প্রসঙ্গ কথা
ছাত্ররা হলো যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান নিয়ামক। কোনো বিপ্লব, সংগ্রাম বা আন্দোলন সফল করতে হলে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতাকে সম্পৃক্ত করা অনিবার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী ইতিহাস তার সাক্ষী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যতগুলো বড় অধ্যায় ছিল, বিশেষত ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ- তার প্রতিটিতেই ছাত্রদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন হলো ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলন সফল হওয়ার পেছনে মূল শক্তি ছিল ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। রাজনৈতিক দলগুলোর জোটের বাইরে তখনকার সকল ছাত্রসংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ২০০০ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়। এ সর্বদলীয় ঐক্যের মাধ্যমে দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ফলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
বর্তমানে চরম সংকটে দেশ। গুম, খুন, হত্যা, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখীসহ নানা দুঃশাসনে পিষ্ট সাধারণ নাগরিক। দেশে নেই কোনো বাক-স্বাধীনতা। ভোটাধিকারের মতো সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার বিলীন প্রায়। গণতন্ত্র আজ পঙ্গু। ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দীনের পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালের নিশি রাতের ভোট ও ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ‘স্বৈরশাসকের ন্যায়’ দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা আইনের জালে ফাঁসানো হচ্ছে। নিরবে গুম করে দিতেও পিছপা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০-এর বেশি মানুষকে গুম করেছে আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনী। এর মধ্যে অনেককে ক্রসফায়ারে হত্যা, কিছু লোককে আদালতে হাজির করা এবং কিছু লোককে ছেড়ে দেয়া হলেও এখনও প্রায় ১০০-এর অধিক মানুষ নিখোঁজ।
দেশের এই চরম সংকটে নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সাংবিধানিক অধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন খুবই প্রয়োজন। যার প্রধান শক্তি হবে ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র ঐক্য। ৫২ থেকে শুরু করে ২০০০ সালের দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলনের মতো তেজদ্বীপ্ত ছাত্রদের আরেকবার রাজপথে ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা নিপীড়িত জনতার।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও এর গুরুত্ব
দেশের ক্রান্তিলগ্নে জনসাধারণের অধিকার সুরক্ষায় সম্মিলিত আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণে যে সর্বঐক্য গঠিত হয়, তাই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। যাকে ইংরেজিতে বলা হয়- Student Organizations Coalition অথবা All-party Student Unity.
বাংলাদেশে চরম ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। দেশে গুম, খুন, হত্যা, লুটতরাজ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। দেশ থেকে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ব্যাংক, বিমা ও শেয়ারবাজার- সব ক্ষেত্রেই মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের দুর্নীতির খবর এখন পত্রিকার পাতায় পাতায়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রিজার্ভ চুরি হওয়ার ঘটনায় সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এসবই জনগণের টাকা। এছাড়া লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক, গ্যাস সংকট, মূল্যস্ফীতি, ডলারের ক্রমবর্ধমান দাম, রিজার্ভ কমে আসা, টাকার অবমূল্যায়ন, বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দেশের মানুষ চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। এককথায়, দেশে দুঃশাসন বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ছাত্র সমাজের ঐক্য অনিবার্য।
- কারণ, তরুণরা বিচ্ছিন্ন থাকলেই ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠে। স্বৈরাচার দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর ছাত্ররা গর্জে উঠলে কোনো স্বৈরাচারই টিকে থাকতে পারে না। এজন্য ছাত্র ঐক্য এখন সময়ের দাবি।
- অতীতের যে কোনো বড় আন্দোলন ছাত্রদের ঐক্য ছাড়া সফল হয়নি। ফলে বাংলাদেশে বিদ্যমান সংকট উত্তরণে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করা অনিবার্য।
- ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধতা সাধারণ নাগরিকের মধ্যে আশার সঞ্চার করে এবং তাদেরকে আন্দোলনে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ফলে আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
- আন্দোলনকে জোরদার করতে কর্মসূচির ঐক্য জরুরী। ছাত্র ঐক্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মসূচির সমন্বয় এবং সফল বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
- তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোকেই মূলত জনগণের রাজনৈতিক দল (Political Party of People) মনে করা হয়। ফলে জনগণের দাবি আদায়ে ছাত্র ঐক্যের ভূমিকা অপরিহার্য।
ইতিহাসে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য
দেশের সংকটকালে যুগে যুগে ছাত্ররা এক কাতারে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কৃষক, শ্রমিক, জনতা। ফলে প্রতিটি আন্দোলনই গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকায় এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র ঐক্যের বর্ণনা তুলে ধরা হলো;
৫২-এর ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। আর ১৯৫২ সালে ঘটে তার চরম পর্যায়। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ; পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা। পূর্ববঙ্গসহ সে-আমলের পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভাষা হচ্ছে বাংলা, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণার দাবি ছিল সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। ভাষা আন্দোলনকারীরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকেফহাল ছিলেন যে, পাকিস্তানের প্রস্তাবিত সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব না হলে দেশের শতকরা ৫৬ ভাগ বাংলাভাষী নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। এজন্যই পাকিস্তান অর্জিত হবার মাত্র ৭ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রথম দফায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ইন্তেকাল হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠী আপাতত ‘নিশ্চুপ’ হয়ে পড়ে। এরপর ১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে ঢাকার মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমউদ্দীন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন সদম্ভে ঘোষণা করলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ফলে ‘তুষের আগুন’ আবার জ্বলে উঠল। দ্বিতীয় দফায় শুরু হল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হল ঢাকার রাজপথ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্ব এখান থেকেই। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ছাত্রসমাজের উদ্যোগে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ- এই দুই দফা ভাষা আন্দোলন সফল করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও আন্দোলন প্রক্রিয়া
ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৫ বছরে কয়েকটি ছাত্র ঐক্য সংগঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে কোনোটা ব্যর্থ হয়েছিল, আবার কোনোটাকে পুনর্গঠিত করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের এ লড়াইয়ে সবগুলো ছাত্র ঐক্যই ছিল এক একটি ধাপ। প্রথম ছাত্র ঐক্য হিসেবে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হওয়ার ফলেই ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ভাষা আন্দোলনকে সফলতা এনে দেয়।
প্রথম সংগ্রাম পরিষদ : ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কলাভবনের (বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সি) কাছেই রশিদ বিল্ডিং-এর একটি রুমে তমদ্দুন মজলিশের অফিস। এই অফিসেই এক সভায় গণতান্ত্রিক যুবলীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশের কিছু কর্মী ছাড়াও জনকয়েক বুদ্ধিজীবী এবং অধ্যাপক হাজির ছিলেন। সভায় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নাম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এই পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয় তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াকে। তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের পৃষ্ঠপোষকতায় এ কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই কমিটি কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ঘোষণা এবং ভাষা আন্দোলন সংগঠনে বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ : ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকায় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, প্রগতি লেখক সংঘ এবং বিভিন্ন হলের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাভাষা আন্দোলনকে অচিরেই সমস্ত পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সবারই সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, প্রথম সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠিত করতে হবে। লক্ষণীয় যে, এই বৈঠকে প্রথম সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া অনুপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলোচনার পর সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রনেতা শামসুল আলমকে ‘দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক মনোনীত করা হয়। সভায় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা শহরে’ সংগ্রাম পরিষদের শাখা গঠন এবং ১১ মার্চ বাংলাভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই মোতাবেক ঘোষণাও দেয়া হয়। এই দ্বিতীয় পরিষদের আমলেই গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ভাষণে জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্রদের তরফ থেকে। এমনকি জনাব জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাভাষার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করে।
তৃতীয় সংগ্রাম কমিটি : ইতিমধ্যে বিভিন্ন হলগুলোতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় এবং এসব কমিটি বাংলাভাষার আন্দোলনকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে চাপ দিতে শুরু করে। উপরন্ত দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বিধায় উক্ত কমিটি স্বীয় কার্যক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। এরই জের হিসাবে ১৯৫০ সালের মার্চের গোড়ার দিকে গঠিত হল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’। আহ্বায়ক জনাব এ মতিন। বন্ধুমহলে ইনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত হন। ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি-এর উদ্যোগে ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হয় । এর কর্মসূচির মধ্যে ছাত্র ধর্মঘট, মিছিল ও জনসভা অন্যতম।
চতুর্থ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ : ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দেন। এই বক্তব্য ছিল, জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো। এতে ছাত্রসমাজে তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট, প্রতিবাদ সভা এবং রমনা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল হয়। বিকালে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় নেতা ও কর্মীদের যৌথ সভা এবং ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠিত হল। এই সভার সিদ্ধান্ত হয়- ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র হরতাল, শোভাযাত্রা ও জনসভা। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে বলে এই দিনটিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় আকস্মিকভাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি এবং পরবর্তী একমাস পর্যন্ত সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা, না করা নিয়ে ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভাজন দেখা দিল। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে গাজিউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশাল ছাত্রসভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। সেই মোতাবেক ‘দশজনী মিছিল’ রাস্তায় বের হবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ এবং ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। ছাত্রদের পক্ষ থেকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকল। বেলা ৩টা ১০ মিনিটে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। ঘটনাস্থলে এবং হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে চারজনের মৃত্যু হয়। বহু ছাত্র গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তারা এসে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সেখানেও পুলিশ গুলি ছুঁড়লে ৪ জন (সরকারি হিসাবে) নিহত হয়।
পঞ্চম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ: গুলিবর্ষণের পরেও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ কোনো কর্মসূচি দিতে পারল না। ফলে ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সে-রাতেই জনাব অলি আহাদকে আহ্বায়ক মনোনীত করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। এই কমিটির নির্দেশ মোতাবেক ভয়াবহ দমননীতির মোকাবেলায় ৫ মার্চ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল।
ষষ্ঠ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ: ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী যথাযথভাবে পালনের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে ষষ্ঠ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ভাষার দাবি জিইয়ে রাখে।
আরমানিটোলায় বিশাল সমাবেশে এক-দফা দাবি জানানো হয়, ভাষার দাবির পাশাপাশি মাওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে।
ফলাফল
এভাবে ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন সফল হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali. (উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা)। ঐতিহাসিক এ সফলতা একমাত্র ছাত্র ঐক্য পরিষদের অব্যাহত আন্দোলনের ফসল।
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান
ভাষা, গণতন্ত্র ও শিক্ষার জন্য সংগ্রাম এবং বৈষম্য অবসানের জন্য সংগ্রামের পথেই এসেছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন জেনারেল আইয়ুব খান। এরপর আবারও পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) ওপর নিপীড়ন শুরু করেন। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এ সরকারকে হটাতে সাধারণ জনগণ আন্দোলনে যোগ দেয়। স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে স্বাধীনতা দেয়ার জন্য এ আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলো শক্তিশালী ভুমিকা পালন করে। এর জন্য দেশের কিছু দামাল ছেলেকে জীবন দিতে হয়। ফলে গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও আন্দোলন প্রক্রিয়া
পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালিন প্রধান ছাত্র সংগঠনসমূহকে নিয়ে সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, রাশেদ খান মেনন সমর্থিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, মতিয়া চৌধুরী সমর্থিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ৮ জন ছাত্রনেতা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ পরিষদ গঠন করেন। একই বছরের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) ভেঙ্গে এর সভাপতি মাহবুবুল হক দুলন, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। পর্যায়ক্রমে সংগঠনের বিস্তৃতি হয় এবং ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি এ সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। যা ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শহর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলেও তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীনতাকামী বিভাগীয় শহর এবং জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ওইসব শহরগুলো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিকগণ রাস্তায় নেমে আসেন। এর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রদের একাংশ ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন পরিষদের এগারো দফার সমর্থনে আন্দোলন করে। তখন প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলন তথা সংগ্রাম পরিষদ এক প্রকার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে জারি থাকা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘দাবি-দিবস’ ঘোষণা করে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম ছাত্রসমাবেশের ডাক দেয়। বটতলা ছাত্রদের একটি বড় মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বের হলে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, রঙিন পানি নিক্ষেপ ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। সে সময় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মোশাররফ হোসেনসহ একাধিক ছাত্র আহত হন।
আন্দোলনে পুলিশের হামলায় ছাত্র আহত হওয়ার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালে ১৮ জানুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট পালনকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। আবার ছাত্র গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং ধর্মঘট পালনে মিছিল বের করলে পুলিশ আট ছাত্রকে গ্রেফতার করে। আন্দোলন সংগ্রামে পুলিশের নির্যাতন বন্ধ, ১১ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ২০ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ দিন ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল বের করে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এক পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে মেনন সমর্থিত পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান শহীদ হন।
পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান নিহতের প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকায় হরতাল পালন করে এবং আসাদের জন্যে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। এ দিন সংগ্রাম পরিষদ ২২ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী (পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান) মিছিল ও প্রতিবাদ সভা, ২৩ জানুয়ারি মশাল মিছিল এবং ২৪ জানুয়ারি হরতাল পালন করে। স্বৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে ২৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংবাদপত্রসমূহে বিবৃতি প্রদান করে পুনরায় একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। তখন ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজাদ, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ- এসব পত্রিকায় প্রতিদিন এই আন্দোলনের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হতো।
ফলাফল
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশী জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মাইলফলক। ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২৪ জানুয়ারি মতিউরসহ চারজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই গণঅভ্যুত্থান পূর্ণতা লাভ করে। আর সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই গণঅভ্যুত্থানের সমাপ্তি ঘটে। এই আন্দোলন শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, একপর্যায়ে কৃষক, শ্রমিক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই তা হয়ে উঠেছিল গণঅভ্যুত্থান। মূলত ছাত্রদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আন্দোলন ও একই দাবিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আইয়ুব খান ঘোষণা করেন তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন না।
৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক বাহিনীর প্রধান হোসাইন মোহাম্মাদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ক্ষমতা দখল করেই সামরিক ফরমান জারি করেন। এতে বলা হয়, যেকোনো ভাবে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করলে ৭ বছরের জেল। তথাকথিত এই কালো আইনে হাজারো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষমতা দখল করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তিনি কথা রাখেননি। বরং বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। প্রহসনের নির্বাচনের আয়োজন করেন। দুর্নীতি-লুটপাটের মচ্ছব চলতে থাকে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করেন। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হত্যা-খুন-গুম-দমন-পীড়নের ঘৃণ্য রাজনীতি শুরু করেন। এ স্বৈরশাসককে হঠাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে ছাত্র ঐক্য।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও আন্দোলন প্রক্রিয়া
এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সকল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ জানায়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও যোগ দেয়। স্বৈরাচারকে মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি হয়। নানা প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে জোট-ঐক্য গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট গঠিত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় জামায়াতে ইসলামীর যুগপৎ আন্দোলন। সেসময় পত্রিকাগুলোতে এই দুটি জোট ও জামায়াতের পৃথক সমাবেশের খবর প্রকাশিত হতো। পরবর্তীতে বামদের পাঁচ দলীয় জোট গঠিত হয়। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে ৮ দলীয় জোট, ৭ দলীয় জোট, ৫ দলীয় জোট ও জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে নতুন করে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠে। জামায়াতে ইসলামীর কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির দাবি অবশেষে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পৃথক পৃথক সমাবেশে ৮ দলীয়, ৭ দলীয়, ৫ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করে।
ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও ২টি জোট গড়ে ওঠে-ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সংগ্রামী ছাত্র জোট। আন্দোলন আরও জোরদার করতে ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদের মরদেহ সামনে রেখে ২৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ গঠন করা হয়। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে ছাত্রশিবির না থাকলেও তারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৪৪ ধারার মধ্যে ছাত্রশিবির ১০-১৫ জনের ছোট ছোট গ্রুপ বিভিন্ন সড়কে জড়ো হয়ে তাৎক্ষণিক মিছিল করত এবং কিছুক্ষণ পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের ৪৯ জন শহীদ হন বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে যেয়ে।
যুগপৎ আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কারফিউ দিলে কারফিউ ভেঙ্গে ছাত্র জনতা মিছিল করে। ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র, শ্রমিক এবং বিভিন্ন পেশার মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে ঢাকা শহর ভরে যায়। সরকারের প্রশাসন ভেঙে পড়ে। পরদিন এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দেন এবং তারপর দিন ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার পদত্যাগ করে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ফলাফল
তিনটি জোট ও জামায়াতে ইসলামীর যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে সব ক’টি ছাত্র সংগঠনের মিলিত শক্তির আন্দোলনের কাছে সেনাবাহিনী সমর্থিত জেনারেল এরশাদ টিকতে পারে নাই। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এর আন্দোলনের সাথে দেশের জনগণ সম্পৃক্ত হলে তা গণআন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দীর্ঘ ৯ বৎসর ধরে পরিচালিত আন্দোলন ১৯৯০ এ এসে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সেই গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেন। এর মাধ্যমে দেশ রক্ষা পায় এক স্বৈরশাসকের কবল থেকে।
২০০০-এর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য
২০০০ সালে মূলত ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতৃত্বেই এই ঐক্যটি গড়ে উঠে। ঐ সময় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন এহসানুল মাহবুব জোবায়ের এবং সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল। তখন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এবং সেক্রেটারি ছিলেন নাসির উদ্দিন পিন্টু। এই ঐক্য হঠাৎ করে হয়নি। ১৯৯৫ সাল থেকে দুই দলের ধারাবাহিক ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে এই ঐক্য গঠিত হয়। মূলত ওই সময় থেকেই তৎকালীন ছাত্রদল নেতা আমান উল্লাহ আমান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ ছাত্রদল ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে এই ঐক্য গঠন করা হয়।
১৯৯৯ সালে ছাত্র ঐক্য বিষয়ে খালেদা জিয়ার সাথে শিবির নেতৃবৃন্দের দীর্ঘ দুই ঘন্টাব্যাপী মিটিং হয়। ওই বছরই ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলসহ ১৫টি ছাত্রসংগঠন নিয়ে সর্বপ্রথম মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের যৌথ প্যানেল ছাত্রলীগের বিপরীতে নির্বাচনে জয়লাভ করে। ভিপি হিসেবে ছাত্রদলের আশিক উর রহমান মাহমুদ ওয়াসিমসহ ৮ পদে, জিএস হিসেবে ছাত্রশিবিরের সানাউল্লাহ মজুমদার, এজিএস শহিদুল ইসলামসহ ১১ পদে বিজয়ী হয়। ফলে ছাত্র ঐক্যের বিষয়টি আরো জোরালো হয়। নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ জাতীয় ছাত্র ঐক্য গঠন বিষয়ে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
পরবর্তীতে ২০০০ সালে ছাত্রশিবির ১৬/১৭টি সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে এক চমকপ্রদ আলোচনা করেন। ২০০০ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর তৎকালীন আওয়ামী সরকারের সীমাহীন নির্যাতনের ফলে অন্যান্য ছাত্রসংগঠন এই ঐক্যের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ে। তবে ছাত্রশিবিরের সাহসী এবং সক্রিয় কর্মকাণ্ডের ফলে ২০০০ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সমমনা ১০টি সংগঠনকে নিয়ে ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়। এই ক্ষেত্রে যেসকল সমাবেশ হয়েছে সেই সমাবেশগুলোতে কেউ একক নেতৃত্বে ছিলেন না। শিবিরের পক্ষ থেকে সভাপতি থাকলে প্রধান আলোচক/বক্তা থাকতো ছাত্রদলের। আবার সভাপতি ছাত্রদলের হলে প্রধান আলোচক/বক্তা থাকতো শিবিরের। এবং বিভিন্ন সমাবেশে ছাত্রদল, শিবির উভয়ের বক্তব্যের সময় স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান দেয়া হতো। ওই সময়গুলোতে শিবির নেতৃবৃন্দ নিয়মিত ছাত্রদলের অফিস ভিজিট করতেন। ছাত্রদলও শিবিরের অফিস ভিজিট করতেন। তৎকালীন সময়ে সকল বিভাগীয় শহরে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাবেশ হয়েছিলো। ছাত্রশিবির নিয়মিত বেগম খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদ, রওশন এরশাদ, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের সাথে যোগাযোগ করত।
২০০১ সালের শুরুতে ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল ও ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি নাসির উদ্দিন পিন্টুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ২০০১ সালের অক্টোবরে ৪ দলীয় জোটের বিজয় সেই আন্দোলনের ফসল।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও বর্তমান পরিস্থিতি
অনির্বাচিত আওয়ামীলীগ সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। দাবি আদায়ে প্রায় অর্ধশত দল যুগপৎ কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনের গতি ধরে রাখতে এসব দলগুলোর সাথে প্রায়ই সমন্বয় ও মতবিনিময় করছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। কিন্তু কোনো ফল আসছে না। কারণ, যে কোনো বড় আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকার উপর। তারুণ্যের শক্তিই আন্দোলনের গতিপথ তৈরি করে এবং পেশী শক্তিকে দাবি মানতে বাধ্য করে।
২০০০-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রদল-শিবিরসহ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা একসাথে রাজপথে অগ্রভাগে থাকলেও বিগত ১৫ বছরে তাদের কোথাও বসতে দেখা যায়নি। সেসময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া পরিষ্কার হওয়ায় আন্দোলন-কর্মসূচিতে রাজপথে সম্মিলিত ভূমিকা পালন করে ছাত্র ঐক্য। যার ফল পাওয়া যায় ভোটের মাঠেও। তরুণ ভোটারদের বড় অংশ চার দলীয় জোটকে ভোট দেয়। ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। কিন্তু এবার দৃশ্যমান ও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়।
২০১২ সালে ছাত্র ঐক্য কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন শিবির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। যদিও ছাত্রদল বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক সাড়া না দেয়ায় ওই উদ্যোগ আর কার্যকর হয়নি। এরপর বিগত ১০ বছরে ছাত্র ঐক্য নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দীর্ঘ এ সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কর্মসূচি দিলেও সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক সভায় “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা” বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করে। সেখানে শিবিরের সাবেক সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘ছাত্রশিবির বিভিন্ন সময়ে ছাত্র ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নিলেও বন্ধুপ্রতীম সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পায়নি। তবে বর্তমান এ জগদ্দল পাথর সরাতে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য খুবই প্রয়োজন।’
চলতি বছরের শুরুর দিকে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল ছাত্র ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নেন। তখন ছাত্রশিবিরকে বাইরে রেখে ২০ দলীয় জোটের অন্যান্য ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্রঅধিকার পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশনসহ একাধিক ছাত্র সংগঠনের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। কিন্তু সেটাও আর সফলতার মুখ দেখেনি।
এদিকে ২৮ জুলাই গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হাফেজ রেজাউলের নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়েছে। এর প্রধান সমন্বয়ক বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মাদ কামাল উদ্দীন ও মুখপাত্র হিসেবে রয়েছেন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি শরিফুল ইসলাম রিয়াদ। এই বৈঠকে ছাত্রদলের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। ইসলামী সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ে গঠিত এ জোটকে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ নাম দেয়া হলেও সেখানে দেশের বৃহত্তর ইসলামী ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে এই ছাত্র ঐক্যও প্রত্যাশিত কোনো আবহ তৈরি করতে পারেনি।
গত ২৪ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র ঐক্যের বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছি। কিছু ছাত্রসংগঠন শাহবাগে কর্মসূচি পালন করছেন। সে উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় সেখানে আমরা ছাত্রদলের প্রতিনিধি পাঠিয়েছি। বারবার বলছি-যারা দেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে চায় সেখানে সকল শিক্ষার্থীরা অংশ নিবেন। একইভাবে ২৬ আগস্ট ছাত্রশিবিরের সভাপতি রাজিবুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মঞ্জুরুল ইসলাম এক যৌথ বিবৃতিতে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা, নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার গঠন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ছাত্র ঐক্য গঠনের আহ্বান জানান।
গত ২৭ আগস্ট জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে ১৯ ছাত্র সংগঠন বৈঠক করে। এ বৈঠকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে সব সংগঠন একমত হয়। তবে এ বৈঠকে ছাত্রশিবিরের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। পরে ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত প্রতিনিধি সভায় ১৫টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’ নামে নতুন জোট গঠিত হয়। এই জোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাঈফ মাহমুদ জুয়েলকে। সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় তিনজনকে; ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদীব। ১৫ ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদের সদস্য করা হয়।
ওই জোটে থাকা ১৫ ছাত্র সংগঠন হলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রলীগ (জেএসডি), গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম-মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাতীয় ছাত্র সমাজ (বিজেপি-পার্থ), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বিপ্লবী ছাত্র সংহতি এবং রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন।
সচেতন গণমানুষের একটি প্রত্যাশা ছিল একটি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের। সেই প্রত্যাশা এ ঐক্য গঠনের মাধ্যমে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এটি বিশিষ্টজনদের মাঝে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করেছে। এখানে যে ১৫টি ছাত্র সংগঠন নিয়ে ঐক্য করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই নাম সর্বস্ব এবং বাম ব্লকের। অধিকাংশ সংগঠনের নেতাদের মানুষ চেনে না। নেই যথেষ্ট কর্মী। ছাত্রদের অধিকার আদায় ও জাতীয় ইস্যুতে বিভিন্ন আন্দোলনে যাদের অধিকাংশ সংগঠনেরই তেমন কোন ভুমিকা নেই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নাম সর্বস্ব সংগঠনগুলো নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য গঠন করবে এটা অপ্রত্যাশিত। যা সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতা বয়ে আনবে বলে কেউ মনে করছেন না। সচেতন মহল মনে করে- এ জোট গঠনেও সরকারী মহল ভর করেছে। ফলে ডান ব্লক এবং ইসলামপন্থী শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনগুলোকে বাদ দেয়া হয়েছে। এটিও সরকারী মহলের একটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, তা এখন অনেকটা স্পষ্ট। ফলে এ ঐক্যের সকল তথ্য সরকার জানতে পারবে এবং চরম পর্যায়ে আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া, বিভেদ সৃষ্টি, আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয় এমনকি ব্যর্থ করে দেয়ার সক্ষমতা থাকবে।
জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় সংগঠন তাদের ৬টি ছাত্র সংগঠন দাবি করলেও এখন পর্যন্ত ৪টির নাম পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ছাত্র ফেডারেশনেই একমাত্র কিছু সংখ্যক কর্মী বা কয়েকটি কর্মসূচি করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (রব) রয়েছে মাত্র ৪/৫ জন কর্মী। নাগরিক ছাত্র ঐক্যের ৮/১০ জন, ভাসানী পরিষদের এখন পর্যন্ত আহবায়ক ও সদস্য সচিব ব্যতিত কাউকে দেখা যায়নি। ৪ সংগঠনের উদ্যোগে “ভোটাধিকার আদায়ে ছাত্র সমাজ” ব্যানারে ২টি কর্মসূচিতে উপস্থিতির সংখ্যা ৫০ পেরোয়নি।
ফলে এটা স্পষ্ট যে, এ দলগুলোর অধিকাংশেরই মাঠে আন্দোলন করার মতো কর্মী বাহিনী নেই। কিন্তু সিদ্ধান্তের জায়গায় নেতার সংখ্যা ঠিক আছে। এ জোটের অধিকাংশেরই অবস্থা ক্লাসের ওই ছাত্রের মতো যাকে জিজ্ঞেস করা হলো-তোমার রোল কত? সে বলল এক। যখন ক্লাসের ছাত্রসংখ্যার কথা জিজ্ঞেস করা হলো তখন বলল একজন। এমন এক নেতার সংগঠন দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন সফল করা কঠিন। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টি, দুর্বল ও ব্যর্থ করতে সিদ্ধান্তের টেবিলে এই এক নেতার কণ্ঠভোটই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সচেতন মানুষ মনে করে, এ ঐক্য সরকারের মদদপুষ্ট এবং এটি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য নয়। দেশের এরকম ক্রান্তিকালে বিভেদ নয়, সরকারবিরোধী সর্বমহলের ঐক্য প্রয়োজন, যা ইতিপূর্বেও হয়েছে। এখনও হবে এটাই প্রত্যাশিত। চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে সরকার ছাত্র সংগঠনের মাঝে বিভেদের সুর তুলেছে এবং ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে। ফলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য না হয়ে নাম সর্বস্ব কিছু ছাত্র সংগঠন নিয়ে আংশিক ছাত্র ঐক্য হয়েছে। আন্দোলনের মাঠে ভুমিকা রাখা ছাত্র সংগঠনগুলোকে জোটের বাইরে রাখা হয়েছে। সুতারাং এটিও যে সফলতার মুখ দেখবে না, তা এখন স্পষ্ট।
ছাত্রদল একটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন। একইসঙ্গে শিবির তৃতীয় বৃহত্তর ছাত্র সংগঠন এবং দেশের সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলিত দল হিসেবে বৃহত্তম দল। ফলে ঐক্য গড়তে হলে সরকারবিরোধী প্রধান ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরকে বিশেষ ভুমিকা রাখতে হবে। সরকারবিরোধী সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে আনতে হবে। আর এ ঐক্য গঠনে মূলধারার সংগঠন বিএনপি এবং জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও বাঞ্চনীয়। কারণ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ছাড়া দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলন সফল হবে না। সুতারাং আন্দোলনকে সফল করতে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এখন সময়ের দাবী।
সুপারিশ
বর্তমান আওয়ামী সরকারের হাতে গণতন্ত্র দলিত মথিত হচ্ছে। মানুষের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। দেশের আলেম-ওলামাদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতনের চরম স্টিম রোলার। রাজনৈতিক দলগুলো সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মিছিল-মিটিংয়ে বাধা দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশকে বাঁচাতে চলমান সরকারের পতন ঘটানো উচিত কি-না? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী দলীয় ঐক্যের চেয়েও ঘনিষ্ঠতর ছাত্র ঐক্য অনিবার্য। ইতিহাস সাক্ষী- ছাত্র ঐক্যের আন্দোলন শুরু হলে একসময় তা জনআন্দোলনে রূপ নেয়। এজন্য সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো:-
- পৃথক বিবৃতি বা বক্তব্যের মাধ্যমে ছাত্র ঐক্য গঠনের আহ্বান না জানিয়ে ন্যূনতম ২/৩টি বৃহত্তর ছাত্র সংগঠন, যেমন; ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরকে এক টেবিলে বসা এবং ছাত্র ঐক্য গঠনের রূপরেখা নির্ধারণ করা।
- দেশ রক্ষার দাবিতে সকল ছাত্র সংগঠনকে এক ছাতার নিচে আনতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এ আন্দোলনে যেই এগিয়ে আসবে তাকে সাধুবাদ জানাতে হবে।
- ছাত্রসংঠনসমূহের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করা।
- এই ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সময় ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের দলীয় কর্মসূচি ও তৎপরতা সম্পূর্ণ আলাদা বা নিস্ক্রীয় রাখতে হবে।
- সরকার পতনই হবে- এ আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য। দফা বিষয়ক সব আলোচনা আপাতত মুলতবী রেখে সরকার পতনের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। দফা বিষয়ক আলোচনা সরকার পতনের পর করা যাবে। (যেমন; রাষ্ট্র মেরামত বিষয় আলোচনা- এর অর্থ, বিস্তৃত রূপ কী? ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনা এক দফার আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।)
- রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী জোটের কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কর্মসূচি ঘোষণা করা।
- ছাত্র ঐক্যের ডাকা সমাবেশগুলোতে কারো একক নেতৃত্বে পরিচালনা করা যাবে না। কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতা সভাপতি থাকলে, অন্য সংগঠনের প্রধানকে প্রধান আলোচক হিসেবে রাখা।
- আন্দোলন হলো দুর্যোগাক্রান্ত মানুষ ও জীবজন্তুর মতো। এই সময় সবাই বাঁচার জন্য সচেষ্ট থাকে। নিজেদের পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে যায়। সাপও মানুষের বন্ধু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে সর্বদলীয় ঐক্যের জন্য সকলকে নিজেদের স্বতন্ত্র চিন্তা, কর্মসূচী, ভাবনা- সব মুলতবি রাখা।
- সাধারণ ছাত্র জনতাকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
- একক সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনে সমস্যা হলে ডানপন্থী, ইসলামপন্থী ও বামপন্থী- এই তিন ব্লকের পৃথক ঐক্য গঠন করা এবং তিন ব্লকের সমন্বয়ে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করা।
- গঠিত ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’-এর পক্ষ থেকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাকে স্মারকলিপি প্রদান করা, যাতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বাক-স্বাধীনতা সুরক্ষার এ সংগ্রামে আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাতে না পারে।
লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট, গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন