post

ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা: প্রেক্ষাপট একবিংশ শতাব্দী

ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ

০১ জানুয়ারি ২০২৪

প্রসঙ্গ কথা

মানব সভ্যতা বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ভূপ্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিবর্তনশীল এই বিশ্বকে সামগ্রিকভাবে কল্যাণমুখী করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

মানুষেরা আসলেই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। ক্রমাগতভাবে তারা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পৃথিবীকে মানবের বাসযোগ্য করে রাখার জন্য নানা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বহুল আলোচিত এজেন্ডা হচ্ছে- গ্রীন হাউজ এফেক্ট। সবুজের বেষ্টনীতে পৃথিবীকে ঢেকে রেখে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখা একটি বিশাল দায়িত্ব। তেমনি আরেকটি বিষয়- নৈতিক অবক্ষয়। মানুষের মানুষ হয়ে সারভাইভ করার জন্য চারিদিকে দৃশ্যমান নৈতিক স্খলন রোধ করার কোনো বিকল্প নেই।

মৌলিক মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ মানবসম্পদ সময়ের অনিবার্য প্রয়োজন। বোধ, বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা, বিনয়, দায়বদ্ধতা, পরোপকারিতা, সমাজ সংস্কার ও বিনির্মাণে আত্মনিয়োজিত প্রাজ্ঞজন খুঁজে বের করা ও তাদের বিকাশে সহযোগিতা প্রদান অতি আবশ্যক।

নানা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা বেশ কিছু শিবিরে বিভক্ত হয়ে আছেন। আজকের দিনে আদর্শিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। যেটিকে সাইয়েদ কুতুব চিহ্নিত করেছেন “বিংশ শতাব্দীর জাহেলিয়াত” হিসেবে। বিংশ শতাব্দী বিদায় নিলেও বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে শক্তির সেক্যুলারিজম-ই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী বিষয়। এটি জন্ম দিচ্ছে একদল ধর্মদ্রোহী মানুষ, যারা দাবি করে তারা ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু আদতেই তারা ধর্মবিদ্বেষী। নানা ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা যার যার ধর্মকে মেনে নিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল ও উদার হলে হয়তো একটি বিচিত্রতায় ভরা আন্তঃধর্ম সম্পর্ক ও সমন্বয় (Interfaith relations and harmony) গড়ে তোলা সম্ভব। ধর্মকে সামগ্রিকভাবে এড়িয়ে চলার যে ধর্মনিরপেক্ষীয় প্রয়াস এটি অচিরেই সমাজকে বড়ো ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।

আমরা আগামী দিনে কেবল প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ব শুধু তাই-ই নয় বরং প্রযুক্তি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাকেও গাইড করবে। ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার পর ডিভাইস ও অ্যাপ নির্ভরতা প্রচণ্ড রকমের বাড়ছে। ডিভাইস এতটা শক্তিশালী যে আপনি আমি ডিভাইস সাথে রেখে যেসব কথাবার্তা বলি ও কাজ করি তা আমাদের পরবর্তী সিদ্ধান্তকে সিগন্যালিং এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। এ.আই (AI) এসে কত কাজকে সহজতম করে দিয়েছে। এখন তো চ্যাটজিপিটি বিশাল বই আর আর্টিকেল তৈরির দায়িত্ব মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশের মতো মধ্য আয়ের দেশের নিম্ন আয়ের মানুষেরাও এখন কমপক্ষে দুটি টেলিফোন সেট ব্যবহার করেন যার একটি অবশ্যই এন্ড্রয়েড ফোন। ভাবা যায়, এদেশের মানুষ টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম ভোক্তা গোষ্ঠী! নরওয়ে জিয়ান টেলিকম কোম্পানি টেলিনর (Telenor) এর রেমিটেন্সের ৭০% যায় বাংলাদেশ থেকে।

বাংলাদেশের যারা ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা, কর্মী, সহযোগী এবং সমর্থক রয়েছেন তাদের জন্য কিছু অপরিহার্য আলোচনা আজকের প্রতিপাদ্য।

ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন কি-কেন-কীভাবে এ সমস্ত বিষয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ লেখা, আলোচনা ইত্যাদিতে উঠে এসেছে। তাতে স্থান পেয়েছে ইসলামী ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয়সমূহ। বিশেষ করে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের যে রূপরেখা ও আন্দোলন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে তার ইতিহাস ঐতিহ্য কর্মপন্থা সামনে রাখলে ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা ও এ পর্যন্ত তার বিস্তৃতির বিষয়ে ধারণা লাভ করা যায় এবং তারই ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনের একটি রোডম্যাপ এর খসড়া নির্মাণ করা যায়। 

সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রোড ম্যাপ

এক. 

সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিষয়ক একদল চিন্তাশীল ও বুদ্ধিভিত্তিক মানুষ দরকার যারা হাসান বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহার উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে উঠবেন। কুরআন, হাদিস, ইসলামী জীবন-বিধান বিষয়ক সাহিত্য ভান্ডার যেভাবে তাদের আয়াত্বে থাকবে তেমনি তারা সাহিত্য সংস্কৃতির যে বিশেষায়িত জ্ঞান ও চর্চা তাতেও ব্যাপক পারদর্শিতা অর্জন করবেন।  বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ক একটি সিলেবাস প্রণয়ন সময়ের দাবি। বর্তমানে বিদ্যমান এ সংক্রান্ত বইপুস্তককে সামনে রেখে সিলেবাসের প্রস্তাবনা হতে পারে নিম্নরূপ: 

(ক) শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

- ইসলামী জীবনব্যবস্থায় শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

- ইসলামী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ও রূপরেখা

- ইসলামী জীবনব্যবস্থায় সংস্কৃতির স্থান

- ইসলামী সংস্কৃতির রূপ

- ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য

- সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

- ইসলামী সাহিত্যের রূপ, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনীয়তা

পাঠ্যবই

১. মক্কার পথ- মুহাম্মদ আসাদ

২. ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা- সাইয়েদ আবুুল আ’লা মওদূদী

৩. শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি- মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম

গ্রন্থনির্দেশনা

১. ইসলামী সংস্কৃতি- আসাদ বিন হাফিজ

২. সংস্কৃতি ও বিনোদন- ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

৩. শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা- অধ্যাপক গোলাম আযম

৪. ইসলামী সাহিত্য: মূল্যবোধ ও উপাদান- আব্দুল মান্নান তালিব

(খ) বিশ্ব সাহিত্য: ইসলামী পরিপ্রেক্ষিত: তুলনামূলক অধ্যয়ন

- সাহিত্যের মূল্যায়ন

- জীবন ও সাহিত্য

ইসলামের সাহিত্য সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি

- সাহিত্যে রাসূলের (সা) পৃষ্ঠপোষকতা

- ইসলামী সাহিত্য ও ব্যাপকতা

- ইসলামী সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য

- মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ

- বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ও মানবিক মূল্যবোধের প্রভাব

এ ছাড়াও বিশ্ব সাহিত্যের ওপর ধারণা লাভের জন্য যেসব কবি ও সাহিত্যিক সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান প্রয়োজন:

১. গ্যাটে ২. জালাল উদ্দিন রুমি ৩. উইলিয়াম শেকসপিয়র ৪. জন মিল্টন ৫. লিও টলস্টয় ৬. আল্লামা ইকবাল ৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮. ওয়ার্ডসওয়ার্থ ৯. দস্তভয়েস্কি ১০. টি এস এলিয়ট প্রমুখ।

পাঠ্যবই

১. ইসলামের দৃষ্টিতে কবি ও সাহিত্যিক (সংকলন)

২. সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য- অধ্যাপক ড. হাসান জামান

৩. সৈয়দ আলী আশরাফ রচনাবলী

৪. মক্কার পথ- মুহাম্মদ আসাদ

৫. গল্প সংগ্রহ, কবিতা সংগ্রহ, প্রবন্ধ সংগ্রহ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৬. বিশ্ব সাহিত্য- মোবাশ্বের আলী

(গ) বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি

- বাংলাদেশের সমাজের ঐতিহাসিক পটভূমি

- ইসলামের আগমন, প্রচার ও প্রতিক্রিয়া

- ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন : পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

 - মুসলিম সমাজে হিন্দু সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

- হিন্দু ও মুসলমান সমাজের কাঠামোগত (Structural) পার্থক্য

- হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির দ্বৈধতা ও বিরোধ

- বাংলাদেশের সমাজে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

- বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক (ঝড়পরড়-ঊপড়হড়সরপ) কাঠামো

- বাংলাদেশের সমাজে বংশ-বর্ণ-গোত্র সমস্যা

- বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা : স্বরূপ

- সাম্প্রতিক বাংলাদেশে আধুনিকতাবাদের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

- বাংলাদেশের সমাজের কাঠামোগত অনুপযুক্ততা ও শিথিলতা

- বাংলাদেশের সমাজে শ্রেণিগত বিরোধ ও এর প্রতিক্রিয়া

- বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাব

- বাংলাদেশের সমাজের পুনর্গঠন : সমস্যা ও সম্ভাবনা

পাাঠ্যবই

১. বাংলাদেশের কালচার- আবুুল মনসুর আহমদ

২. বাংলাদেশে ইসলাম- আবদুল মান্নান তালিব

৩. বাঙ্গালীর ইতিহাস- মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ

৪. বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতির সমস্যা- লেখক শিবির

৫. বাঙ্গালীর ইতিহাস- নীহার রঞ্জন রায়

৬. বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর- আবদুল মওদূদ

৭. পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য- বাংলা একাডেমি

৮. সংস্কৃতির রূপান্তর- গোপাল হালদার

৯. পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি- কামরুদ্দিন আহমদ

১০. লোকায়ত সমাজ ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি- আবুু জাফর শামসুদ্দিন

১১. সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতি- অধ্যাপক ড. হাসান জামান

১২.Bangladesh Past and Present: Asiatic Society Published (Three Vol.)

১৩. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা- মোহাম্মদ আবদুল মান্নান

(ঘ) বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন

প্রাচীন ও মধ্যযুগ

- হিন্দু ও বৌদ্ধযুগ

- মধ্যযুগে মুসলিম প্রভাব ও মুসলিম সাহিত্যকর্ম

 - আরাকানে মুসলিম সাহিত্য

আধুনিক যুগ

- আধুনিক বাংলা সাহিত্য উদ্ভব, বিকাশ, কারণ ও প্রতিক্রিয়া

- সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রধান প্রধান ব্যক্তিত্ব

- আধুনিক সাহিত্য সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব

- মুসলিম সাহিত্য সংস্কৃতিসেবী

- নজরুলের মূল্যায়ন

- হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সাহিত্য সংস্কৃতিতে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

- পাকিস্তানোত্তর সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন

- ইসলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের সংঘাত

- ফররুখ আহমদ : একটি স্বতন্ত্র ধারার স্রষ্টা

- সাম্প্রতিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন

- চারটি ধারা : ইসলামী, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও সমাজতান্ত্রিক

- সাম্প্রতিক সাহিত্যে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ

- আদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে সাহিত্য- কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ,

- ছড়া, গান ইত্যাদির উপযোগিতা

- সংস্কৃতি বিকাশে গণমাধ্যমের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া : পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ইত্যাদি

- ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের অন্তরায়সমূহ ও অন্তরায়সমূহ মোকাবিলায় করণীয়, ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সাহিত্য সৃষ্টি : সমস্যা ও সমাধান

- নীতিনির্ধারণী সমস্যা (Conceptual Problems)

পাঠ্যবই

১. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত- মুহাম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান

২. মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য- আনিসুজ্জামান 

৩. সাহিত্য সংস্কৃতি ও জাতীয়তা- মোঃ মাহফুজ উল্লাহ

৪. পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য- বাংলা একাডেমি

৫. কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী- এম আর আখতার মুকুল

৬. কালজয়ী কালোত্তর- আব্দুল মান্নান সৈয়দ 

৭. ফররুখ আহমদ কবি ও ব্যক্তিত্ব- ইসলামিক ফাউন্ডেশন

৮. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান- মোশাররফ হোসেন খান

৯. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- গোপাল হালদার

১০. প্রবন্ধ সংগ্রহ, কবিতা সংগ্রহ, গল্প সংগ্রহ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১১. বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও প্রতিকার- আরিফুল হক

১২. Islam in Bengali Verses-BIIT

১৩. বুদ্ধির মুক্তি ও রেনেসাঁ আন্দোলন- মোঃ মাহফুজ উল্লাহ

১৪. বাংলাদেশের কালচার- আবুুল মনসুর আহমদ

১৫. নজরুল রচনাবলী- বাংলা একাডেমি

১৬. ইসলামী সংস্কৃতির প্রকৃতি ও স্বরূপ- ড. মুহাম্মাদ রেজাউল করিম

দুই.

এসব তাত্ত্বিক অধ্যয়নের বাইরে এ আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন হবে একদল সাংস্কৃতিক সংগঠক। সাংস্কৃতিক সংগঠক কোথাও হতে অকস্মাৎ নাযিল হওয়ার কোনো উপায় নেই। শৈশব-কৈশর থেকে সাহিত্য সাংস্কৃতিক কার‌্যাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট একজন মানুষ যেভাবে তৈরি হন, মধ্য বয়সে এসে হঠাৎ করে নিয়োজিত জনশক্তি (Demployed manpower) সেভাবে গড়ে উঠতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এভাবে বলতে পারি খেলাঘর/কচিকাঁচা/স্কাউট বা অনুরূপ শিশু-কিশোর সংগঠন কিংবা স্থানীয় শিশু-কিশোর ক্লাব/স্কুল পর্যায়ের প্রতিযোগিতা ইত্যাদির সাথে যুক্ত হওয়া একজন মানুষ অনেকটা সংগঠন বুঝতে পারে। প্রতিভাবান  শিশু-কিশোরেরা স্বাভাবিক নিয়মেই এসবের সাথে সম্পৃক্ত হয়। আবার বিশেষ প্রতিভা না থাকলেও কিছু কিছু মানুষ শৈশব-কৈশরেই সংগঠনের সংস্পর্শে আসে। নানা প্রকার কাজকর্মের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। এরাই পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সংগঠক হয়ে থাকে।

যারা এভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞতালব্ধ হয়ে সংগঠক হন তারা সৌভাগ্যবান। এদের সংখ্যা অনেক নয় বরং সীমিত। আজ দেশের আনাচে-কানাচে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড/ইনস্টিটিউশন/প্রতিযোগিতা/মেলা ইত্যাদি সংঘটিত হচ্ছে। ইসলামী ধারার তৃণমূল পর্যায়সহ সকল পর্যায়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংগঠক, শিল্পী তাতে অংশ নিতে পারেন। যদি না পারেন এমনকি পারলেও এসবের পাশাপাশি নিজেরাও নানা ধরনের কার্যক্রম সংগঠিত করা/আয়োজন করা সময়ের দাবি।

বাংলাদেশে বামধারার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিগণ জনপ্রিয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, চ্যানেল ও মিডিয়ার কল্যাণে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠার পেছনে রহস্য একটাই তারা ধারাবাহিক ও নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সুযোগ পেয়েছেন। ইসলামী ধারার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীরা এসব সুযোগের হকদার কিন্তু বর্তমানে বঞ্চিত। তাই আজ তাদেরকে বিকল্প ব্যবস্থা ও ধারার দ্বারস্থ হতে হবে। আমরা লেগে থাকলে অবশ্যই একদিন সাফল্য ধরা দেবে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০-১৯৪১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কালে গান, কবিতা, নাটক, গল্প ইত্যাদি সৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্মেলন, সমাবেশে জাগরণীমূলক অভিভাষণ প্রদান করেন। এসব অভিভাষণে তিনি তরুণ সমাজকে জাগিয়ে তোলা, নাগরিক সমাজকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন করার প্রয়াস লাভ করেন। 

নজরুল রচনাবলীর একটি খণ্ড এই অভিভাষণগুলোর সমষ্টি। তিনি পরিষ্কারভাবে মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণ, প্রাচ্য-সংস্কৃতির আদি নিবাস হিসেবে আমাদের উত্থান বিষয়ে পথপ্রদর্শন করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি (১৯২৯), ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে ভাষণ (১৯৩৮) কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউশন ভাষণ  (১৯৪০, ১৯৪১)-এ সাংস্কৃতিক সংগঠন, সামাজিক আন্দোলনের আহ্বান জানান।

যে কাজের তিনি সূচনা করেছিলেন তা শেষ করার দায়িত্ব এখন আমাদের। যুগের নকীব নজরুল ডাক দিয়ে গেছেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী ধারাবাহিকতা টেনেছেন, ফররুখ জাগরণী কবিতা লিখেছেন, আব্দুল মান্নান তালিব, মতিউর রহমান মল্লিক তাকে অনেক দূর টেনে এনেছেন।

আর এখন সে দায়িত্ব আমাদের প্রজন্মের। ইতোমধ্যে বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন ও ছাত্র সংগঠনের তত্ত্বাবধানে কাজটি অনেক দূর গুছিয়ে এসেছে। অমানিশার অন্ধকার ঠেলে সুবহে সাদিকের সূচনা হয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু নবীন-অরুণের উদয়। আলোয় আলোয় দিগন্ত উদ্ভাসিত হওয়ার। আর এ জন্য চাই রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়নসহ পাড়া মহল্লায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নব উম্মেষ ও পরিকল্পিত বিকাশ। আর তা হতে হবে শেকড়ে প্রোথিত শিখর পর্যন্ত বিস্তৃত মজবুত কর্মধারা।

তিন.

যখনই কোনো সংগঠন ডালপালা মেলে বিকশিত হতে থাকে তখন স্বাভাবিক নিয়মে তার ভেতর চিন্তার দ্বন্দ্ব ও বিচ্যুতি ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে থাকে যদি না তা প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ‘একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ : তার থেকে বাঁচার উপায়’ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য একটি বই।

সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে সম্পৃক্ত মানুষজন মূলত পারফর্মিং আর্ট এর সাথে যুক্ত থাকেন, তাদের কম-বেশি প্রতিভা থাকে আর প্রতিভা থাকলে তা প্রদর্শনের আগ্রহও থাকে। প্রদর্শনের সুযোগ যেমন তাদের পুলকিত ও গর্বিত করে তেমনি সুযোগ না পেলে এক ধরনের অভিমান ও বঞ্চিত হওয়ার ভাবনা তাদের আড়ষ্ট, পশ্চাদগামী ও বিস্তৃতি করে ফেলে।

এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

১. জনশক্তিকে নৈতিকভাবে উজ্জীবিত করা। প্রদর্শনেচ্ছা ও আত্মগর্বী হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখা।

২. সবাইকে সমান চোখে দেখা। সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া। দৃশ্যমান পক্ষপাতিত্ব থেকে বেঁচে থাকা। প্রকৃত প্রতিভাবান মানুষের মূল্যায়ন করা।

৩. সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কাজের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা। অতিমাত্রায় বিলাসী কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

৪. সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর আদর্শিক অবস্থান ও মান নিশ্চিত করা। কাউকে স্রষ্টার কাছে পূর্ণমাত্রায় আত্মসমর্পিত হওয়া থেকে দূরে থাকার সুযোগ না দিয়ে বাইয়াত-এর নিয়ামত লাভে সাহায্য করা।

চার. 

ইসলামী আদর্শের ওপর অবিচল থাকা ও হালাল হারামের সীমা বজায় রাখা

সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীদের জন্য অন্যতম জটিল বিষয় হচ্ছে শরীয়তের সীমার মধ্যে টিকে থাকা (Shariah Compliace)। এক্ষেত্রে বিগত দিনগুলোতে সংগঠনের একটি গ্রহণযোগ্য ঐতিহ্য ও প্রায়োগিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে।

বিশেষ করে অমীমাংসিত, কিছুটা বিতর্কিত মতভেদযুক্ত বিষয়ে অনেকেই নিজ নিজ তাহকিকের নামে তাজবিদকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিয়াসনির্ভর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করছেন অথচ সংগঠন একটি গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থা-বান্ধব শূরায়ী সিদ্ধান্ত মেনে চলছে।

যেমন : বাংলাদেশের ইসলামিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গান গজলসহ সকল বিষয়ে মিউজিক এর ব্যবহার পরিহার করা হয়। মতিউর রহমান মল্লিকসহ অতীত দায়িত্বশীলগণ সর্বসম্মতভাবে এটি মেনে চলেছেন এবং চলছেন।

এইভাবে নারী-পুরুষের যৌথ কোনো কর্মসূচির ব্যাপারে এযাবৎকালে একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কন্যা শিশুদের সবার সাথে পারফর্ম করার সুযোগ দেওয়া হয়। ২৫-৩০ বছরের এ প্রাকটিসে আল্লাহর রহমতে এখনো ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছরে বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বেশ কজন কন্যা শিশুশিল্পী নির্দিষ্ট বয়সের পর একই প্লাটফর্মে/মঞ্চে পারফর্ম করছে না এবং তাদের তৈরি করা কন্টেন্ট এয়ারে যাচ্ছে না। এসব শিল্পীরা মহিলা মহলে তাদের মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে আন্দোলনে ভূমিকা রাখছে।

এমনই আরেকটি ইস্যু হচ্ছে নাটক/সিনেমা ইত্যাদিতে নারী শিল্পীদের অংশগ্রহণ। অনেকেই Messenger the dawn of Islam কিছু Turkish Serial এর উদাহরণ টেনে প্রশ্ন তুলেছেন- আমরা কী করব? এ বিষয়টি জটিল, অমীমাংসিত ও ব্যাপক গবেষণার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে অবশ্যই একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি হবে।

ইসলামী সংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রশ্ন আসবে। এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে, Shariah Compliance স্থির করতে গেলে, অবশ্যই রাষ্ট্রের সমসাময়িককালের মহাক্কিক আলেমদের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত বা ইজমা তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে আশার দিক হলো কিছু কিছু গ্রহণযোগ্য বড়ো আলেম এসব নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সংগঠনও মুফতি ও আলেমদের নিয়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আশা করি সময়ের প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের এসব সংকট থেকে বের করে আনবে।

পাঁচ.

জাতীয়/ধর্মীয় ও সামাজিক ইস্যু ও দিবসে সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ কি করবে?

ইতোমধ্যে এসব বিষয়ে জাতীয়/স্থানীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য কিছু কর্মসূচি আমাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বছরের শুরুতেই সংগঠনসমূহকে সুচিন্তিত, সমন্বিত ও বাস্তবায়নযোগ্য বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় সংগঠনসমূহ সমন্বয় করে দিবসপালন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা আয়োজন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ ও বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে শাখা বা সংগঠনসমূহ নিজেদের সামর্থ্য বিবেচনা করে পরিকল্পনা নেবেন। ধার করে ঘি খাওয়ার মতো অবস্থা যেন না হয়। আমাদের পরিকল্পনা হবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে, SWOT এনালাইসিস-এর ভিত্তিতে সামর্থ্যকে সামনে রেখে এবং গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে হবে মজবুত কদমে এগিয়ে চলা সৈনিকের মতো।

এই ক্ষুদ্র প্রস্তাবনা হিসেব সামনে রেখে আমরা যদি সামস্টিক ও সামগ্রিক বিষয়ে সময়ের দাবীকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাই, কোনো বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা আমাদের পথচলা রুখে দিতে পারবে না। আমাদের রব তো জানিয়ে দিয়েছেন- ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, হতাশ হয়ো না, বিজয় তোমাদেরই হবে যদি তোমরা হও মুমিন’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১৩৯)। আর আমাদের নির্ভরতা তারই ওপর- ‘নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন ক্বারিব’ আল্লাহর সাহায্য সুস্পষ্ট ও বিজয় সুনিশ্চিত (সূরা সাফ, আয়াত : ১৩)।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির