার্থক্য হলো ইসলামের সকল মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এবং সে চাইলেই একটা খারাপ কাজ করতে পারে না। কিন্তু অপরদিকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ইচ্ছে করলে যেকোনো কিছু করতে পারে, এক্ষেত্রে তাদের কোনো বাধা নেই। এবং পরকালে তাদের এটার জন্য জবাবদিহিতারও প্রয়োজন মনে করে না। নিম্নোক্ত ইসলামী অর্থনীতির কর্মকৌশল উল্লেখ করা হলো:

বিশ্বব্যবস্থা : তাওহিদ-খিলাফত-আদল।

মানবব্যবস্থা : বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব-সম্পদ একটি আমানত-সাদাসিধে জীবন যাপন- মানব স্বাধীনতা।

রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা : জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা-সম্মানজনক উপার্জনের উৎস-আয় ও সম্পদের সমতাভিত্তিক বণ্টন-প্রবৃদ্ধি ও স্থিতি-শরিয়তকে অনুসরণ-উৎপাদনব্যবস্থা বৃদ্ধিকরণ-পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ শাহ আব্দুল মান্নান স্যার ইসলামী অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল বইয়ে বলেছেন- ইসলামী অর্থনীতি তার চারটি স্ট্র্যাটেজি মেনে চলে। সেগুলো হলো :

১. নৈতিক চাকনি।

২. প্রাইস বা দাম।

৩. প্রোপার মোটিভেশন

৪. সামাজিক অর্থনৈতিক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা।


আরও কিছু কথা

মানব জীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম, বর্তমানে অর্থনৈতিক সমস্যাকে বড় সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হয়, এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বাতলে দেয় পুঁজিবাদী এবং সমাজতন্ত্রকে, কিন্তু ইসলামের আলোকে যদি আমরা সমস্যাগুলোকে সমাধান করি তাহলে কতই না সুন্দর দেখায়। আমাদের সমাজে ইসলামী অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য বিগত কয়েক দশক ধরে কিছু অর্থনীতিবিদ এবং মনীষী কিছু প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজে ইসলামী অর্থনীতির ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করতে পারি। যেমন: Association of Muslim social scientist, International Center for Islamic economic Jeddah.

আন্তর্জাতিকভাবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এই কোর্সটি চালু করেছে। তার মধ্যে বিশেষভাবে সৌদি আরব, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, তুরস্ক উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে অনার্স লেভেলে চতুর্থ বর্ষে এই কোর্সটি রাখা হয়েছে। তবে তার পরিধি আরও বিস্তর করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভুল ধারণা যেটা, সেটা হলো অনেকেই মনে করে ইসলামী অর্থনীতি মানে চৌদ্দশত বছর আগে যে অর্থব্যবস্থা ছিল সেটা। আসলে তা না, যদি বর্তমানে কোনো রাষ্ট্র ইসলামী অর্থব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাহলে তা হবে আধুনিক উপায়ে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই নজর রাখতে হবে।

১. ইসলামে সুদ হারাম এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থায় এটা পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ।

২. সম্পদের মালিকানা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। (সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ)

৩. দুস্থদের জন্য সামাজিক ব্যবস্থা। যেমন- জাকাত।

৪. ব্যবসা ও জীবিকা অনুসন্ধানের অধিকার।

৫. অর্থ ও সম্পদ জমাকরণের বিরুদ্ধে শক্ত মনোভাব।

৬. ইসলামের মিরাস ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৭. অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা।

৮. দুর্নীতির প্রতিরোধ।

৯. সকল কাজে শরিয়তকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

১০. দাম ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ।

১১. কালোবাজারি, মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ।

১২. উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন কৌশল উদ্ভাবন।

এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে যদি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান তার রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায় তাহলে সে রাষ্ট্র একটি আদর্শিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু ঐতিহাসিক কারণে ইসলামী অর্থব্যবস্থা তার পূণর্তা রূপ লাভ করতে পারেনি। এর পেছনে অবশ্য কয়েকটি কারণ রয়েছে। কারণগুলো হলো-

প্রথমত: মুসলমানদের অধঃপতন।

দ্বিতীয়ত: ইসলামী শাসনের পর পুঁজিবাদী এবং অন্যান্য অর্থব্যবস্থার শাসন।

তৃতীয়ত: জনগণকে অবগত করার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পন্থা না নেওয়া।

তবে আধুনিক বিশ্বের কয়েকটি দেশ ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে আবার নতুনরূপে গ্রহণ করতে শুরু করেছে, যেটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক।

লেখক : শিক্ষার্থী সরকারি কবি নজরুল কলেজ, ঢাকা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির