post

এরদোগান তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যেতে চান

মাসুম খলিলী

০৫ জুলাই ২০২৩

২০২৩ সালের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক আলোচিত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েব এরদোগান শেষ মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যে বার্তা দেশের জনগণের জন্য দিয়েছেন, সেটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এক টুইটার বার্তায় বলেন, ‘আগামী ৫ বছরের জন্য, আমরা তুর্কি প্রজাতন্ত্রের গৌরব ও সম্মান রক্ষা করতে, এর সুনাম বৃদ্ধি করতে এবং সারা বিশ্বে এর নাম মহিমান্বিত করতে আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তুর্কি শতাব্দী নির্মাণের জন্য আল্লাহর নামে আমরা আমাদের প্রচেষ্টা শুরু করবো।

নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল অনুযায়ী ২৮ মের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী কামাল কিলিচদারোগলুর বিরুদ্ধে এরদোগান ৫২.১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। তুর্কি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক মেরামত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এরদোগানের প্রথম দফার নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তির কাছাকাছি চলে যাওয়া তার চূড়ান্ত বিজয়ের ইঙ্গিত ছিল। দ্বিতীয় দফা ভোটে সেটি আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ মের এই নির্বাচনে এরদোগানের নেতৃত্বে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টি ২৬৮টি আসন লাভ করে সংসদে শীর্ষ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। একে পার্টি ছাড়াও ক্ষমতাসীন পিপলস জোটের অংশীদার ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি) ৫০টি আসন জিতেছে এবং নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টি পেয়েছে পাঁচটি আসন। সব মিলিয়ে শাসক জোট সংসদে মোট ৬০০টি আসনের মধ্যে ৩২৩টি আসন পেয়ে সম্মিলিতভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে।

বিরোধী ন্যাশন্স জোটের মূল দল সিএইচপির প্রতীক নিয়ে ১৬৯ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, যার মধ্যে ইসলামিস্ট সাদাত পার্টি ও ফিউচার পার্টি ১০টি করে এবং দেভা পার্টি ১৫টি ও ডেমোক্র্যাট পার্টির ৩টি আসন রয়েছে। আলাদা প্রতীকে নির্বাচন করে বিরোধী জোটের অংশীদার গুড পার্টি ৪৩টি আসন লাভ করেছে। সব মিলে বিরোধী জোটভুক্ত দলগুলো সংসদে ২১২টি আসন পেয়েছে। এর বাইরে সংসদের অবশিষ্ট ৬৫টি আসনের মধ্যে এইচডিপির প্রক্সি দল গ্রিন লেফট পার্টি ৬১টি আসন এবং তুর্কি লেবার পার্টি (টিআইপি) চারটি আসন পেয়েছে।

নির্বাচনের এই ফলাফলে দেখা যায় প্রেসিডেন্ট এরদোগান আগের বার যেখানে প্রথম দফা নির্বাচনেই ৫২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেখানে এবার তাকে দ্বিতীয় দফা ভোটে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে গতবার একে পার্টি সংসদ নির্বাচনে মোট ভোট পেয়েছিল ৪২.৫৬ শতাংশ। যার বিপরীতে আসন পেয়েছিল ২৯৫টি। এবার একে পার্টির আসনসংখ্যা ২৭টি কমে ২৬৮টি এবং ভোট সংখ্যা ৬.৯৫ শতাংশ কমে ৩৫.৬১ শতাংশে নেমে গেছে। সেই তুলনায় প্রধান বিরোধী দল এমএইচপি এবার ২৫.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে যেখানে আগের বার দলটি পেয়েছিল ২২.৬৫ শতাংশ। দুটি ইসলামিস্ট দল এবং একটি লিবারেল ডেমোক্র্যাট দল সিএইচপি জোটভুক্ত হয়ে একই প্রতীকে নির্বাচন করায় তাদের প্রকৃত ভোট সেভাবে বেড়েছে বলে মনে হয়নি। সিএইচপির ২.৬৮ শতাংশ ভোট বাড়লেও এই তিন দলের ভোটসংখ্যা এরচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়। অন্য দলগুলোর মধ্যে শাসক জোটের অন্তর্ভুক্ত জাতীয়তাবাদী এমএইচপি জোট ১০.০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫০টি আসন পেয়েছে। এই দলের পপুলার ভোট ১ শতাংশের মতো কমলেও আসন বেড়েছে একটি। বিরোধী জোটভুক্ত জাতীয়তাবাদী দল গুড পার্টি গতবারের প্রায় সমসংখ্যক পপুলার ভোট ও আসন পেয়েছে। ইসলামিস্টদের মধ্যে নতুন শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে নেজমেত্তিন এরবাকানের ছেলে ফাতিহ এরবাকানের নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টি। দলটি প্রথমবারের মতো নির্বাচন করে ২.৮১ শতাংশ ভোট ও ৫টি আসন লাভ করে। কুর্দি দল এইচডিপি এবার গ্রিন লেফটের প্রতীকে নির্বাচন করে ৮.৮২ শতাংশ ভোট ও ৬১টি আসন জিতেছে। আগের তুলনায় ২.৮৮ শতাংশ ভোট ও ৪টি আসন কমেছে দলটির।

এবারের সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষ এরদোগানের শাসন অব্যাহত থাকুক সেটি কামনা করেছে, কিন্তু একইসাথে অর্থনীতি, শরণার্থী ও অভিবাসন নীতির প্রতি তুরস্কের অনেকে সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে বলে মনে হয়েছে। ফলে ভোটের মাধ্যমে আরো ৫ বছর রাষ্ট্র চালানোর রায় জনগণ এরদোগানকে দিয়েছে বটে, তবে একই সাথে কিছু বার্তাও দিয়েছে। সেই বার্তা গ্রহণ করে এরদোগান তার পরবর্র্তী মন্ত্রিসভা সাজিয়েছেন বলে মনে হয়। 


এরদোগানের নতুন যাত্রা

নতুন অভিযাত্রায় এরদোগানের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তুর্কি প্রজাতন্ত্র অক্টোবরে তার শতবর্ষ উদযাপন করবে। আর একটি নতুন ‘তুর্কি শতাব্দী’র সূচনায় নেতৃত্ব দেওয়া এরদোগানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তিনি বিজয়ের পর ‘তুর্কি শতাব্দীর সূচনাকে’ দেশের জন্য গৌরবের একটি নতুন সময় হিসেবে চিহ্নিত করে এটাকে স্বাগত জানান। নবগঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ‘আমরা দুটি ধারণা বাস্তবায়ন করব, তার মধ্যে একটি হলো স্থিতিশীলতা আর অন্যটি হলো নিরাপত্তা। স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার সাথে আমরা তুর্কি-শতাব্দী গড়ে তুলব। নতুন সরকার সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়টি তুলে ধরবে। সংসদে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব পুনরায় আনা হবে।’

বিজয়ের পর তিনি অর্থনীতিকে পুনর্গঠন এবং জনগণের আর্থিক দুর্দশা কাটানোর উপর বিশেষ জোর দেন। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে সেটির প্রতিফলনও দেখা যায়। এরদোগান অর্থনীতির বিভিন্ন দিকে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব সেভদেত ইলমাজকে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন। এছাড়া প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এবং সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী মেহমেত সিমসেককে অর্থমন্ত্রী হিসাবে পুনঃনিয়োগ করেছেন। কুর্দি বংশোদ্ভূত তুরস্কের নাগরিক সিমসেক ছিলেন একজন প্রাক্তন লন্ডন-ভিত্তিক মেরিল লিঞ্চ ব্যাংকার। রাজনীতি থেকে পাঁচ বছর দূরে থাকার পর ট্রেজারি ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় ফিরে আসলেন তিনি। এরদোগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনিয়র ফাইন্যান্স এক্সিকিউটিভ হাফিজ গায়ে এরকানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দান করছেন। উচ্চ শিক্ষিতা মেধাবী এই নারী আঙ্কারায় তুরস্কের নবনিযুক্ত ট্রেজারি ও অর্থমন্ত্রী মেহমেত সিমসেকের সাথে দেখা করেছেন। সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে তিনি শীঘ্রই এরদোগানের সাথে দেখা করছেন। এরদোগানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ হলো তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা মিত এর প্রধান হাকান ফিদানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া। জুনিয়র কমিশন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা এই ব্যক্তি পিএইচডি করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ নিয়ে। ২০১০ সাল থেকে তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মিতের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময়কালে তিনি এই সংস্থাকে বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থায় পরিণত করেছেন। ফিদান ২০১৪ সাল থেকে এই পদে অধিষ্ঠিত মেভলুত কাভুসোগলুর স্থলাভিষিক্ত হন।

তুরস্কে বিচারমন্ত্রী হয়েছেন ইলমাস টুঙ্ক। নতুন একটি সংবিধান তৈরি এবং জাতীয় সংহতির জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। পরিবার ও সমাজসেবা মন্ত্রী হিসাবে এরদোগান বেছে নিয়েছেন মাহিনুর ওজদেমির গোক্তাসকে। তিনি বেলজিয়ামের সংসদের দুই মেয়াদে এমপি ছিলেন। আর্মেনিয়ার গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে তিনি নিজ দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে এরদোগান তাকে আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন। এরদোগান ঘোষণা করেছেন, সামরিক বাহিনীর প্রধান, জেনারেল ইয়াসার গুলার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করবেন। এর মধ্যে তাদের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর হয়ে গেছে। বিদায়ী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারকে এরদোগান নতুন কোনো দায়িত্ব দিতে পারেন।

নতুন মন্ত্রিসভায় শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রী হয়েছেন বেদাত ইশিখান। মন্ত্রিসভায় তিনি প্রথমবার নিয়োগ লাভ করেন। পরিবেশ, নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী হয়েছেন মেহমেত ওজাসেকি। জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী হয়েছেন আলপারসলান বায়রাক্তার। এই মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী থাকাকালে তিনি ব্যাপক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী হয়েছেন ওসমান আসকিন বক। তিনি আগে ইস্তাম্বুল চেম্বার অব কমার্সে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওসমান বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, বোর্ড সদস্য, সাধারণ পরিষদের প্রতিনিধি এবং ফেডারেশনে সভাপতি ছিলেন। তিনি ন্যাটো সংসদীয় পরিষদের তুর্কি গ্রুপের সদস্য এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনের মুখপাত্র হন। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন আলী ইয়ারলিকায়া। এর আগে তিনি ইস্তাম্বুলের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী হয়েছেন মেহমেত নুরি এরসয়। তিনি আগের মন্ত্রিসভায় একই দায়িত্বে ছিলেন। জাতীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন ইউসুফ তেকিন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে পুনঃনিয়োগ পেলেন ফাহরেটিন কোকা। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি ব্যাপক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হয়েছেন মেহমেত ফাতিহ কাসির। কৃষি ও বনমন্ত্রী হয়েছে ইব্রাহিম ইউমাকলি। বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছেন ওমর বোলাত। পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রী আব্দুল কাদির উরালোগগ্লু। ভূমিকম্প উপদ্রুত অঞ্চলের পুনর্বাসনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

তৃতীয় মেয়াদের চ্যালেঞ্জ । আরেক দফা ক্ষমতায় যাবার পর এরদোগান অদূর ভবিষ্যতে অনেক কিছু করার পরিকল্পনা করেছেন। তবে তার সামনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও। তাকে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করা, শরণার্থী সঙ্কটের সমাধান খুঁজে বের করা এবং ১০ মাসের মধ্যে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। 


কঠিন অর্থনৈতিক সঙ্কট : সম্প্রতি তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০২ সালের পর প্রথমবারের মতো নেতিবাচক নেট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রিপোর্ট করেছে, ১৯ মে পর্যন্ত ১৫১.৩ মিলিয়ন ডলারের ভারসাম্য ছিল। এরদোগান উপসাগরীয় মিত্র ও রাশিয়া থেকে মুদ্রার অদলবদল এবং বিলিয়ন ডলার পাওয়ার মাধ্যমে কম সুদের হার বজায় রাখার জন্য তার অপ্রচলিত আর্থিক নীতির অর্থায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এসব সম্পদ ক্ষয় হয়ে গেছে।

মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরাকে স্থিতিশীল করতে এরদোগানের অর্থনৈতিক দল প্রাথমিকভাবে পাবলিক ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাকডোর পদ্ধতি ব্যবহার করছে। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও, লিরা ডলারের বিপরীতে একটি স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রেখেছে। মুদ্রার মান তুর্কি রফতানিকারকদের জন্য তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে প্রতিযোগিতা করা ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কিছু রফতানিকারক তাদের প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য ডলারের বিপরীতে লিরার মূল্য ২৫ শতাংশ কমানোর আহ্বান জানাচ্ছে, কারণ তুর্কি পণ্যগুলো এখন অত্যধিক মূল্যবান এবং অন্য জায়গার পণ্যগুলোর তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যয়বহুল। এর ফলে, তুরস্কের বাণিজ্য ঘাটতি এপ্রিল মাসে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আগের বছরের ৬.১৫ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৮.৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মরগান স্ট্যানলি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে প্রেসিডেন্ট যদি পথ পরিবর্তন না করেন তবে আগামী মাসে লিরার দাম ২৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। এরদোগান একটি সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছিলেন যে তার উদ্দেশ্য বিশ্বাস এবং স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে অর্থনীতিকে শক্তভাবে পরিচালনা করবেন। এরদোগান আরো বলেছিলেন যে তিনি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান-ভিত্তিক উৎপাদন অর্থনীতি ডিজাইন করার লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।

সমালোচকরা এরদোগানের প্রবৃদ্ধির জন্য সুদের হার কমানোর নীতিকে অস্থিরতার জন্য দায়ী করেন, যা প্রচলিত অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বিপরীতে চলে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে সিমসেকের নিয়োগ একটি ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে যে এরদোগান নীতিগুলো পরিত্যাগ করতে পারেন যা অনেক অর্থনীতিবিদ ‘অপ্রথাগত’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।


শরণার্থী সঙ্কট : তুরস্কে ৩৭ লাখ সিরীয় শরণার্থীর উপস্থিতি একটি প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বিরোধীরা এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। তুরস্কের অর্থনৈতিক দুর্দশা অনুভূত হতে শুরু করার পর ২০২০ সাল থেকে সিরিয়ানদের প্রতি বৈরিতা বাড়ছে। এরদোগান বলেছেন যে তিনি ‘অমানবিক’ এবং ‘অ-ইসলামিক’ বিবেচনা করে সিরিয়ানদের সমষ্টিগতভাবে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন না। তবে, শরণার্থী বিরোধী রাজনীতি তুরস্কে যথেষ্ট সমর্থন লাভ করেছে, যার ফলে এরদোগান নিজেকে অতিজাতীয়তাবাদী সিনান ওগানের সাথে মৈত্রী করতে বাধ্য করেছে, যিনি নির্বাচনের সময় সিরিয়ানদের বহিষ্কারের পক্ষে ছিলেন।

জয়ের পর দেয়া ভাষণে এরদোগান স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের নীতির প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ৬ লাখ সিরিয়ান ইতোমধ্যেই বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তর সিরিয়ার এলাকায় ফিরে গেছে। কাতারের সাথে সহযোগিতা এবং একটি নতুন পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে, তুরস্ক আগামী বছরগুলোতে আরও দশ লাখ সিরীয়কে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য রাখে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হতে থাকে তাহলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। তুর্কি সমাজের কিছু অংশ বিশ্বাস করে যে সিরিয়ানরা তাদের চাকরি চুরি করে এবং সাংস্কৃতিক সমস্যায় অবদান রাখে, বর্ণবাদ এবং জেনোফোবিয়াকে উৎসাহিত করে। এই সমস্যার সমাধান বের করার জন্য এরদোগানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হাকান ফিদানকে বেছে নেবার অন্যতম কারণ হতে পারে। এরদোগান রাশিয়ার সহায়তায় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাথে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করেছেন। আঙ্কারা বিশ্বাস করে যে উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি এবং আসাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং একটি বাণিজ্য পথের প্রয়োজনের কারণে দামেস্কের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এরদোগান আসাদকে সিরিয়ার কুর্দি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজি করাতে চাইছেন যেগুলোকে আঙ্কারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে মনে করে। শেষ পর্যন্ত, তিনি আসাদের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্য রেখেছেন যা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজতর করবে এবং একটি সাংবিধানিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে, যাতে সিরিয়ার বিরোধীদের রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। পুনর্মিলনকে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়, কারণ এটি সমাজে সিরিয়া বিরোধী মনোভাব প্রশমিত করতে এবং উন্নত সহ-অবস্থানের জন্য উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করতে সহায়তা করবে।


সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ : গত মাসে এক সাক্ষাৎকারে এরদোগান ন্যাটোতে সুইডেনের সদস্যপদ অনুমোদন করতে তার অনিচ্ছা প্রকাশ করে অভিযোগ করেছিলেন যে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না। যার দ্বারা তিনি তার দেশের কাক্সিক্ষত কুর্দি ব্যক্তিদের আশ্রয় দেয়ার অর্থ বোঝাচ্ছেন। অবশ্য, তুর্কি কর্মকর্তারা বলেছেন যে তারা এখনও সুইডেনের সদস্যপদ সমর্থন করেন তবে স্টকহোম পিকেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্দেহভাজন সদস্যদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে এমনটি দেখতে চায়। ১১-১২ জুলাই লিথুয়ানিয়ায় মিত্র নেতাদের মিলিত হওয়ার সময় ন্যাটো সুইডেনকে জোটে আনতে চায়, কিন্তু তুরস্ক এবং হাঙ্গেরি এখনও বিডটি অনুমোদন করেনি।


পৌর নির্বাচন : এরদোগানের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী পরীক্ষা হবে ২০২৪ সালের মার্চে নির্ধারিত মেয়র নির্বাচন। এরদোগান এগুলোকে তাদের প্রতি আস্থার ভোট হিসেবে দেখেন। তিনি তার সমর্থকদের ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা এবং আন্টালিয়ার মতো বড় শহরগুলো পুনরুদ্ধার করার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে পৌরসভা নির্বাচনে বিরোধীদের কাছে এগুলোতে হেরে গিয়েছিল একেপি। বিরোধীরা তার ঐক্য বজায় রাখা এবং নগর কেন্দ্রে কুর্দি ভোটারদের সমর্থন বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে এর সুবিধা পেতে পারেন এরদোগান। উপরন্তু, বিরোধী সিএইচপির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর উপর একটি আদালতের ঝুলন্ত রায়ের ফলে তাকে কয়েক বছরের জন্য রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। এরদোগান ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন কিন্তু ১০ মাসের মধ্যে বিরোধীদের কাছে প্রধান শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তুরস্কের রাজনীতিতে সবকিছুই হয়তো সম্ভব। নতুনভাবে সরকার গঠনের পর অর্থনীতি ও সিরীয় শরণার্থী ইস্যু নিষ্পত্তি করতে পারলে এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একেপির জন্য সাফল্য নিয়ে আসতে পারে। 

সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জ : এবারের নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক নেতাই এরদোগানের বিরোধিতা করেছেন। যদিও আঙ্কারায় তার বিশাল প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে এরদোগানের অভিষেক অনুষ্ঠানে কয়েক ডজন বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশ নেন। যাদের মধ্যে ছিলেন ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ এবং একজন হাই-প্রোফাইল প্রাক্তন সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ডট ছিলেন। স্টকহোম আশা করছে ন্যাটো সামরিক জোটে সুইডেনের সদস্যপদ নিয়ে তার দেশের আপত্তি তুলে নিতে এরদোগানকে চাপ দেয়া যাবে। এরদোগানের অনুষ্ঠানে অন্যান্য নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, আজারবাইজানের ইলহাম আলিয়েভ, ভেনিজুয়েলার নিকোলাস মাদুরো, আর্মেনিয়ার নিকোল পাশিনিয়ান, পাকিস্তানের শাহবাজ শরিফ এবং লিবিয়ার আবদুল হামিদ দ্বেইবাহ।

এবারের বিজয়ের পর এরদোগান তুরস্কের দীর্ঘকালীন নেতা হতে চলেছেন এবং তার পুনর্নির্বাচন তুরস্ক এবং বাকি বিশ্বের জন্য গভীর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। এরদোগান এই অঞ্চলে এবং তার বাইরেও তুর্কি শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন, একটি নিরপেক্ষ এবং দৃঢ় পররাষ্ট্রনীতি তিনি অনুসরণ করেছেন। তিনি একটি বহুমুখী বিশ্বে বিশ্বাস করেন, এবং তুরস্ককে অন্যতম বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করতে চান। তিনি তুরস্কের সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে তার লিভারেজ ব্যবহার করে পশ্চিমাদের কাছ থেকে আঙ্কারাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছেন কিন্তু পাশ্চাত্যকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেননি। তুরস্কের সামরিক হার্ডওয়্যার দেখানোর মতো বিষয়, কারণ এরদোগান তার বৈশ্বিক স্বাধীনতার চিহ্ন হিসেবে স্বদেশী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে চাইছেন। তিনি উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় অভিযানও শুরু করেন। তিনি উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার (ন্যাটো) সাথে লড়াইয়ে থেকেছেন এর সদস্য হিসেবে। আবার রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের কাছাকাছি গেছেন, রাশিয়ান অস্ত্র ব্যবস্থা কিনেছেন এবং ইউক্রেনে মস্কো যুদ্ধ শুরু করার পরও রাশিয়ান তেল কেনা অব্যাহত রাখেন, আবার সেই সাথে কিয়েভের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য ড্রোন বিক্রি করছেন। এরদোগান তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেন। ইলিনয় স্প্রিংফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সিবেল ওকতায় বলেছেন, “এরদোগানের জন্য, বিদেশী নীতি শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য নয়, এটাও নিশ্চিত করা যে আপনি বিদেশী ডোমেনে যাই করেন না কেন তা পরবর্তী নির্বাচনে আপনার হাতকে যেন শক্তিশালী করে।”

ওয়ার অন দ্য রকসের সম্পাদক নিকোলাস ড্যানফোর্থ বলেছেন, ‘এমনকি যদি এরদোগানের জাতীয়তাবাদ তার জনপ্রিয়তাকে ঢাল করে থাকে, তবুও এই নির্বাচনে যে সঙ্কটগুলো তাকে মুক্ত করার কাছাকাছি এসেছিল তা দূর হচ্ছে না। সামনে অবস্থা আরও অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তুরস্কের অর্থনীতি এখনও বিপর্যস্ত। দেশের কিছু অংশ এখনও একটি বিপর্যয়কর ভূমিকম্প থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এরদোগান নিজের চারপাশে প্রভাববলয় গড়ে তুলেছেন। তিনি বিশ্বজুড়ে তুরস্কের প্রভাব জোরদার করার চেষ্টা করছেন। তিনি ভোটারদের কাছ থেকে একটি ম্যান্ডেট জিতেছেন যারা এটা খুব স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে অর্থনীতিতে যা কিছু ঘটেছে তা সত্ত্বেও তারা এরদোগানকে সমর্থন করেন। তার পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করার জন্য এটি প্রয়োজনীয় মূল্য দিতে তারা ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে।’ 


এরদোগানের পররাষ্ট্র কৌশলের তাৎপর্য

একটি বহুমুখী বিশ্বে এরদোগানের বিশ্বাসের অর্থ হলো তিনি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন না। তুরস্ক দীর্ঘসময় ধরে ন্যাটো সদস্য হলেও এরদোগান আরও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, যা আঙ্কারাকে তার ওয়াশিংটন-নির্ভরতা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এটি করার মাধ্যমে, এরদোগান তুর্কি সমাজে এক ধরনের পশ্চিমা বিরোধিতাকে ট্যাপ করেছেন এবং এটিকে সুপারচার্জ করেছেন। এরদোগানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার বিশেষ বৈরিতা তৈরি হয়। অভ্যুত্থানের জন্য পেনসিলভানিয়ায় নির্বাসিত ‘ধর্মগুরু’ ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করে তুর্কি সরকার। এরদোগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুলেনকে প্রত্যর্পণের জন্য জোর দাবি জানিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের কাছে প্রমাণের অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করে তাতে সাড়া দেয়নি। সেখান থেকে দু’দেশের সম্পর্কের ফাটল আরও গভীর হয়। ২০১৬ সালে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তুরস্ক একজন আমেরিকান যাজককে আটক করে, যার ফলে দুই বছর পর যাজকের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বাণিজ্য বিবাদ তৈরি হয়। সিরিয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিরিয়ার কুর্দি যোদ্ধাদের সাথে অংশীদারিত্ব করেছে, যেটিকে এরদোগান তার দেশের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে কারণ কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে।

২০১৭ সালে, তুরস্ক তার এস-৪০০ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার জন্য রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি করে, যা আঙ্কারা ও মস্কোর মধ্যে উষ্ণ সম্পর্কের মধ্যে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এ ব্যাপারে সতর্ক করে যে কোন ন্যাটো মিত্রের মস্কোর তৈরি সামরিক জিনিসপত্র কেনা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে কৌশলগত সমরাস্ত্র দিতে অনীহা প্রকাশ করায় তুরস্ক শেষ পর্যন্ত তা ক্রয় করেছে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং তুরস্ককে তার ফাইটার জেট প্রোগ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। এরকম নানা বিষয় নিয়ে তুরস্ক এবং পশ্চিমের মধ্যে ফাটল তৈরি হয়েছে, কিন্তু এরদোগান কী চায় তা ইউক্রেন যুদ্ধের সময় পররাষ্ট্র-নীতিতে প্রদর্শিত হয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার জন্য অন্যান্য ন্যাটো মিত্রদের সাথে যায়নি এবং সস্তায় রাশিয়ান তেল সংগ্রহ করছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুরস্ক সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ আটকে রেখেছে এই কথা বলে যে, পিকেকে এবং তুরস্কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর প্রতি স্টকহোম শিথিল নীতি গ্রহণ করেছে। এরদোগান এই বছরের শুরুর দিকে ফিনল্যান্ডের জোটে যোগদানের বিষয়ে আপত্তি তুলে নেন, কিন্তু তিনি এখনও সুইডেনের দিক থেকে আপত্তি তুলেননি। এটি রাজনৈতিকভাবে একটি জনপ্রিয় অবস্থান ছিল এবং এরদোগান নির্বাচনের সময় সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। ন্যাটো সুইডেনকে জুলাই মাসে তার বড় শীর্ষ সম্মেলনের সময় একটি পূর্ণ সদস্য হিসেবে চায়, তাই পশ্চিমা কর্মকর্তারা আশা করছেন যে এরদোগানের জয় তাকে আরও কিছুটা সহনশীল করে তুলবে। তবে খুব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্কের সাথে আবার এফ-১৬ কেনার অনুমতি দিয়ে চুক্তি করতে হবে বলে মনে হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে যে দেশটি তুরস্ককে আপগ্রেড করা সরঞ্জাম দিতে প্রস্তুত, তবে এ জন্য শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন। যদিও এরদোগানের কাছে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।

আরও বহুমুখী বিশ্বে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কল্পনায় এরদোগান একা নন। অন্যান্য দেশ, যেমন ভারত বা ব্রাজিল, ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে, যেখানে এটি তাদের পরিষেবা দেয়, তবে কৌশলগত দূরত্বও খোঁজে। তারা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে চেয়েছে। যদিও তাদের ও তুরস্কের পার্থক্য হচ্ছে তুরস্ক একটি ন্যাটো সদস্য দেশ কিন্তু বাকিরা তা নয়। নতুন যাত্রার পর এরদোগান পররাষ্ট্র কৌশল নিয়ে ঠিক কী করবেন তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা মত রয়েছে। আইডিনতাবাস বলেছেন, ‘মূলত, আমি মনে করি তিনি পশ্চিমের সাথে একটি নতুন দর কষাকষি করতে চাইবেন, এবং এর শর্তগুলো হবে এমন- আমি যেমন আছি তেমনই আমাকে গ্রহণ করুন, আমি স্থানীয়ভাবে যা করি তা সহ, আমি আঞ্চলিকভাবে যা করি তা সহ। এবং এরপরে আমরা কথা বলতে পারি।’ মধ্যপ্রাচ্য গণতন্ত্র প্রকল্পের তুরস্কের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মেরভে তাহিরোগলু বলেছেন, ‘তুরস্কের ক্ষমতা অনেকটাই এই সত্য থেকে এসেছে যে, এটি ন্যাটোতে রয়েছে। এরদোগান অযৌক্তিক নন, যার অর্থ তিনি তুরস্কের ন্যাটো সদস্যপদ সম্পর্কে মৌলিক কিছু বোঝেন: এটি তাঁকে তাঁর প্রভাব বজায় রাখতে দেওয়ার অংশ। সেই শক্তি আংশিকভাবে জোটের মধ্যে থাকা অন্যান্য সদস্যদের সাথে আধিপত্য বিস্তার করে, অবশ্য এর বাইরেও কিছুটা। বিশেষ করে, ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও রাশিয়া তাদের সহযোগিতা আরও গভীর করেছে। এটি অনেকটাই পরিস্থিতিগত। সিরিয়া এবং লিবিয়ার মতো স্থানে তাদের প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ রয়েছে। যদিও তারা সবসময় একই লক্ষ্যের দিকে কাজ করে না, তবে তারা যোগাযোগের লাইন উন্মুক্ত রেখেছে। এরদোগান মস্কোর সাথে তার সম্পর্ককে উভয় পক্ষের সাথে খেলার চেষ্টা করার জন্য ব্যবহার করেছেন, রাশিয়ার সাথে পুরোপুরি বন্ধুত্ব নয়, তবে পশ্চিমকে বিরক্ত করার জন্য এটি যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। এরদোগান কীভাবে সব দিক দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছেন তার উদাহরণ ইউক্রেনও। যখন রাশিয়ার কথা আসে, তুরস্ক ন্যাটো জোটের বাকি অংশ থেকে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি সিএনএনকে এরদোগান বলেছেন, “আমরা এমন এক পর্যায়ে নেই যেখানে আমরা পশ্চিমাদের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করব। আমরা পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় আবদ্ধ নই, আমরা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সাথে আমাদের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্ককে রাশিয়ানদের সাথে ব্যবসাকে স্বাগত জানাতে হয়, তুরস্কের অর্থনীতির জন্য এটি একটি ছোট লাইফলাইনও।”

রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার একই সময়ে, এরদোগান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে যোগাযোগ উন্মুক্ত রেখেছেন এবং ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকে বারবার ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে সামরিক হার্ডওয়্যার বিক্রি করেছে; ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রগুলো তুর্কি তৈরি বায়রাক্টার ড্রোনগুলোর একটি শোকেস হয়ে উঠেছে। এরদোগান জাতিসংঘ-সমর্থিত কৃষ্ণসাগরের শস্য চুক্তিতেও সাহায্য করে, যা অবরুদ্ধ বন্দরগুলো থেকে ইউক্রেনীয় শস্য পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কিছু তুরস্ককে একটি সুন্দর ও অনন্য অবস্থানে রাখে, বিশেষ করে যখন কিয়েভ এবং মস্কো কথা বলার ইচ্ছা বা প্রয়োজনের পর্যায়ে চলে যায়। তুরস্কের সামনে মধ্যস্থতা করার একটি সত্যিকারের সুযোগ আছে, বিশেষ করে এরদোগানের মধ্যস্থতা করার একটি বাস্তব সুযোগ এবং ইচ্ছে দুটোই রয়েছে। যদিও এই সময়ে, এরদোগান ঘটনাগুলোকে প্রভাবিত করার চেষ্টা না করে সাইডলাইনে বসে পর্যবেক্ষণ করছেন। ড্যানফোর্থ এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমি মনে করি এরদোগান হয়তো এটাকে তার সুযোগ হিসেবে মনে করতে পারেন, তার শেষ মেয়াদে তার ক্রাউনিং কৃতিত্ব হিসেবে, এবং তাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছেন।” ওকতে বলেছেন, “তিনি ইতোমধ্যে তুর্কি রাজনীতির জন্য একটি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।” আয়দিনতাসবাশ এর মতে, ‘এরদোগান তাঁর বিজয়কে তুরস্কের আন্তর্জাতিক ভঙ্গিতে আরও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারেন। আজকের তুরস্ক এমন একটি তুরস্ক যেটি নিজেকে একটি মেরু হিসেবে মনে করে, এমন একটি দেশ হিসেবে যার একটি বহুমুখী বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি কেন্দ্রের মধ্যে আলোচনা করা উচিত। তাহিরোগলু বলেছেন, ‘‘এরদোগান তার পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে তুরস্ককে আবার মহান করার বিষয়ের দিকে নিয়ে গেছেন।” এখন প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি এরদোগান এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন করতে পারবেন এবং তুরস্কের জন্য এর অর্থ কী হতে পারে?

