বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগ। তাই এখন মানুষ কোনো কিছু গ্রহণ করা বা বর্জন করার মধ্যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অন্বেষণ করে। আমরা মুসলিম জাতি। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করে সাথে একটি জীবনবিধান দিয়েছেন সেটি হচ্ছে মহাগ্রন্থ বিজ্ঞানময় আল-কুরআন এবং এই বিজ্ঞানময় কুরআনকে মানুষের কাছে বিশদভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ সা.-কে। মুহাম্মাদ সা.-এর কথা, কাজ ও মৌনসমর্থনকে ইসলামী আইনের পরিভাষায় সুন্নাহ বা হাদিস বলা হয়। তাই আমাদের জন্য এখন দুইটি নির্দেশিকা রয়েছে। এই দুইটি নির্দেশিকা অনুযায়ী আমাদের জীবন পরিচালনা করতে হবে। সময়োপযোগী হিসেবে এই দুইটি নির্দেশিকা আধুনিক বিজ্ঞানও সমর্থন করে। উল্লেখ্য, এই দুইটি জীবনবিধান যদি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আমরা বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে এ দুটিকেই গ্রহণ করব। মহান আল্লাহ সূরা হাশরের ৭ নং আয়াতে বলেন, “তোমাদের রাসূল যে জীবনবিধান নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর আর যে জীবনবিধান গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।” পবিত্র কুরআনে ৬২৩৬টি আয়াতের মধ্যে ৭৫০টি আয়াত তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত। এখন আমি ইসলামী জীবনবিধান এবং আধুনিক বিজ্ঞান প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
এইড্স : এর পূর্ণরূপ হচ্ছে- Acquired Immune Deficiency Syndrome. যার অর্থ দাঁড়ায়-অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঘাটতির লক্ষণ। বর্তমানে এইড্স বহুল পরিচিত একটি গজবি রোগ। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ রোগের উৎপত্তি হলেও অনুসন্ধানীরা বলছেন এর সূচনা ১৯২০ সালে। বাংলাদেশে এ রোগের উৎপত্তি হয়েছে ১৯৮৯ সালে সিলেটে। ১৯৯০ সালে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলেও ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এখন প্রায় চার কোটি মানুষ সাবসাহারাতে এ রোগের এলাকার মধ্যে। এ রোগের প্রধান কারণ polygamy তথা বহুগামিতা। এ polygamy বলতে বুঝায় স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্যান্যদের সাথে দৈহিক মিলনে অভ্যস্ত হওয়া। বর্তমান বিজ্ঞান বলছে এইড্স রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যুসহ যাবতীয় ধ্বংসাত্মক রোগের জন্ম দিতে পারে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এইড্সের কারণে ২০২০ সালের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু আল-কুরআন ১৪০০ বছর পূর্বে যে বিধান দিয়েছে তা যদি আমরা বাস্তবায়ন করি তাহলে পৃথিবী থেকে এইড্স নামক মারণব্যাধিটি নির্মূল করা সম্ভব হবে অবশ্যম্ভাবী। যদি কোনো ব্যক্তি একজন স্ত্রী নিয়ে স্বীয় যৌনচাহিদা মেটাতে সক্ষম না হয়, তখন ইসলাম তাকে সামর্থ্যানুযায়ী একই বিবাহবন্ধনে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী বিবাহের অনুমতি দিয়েছে যা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা নিসার ৩ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। ইসলামের এই শাশ্বত বিধানকে উপেক্ষা করে জাতি আজ অধঃপতিত। আজকাল আমেরিকায় প্রতি সাতজনের তিনজনই নানা যৌন রোগের কারণে সামরিক বাহিনীতে চাকরির অযোগ্য প্রমাণিত হচ্ছে। আজকাল আমাদের সমাজে সহশিক্ষার কারণে যুবসমাজ অবৈধ যৌনাচারের সুযোগ পাচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয় এই সহশিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলে আমাদের এই পবিত্র লীলাভূমিতেও আমেরিকার মতো পরিণতি হতে পারে।
রোজা : সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে। সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াত দ্বারা রোজা ফরজ করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এক বিশিষ্ট ডাক্তার গোলাম মোয়াজ্জেমের ১৯৬০ সালের মানবশরীরে রোজার প্রভাব শীর্ষক গবেষণামূলক তথ্য থেকে জানা যায়- রোজা পালনে শরীরের ওজন সামান্য হ্রাস পায় বটে তবে তা শরীরের কোনো ক্ষতি করে না। শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক ফলপ্রসূ। যারা মনে করে রোজা রাখলে শূল বেদনার প্রকোপ বৃদ্ধি পায় আসলে তাদের ধারণা সঠিক নয় বরং রোজা রাখলে শূল বেদনার উপশম হয়। কেননা রোজা রাখলে এসিড্ কমে যায় এবং ভোজনে তা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানের প্রবীণ চিকিৎসক ডা: মুহাম্মাদ হোসাঈনের তথ্য থেকে জানা যায়- যারা আজীবন নিয়মিত রোজা রাখে তারা সাধারণত বাত, কাশ, বহুমূত্র, অজীর্ণ হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত কম হয়। রোজা বহুমূত্র রোগীর জন্য বেশ উপকারী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আলসার ও গ্যাস্ট্রিক রোগীর জন্য রোজা খুবই ফলপ্রসূ। অতিভোজন, চর্বিজাতীয় ও গুরুপাকজাতীয় খাদ্যগ্রহণে যখন লিভার অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন রোজা নিয়মবদ্ধ উপবাসের মাধ্যমে লিভারকে সবল করে এবং লিভারজনিত রোগ থেকে দেহকে রক্ষা করে।
দাঁড়িয়ে প্রস্রাব না করা : উমর রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে দেখলেন-আমি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছি, তখন তিনি বললেন হে উমর, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করো না। এরপর থেকে আমি কোনোদিন দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করিনি। (ইবনে মাজাহ : ৩৪৬)। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় প্রস্রাবের সাথে মূত্রদ্বারে জ্বালাপোড়া, পুঁজ-রক্ত নির্গত হওয়া এবং কিডনিতে ইনফেকশনজনিত জীবাণু বিদ্যমান থাকে। দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলে উক্ত প্রস্রাবের জীবাণুযুক্ত ছিঁটা শরীরে ও কাপড়ে লেগে উল্লিখিত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এছাড়া দাঁড়িয়ে প্রস্্রাব করলে কিডনিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়া, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব আসা, প্রস্্রাবে যন্ত্রণা, চর্মরোগ ও বীর্য পাতলা হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
দাড়ি রাখা ও গোঁফ ছোট করা : দাড়ি রাখা নবী সা.-এর সুন্নাত এবং এটা পূর্ববর্তী নবীগণেরও সুন্নাত। বুখারি শরীফের একটি হাদিসে তিনি বলেন : “তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা করো এবং দাড়ি বাড়াও আর গোঁফ কাটো।” (মাজমা‘উজ জাওয়ায়েদ : ৮৮৪৫)। এখানে মুশরিক বলতে অগ্নিপূজারিদের বুঝানো হয়েছে। ওরা দাড়ি কেটে ফেলতো। ওদের অনেকে আবার দাড়ি মুণ্ডনও করতো। তবে যদি দাড়ি সীমাতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যায় যে তা দেখতেও খারাপ লাগে তখন দাড়ির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কাটা যেতে পারে। দাড়ি সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা হচ্ছে, দাড়ি রাখা সুন্নাত এবং এটি রাখার যথেষ্ট উপকারিতাও রয়েছে। এ কথা সত্য যে, পূর্বকালের কোনো মুসলমান দাড়ি মুণ্ডন করেছেন বলে জানা যায় না। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে এসেছে, দশটি বিষয় সনাতনী স্বভাবের অন্তর্গত, তন্মধ্যে গোঁফ খাটো করা ও দাড়ি লম্বা করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রফেসর ডা: জর্জ এল তাঁর গবেষণায় বলেন, দাড়িতে পানি আটকে থাকলে তা গর্দানের সঙ্গে থাইরয়েড (ঞযুৎড়রফ) গ্রেন্ড ও গলার রোগ থেকে রক্ষা করে। বার্লিন ইউনিভার্সিটির এক ডাক্তার মোর শেভ, ব্লেড এবং সাবানের ওপর দীর্ঘ গবেষণার পর যে ফলাফল পেয়েছেন তা দিল্লির মাসিক পত্রিকা ‘স্বাস্থ্য’ এভাবে তুলে ধরেছে- ‘শেভের কারণে চামড়ায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয় শরীরের অন্যান্য অংশের কোনো কিছুর দ্বারা সম্ভবত এ পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয় না।’ মূলত শেভের সময় রেজার বা ক্ষুর চামড়াকে দলতে থাকে। তাই বারবার একটি চামড়াকে ব্লেড অথবা ক্ষুর দিয়ে মুণ্ডানো হলে চামড়া খুবই স্পর্শকাতর হয়ে যায় এবং তা বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি করে। এভাবে শেভকারী সহজেই বিভিন্ন রোগের শিকার হন। প্রথমে চেহারায় এক প্রকার গোটা দেখা দেয়। পরে এক প্রকার চর্মপ্রদাহ দেখা দেয়। একাধারে শেভ করলে মস্তিষ্কের স্থিত গ্রন্থির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে ¯œায়বিক ব্যবস্থাপনা এবং যৌন উত্তেজনায় দুর্বলতা দেখা দেয়। ডাক্তারদের অভিজ্ঞতায় এরূপ অনেক রোগী ধরা পড়েছে। তারা শেভ বন্ধ করার পর উক্ত রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। এছাড়াও শেভের কারণে আরো অনেক ছুঁচালু রোগ চেহারায় দেখা দেয়। পরে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যার কিছু চিহ্ন হচ্ছে চেহারার ব্রণ, খুশকি, মেছতা, নাকে গোটা, একজিমা ও অ্যালার্জি প্রভৃতি। গোঁফ ছাঁটার উপকারিতা প্রসঙ্গে কিউল ফাদার একটি সুন্দর তথ্য দিয়েছেন, যিনি একজন পর্তুগিজ শরীর বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ। তার মতে, মানুষের ঠোঁট খুব অনুভূতিপ্রবণ অঙ্গ তার সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক রয়েছে। উপরের ঠোঁটের মধ্যে এমন হরমোন সৃষ্টি হয়-যার জন্য বাহ্যিক প্রভাব ও পানি অতি জরুরি। গোঁফ বড় থাকলে এসব প্রভাব পড়তে পারে না। গোঁফ বড় রাখার কারণে যদি উক্ত গ্লান্ডসমূহে পানি, বায়ু ইত্যাদি স্পর্শ না করে তবে সর্বদা সর্দি-কাশি, দাঁতের মাড়ি ফোলা, অঙ্গ খিচুনি প্রভৃতি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অধিকন্তু গোঁফ বড় হলে তাতে জীবাণু আটকে যায় এবং খাওয়ার সময় তা পেটের মধ্যে চলে যায়।
কিবলামুখী হয়ে পায়খানা প্রস্রাব না করা, ডান হাতে শৌচকার্য না করা, ঢিলা ব্যবহার করা : সহিহ বুখারি ও মুসলিমের হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি- রাসূল সা. নিষেধ করেছেন কিবলামুখী হয়ে পায়খানা প্রস্রাব করতে, ডান হাতে শৌচকার্য করতে, শৌচকার্যের ঢিলা তিনটির কম ব্যবহার করতে এবং শুষ্ক গোবর অথবা হাড় দ্বারা ঢিলার কাজ সমাধা করতে। ডা: কমন বীম দীর্ঘ গবেষণায় দেখেছেন যে, কাবাগৃহ থেকে সর্বদা পজিটিভ রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রস্রাব-পায়খানা নেগেটিভ বিচ্ছুরণের অংশ। তাই কাবাগৃহের দিকে নেগেটিভ রশ্মির গতি অবশ্যই ক্ষতির কারণ। বিশেষত খোলা জায়গায় প্রস্রাব-পায়খানা করলে এ সমস্যা দেখা দেয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ডান হাত থেকে পজিটিভ রশ্মি ও বাম হাত থেকে নেগেটিভ রশ্মি নির্গত হয়। এ দিকে প্রস্রাব-পায়খানা নেগেটিভ বিচ্ছুরণের অংশ। তাই শৌচকার্যের সময় ডান হাত ব্যবহার করলে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। আবার যেহেতু খাওয়ার সময় ডান হাত ব্যবহার করা হয় সেহেতু ডান হাত দিয়ে শৌচকার্য করলে ডান হাতের রোগ-জীবাণু খাবারের সাথে মিশে শরীরে বহুবিধ রোগ-ব্যাধি ছড়াবার সম্ভাবনা থাকে। ডা: হালাকু বলেন, শৌচকার্যে ঢিলার ব্যবহার গবেষণাজগৎকে বিস্মিত করে দিয়েছে, কারণ মাটিতে থাকে অ্যামুনিয়াম ক্লোরাইড ও উৎকৃষ্ট মানের রোগ প্রতিরোধক বা জীবাণুনাশক উপাদান (Antiseptic) যা মলদ্বার পরিষ্কারক। সে সাথে এর দ্বারা মলদ্বারে যে মাটি লেগে থাকে তার দরুন মলদ্বারের বাইরের জীবাণু মারা যায় এবং পেনিস্ ক্যান্সার হয় না। ঢিলা ব্যবহারের ফলে মলদ্বারে শিরা ধমনীর রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে ঢিলা সামনে থেকে পিছনে এবং পিছন থেকে সামনে ব্যবহারের ফলে শিরা ও ধমনীতে চাপ পড়ার কারণে পাইল্স রোগ হয় না। এভাবে ইসলামের প্রতিটি বিধানকে যদি আমরা বিজ্ঞানের নিরিখে যাচাই করি তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে যে, ইসলাম মানবতাবাদী এবং বিজ্ঞানময় জীবনবিধান।
লেখক : প্রভাষক, জলদী হোসাইনিয়া কামিল (স্নাতকোত্তর) মাদরাসা, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
আপনার মন্তব্য লিখুন