post

উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস

আহমেদ আফগানী

২৭ জুন ২০২৩

উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। গত দুই পর্বে আমরা উল্লেখ করেছি কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির উত্থান হয়েছিল এবং কিভাবে উপমহাদেশে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে গঠিত হওয়া ছাত্ররাজনৈতিক দল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শেষ পর্বে থাকবে বাংলাদেশ পিরিয়ডে গঠিত হওয়ায় ছাত্ররাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলে বাংলাদেশে রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। বামপন্থী রাজনীতির উন্মেষ ঘটে। ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। জাতীয় রাজনীতির সাথে মিল রেখে ছাত্ররাজনীতিতে একই পরিবর্তন শুরু হয়। 

জাসদ ছাত্রলীগ  

পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের মধ্যে সুস্পষ্ট দুইটি ধারা বিদ্যমান ছিল। একটি ছিল বামপন্থী রাজনীতির ধারা এবং অপর অংশ ছিল সাধারণ সেক্যুলার। বাম রাজনীতির ধারার তিনজন ছাত্রনেতা ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন।১ তিন সদস্যের এই ক্ষুদ্র সত্তা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নিউক্লিয়াসের তিনজন সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। নিউক্লিয়াসের কাজ ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যাবতীয় নীতিকৌশল প্রণয়ন করা এবং স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ছিল এই তিন ছাত্রনেতার কাছে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিউক্লিয়াস প্রায় সাত হাজার কর্মীর একটি বিশাল বাহিনীতে পরিণত হয়।২

এই সংগঠনের কাজ ছিল দেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচি বিশেষত শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফা, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এগারো দফার আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনকে গণরূপদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। একইসাথে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করা ছিল নিউক্লিয়াসের অন্যতম কাজ। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন, জয়বাংলা বাহিনী গঠন এবং তার কুচকাওয়াজ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভিবাদন জানানো, সবই ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের বা নিউক্লিয়াসের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ।৩ বিপ্লবী পরিষদের সকল কর্মকাণ্ডের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের পরোক্ষ সমর্থন ছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের সাথে নিউক্লিয়াস সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। এর মূল কারণ আদর্শগত। নিউক্লিয়াস সদস্যদের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। অন্যদিকে শেখ মুজিব এটাকে শুধু সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ) নামে একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। জাসদের সাত সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আবদুল জলিল হন সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রব হন যুগ্ম আহ্বায়ক।৪ একই বছরে ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অতিরিক্ত কাউন্সিলে ১০৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে জাসদ তার ঘোষণাপত্রও অনুমোদন করে। সেই ঘোষণাপত্রে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা শ্রেণিহীন-শোষণহীন কৃষক শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। জাসদ ছিল মূলত পূর্বের গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস সদস্যদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কার্যত আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে জাসদ নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের যাত্রা শুরু করে। জাসদের যাত্রার সাথে সাথে তাদের ছাত্রসংগঠন ‘জাসদ ছাত্রলীগ’ নামে কর্মকাণ্ড শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত হওয়া প্রথম ছাত্রসংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ। 


বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 

স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রেক্ষিতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় হয়। ইসলামী জমিয়তে তালাবার অনুসারীরা বাংলাদেশে নতুনভাবে ছাত্ররাজনীতি শুরু করে। নতুন ছাত্রসংগঠনের নাম হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মীর কাসেম আলী এবং প্রতিষ্ঠাকালীন দলটির সদস্য ছিল মাত্র ছয়জন।৫ স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসাবে ঠিক করলো ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল সা. প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দ্বীন কায়েমের লক্ষ্যে শিবির ঠিক করলো পাঁচ দফা কর্মসূচি। নবী-রাসূলদের আন্দোলনের ইতিহাসকে সামনে রেখে শিবির তিন দফা স্থায়ী কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করলো দাওয়াত, সংগঠন ও প্রশিক্ষণের কর্মসূচি। অপর দিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে গ্রহণ করলো শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা আন্দোলন এবং সামগ্রিক ইসলামী জীবনাদর্শের কর্মসূচি। এভাবেই শিবির স্থির করলো তার ৫ দফা বাস্তবসম্মত ও  বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি।


বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালে ৩০ এপ্রিল জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনকে বেসামরিক করার উদ্দেশ্যে ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন।৬ জিয়া যখন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচন করবেন তখন তাঁর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন আব্দুস সাত্তার। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসলে জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গঠন করেন। জাগদলকে বিএনপির সাথে একীভূত করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়াউর রহমানের এই দলে বাম, ডান, মধ্যপন্থী সকল প্রকার লোক ছিলেন। বিএনপির সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগপদ্ধতি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন।৭

জিয়াউর রহমান যখন বিএনপির প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনি ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরি জন্য এর একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই তিনি বিএনপির জন্য ছাত্রসংগঠন করার কথা ভাবেন। ১ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে তিনি ছাত্রদল প্রতিষ্ঠা করেন। কাজী আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ওইদিন ছাত্রদলের প্রথম কমিটি প্রকাশ করা হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল মূলত তিনটি ছাত্রসংগঠন। ন্যাপের (ভাসানী) ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রদল, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) ছাত্রসংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) ছাত্রসংগঠন জাগ ছাত্রদল। জিয়াউর রহমান ও তাঁর ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা মুস্তাফিজুর রহমানের প্রচেষ্টায় এই তিন ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ছাত্রদলের প্রথম সভাপতি এনামুল করিম শহীদ ও পরবর্তী আহ্বায়ক ও সভাপতি ছিলেন গোলাম সারোয়ার মিলন। এরা দু’জনই ভাসানী ন্যাপের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রদল থেকে এসেছিলেন।৮ ছাত্রদলের প্রধান স্লোগান হচ্ছে- শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি। এই সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় ঢাকার নয়াপল্টনে অবস্থিত। বর্তমানে যারা বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত, তাদের মধ্যে অনেকেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাথে যুক্ত ছিলেন।


বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা

ইসলামী ছাত্রসেনা বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ছাত্রসংগঠন। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২১ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশে সুন্নি মতাদর্শভিত্তিক ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের লক্ষ্য। ইসলামী ফ্রন্ট গঠিত হওয়ার ১০ বছর আগেই এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসেনা আত্মপ্রকাশ করে। আহ্বায়কসহ মোট এগারোজন সদস্য নিয়ে ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিমে দেবপাহাড়ে আহলা দরবার শরিফের খানকায় এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে।৯ প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান। এই সংগঠনটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের দৃঢ়বিশ্বাস অর্থাৎ ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর সাহাবিদেও পথকে অনুসরণ করে। মূলত সুফিবাদ ও মাজার সংশ্লিষ্ট বিদয়াতি কার্যক্রমে তারা জড়িত। ইসলামী আইনশাস্ত্রের চারটি মাজহাব- হানাফি, মালেকি, শাফিয়ি এবং হাম্বলি ও সুফি তরিকা অর্থাৎ কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া এবং মুজাদ্দেদিয়াকে তারা লালন করে। ইসলামী ছাত্রসেনার বর্তমান সভাপতি সাইফুদ্দীন আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল জাবের।


বাংলাদেশ ছাত্র  মৈত্রী

ছাত্র মৈত্রীর মূল সংগঠন বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে, সত্তরের দশকের মধ্যভাগে রামপন্থী কমিউনিস্ট ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয় বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে। এরই পথ ধরে ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ঐক্য সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্রদলের দুইটি অংশ এবং বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন মিলিত যাত্রা শুরু করে। তখন জাতীয় ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আজিজুর রহমান খান আসাদ। ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘বিপ্লবী ছাত্র  মৈত্রী’। ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে এই ঐক্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সনে জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নের সাথে ঐক্য হয় এবং সংগঠনের নাম ‘বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী’ অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৮৪ সনে ২২ সেপ্টেম্বর বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশের সাথে ঐক্য হলে সংগঠনের নাম পরিবর্তন হয়ে ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী’ নামটি ধারণ করে। ১৯৮৮ সনে ৭ এপ্রিল বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের আরেকটি অংশের সঙ্গে ঐক্যের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’ নাম ধারণ করে সংগঠনটি। এরপর আরো দুই দফায়; ১৯৮৮ সনে ২১ নভেম্বর জাতীয় ছাত্র সংসদের সঙ্গে এবং ১৯৯২ সনে ২৩-২৪ অক্টোবর গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ঐক্য হয় বাংলাদেশ ছাত্র  মৈত্রীর।১০


জাতীয় ছাত্রসমাজ

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্যু করে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অপসারণ করে সেনাশাসন শুরু করেন। বহুদিন সেনাশাসক হিসেবে দেশ শাসন করার পর ১ জানুয়ারি ১৯৮৬ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন।১১ এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন হিসেবে জাতীয় ছাত্রসমাজ নামে একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। 


সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসে বামপন্থী নিউক্লিয়াসের সদস্যরা। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর তাদের সমন্বয়ে যাত্রা শুরু করে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসা এই লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে নিয়ে গঠিত হয় জাসদের ছাত্রসংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ। এর ৮ বছর পরে জাসদ থেকে খালেকুজ্জামান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়।১২ তখন জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জাসদ থেকে আলাদা হয়ে বাসদের ছাত্রসংগঠন হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। দেশে তারা পরিচিত হয় বাসদ ছাত্রলীগ নামে। ১৯৮০ এবং ১৯৮২ সালে পরপর দুইবার বাসদ ছাত্রলীগের প্যানেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসুর নির্বাচনে ভিপি এবং জিএস পদে জয়ী হয়। ১৯৮৩ সালে এই ছাত্রলীগের অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে পৃথক ও স্বতন্ত্র সাংগঠনিক অস্তিত্ব চিহ্নিত করার জন্য সংগঠনের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৮৪ সালের ২১ ও ২২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে বাসদ ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট নামে নামকরণ করা হয়।(১৩) সংগঠনটির প্রতিষ্ঠালগ্নে ঘোষণা দিয়েছিল কমিউনিস্ট সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সর্বজনীন,  বৈষম্যহীন, সেক্যুলার, বিজ্ঞানভিত্তিক, একই পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শিক্ষার দাবিতে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করবে। 


বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন

এরশাদ  বিরোধী  আন্দোলনের  মধ্য দিয়ে ১৯৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়।১৪ এটি কমিউনিস্ট আদর্শভিত্তিক সংগঠন। দলটির তৎকালীন সভাপতি ফয়জুল হাকিম স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতৃত্ব ছিলেন। দলটি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, অধ্যাপক গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ৯২-এর আন্দোলন, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেয়। ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সংগঠন যেমন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বাংলাদেশ বহুমুখী শ্রমজীবী ও হকার সমিতি, নারী সংহতি, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি, প্রতিবেশ আন্দোলন ও বাংলাদেশ কৃষক-মজুর সংহতি ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখকে নিয়ে একটি জাতীয় প্লাটফর্ম ‘গণসংহতি আন্দোলন’ নামে যাত্রা শুরু করে। এরপর প্রায় ১৪ বছর পরে ২০১৬ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ নভেম্বর গণসংহতি আন্দোলন তার তৃতীয় জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সম্মেলনে জোনায়েদ সাকি প্রধান সমন্বয়কারী ও অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম নির্বাহী সমন্বয়কারী হিসেবে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হন।


বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস

৮ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন, ড. আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী যুব শিবির, তমদ্দুন মজলিসের সংগঠক ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মাসউদ খানের নেতৃত্বে মওলানা ভাসানীর ন্যাপের একাংশ একীভূত হয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আত্মপ্রকাশ করে। এর কিছুদিন পর অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি ১৯৯০ সালে দলটির ছাত্রসংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।১৬


বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র আন্দোলন

১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন’ নামে রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রায় ৯ বছর পর ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ৮ জুন ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়।১৭


ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ

১৯৮৭ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবগুলো ইসলামী রাজনৈতিক দল ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে একটি জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয় জামায়াতের পক্ষ থেকে। এই জোটবদ্ধ আন্দোলনকে একটি দলে পরিণত করেন চরমোনাই পীর  সৈয়দ ফজলুল করিম। প্রথমে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন নামে এই সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। পরে নাম পরিবর্তন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাখা হয়।১৮ মূল দল প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর ১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন’ নামে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন যাত্রা শুরু করে। মূল সংগঠনের নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাত্র শাখার নাম পরিবর্তন হয়ে ‘ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ’ হয়।     


বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ বাংলাদেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়, সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি গণতান্ত্রিক ছাত্রসংগঠন। এর পূর্বনাম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ২০১৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সংগঠনটি অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। সংগঠনটির আন্দোলনের চাপে বাংলাদেশ সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটাপ্রথা বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়। ২০১৮ সালে বেশ কয়েকবার সংগঠনটির কর্মীরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামকে সংক্ষেপে ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’ হিসেবে সম্বোধন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সংগঠনটি ২৫ ফেব্রুয়ারি নিজেদের প্যানেল ঘোষণা করে। প্যানেলের সহ-সভাপতি প্রার্থী মো: নুরুল হক নূর, সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মো: রাশেদ খান এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মো: ফারুক হোসেন মনোনীত হন। নুরুল হক ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন।২০


তথ্যসূত্র 


১. আমি সিরাজুল আলম খান / শামসুদ্দিন পেয়ারা / মাওলা ব্রাদার্স/ পৃ : ৪২-৪৩ 

২. আমি সিরাজুল আলম খান / শামসুদ্দিন পেয়ারা / মাওলা ব্রাদার্স/ পৃ : ৪৯ 

৩. ৭ মার্চের ভাষণ এবং সিরাজুল আলম খান / জাফরুল্লাহ চৌধুরী / দৈনিক নয়া দিগন্ত / ৯ এপ্রিল ২০১৮ 

৪. উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী ও বামধারার রাজনীতি, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ / জয়নাল আবেদীন / বাংলাপ্রকাশ / পৃ. ২৬২, ২৬৬, ৪৫৩

৫. গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস/ ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইট / নধহমষধ.ংযরনরৎ.ড়ৎম.নফ/ধৎঃরপষব/ ধৎঃরপষবফবঃধরষ/৬২৪ / অ্যাকসেস ইন ১৬ আগস্ট ২০২৩। 

৬. জিয়া কেন স্মরণীয় / মহিউদ্দিন খান মোহন / দৈনিক ইনকিলাব / ৩০ মে, ২০১৭ 

৭. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল / এমাজউদ্দীন আহমদ / বাংলাপিডিয়া / এশিয়াটিক সোসাইটি 

৮. ছাত্রদলের ৩৯ বছরের উপপাদ্য / সর্দার আমিরুল ইসলাম / বাংলা ট্রিবিউন / ১ জানুয়ারি ২০১৮ 

৯. সুন্নি জাগরণের সূচনায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা / এম এ  মতিন / বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা / পৃ. ৬ 

১০. ছাত্র মৈত্রীর ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী মঙ্গলবার / আনোয়ারুল করিম / বাংলা নিউজ ২৪ / ৫ ডিসেম্বর ২০১১ 

১১. জাতীয় পার্টি সম্পর্কে / জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইট / bit.ly/3OAqk Pt / অ্যাকসেস ইন ১৬ আগস্ট ২০২৩

১২. ‘অনেক সূর্যের আশায়’ মান্না / এনাম আবেদীন / কালের কণ্ঠ / ২ ডিসেম্বর ২০২০

১৩. গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র / সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

১৪. প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছাত্র ফেডারেশনের মিছিল-সমাবেশ / বাংলা নিউজ ২৪ / ১১ জানুয়ারি ২০১৬

১৫. গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচিতি / বাংলা নিউজ ২৪ / ৮ নভেম্বর ২০১৬ 

১৬. খেলাফত মজলিস / জাগরণীয়া / ১৯ আগস্ট ২০১৮

১৭. তওবার রাজনীতির প্রবর্তক আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. / মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী /   দৈনিক সংগ্রাম / ১৯ নভেম্বর ২০১৪

১৮. বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির তিন দশক / মো. এনায়েত উল্যা পাটোয়ারী / অসডার পাবলিকেশন / পৃ. ২৮০ 

১৯. বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এক বছর / নুর হোসেন ইমন / দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস / ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

২০. নূরের উত্থান, ২৮ বছর পর ডাকসুতে নির্বাচিত ভিপি / বাংলা নিউজ ২৪ / ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির