মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম পৃথিবীর আলোচিত একজন ধর্মপ্রচারক এবং রাষ্ট্রনায়ক। সকল বিবেচনায় ইতিহাসে তাঁর পার্থিব অবস্থান সবার উচ্চে ও সর্বাগ্রে। ইতিহাস মানব জীবনের দর্পণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তাঁর সামগ্রিক পরিচয় বিকশিত হয়েছে। মানুষের কাছে যে সকল ঐতিহাসিক জ্ঞাতব্য বিষয় এসেছে তন্মধ্যে পূর্ববর্তী সময়ের ঐশী গ্রন্থ ও সমসাময়িক লিখিত প্রাপ্ত তথ্য অন্যতম। পৃথিবীর সূচনা লগ্ন হতে সকল ঐশী গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সা. এর আগমনের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কিত পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থের ঐতিহাসিক ঘটনা গ্রহণ এবং সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআনে বর্ণিত ইতিহাসের তথ্যসমূহ ঐতিহাসিকদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ইতিহাসের আকর হাদিস গ্রন্থের ঐতিহাসিক বিবরণ প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদ যাচাই-বাছাই পূর্বক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এছাড়া রাসূল সা. এর ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি সমসাময়িক সব বিষয়ে ইতিহাসের পাঠে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। মুসলিম ইতিহাস লিখন পদ্ধতি প্রাচীনকালের সকল ধারণাকে উপেক্ষা করে বস্তুনিষ্ঠ এক নতুন ধারা আবিষ্কার করে। তাঁকে কেন্দ্র করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ শাখায় বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ভাণ্ডারের সমাহার গড়ে ওঠে। এ সকল গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ পর্যালোচনার মাধ্যমে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সম্বন্ধে আলোচ্য প্রবন্ধে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
রাসূল সা. সম্পর্কে রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ বিশ্লেষণ
ইতিহাস প্রাগ-ঐতিহাসিক, প্রাচীন ও আধুনিক মানবজাতির নানা দিক ও বিভাগ নিয়ে আলোচনা করে। মানুষ সৃষ্টির শুরু হতে আজ অবধি সকল বিষয় ইতিহাসের উপজীব্য হিসেবে লিখিত বা বর্ণিত হয়েছে। এক শ্রেণির ইতিহাসবিদ সকল বিবরণকে যাচাই-বাছাই না করেই সেগুলোকে তাদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসচর্চার অন্য একটি ধারায় ইতিহাস লিপিবদ্ধ হতে দেখা যায়। বস্তুনিষ্ঠ আলোচ্য বিষয়ের আলোকে লিখিত ইতিহাস মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে সঠিক স্থান প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে কুরআন সন্দেহাতীতভাবে তাঁর তথ্য উপস্থাপন করেছে। এ ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাহাবিগণ সম্পর্কে সকল তথ্য-উপাত্ত হাদিস গ্রন্থের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। পরবর্তীকালে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার লাভ করলে ইতিহাস গ্রন্থ রচনার সূচনা হয় এবং সময়ের পরিক্রমায় মুহাম্মাদ সা. এর জীবনী কেন্দ্রিক সিরাহ ও যুদ্ধ নিয়ে রচিত হয় মাগাজি সাহিত্য। ইতিহাসের এ পথ অনুসরণ করে মুসলিম বোদ্ধা পণ্ডিতগণ বিশ^ ইতিহাস লিখতে শুরু করে। মুসলিম ইতিহাসের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আজকের পৃথিবীকে করেছে তথ্য-উপাত্ত ভাণ্ডারের এক অসীম আধার বা খনি। তাই পৃথিবীর মহান নেতা, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সবশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে পরিচিত এ মহান ব্যক্তির আলোচনা ইতিহাসের দৃষ্টিতে করতে হলে উপরোক্ত তথ্য ভাণ্ডার হতে নির্ভুল তথ্যের আলোকে তাঁকে উপস্থাপন করার দাবি রাখে।
হিজরি প্রথম শতকে রাসূল সা. সম্পর্কে হাদিস গ্রন্থ লিখন ও পঠন-পাঠনের সূচনা হলে তার ধারাবাহিকতায় উরওয়া ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবান ইবনু উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অনেকে রাসূল সা. সম্পর্কে ইতিহাস বর্ণনা করারও প্রয়াস পেয়েছেন। সুতরাং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. সম্বন্ধে পরবর্তীকালে হাদিসশাস্ত্রের আলোকে ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হতে দেখা যায়। প্রাথমিক যুগে হাদিস রচনার ধারায় ইতিহাস লিখনের যাত্রা শুরু হলেও একইভাবে পরিচালিত না হওয়ায় ইতিহাস ও ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে পূর্বোক্ত ইতিহাসচর্চার শিথিলতা লক্ষ করা যায়। ইতিহাসের গ্রন্থসমূহকে আজকের বাস্তবতায় নি¤েœাক্তভাবে লিপিবদ্ধ হতে দেখা যায়।
সিরাত সাহিত্য (রাসূলুল্লাহর সা. সম্পর্কে রচিত গ্রন্থ)।
তারিখ গ্রন্থ (আদম আ. হতে ঐতিহাসিকের সময় পর্যন্ত লেখা ইতিহাস গ্রন্থ)।
আত-তারাজিম ওয়াত তাবাকাত ( অনুবাদ ও স্তর বা শ্রেণি বিন্যাস সংক্রান্ত ইতিহাস গ্রন্থ)।
আল-আনসাব (বংশীয় ইতিহাস গ্রন্থ)।
আল-বুলদান ওয়ার-রিহালা (দেশসমূহ ও ভ্রমণ ইতিহাস গ্রন্থ)।
প্রাচ্যবিদ রচিত ইতিহাস এবং
কুতুবুল আম্মাহ (সাধারণ গ্রন্থ)।
ওপরের আলোচ্য ইতিহাসের গ্রন্থাবলির মধ্যে অধিকাংশ গ্রন্থে রাসূল সা. সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ও অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে রচিত হয়েছে। এ গ্রন্থগুলোকে দুইভাগে বিভক্ত করে আলোকপাত করা যায়। যথা:
ক) সনদভিত্তিক ঐতিহাসিক বিবরণ।
খ) মতনভিত্তিক ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা।
ক) সনদভিত্তিক ঐতিহাসিক বিবরণ: এ শ্রেণির লিখিত গ্রন্থগুলোকে আবার দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা:
১) সহিহ সনদ তথা সকল প্রকারের সহিহ সনদে বর্ণিত বর্ণনাসমূহ যা কোনোভাবেই দুর্বল সনদের মাধ্যমে গ্রন্থ পর্যন্ত আসেনি।
২) দয়িফ সনদ বা দুর্বল সনদ, বর্ণিত ইতিহাস সনদের মাধ্যমে এসেছে যা কোন ভাবেই তথ্য গ্রহণ পর্যায়ের মধ্যে গণ্য হতে পারে না।
খ) মতনভিত্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা: ইতিহাসের ঘটনাবলি বর্ণনা করা হয়েছে কোনো ধরনের সনদ উল্লেখ না করে, এমনকি সে সকল বিবরণের মধ্যে অনেক অসত্য তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। ইতিহাসের এ ধরনের বিবরণ সম্মলিত গ্রন্থের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।
গ) প্রাচ্যবিদদের বর্ণিত ইতিহাস: পাশ্চাত্যের কিছু কিছু অমুসলিম ঐতিহাসিক মুসলিম ইতিহাস গ্রন্থ হতে তথ্য সূত্র গ্রহণ করে নিজেদের মতামত ব্যবহার করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওপর ইতিহাস রচনা করেছেন। যা যাচাই বাছাই করা অত্যাবশ্যক। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলের ইতিহাসবিদগণ পাচ্যবিদদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
রাসূল সা. সম্পর্কে আল-কুরআনের ইতিহাস বর্ণনা:
আল-কুরআন পৃথিবীর এমন একটি গ্রন্থ যার ঐতিহাসিক বিবরণের সত্যাসত্য সম্পর্কে পৃথিবীর বিশাল অংশের মানুষ কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই গ্রহণ করে। এমনকি অন্য ধর্মের মানুষও এর বর্ণনাভঙ্গি ও তথ্যাবলি অস্বীকার করে না বরং ইতিহাসের ঘটনাবলি সম্পর্কে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন করতে পারে না। যেমন, আসহাবে কাহাফের ইতিহাস, মুসা (আ.) এর ঐতিহাসিক তথ্য এবং ঈসা আ. এর আগমন প্রভৃতি ইতিহাস বর্ণনা। এ গ্রন্থটির বাচনভঙ্গি অতুলনীয় এবং এর বিশ^স্ততা ও নির্ভরতা এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে যে, এর বর্ণনাকে কোনোভাবেই সন্দেহ করার অবকাশ নেই। আল্লাহ এ বিষয়ে বলেন-
“এ গ্রন্থেও ভেতর কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। (গ্রন্থটি) আল্লাহ ভীরু মানুষদের জন্য সঠিক পথ প্রদর্শনকারী। (সূরা বাকারা : ০২)। এ গ্রন্থে বর্ণিত ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতি, শিক্ষাসহ মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ নিয়ে যত আলোচনা করা হয়েছে তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে সকল মুসলিম বাধ্য। সুতরাং মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ সা. সম্পর্কে কুরআন যা বলেছে তা অকাট্য সত্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাঁর মুখ নিঃসৃত বক্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তিনি মনগড়া কোনো কথাও বলেন না এবং এটা ওহি যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়।’ (সূরা নাজম : ৩)। এ আয়াত হতে আল্লাহ বলতে চেয়েছেন যে, এ গ্রন্থে বর্ণিত কোনো তথ্য মুহম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহর নিজের তৈরি করা নয়। এ কিতাবে তাঁর জীবনচরিত সম্পর্কে অনেকভাবে আয়াত নাজিল করেছেন। তাঁকে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তি হিসেবে আল্লাহ উপস্থাপন করেছেন। পৃথিবীর ¯্রষ্টা বলেন-
“তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।” সূরা কলাম : ৪)। এ আয়াতে পৃথিবীর মানুষের জন্য রাসূল সা.-কে শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ আয়াতের প্রতিধ্বনি দেখা যায় অমুসলিমদের তৈরি করা তালিকায়, যেখানে মুহাম্মাদ সা.-কে সবার ওপরে স্থান প্রদান করা হয়েছে। এ মহান ব্যক্তিকে পৃথিবীর অন্যান্য মানুষদের ন্যায় উল্লেখ করেছেন এবং অন্যান্য বার্তাবাহকদের সাথে তুলনা করে আল্লাহ বলেছেন-
‘এবং মুহাম্মাদ একজন রাসূল সা. ব্যতীত কিছুই নন, নিশ্চয় তাঁর পূর্বে রাসূলগণ চলে গিয়েছেন, যদি তাঁর মৃত্যু হয় বা নিহত হয় তাহলে কি তোমরা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে? যারা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে তাতে আল্লাহর কোনই ক্ষতি হবে না এবং আল্লাহ শুকর গুজারকারীদের প্রতিদান দেন’। ( সূরা ইমরান : ১৪৪)।
আল-কুরআনের মাধ্যমে ওপরের ন্যায় আরো অনেক উদাহরণ উপস্থাপন করা যাবে যেখানে আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে উপস্থাপন করেছেন। এ সকল তথ্যের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয় যে, মুহম্মদ সা. তায়ালার প্রেরিত রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।
আল-হাদিসে ইতিহাস বর্ণনা
ইসলামের দ্বিতীয় যে নির্ভরযোগ্য তথ্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে তা হলো হাদিস বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের মুখ নিঃসৃত বাণী। ব্যাপকভাবে হাদিস শব্দটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কথা, কাজ এবং সমর্থন ও তাঁর সঙ্গীদের কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিকে বলা হয়ে থাকে। সে সকল গ্রন্থের মাধ্যমে রাসূল সা. সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে। যা পাঠ করলে তাঁর সম্পর্কে প্রায় সকল কিছুই অবগত হওয়া যায়। হাদিস গ্রন্থের মধ্যে মুহাম্মাদ সা. এর বংশ পরিচয় ও এর তালিকা প্রণয়ন, তাঁর জন্ম সময়, শিশুকাল থেকে নবুয়াত লাভ, মক্কার কাফিরদের আলোচনা, নওমুসলিম ও তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা, হিজরতের বিবরণ, মদিনায় আগমন এবং সেখানে তাঁর একক প্রাধান্য বিস্তার, তাঁর জীবদ্দশায় সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ, হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়, আরব বিশে^ ইসলামের প্রাধান্য বিস্তারসহ রাসূল সা.-এর জীবনের সকল বিবরণ এবং সাহাবিদের খিলাফত আমলের ঘটনাবলিও স্থান লাভ করেছে। সুতরাং মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে তিনি ও তাঁর সাহাবিগণ যে মতামত ব্যক্ত করেছেন তা নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থের আলোকে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় ইতিহাসের এ উৎস ভাণ্ডারের বিকল্প নেই।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সম্পর্কে উৎস গ্রন্থ
আলোচনা বোধগম্য করণের জন্য রাসূল সা. এর বিষয়ে ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি বলতে গেলে তার পূর্বে ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের প্রকরণ সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া জরুরি। কেননা নবীজি সা. সম্পর্কে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকলে রাসূল সা. চরিত সঠিকভাবে পরিস্ফুটিত হবে না। সে ক্ষেত্রে রিওয়ায়াত ও দিরায়াত পদ্ধতি অনুসরণ করে রচিত ইতিহাস গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য অবগত হওয়া সম্ভব হবে। উল্লেখ্য যে, ইতিহাস লিখনের চর্চা হাদিস পঠন-পঠনের ধারাবাহিকতায় বিদ্বান মহলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তাই রাসূলুল্লাহর সা. হাদিস যেমন একটি মাপকাঠিতে তুলে বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারে সুপরিচিতি লাভ করেছে ইতিহাসও সেই একই মানদণ্ডে রেখে বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এ সকল সুবিচারপ্রসূত চিন্তার প্রচার ও প্রসারের জন্য মুসলিম ঐতিহাসিকগণ নিরলস সাধনা করেছেন। যার মাধ্যমে ইতিহাস পঠন-পাঠনই নয়, এ বিষয়ে গবেষণার একটি উন্মুক্ত দ্বারও তারা উন্মোচন করেছেন। যা মানুষ মাত্রই বিশ্লেষণ ও সঠিক নিক্তিতে মেপে দেখতে পারে। এ বিষয়ে বলা যেতে পারে যে, হাদিসচর্চা ও ইতিহাসচর্চা পৃথক দুইটি বিজ্ঞানের বিষয় হলেও মাপকাঠির বিবেচনায় তা একাকার হয়ে গিয়েছে। এ বিশেষ পদ্ধতিতে রচিত ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের ধারণা। নি¤েœ তাঁর সম্পর্কে এ পদ্ধতি অনুসরিত তথ্যের আলোকে নাতিদীর্ঘ উপস্থাপন করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সম্পর্কে ইতিহাসের দৃকপাত
মুহাম্মাদ সা. এর আগমনে শুধুু আরব নয় বিশ্বজাহান হয়েছিল এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত। ওই আলো সহজে পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারেনি। সে জন্য প্রয়োজন হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছা, রাসূলের সা. আগমন, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, রাসূল্লাল্লাহর সা. ঘনিষ্ঠ সাথিদের ত্যাগ তিতিক্ষা, সর্বোপরি নবী সা. ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের সময় দান। সে হিসেবে প্রথমে তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিচিতি তুলে ধরা প্রয়োজন।
রাসূলুল্লাহর বংশ পরিচয়
আদম (আ.) হতে মুহাম্মাদ সা. পর্যন্ত বংশ তালিকা যেভাবে মুসলিম ইতিহাসবিদগণ সুন্নাহর আলোকে তুলে ধরেছেন তা অতুলনীয়। যে ধরনের ঐতিহাসিক বংশ তালিকা আরব জাতি-গোষ্ঠীর বাইরে খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁর বংশ তালিকার তথ্য অনেক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এখানে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতামতের ভিত্তিতে রচিত তাঁর নসব বা বংশ তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো:
তিন অংশে বিভক্ত করে ঐতিহাসিকগণ তা উপস্থাপন করেছেন। প্রথম অংশ হলো, “মুহম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম শায়বা ইবনু হাশিম তাঁর নাম আমর ইবনু আবদু মানাফ তাঁর নাম মুগিরা ইবনু কুসাই তাঁর নাম যায়েদ ইবনু কিলাব র্মুরা ইবনু কাব ইবনু লুয়াই ইবনু গালিব ইবনু ফিহ্র, ফিহরকে কুরাইশ উপাধি দেয়া হয় এবং তার দিকে গোত্রের নাম সম্পর্কিত হয়। ইবনু মালেক ইবনু নাদার তার নাম কায়েস, ইবনু কিনানা ইবনু খুযাইমাহ ইবনু মুদরাকাহ তাঁর নাম আমের ইবনু ইলইয়াস ইবনু মুদার ইবনু নাযার ইবনু মাদ ইবনু আদনান। তাঁর বংশ তালিকার দ্বিতীয় অংশ নিম্নরূপ :
“আদনান তিনি ইবনু আদ ইবনু হামিসা ইবনু সালামান ইবনু আওস ইবনু বুয ইবনু কামওয়াল ইবনু উবাই আওয়াম ইবনু নাশিদ ইবনু হাযা ইবনু বালদাস ইবনু ইয়ালদাফ ইবনু তাবিখ ইবনু জাহিম ইবনু নাহিস ইবনু মাখি ইবনু ইয়াদ ইবনু আবকার ইবনু উবাইদ ইবনুদ দায়া ইবনু হামদান ইবনু সানবার ইবনু ইয়াসরাবা ইবনু ইয়াহযান ইবনু ইয়ালহান ইবনু আরউয়া ইবনু ইয়াদ ইবনু দাইশান ইবনু আইসার ইবনু আফনাদ ইবনু আইহাম ইবনু মাক্কছার ইবনু নাহিছ ইবনু যারিহ ইবনু সামা ইবনু মাযা ইবনু আওদাহ ইবনু ইরাম ইবনু কিদার ইবনু ইসমাইল ইবনু ইব্রাহিম আলাইহুমাস সালাম। মুহাম্মাদ সা. এর বংশ তালিকার শেষ অংশ প্রদান করা হয়েছে এভাবে- “তিনি (ইব্রাহিম) ইবনু তারিহ তার নাম ছিল আযর ইবনু নাহুর ইবনু সারুয় বা সারুগ ইবনু ফালিখ ইবনু আবির ইবনু শালিখ ইবনু আরফাখশাদ ইবনু সাম ইবনু নূহ (আ.) ইবনু লামিক ইবনু মুতাওয়াশ্শালিখ ইবনু আখনুখ, যাকে ইদরিস (আ.) বলা হয়। ইবনু ইয়ারিদ ইবনু মাহলায়িল ইবনু ক্কিনান ইবনু আ-নুশাহ ইবনু শীষ ইবনু আদম আলাইহুমাস সালাম।”(আর- রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৩৯)।
ইতিহাস গ্রন্থে পৃথিবীর অনেক মানুষের ব্যক্তি বা বংশীয় ইতিহাস লিখিত হলেও রাসূলের ন্যায় এমন বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে তালিকা তেমন একটি দেখতে পাওয়া যায় না।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের আগমন ও নবুয়ত লাভ : ঐতিহাসিকগণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের আগমন সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মাদ সা. আমুল ফিল বা হাতির বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কয়েকটি মতামত পাওয়া গেলেও উক্ত মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য বলে ঐতিহাসিকগণের কাছে গৃহীত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর সা. আগমনের সময়কে জাহেলিয়া যুগ বা অন্ধকার যুগ হিসেবে অনেক ঐতিহাসিক তাদের বিবরণে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু এর সামগ্রিক বিবরণ তারা তুলে ধরতে প্রয়াস পাননি। হতে পারে এ বিষয়ে তারা গভীরভাবে ভাবেনি অথবা সত্যকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো ঐতিহাসিক এ বিষয়টিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। তারা সে সময়কে মূর্খতা বলতে সকল ক্ষেত্রের মূর্খতাকে বুঝিয়েছেন। যেমন: সেখানকার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়েও তাদের (আরবদের) পিছিয়ে থাকার কথা প্রকাশ করতে চেয়েছে। কিন্তু সে সময়ের আরব জাতির ব্যবসায়িক কুরাইশ বংশের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। তাই সে সময়কে আক্ষরিক অর্থে জাহেলিয়া যুগ বলা সমীচীন নয়। কেননা সে সময়কে ঐতিহাসিকগণ অন্ধকার যুগ বলেছেন আল্লাহর জ্ঞানের আলোর উপস্থিত না থাকায় বা ব্যবহার না হওয়ার জন্য। তারা ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন এবং জীবনাচারসহ সকল মানবিক দিক ও বিভাগে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো পরিচালনা করছিল। ¯্রষ্টাকে পাশ কাটিয়ে এ সকল জ্ঞান ও নিজেদের তৈরি করা ব্যবস্থা কারণেই আল্লাহ, তাঁর নবী সা. এবং মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ঐ সময়কে জাহেলি যুগ বলেছেন। লক্ষণীয় যে, আল্লাহ সেই জাহেলি বা অন্ধকার যুগের আক্ষরিক অর্থে বুঝানো হলে নিম্নোক্ত আয়াত অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। আল্লাহ বলেন- “রমণী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা ও রূপার ভাণ্ডার, প্রশিক্ষিত ঘোড়া গৃহপালিত পশু এবং শস্যক্ষেত্র প্রভৃতি আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা মানুষদের জীবনকে সুশোভিত করা হয়েছে, এগুলো মানুষের পার্থিব জীবনের সম্পদ এবং আল্লাহর কাছে রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠতম স্থান।” (সূরা আল ইমরান : ১৪)।
উপরোক্ত আয়াত নাজিল হয়েছে আরবের ওই সময়ের মানুষের কাছে, তারা যদি পরিবার, সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, অর্থ ও ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ বা জাহেল থাকতেন তাহলে তাদের কাছে এত উচ্চাঙ্গের বাণী পাঠাতেন না বা তারা সে সম্পর্কে বুঝতেও পারত না। এ আয়াত যদি সে সময়ের মানুষ বুঝতে না পারত তাহলে তাদের কাছে মানুষ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা তা পৌঁছাতেন না। সুতরাং বলা যায় যে, ওই সময়ের মানুষ মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে অবগত হয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে দিন অতিবাহিত করছিলেন। শুধুমাত্র ইসলাম বা আল্লাহর নির্ধারিত ব্যবস্থার বাইরে থেকে তারা তাদের জীবনের উক্ত বিভাগে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করত। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় যে, ইসলাম বাদ দিয়ে তাদের কর্ম পরিচালিত করছিল বলেই সে সময়কে ‘জাহেলি যুগ’ উল্লেখ করা হয়েছে। তারা আক্ষরিক অর্থে মূর্খ হলে তাদের নিকট মহান আল্লাহ এ আয়াত নাজিল অহেতুক হিসেবে গণ্য হতো। যা আল্লাহর শানের খেলাপ বৈ অন্য কিছু হতো না। আরো উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কায় জন্ম লাভ করেন তার পূর্ব হতে ইয়েমেন প্রভাবশালী ও উন্নত শাসন পদ্ধতির মাধ্যমে শাসিত হচ্ছিল, তখন সেখানকার সকল উন্নত ব্যবস্থাপনার সাথে মক্কার প্রভাবশালী গোত্রগুলোর যোগসূত্র ছিল। আবার পারস্য, রোমান এবং চীনা ব্যবসায়ী ও শাসকদের সাথে আরব বা মক্কার গোত্র প্রধানদের ব্যবসায়িক ও অন্যান্য কারণে সেতুবন্ধন ছিল। সুতরাং মক্কার মানুষের বিশে^র প্রভাবশালী সকলের সাথে যোগাযোগ ছিল এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমনকি তাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিকসহ সকল জ্ঞানের সাথে আরবরা সুপরিচিত ছিল। এ সকল তথ্য বিচার করলে আরবদের সাথে জাহেল (মূর্খ) শব্দটি যায় না। তবে জাহেলি যুগে তাদের ঐশী জ্ঞানের পার্থক্য ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে ঘাটতি বা কমতি ছিল না।
মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা. ইসলাম
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে আগমনের পর হতে বিশেষ বিশেষ অবস্থা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। যেমন, হালিমা রা. এর তত্ত্বাবধানে আসার পর তাঁর উটের গতি বৃদ্ধি, বাড়ির গবাদি পশুর দুধের প্রবৃদ্ধি এবং নির্জন স্থানে তাঁর বক্ষদেশ বিদীর্ণের ঘটনাবলি সুন্নাহভিত্তিক ইতিহাস গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে। এছাড়া তিনি দুধমায়ের বাড়ি হতে মক্কায় ফিরে আসার পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত-পালিত হতে থাকেন। তাঁর চাচার সাথে ব্যবসার কাজে সিরিয়া গমন ও রাহিবের সাথে সাক্ষাৎ লাভ, তাঁর বিবাহ, হিরা গুহায় একাকিত্ব অবস্থান, ওহি লাভ, নিকটতম লোকদের মাঝে ইসলাম প্রচার মুসলিমদের উপর নানা অত্যাচার ও নির্যাতনের বিবরণ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। মক্কায় সে যুগে ঐ উন্নত সভ্য মানুষদের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ইসলাম প্রচার করলে কুরাইশরা তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিপত্তি ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কায় বিরোধিতা শুরু করে। সেখানকার গোত্র প্রধানগণ ধর্মীয় বিষয়ে নবী সা. তাদের পূর্বসূরিদের অনুসরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে তারা মক্কার প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করার ইচ্ছাও পোষণ করে। কিন্তু তিনি তাদের সে রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি জানতেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করলে ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য মৌলিক দিকে নজর দিতে সক্ষম হবেন না। কেননা মানুষ ইসলামের সকল মৌলিক বিষয় আত্মস্থ করতে না পারলে সামগ্রিকভাবে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তাই তিনি ক্ষমতার প্রলোভন মুক্ত থেকে সকল মানুষের মাঝে ইসলামের মৌলিক মেসেজ পৌঁছাতে থাকেন। ইসলাম প্রচার বন্ধে অপারগ হয়ে মক্কার নেতৃস্থানীয়রা নবীজি সা. ও তাঁর অনুসারীদের ওপর নানা রকমের অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকলে নব্য মুসলিমদের মধ্যে কতিপয় সাহাবিদের আবিসনিয়ায় হিজরত করতে নির্দেশ প্রদান করেন এবং তাঁর অন্যান্য সাহাবিসহ তিনি মক্কায় অবস্থান করতে থাকেন। আল্লাহ তাঁর রাসূল সা.-এর নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলেন। যথা- ‘হে রাসূল সা. আপনার রব বা প্রতিপালক আপনার ওপর যা অবতীর্ণ করেন তা আপনি প্রচার করেন। আপনি যদি তা না করেন, তাহলে আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করলেন না। আর আল্লাহ আপনাকে মানুষ (কাফির) হতে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে সুপথ দেখান না।’(সূরা আল মায়েদা : ৬৭)।
এরপরও তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলে মক্কার স্বার্থান্বেষীরা তাঁর কাজে বাধা দিতে থাকে। মক্কায় অবস্থানরত অনুসারীদের উপর নির্যাতন পরিচালনা করতে থাকে, এমনকি তারা সম্মিলিত ভাবে তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নিশ্চয়তার কারণে তারা তাঁর কোন ক্ষতি সাধনে ব্যর্থ হয়। তিনি আল্লাহর নির্দেশে মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেন। আল্লাহ বলেন- “হে নবী সা. বলুন, হে আমার রব! সে স্থানে আমাকে প্রবেশ করান যেখানে যাওয়া শুভ ও সন্তুষ্টিপূর্ণ হয় এবং যে স্থান হতে বের হওয়া সন্তোষজনক হয় সেখান হতে আমাকে বের করে নিয়ে যান এবং আপনার পক্ষ হতে আমাকে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি।” (সূরা ইসরা : ৮০)। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর শেখানো নির্দেশের আলোকে মক্কা থেকে হিজরতের অনুমতি লাভ করেন। কেননা মক্কায় তিনি ইসলামের সকল দিক বা বিভাগ পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিপালনে সক্ষম ছিলেন না। তাই তিনি ইসলাম পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালনের জন্য মক্কা পরিত্যাগ করে মদিনায় গমন করেন।
মাদানি জীবন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম মক্কা হতে মদিনা আসার পূর্বে আকাবা নামক পাহাড়ের কাছে মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের মানুষদের পর পর দুই বছর শপথবাক্য পাঠ করান। তখন মদিনার এ গোত্রদ্বয়ের মুসলিমগণ রাসূল সা.-কে মক্কা ছেড়ে মদিনা আগমনের আহবান জানান। তিনি তাদের আহ্বানে সাড়া না দিলেও তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে হিজরতের অনুমতি প্রাপ্ত হন। ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, ‘নবী সা. বলেন যে, তিনি স্বপ্নে দেখছেন, খেজুর গাছে ঢাকা এলাকায় তথা ইয়াসরিবে হিজরত করছেন। সে মোতাবেক তিনি মদিনায় হিজরত করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সেটাকে ইসলামের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেন। মক্কায় সে সময় যেমন কুরাইশরা একক নেতৃত্ব দিত, কিন্তু মদিনার মানুষের মধ্যে তেমন একক নেতৃত্ব ছিল না। রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের পর সেখানকার সকল নাগরিকদের নিয়ে তিনি মদিনা সনদ রচনা করেন এবং তাঁর একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় আগমনের পর তিনি মক্কার তুলনায় অনেকটা সহজে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু মক্কার মুশরিক কুরাইশ নেতা এবং মদিনার কুচক্রী গোষ্ঠী তাঁর নিরবচ্ছিন্ন প্রচার মেনে না নেওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে নানা রকমের চক্রান্ত আরম্ভ করে। তাই এ কূটকৌশলের সমুচিত জবাব দেওয়ার নিমিত্তে তাঁর জীবদ্দশায় মুসলিমগণ অসংখ্য গাযওয়া ও সারিয়ায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসলাম আরব বিশে^র বাইরে রোম ও পারস্য সা¤্রাজ্যে উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল সা. হওয়ায় মদিনায় আগমনের মাত্র দশ বছরের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। এমনকি বলা যায় যে, তাঁরসম কোনো প্রচারক ও রাষ্ট্রপ্রধান পৃথিবীতে কখনো আসে নাই এবং আসবেও না। তাই ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে তাঁর ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক, কৃষি, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সর্বোপরি সকল বিষয় ফুটে উঠেছে।
পরিশেষে যৌক্তিকভাবে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আইহিস সালাম শুধু আরব জাহান নয় বরং পৃথিবীর জন্য রহমাতের বার্তাবাহক। তাঁর বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আরবি ভাষায় রচিত মৌলিক উৎস গ্রন্থের বিকল্প নেই। কেননা মৌলিকত্ব না থাকলে সে বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দুঃসাধ্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাসূল সা.-এর জীবনচরিত নিয়ে অনূদিত হয়েছে সিরাতু ইবনু হিশাম, ইবনু ইসহাক ও আর রাহিকুল মাখতুমসহ কয়েকটি মৌলিক সিরাত গ্রন্থ, যা প্রাথমিক সিরাত সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। কিন্তু এগুলো মৌলিক গ্রন্থ হলেও তাঁর বিশালতার তুলনায় অপ্রতুল। তাছাড়া তৎপরবর্তী যুগে ইসলামের মৌলিক উৎস গ্রন্থ তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে যেভাবে এ অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে সেভাবে ইতিহাসশাস্ত্রটি বিকাশ লাভ করেনি। যদিও এ তিনটি শাস্ত্র (তাফসির, হাদিস ও ইতিহাস) মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের একই সূত্রে গাঁথা এবং মুসলিম বিশে^র অন্যান্য এলাকায় একই ধারায় চর্চা হচ্ছে। তাই দেশের ইতিহাসের এ শাখার উন্নতি সাধন করতে হলে এর মৌলিক উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করার দাবি অনস্বীকার্য। নচেৎ প্রাচ্যবিদ তথা পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকদের লিখিত গ্রন্থের প্রচারে ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং সিরাত ও মাগাজি সাহিত্য এবং ইতিহাসের মৌলিক গ্রন্থের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক তথ্য উদঘাটন করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আপনার মন্তব্য লিখুন