এই নির্বাচনের পর এরদোগানের সামনে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ থাকবে। অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে, এবং নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে অর্থ পাম্প করার মতো কাজ করে তিনি এটির কোনো উপকার করেননি। এর অর্থ সাধারণ তুর্কিদের জন্য সত্যিকারের বেদনা, তাদেরসহ যারা তাঁকে পুনরায় নির্বাচিত করেছেন সবার জন্য। এরদোগানের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থান মূল বাণিজ্য অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে দিতে পারে তার উপর আরও কিছুটা বেশি লিভারেজ। এরদোগান তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে যা করেছেন তা তিনি তুরস্কের রাষ্ট্রের জন্য করেছেন। এটি তিনি গ্রহণ করেছেন, এটিকে নতুন আকার দিয়েছেন এবং কেন্দ্রে তার এজেন্ডা রেখেছেন। এটি দেখতে কেমন হবে তার আবার অনেক কিছু নির্ভর করে আপনি এরদোগানকে কীভাবে দেখছেন; তার ওপর। তাঁর সমর্থকরা তাঁকে মুসলিম বিশ্বের একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে দেখেন যিনি তুর্কি প্রভাব ও ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান। তাঁর সমালোচকরা তাঁকে একজন অবিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে দেখেন। যেটি সর্বত্র তার প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে আঙ্কারাকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে।


উপসংহার

রিসেপ তাইয়েব এরদোগানকে মূল্যায়ন করতে হলে তিনি কী এবং কী চান সেটিকে মূল থেকে উপলব্ধি করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে এরদোগান একজন মুসলিম। ইসলামিক স্কুল হাতিপে পড়াশুনা করেছেন। অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। তুরস্কে ইসলামী রাজনীতির প্রধান ব্যক্তিত্ব নেজমেত্তিন আরবাকানের কাছে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। একটি বৃহত্তর রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী ঐক্য গড়ে ২০ বছরের বেশি সময় তুরস্কে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাষ্ট্রের সেক্যুলার মতাদর্শের সাইনবোর্ডকে বহাল রেখেই তিনি দেশের জনগণের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করছেন। ইসলামী ঐতিহ্যভিত্তিক খেলাফত আমলের মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য ফেরানোর নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। ন্যাটো সদস্য হিসেবেই পশ্চিমা মৈত্রী এবং রাশিয়া-চীনের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে শক্তিমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিয়ে একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন। 

এই প্রচেষ্টায় এরদোগানের নীতি অনেকখানি কৌশলী। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন লম্বা সময় ধরে। আবার তুরস্কের রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সমঝোতাও করেছেন। এসব কিছু করতে গিয়ে তিনি মূল লক্ষ্য রেখেছেন তুরস্ককে একটি শক্তিমান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দিকে। যার সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা থাকবে, অর্থনীতির থাকবে শক্তিমান শিল্পভিত্তি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতা নিশ্চিত হবে এবং সামাজিক সংহতির শক্ত ভিত্তি থাকবে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এবং সামরিক সক্ষমতার মধ্যেও থাকবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়। এরদোগানের সাফল্য হলো এই পথে তুরস্ককে এগিয়ে নেওয়া। তিনি তুর্কি শতাব্দীর যে সূচনা ভিত্তি তৈরি করার স্বপ্ন দেখছেন সে জন্য আগামী পাঁচ বছর হবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে অর্জিত ভিত্তির উপর আগামী দিনের তুরস্ককেন্দ্রিক একটি মুসলিম শক্তি বলয়ের সৌধ নির্মিত হতে পারে যা ইসলামের সোনালি প্রভাবের দিনগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।

লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির